অশেষ: শিল্পী সারস্বত বসুর চিত্রকর্ম নিয়ে প্রদর্শনী
সম্প্রতি দেবভাষার নিবেদনে তাঁদের প্রদর্শকক্ষে তুলে ধরা হল স্বনামধন্য শিল্পী অতুল বসুর পৌত্র সারস্বত বসুর চিত্র প্রদর্শনী। সূচনা পর্বের প্রারম্ভে আয়োজকদের তরফে বিশেষ আলোকপাত করা হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের গানের দু’টি লাইনে— ‘হৃদয়ে হৃদয়ে আধো পরিচয়, আধখানি কথা সাঙ্গ নাহি হয়...’। কথাগুলির সারমর্মে লুকিয়ে আছে এক গভীর বেদনা। এ প্রদর্শনীর শিরোনামও তাই ‘শেষ নাহি যে...’ সেই বেদনার দ্যোতনা বয়ে আনে। সারস্বত বসুর প্রথম একক প্রদর্শনী।
কিছু শোনা ও জানার পরে সারস্বত বসুর যে পূর্বাপর পরিচয় আমরা পাই, সেখানে দেখি তাঁর চিত্রভাষা হঠাৎই থেমে যায় জীবনের মধ্যগগনে। ১৯৭৪-এ জন্ম এবং ২০২২-এ শিল্পীর হঠাৎ চলে যাওয়া, স্বাভাবিক ভাবেই এক অসম্পূর্ণতা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে সেই পরিবার, যেখানে রয়েছেন ঠাকুরদা অতুল বসু এবং মায়ের বাবা রবীন্দ্রপরবর্তী অন্যতম শীর্ষ কবি বিষ্ণু দে। এই দুই মহীরুহের মতো শিল্পজ্ঞান সমৃদ্ধ দু’জন ব্যক্তিত্বকে পরিবারেই পেয়েছিলেন সারস্বত। এমন ঐতিহ্যের যে পরম্পরা, এই প্রদর্শনীতে তা উঠে না এলেও যেটি পাওয়া যায়, তা হল সম্পূর্ণ মৌলিক এক শিল্প-আচরণের আধিপত্য।
প্রদর্শকক্ষের দেওয়ালে সাজানো হয়েছিল ছোট ছোট কাগজের উপরে শিল্পীর করা ১৬টি কাজ। প্যাস্টেল, ড্রাই প্যাস্টেল, গোয়াশ, জলরং, তেলরং, অ্যাক্রিলিকের দু’একটি ছবি ছাড়া বেশির ভাগই মিশ্র মাধ্যমে করা। রঙের স্টাইল এবং অভিব্যক্তির উপস্থাপনে এই প্রদর্শনীটি শৈল্পিক অস্থিরতার একটি মাইলফলক হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে। এখানে যে সব কাজ প্রদর্শিত হয়েছে, তাতে সাধারণের বাইরে এমন কিছু দেখা যায়, যা প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে অদ্ভুত, অথচ অসম্ভব সংবেদী। এই অদ্ভুত অনুভূতির নেপথ্যে যে হৃদয়-নিংড়ানো আকুতি, তার পরিচয় পাওয়ায় শিল্প ও দর্শকের মধ্যে একটি অলিখিত সংযোগ তৈরি হয়ে যায় আপনা থেকেই।
যেমন অয়েল স্কেচ পেপারে হালকা-গাঢ় ব্রাউনে দ্রুত প্রকাশ ‘সেল্ফ পোর্ট্রেট’। জটিল মুহূর্তের প্রতিক্রিয়ায় চোখে জড়ো হয় বেসামাল ক্রোধ। জানালামুখী ঘরের একটি অংশ নিয়ে ড্রাই প্যাস্টেলের কম্পোজ়িশন ছিল চোখে পড়ার মতো। বার্ডস আই ভিউয়ের দূরত্বে কমলা রোদের নিসর্গ, অদেখা শিল্পীকে বড্ড কাছে টেনে নেয়। মিশ্র মাধ্যমে ‘কনভারসেশন অ্যান্ড লাভ’-এ অনুচ্চারিত শব্দগুলি ভেসে বেড়ায় রাতের নৈঃশব্দ্যে। গভীর আঁচড়ে (মিশ্র মাধ্যম) জ্বলন্ত প্রতিবাদ ফুটে ওঠে একটি মুখাবয়বকে ঘিরে। আর একটি মিশ্র মাধ্যমে অনবদ্য (নামহীন) কাজের কথা না উল্লেখ করলেই নয়। পটের ডানদিক ঘেঁষে ঊর্ধ্বমুখী এক নারী। রাতের আগুন-রং ভেদ করে আশ্রয় চায় উঁকি মারা কোবাল্ট ব্লু-র আকাশে।
ছোটবেলা থেকেই আত্মমগ্ন সারস্বতের প্রিয় জগৎ ছিল রং, তুলি, কাগজ। কিন্তু স্থিতির চেয়ে অস্থিতিই হয়ে উঠেছিল তাঁর দোসর। এই প্রসঙ্গে সঞ্জিৎ বসু (সারস্বতের বাবা) জানালেন, সব কিছু ভেঙেচুরে বেরিয়ে পড়ার প্রবণতা ছিল শিল্পীর মধ্যে। হতাশা থেকে ‘হবে না’, ‘হল না’, ‘দিতে পারলাম না’ গোছের মনোভাবও তৈরি হয়েছিল একটা সময়ে। পরিজনদের উপদেশ ওঁর কাছে ছিল নিরর্থক। পরিবারসূত্রেই জানা গেল, কিছুটা মানসিক ভারসাম্যের সমস্যা তৈরি হয়েছিল তাঁর, যদিও সেটা কাটিয়ে উঠেছিলেন পরে। সরষেখেতের ভ্যান গঘকে খুব পছন্দ করতেন সারস্বত।
পিতামহ অতুল বসুর কাজের প্রতি শ্রদ্ধা থাকলেও, ধরাবাঁধা রুটিনের বিরুদ্ধে যেতে চেয়েছিলেন বলেই বরোদা আর্ট কলেজে ফাইন আর্টস বিভাগে ভর্তি হয়েও বেরিয়ে আসেন সারস্বত। পরে গড়িয়া ভিসুয়াল আর্ট কলেজ থেকে শিক্ষা সম্পূর্ণ করেন। ক্রমাগত ছবি আঁকলেও মাঝে মাঝেই একেবারে নিষ্ক্রিয় থাকতেন এই শিল্পী। কারও কাছে নিয়ে গিয়ে নিজের ছবি দেখানোর তাগিদ অনুভব করেননি কখনও। সম্পূর্ণ নিজের জগতে বাস করতেন। প্রচুর কাজ রেখে গিয়েছেন শিল্পী, তার মধ্যে স্টাডিধর্মী কিছু কাজ ছাড়াও রয়ে গিয়েছে মনোজগতের ক্রমবিকাশ। দেবভাষা আয়োজিত এই প্রদর্শনীর প্রতিটি ছবিই বলে দেয়, আরও সময় পেলে শিল্পী কোথায় পৌঁছতে পারতেন!
পিয়ালী গঙ্গোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy