ময়ূর পাহাড়
ছুটির আমন্ত্রণে...
শীত ক্রমশ ফুরিয়ে আসছিল। কিন্তু মিষ্টি রোদমাখা ছুটির গন্ধটা তখনও হাতছানি দিচ্ছে। আমার শহরে গাছে গাছে লাল ধরতে শুরু করেছে সবে। শেষমেশ প্ল্যানটা হয়েই গেল। ব্যাগ গুছিয়ে উঠে পড়লাম ট্রেনে। হাতে মাত্র দিন তিনেকের ছুটি। গন্তব্য হল লাল মাটির এক দেশ, পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়।
তখন সবে আলো ফুটতে শুরু করেছে। বোধহয় আদ্রা ছাড়িয়েছে ট্রেন। জানালায় চোখ রাখতেই দেখলাম, আকাশের লালের সঙ্গে রীতিমতো পাল্লা দিচ্ছে গাছের সারি। বুঝলাম, পলাশের দেশে ঢুকে পড়েছি। আর অল্পই বাকি পথ।
পিন্দারে পলাশের বন
পালাব পালাব মন...
গাড়ি বুক করা ছিল। স্টেশন চত্বর থেকে বেরিয়ে সওয়ার হলাম বড়সড় এসইউভি-টায়। গাড়ি ছুটতে শুরু করল অচেনা রাস্তা ধরে। কিছু দূর যেতে না যেতেই দু’চোখ পুড়িয়ে দিল একরাশ লাল। সারা রাত ট্রেনজার্নির সমস্ত ক্লান্তি নিমেষে উবে গেল। যে দিকে চোখ যায় শুধু পলাশ আর পলাশ। থোকায় থোকায় আগুন লাগিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে রাস্তার দু’পাশে। দূরে আবছা দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের সারি।
গাড়ি ছুটতে লাগল। গাইড দাদা বললেন, পাহাড়ে ওঠার আগে সমতলে যা যা দেখার, আজই দেখে নেব আমরা। এর মাঝে আর পাহাড় থেকে নামা হবে না। একটু যেতে না যেতেই উপরে তাকিয়ে দেখি, ছোটখাটো পাহাড়টার গায়ে উড়ে যাচ্ছে অসংখ্য ডানা মেলা পাখি। গোটা পাহাড়টার গায়ে খোদাই করে করে আঁকা হয়েছে একঝাঁক উড়ন্ত পাখির ছবি। সৌজন্যে কলকাতার একদল শিল্পী। সেই থেকে গোটা পাহাড়টারই নাম পাখি পাহাড়।
মুখ-মুখোশে দেখা হয়ে যায়...
জঙ্গলের পথে
এর পর গাড়ি থামল একটা ছোটোখাটো গ্রামের মাঝখানে। নাম চড়িদা। চারপাশে ছোটছোট দোকানে থরে থরে সাজানো নানা বেশের মুখোশ। কোনওটা দু্র্গা তো কোনওটা অসুর, কোনওটা গণেশ তো কোনওটা কথাকলি ঢঙে। বাদ যায়নি সাঁওতাল বর-বউয়ের আদলও। পাশেই বসে কাগজের মণ্ড আর আঠা দিয়ে রংবেরঙের মুখোশ বানাচ্ছেন কারিগর। প্রায় ২০০ বছর আগে নাকি বাঘমুন্ডি রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় ছৌ-নাচের উৎপত্তি। পুরাণে বর্ণিত নানা দেবদেবীর গল্প বলে ছৌ-নাচ। আর তা ওই মুখোশ আর শিল্পীদের অসাধারণ দক্ষতায় ভর করেই। অনেক দিনের সাধ ছৌ-মুখোশের, কিনেও ফেললাম গোটা কয়েক। ফের গাড়ি ছুটল।
খানিক দূর যেতেই দেখলাম রাস্তা পাহাড়ের পথে পাকদণ্ডীর মতো বাঁক নিয়েছে। খাড়াই পথ ধরে ছুটছে গাড়ি। কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা একটা ছোট পাঁচিল মতো, সেখানে দাঁড়ালাম। নীচে চোখ যেতেই দেখি আকাশের মতো নীল জল। ছবির মতোই সুন্দর নীচের গ্রামগুলো। গাইড দাদা চিনিয়ে দিলেন, এটা লোয়ার ড্যাম। বামনিঝোরাকে বাঁধ দিয়েই তৈরি হয়েছে এই ড্যাম। আরও একটু উপরে উঠে পৌঁছলাম আপার ড্যামে। প্রায় দেড় কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই ড্যামের জলের রংও উজ্জ্বল নীল। হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তার মধ্য দিয়ে পৌঁছলাম হোটেলে। তখন দুপুর।
ফুলের আগুন
সূর্য ঢলে রক্তপাতে...
বিকেলের দিকে ফের গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়া হল। যেদিকে তাকানো যায় লাল মাটির রাস্তা। তার মাঝখানে ছবির মতো সুন্দর মাটির ঘর, নিকোনো মেঝে। সে সব পাশে রেখে গাড়ি ছুটল সীতাকুণ্ডের উদ্দেশে। সবটা পথ গাড়ি যায় না, অগত্যা পায়ে হেঁটেই পৌঁছলাম। অযোধ্যা পাহাড়ের বুকের ভিতর ছোট্ট একটা প্রস্রবণ। কথিত আছে, রামচন্দ্র বনবাসের সময় এখানে কিছু দিন আত্মগোপন করেছিলেন। সে সময় তির মেরে ভূমি ভেদ করে জল বের করে সীতার তৃষ্ণা মিটিয়েছিলেন রাম। স্থানীয়দের কাছে ভারী পবিত্র এই জায়গা।
এ বার উদ্দেশ্য ময়ূর পাহাড়। অযোধ্যা পাহাড়ের সবচেয়ে উঁচু টিলা এটি। মায়াবী আলোয় সূর্য ডোবে এখানে। গাড়ি রাস্তা ফেলে হেঁটে খানিকটা উঠলেই একটা ছোট হনুমান মন্দির। নিস্তব্ধ সেই বিকেলের ধার ঘেঁষে টুপ করে ঢলে পড়ে সূর্য। আকাশ তখন রক্তরাঙা। ফেরার পথে স্থানীয় মেলায় মিলল অদ্ভুত জিলিপির প্যাঁচের মতো তেলেভাজা। জিজ্ঞেস করে জানলাম এর নাম ভাবরা। আহা, কী স্বাদ!
রাঙা মাটির পথে লো...
পর দিন সকালে জলখাবার খেয়ে ফের রাঙামাটির রাস্তা ধরে বেরিয়ে পড়া হল মার্বেল লেকের উদ্দেশে। জঙ্গলের পথ ধরে খানিক দূর গিয়ে মিলল ছোট্ট জলাশয়। স্বচ্ছ নীল জল আর উঁচু উঁচু পাথরের টিলা। এখান থেকেই প্রয়োজন মতো পাথর কেটে নিয়ে গিয়ে তৈরি হয়েছে বাঁধগুলি। মার্বেল লেক থেকে সামান্যই দূরে বামনি ফলস। গাড়ি থেকে নেমে প্রায় অনেকটা পাথুরে পথ, তার পরে প্রপাত।
চড়াই-উতরাই বেয়ে বেশ কিছুক্ষণ চলার পর দেখা মিলল বামনি ফলসের। উপরের দিকে খাঁড়া পাথরের খাঁজ বেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে অশান্ত বামনি। কয়েক জন পর্যটক সেখানেই স্নান জুড়ে দিয়েছেন। আরও একটু এগোলে মূল ঝরনা। সেখানে প্রায় তিন ধাপে অনেকটা উপর থেকে পাহাড়ের শরীর কেটে নেমে আসছে ঝরনার জল। জলে খেলে বেড়াচ্ছে কাঁচপোকারা। বামনি ফলস
থেকে মাত্র দেড় কিলোমিটার দূরেই টুর্গা ফলস। বামনির মতো বড় না হলেও দিব্যি সুন্দরী টুর্গা। তার জলকে বেঁধেই তৈরি হয়েছে টুর্গা ড্যাম। খাড়াই পথ ওঠানামার পরিশ্রমে ক্লান্ত লাগছে। খিদেও পেয়েছে। তাই ফিরতে হল হোটেলে।
দিনশেষে বৈকালে মিষ্টি শপথ
আর হাতে মাত্র একটা বেলা। কাল সকালেই ট্রেন। ফেরার আগে শেষ গন্তব্য মুরগুমা লেক। স্থানীয়েরা নাম দিয়েছেন সুইসাইড পয়েন্ট। গাড়ি ছুটছে দু’পাশে জঙ্গলমোড়া পথ দিয়ে। সমস্ত গাছপালা জুড়ে শুষ্ক খয়েরি ছায়া। দেখলাম সুন্দর পথ, গাছপালাই কেমন রাস্তার সীমারেখা বানিয়ে দিয়েছে। পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তায় খেলছিল চার-পাঁচটি ময়ূর। গাড়ি দেখেই জঙ্গলে উড়ে পালাল। আমরা থামলাম জঙ্গলের মধ্যে এসে। এর পরের পথটুকু হেঁটেই। বেশ গোলকধাঁধার মতো রাস্তা, আর ড্রাইভারদাদাও যেতে চাইলেন না কিছুতে। অতএব একাই রওনা হলাম। আবার পাথুরে পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটা শুরু হল।
অবশেষে পৌঁছনো গেল নির্জন পাহাড়ের ঢালে। চারদিকে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা, শুকনো পাতা মাড়ানোর শব্দে ঘোর ভাঙে। নিজের পায়ের শব্দ চিনতে ভুল হয়ে যায় নিজেরই। যে দিকে চোখ যায় রুক্ষতার চাদরে ঢাকা পাহাড় আর জঙ্গল। দূরে দেখা যাচ্ছে মুরগুমা লেক। তাতে নানা পরিযায়ী পাখিদের ভিড়। চাইলে ঘুরে আসা যায় মুরগুমা ড্যামও। পাশেই আদিবাসীদের গ্রাম। এর মধ্যেই পাহাড়ের গা বেয়ে টুপ করে নিভে গেল সূর্য। এক মায়াবী নিস্তব্ধতা বুকে নিয়ে নেমে আসছি আমরা। ফিরে আসবার শপথটুকু সন্ধের বাতাসে রেখে...
ফিরে যেতে চাই বারবার ডাকছে আমার ইচ্ছেগুলো
গাড়িতে ফেরার পথে দেখলাম, পাহাড়ের বিস্তীর্ণ অংশ জুড়ে আগুন লেগেছে। দাউ দাউ করে জ্বলছে... দাবানল। নিজের মর্জিতেই কখনও নিভবে। পাহাড় আসলে আপন মনমর্জির মালিক।
পর দিন সকাল হতেই ট্রেন। সময় শেষ। গাড়ি অযোধ্যা পাহাড় থেকে নেমে আসছিল বরাভূম স্টেশনের দিকে। পথে গাইড দাদা শোনাচ্ছিলেন পুরুলিয়ার নানা গল্প। পাগলা হাতির, মাওবাদী-যৌথবাহিনীর লড়াই, আরও কত কী... আদতে জীবনের গল্প, যা বুকে নিয়ে ফিরে আসছিলাম নিজের শহরে। শুধু কথা দিয়ে এসেছিলাম, ফের আসব এই মায়াবী রাজ্যে।
টুকটাক ইনফো
কী ভাবে যাবেন
হাওড়া চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে পুরুলিয়া বা বরাভূম। সেখান থেকে ভাড়া গাড়ি বা বাসে চেপে অযোধ্যা পাহাড়। ধর্মতলা থেকে মিলবে পুরুলিয়া যাওয়ার দূরপাল্লার বাসও।
কখন যাবেন
নভেম্বর থেকে মার্চ মাসের যে কোনও সময়। গ্রীষ্মকালে এসব এলাকার তাপমাত্রা ৪৫ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়। তাই শীতকাল বা বসন্তকাল ঘোরার জন্য আদর্শ।
থাকার জায়গা
নিহারিকা লজ (সিএডিসি)।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy