তালাত মাহমুদ ক’টা, এই প্রশ্ন উঠে গেল এক সময়ে।
অনুরোধের আসরে এক দুপুর তপন কুমারের নাম ঘোষণা হয়ে গান এল ‘চাঁদের এত আলো, তবু সে আমারে ডাকি/ মাগিছে যে মোর আঁখি’।
এখন তালাত মাহমুদের ওই রেশমি-রুপোলি কণ্ঠস্বর কে না চেনে? তদ্দিনে ‘যেথা রামধনু ওঠে হেসে’, ‘আলোতে ছায়াতে দিনগুলি’ কী ‘এই রিম ঝিম ঝিম বরষা’ পাড়ার ছোকরাদের ঠোঁটেও উঠে গেছে।
আর হিন্দি সিনেমার গানে যাদের ঝোঁক তারা রোম্যান্সের ভাবে পড়লেই গেয়ে নিচ্ছে বিমল রায়ের ‘সুজাতা’ ছবির গান ‘জ্বলতে হ্যায় যিসকে লিয়ে’। একটু মডার্নমার্কা ছেলেরা তুলছে সলিল চৌধুরীর সুর করা খাস বিলিতি সুরের ‘ইতনা ন মুঝসে তু পিয়ার বঢ়া’, যাতে নাকি মেয়েরা ভীষণ পটে। আমাদের মধ্য কলকাতার তালতলা পাড়ার দুর্ধর্ষ রফিকণ্ঠ ছিল মুসলিম ছেলে ওমর। সে-ও এক দিন এক জলসায় গেয়ে বসল (আহা, আর কী মেজাজে!) তালাতেরই এক বিস্ময়গীতি ‘ফির ওহি শাম ওহি গম’! আর সেই তালাতের নাম রেডিয়োতে বলে দিল তপনকুমার!
সন্দেহের নিরসন হতে বেশি সময় লাগেনি। সে দিন সন্ধেতেই রকের আড্ডায় মেজরিটি ভোটে পাস হয়ে গেল বিল যে, তালাত মাহমুদ আর তপনকুমার মুদ্রার ও পিঠ-ও পিঠ, দুটো তালাত নেই।
তবু ওই আটান্ন-ঊনষাট সালে দুপুরবেলায় ছাদে উঠে ঘুড়ি ওড়াতে গেলে আমার কচি বুকে ধারণা বাঁধত তালাত সত্যি হয়তো দুটো। কারণ উত্তর দিকে চাইলে ক্রিক লেনের একটা ঢাউস চার তলা বাড়ি নজরে আসত, যেখানে কিছু কাল নাকি বাস করে গেছেন প্রিয় তালাত মাহমুদ!
শোনা কথা, তবে পাড়ার হাজারোখোঁজ বড়দের মুখে শোনা, ওতেই যথেষ্ট। ঘুড়ি যে দিকেই উড়ুক, থেকে থেকেই চাহনি ভেসে যেত ওই বাড়ির ওই ঘরগুলোর দিকে, যেন কীসের হানায় পড়েছি।
হানা আসলে একটি অপরূপ কান্নামাখা, ভদ্র আওয়াজের, যাকে পুরোপুরি বুঝে ভালবাসার বয়সও হয়নি হয়তো, তবু সে যে কী এক হানাদারি ওই কণ্ঠের! অনুরাগটাকে আরও জটিল করল ওঁর হিন্দি ও বাংলা গানের দুই খেয়া। পাশাপাশি হিন্দি ও বাংলায় গান করেন হেমন্ত ও মান্না, কিন্তু ওঁরা তো বাঙালি, গাইছেন হিন্দিতে। যেমন গীতা। কিন্তু ইনি কেমন বাঙালি, যিনি বাংলায় নেই? কিংবা বম্বে মাত করা নায়ক-গায়ক যিনি কিনা বম্বেরও নন?
ক্রমে টুক টুক করে জেনেছি যে, তালাত মাহমুদকে ঘিরে একটা ‘টেল অব টু সিটিজ’-ই গড়ে উঠতে পারে। যদিও মানুষটির জন্ম, শিক্ষা, শেকড়বাকড় নবাব ওয়াজেদ আলি শা-এর রূপকথাময় লখনউ-এ নবাব-সিংহাসনচ্যুত হয়ে শেষ জীবন কাটাতে এসেছিলেন, কলকাতার মেটিয়াবুরুজে (কলকাতায় নোঙর করেছিলেন ১৩ মে, ১৮৫৬), আর তাঁরই শহরের এই সেরা রত্নটি আরও আশি-পঁচাশি বছর পর কলকাতায় এলেন তাঁর গানের জীবনের ভাগ্যান্বেষণে। বাংলায় রেকর্ড করা তাঁর দ্বিতীয় গানটির (সুর কমল দাশগুপ্ত) বাণীও (গিরীন চক্রবর্তী) অবাক-করা।— ‘দুটি পাখি দুটি তীরে, মাঝে নদী বহে ধীরে’। একজনের জীবনের দ্বিতীয় দরবার ও পরি-খানা শুরু ও শেষ করার জন্য, অন্যজনের গানের দ্বিতীয় শুরুর জন্য।
তালাত মাহমুদের গান শুরু হয়ে গিয়েছিল গজল দিয়ে লখনউয়ে, ১৯৩৯ সালে। যেখানকার দেশপ্রসিদ্ধ ম্যারিস কলেজে (পরে নাম বদলে ভাতখণ্ডে সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়) শুদ্ধ হিন্দুস্তানি উচ্চাঙ্গে শিক্ষা হয়েছে ত্রিশের দশকের শেষ ক’বছর। ’৩৯-এ বয়স তখনও মোটে ষোলো, কিন্তু তখনই লখনউ রেডিয়োতে ওঁর গাওয়া মীর, দাগ, জিগরের গজলের সুরভি বিস্তারিত হতে শুরু করেছে সারা ভারত, এবং এক সময় হাওয়ায় হাওয়ায় এসে পড়েছে কলকাতায়। চল্লিশের দশকের সিনেমা মহল যে-শহর। যেখান থেকে গানে আর অভিনয়ে উঠেছেন কে.এল. সায়গল।
কলকাতার টান আরেকটা কারণে ছিল তালাতের। ফিল্ম অ্যাক্টিং। আর হবে নাই’বা কেন? আল্লার ‘দেন’ বলতে কণ্ঠের পাশাপাশি মুখেরও অপরূপ শ্রী। যে-মুখ দেখে পরে বম্বেতে দিলীপ কুমার মন্তব্য করেছিলেন, ‘‘মানুষটার ভদ্রতা ওঁর চেহারায় বেরিয়ে আসে।’’
আর এক আনকোরা তরুণ শম্মীকপূর ওঁর প্রথম দিককার এক ছবিতে প্লে-ব্যাক করতে আসা তালাতকে দেখে বলে ফেলেছিলেন, ‘‘স্যার, আপনিই তো হিরো হয়ে গেলে পারতেন এ ছবিতে!’’
সে-ছবিতে না হলেও তালাত মাহমুদ ১৯৪৫ থেকে ১৯৫৮-র মধ্যে অভিনয় করে ফেলেছিলেন ডজনখানেক ছবিতে। শুরুতে নায়িকা পেলেন ‘রাজলক্ষ্মী’ ছবিতে কাননবালাকে (তখনও দেবী হননি)। শেষ করলেন টলটল লাবণ্যের সুন্দরী নূতনকে নায়িকা পেয়ে ‘সোনে কি চিড়িয়া’ ছবিতে। মাঝখানে নায়িকা হয়েছেন কখনও মধুবালা, কখনও সুরাইয়া, কখনও শ্যামা, কখনও রূপমালা, শশীকলা, মালা সিনহা। এ সব ছবির কতটা কী মানুষ মনে রেখেছে জানিনা, তবে আজও মানুষ ভোলেনি আর আগামী একশো বছরেও ভুলতে পারবে না ‘মির্জা গালিব’ ছবিতে তালাত ও সুরাইয়ার ওই অলৌকিক গালিব-গজল ‘দিল-এ-নাদান তুঝে হুয়া কেয়া হ্যায়’।
ক’দিন আগে সমুদ্রতীর থেকে ফেরার পথে গাড়িতে বাজল যখন এই গান সমগ্র, সময় যেন স্থির হয়ে গেল। ‘মির্জা গালিব’ ছবি আমি দেখিনি। কিন্তু সেই ছেলেবেলা থেকে যখনই এই প্রিয়, হৃদয়বিদারক গানটা শুনেছি আমার মনের পর্দায় ভেসে উঠেছে স্যুট-টাইয়ে নিটোল হ্যান্ডসাম তালাত মাহমুদের মুখ, পাশে পরির মতো রূপময়ী সুরাইয়া। গজলটাকে প্রেমিক ও প্রেমিকার সংলাপে ভেঙে ফেলে কবি গালিবেরই ভেতরকার দ্বন্দ্বটাকেই যেন বার করে আনা হয়েছে। বিশেষ করে তালাত যখন তীব্র বেদনায় প্রশ্ন তোলেন, ‘‘আখের ইস দর্দ কি দাওয়া কেয়া হ্যায়।’ তা’হলে শেষে এ ব্যথার ওষুধ আর কী থাকে?
প্রেমের বিষণ্ণতার এ গান মধুর তিলক কামোদে বাঁধা, ক্রমান্বয়ে প্রেমিকের হয়ে প্রশ্ন তুলে যায়, যা রবীন্দ্রনাথের ‘ভালবাসা কারে কয়’ উচ্চারণের মতো সংযম ও মর্যাদায় গেয়ে যান তালাত। বলার চালে কোনও বাড়তি অলঙ্কার নেই, অথচ কী কবিদগী বা ব্যথার মোচড় ওঁর প্রশ্নে: কশ পুছো কে ইয়ে উদাস কেয়া হ্যায়। যদি কখনও জানতে চাও এই ব্যথা কোথাকার।
কেকর্ড হওয়া গানের যুগে গালিবের অজস্র শেরের মধ্যে ‘দিল-এ-নাদান’ যে কেন এত প্রিয়, এত মহৎ, এত স্মরণীয় হল তা, বহু দিন ধরে মনে হয় আসছে, তালাত-সুরাইয়ার এই নিবেদনের জন্য। রেকর্ড যুগেও গজল তো কম গাওয়া হয়নি, কিন্তু যে-ভদ্র আওয়াজ ও কণ্ঠপ্রয়োগ দিয়ে তালাত গজলকে এত পবিত্র কবিতা করে রেখে গেলেন তার তুলনা মেলেনি।
লখনউ ছেড়ে কলকাতায় এসেছিলেন যখন তালাত তখন দেশে গজলের মহল আলো করে আছেন উস্তাদ বরকত আলি খান, কে এল সায়গল এবং এম এ রউফ। উর্দু, হিন্দি যা গাইছেন তা তো গাইছেন, সেই সঙ্গে কমল দাশগুপ্তের সুরে পর পর ক’টা বাংলা গানও গাইলেন যার প্রথমটিতে (শোনো গো সোনার মেয়ে, ১৯৪৪) সায়গলের প্রভাব পরিষ্কার। কী টোনে, কী উচ্চারণে, কী গায়নভঙ্গিতে। কিন্তু পরের গান ‘দুটি পাখি দুটি তীরে’ (১৯৪৫) তালাত সম্পূর্ণ নিজস্ব, সম্পূর্ণ তালাত। ওঁর বাংলা উচ্চারণটাও এতটাই বাঙালি যে ওঁর তপনকুমার নামকরণ ভেদ করে তালাত খুঁজে পাওয়াও সমস্যা। সাধে ’৫৮-’৫৯-এও বাঙালি ছেলেছোকরাদের মধ্যে তালাত/তপন নিয়ে অত দুর্বেদ রহস্য!
১৯৪৪-এই তালাত গেয়ে ফেলেন ওঁর বেসিক হিন্দি হিট ‘তসবির তেরি দিল মেরা ব্যাহেলা ন সকেগি’। রেকর্ডটার আশ্চর্য চল হয়েছিল সে-সময় এবং আজও নন-ফিল্মিক রেকর্ডের বিক্রির তালিকায় ওপরের দিকে থেকে গেছে গানটা। এই গানের সাফল্যই ওঁকে কলকাতায় বানানো তিনটে হিন্দি ছবির নায়কের রোল পাইয়ে দিল। যার দুটোতে কাননদেবী (‘রাজলক্ষ্মী’ আর ‘তুম অউর ম্যাঁয়) আর একটিতে ভারতী দেবী (‘সমাপ্তি’)।
১৯৪৯-এ, বোম্বাই পাড়ি দিলেন তালাত। অভিনয়ের আকাঙ্ক্ষা অবশ্যই ছিল, তবে তত দিনে বড় টান হয়েছে বম্বেতে প্লে-ব্যাক গাওয়ার। কলকাতা থেকেই ওঁর নাম পৌঁছেছিল বম্বেতে, তাতে একটার পর একটা অফার এসেই চলেছিল। কিন্তু বম্বেতে তালাত মাহমুদের ‘তালাত মাহমুদ’ হয়ে ওঠার শুরু অনিল বিশ্বাসের সুরে ‘আর্জু’ ছবিতে ‘অ্যায় দিল মুঝে অ্যায়সি জগহ লে চল যঁহা কোই ন হো’ গেয়ে।
বম্বের ছবির সাউন্ডট্র্যাকে যিনি গজলের স্টাইলকে মসৃণভাবে বুনে দিয়েছিলেন সেই অনিল বিশ্বাসই যেন হিন্দি গানে তালাতের গায়কির ছায়াপথ নির্দিষ্ট করে দিলেন। বাংলায় বেসিক গানে যেমন ওঁর গজল স্টাইলের অনুচ্চ স্বরতরঙ্গকে কাজে লাগিয়েছিলেন তেমনি হিন্দি ফিল্মগানেও তখনকার বাংলা গীতিধারার মূর্ছনা ও আবেশ বয়ে এনেছিলেন। ওঁর অনেক হিন্দি প্লে-ব্যাকে শ্রোতা যেন এক বাঙালি কণ্ঠস্বর খুঁজে পায়। সব চেয়ে বেশি বাঙালি পরিচালক বিমল রায়ের বাঙালি জীবন নিয়ে তৈরি ‘সুজাতা’ ছবিতে বাঙালি সুরকার শচীনদেব বর্মনের নির্মিত ‘জ্বলতে হ্যায় যিসকে লিয়ে’ গানে। পর্দায় গানটা নায়ক সুনীল দত্ত টেলিফোনে গেয়ে শোনাচ্ছেন নায়িকা নূতনকে। দৃশ্যের বাঙালি আমেজটা সম্পূর্ণ হয়েছে একটা প্রায় নিখুঁত বাঙালি আওয়াজে। যেটা তালাত মাহমুদের।
কে জানে, হয়তো এই বাঙালি ধারার— প্রায় রাবীন্দ্রিক— কণ্ঠে মজে সলিল চৌধুরী ওঁর সুরারোপিত দুটি হিন্দি ছবির তিনটি অবিস্মরণীয় গানে তালাতের গলা নিয়েছেন। তার একটি মোৎজার্টের জি মাইনরের ৩৯ নং সিমফোনি থেকে নেওয়া সুরের আদলে গড়া ‘ইতনা ন মুঝসে তু পিয়ার বঢ়া’, যা আজ অর্ধশতাব্দীকাল পেরিয়েও ঠোঁটে ঠোঁটে, আইপডে আইপডে ঘুরছে। ‘ছায়া’ নামের এই ছবিটির নির্মাণসালটাও খেয়াল করার মতো। ১৯৬১; রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ।
দ্বিতীয় গানটাও কানে বসে আছে বাঙালির, কারণ এর সুর নির্ভুল ভাবে সলিলীয়। সুরটাকে বাংলা বাণীতে গেয়েছেন শ্যামল মিত্র— ‘আহা, ওই আঁকাবাঁকা যে পথ যায় সুদূরে’। হিন্দি অবতারে গানটা ডুয়েট ছিল তালাত ও লতার। যদ্দুর মনে করতে পারি, সলিলবাবু এক বর্ষার দিনে বম্বের ট্র্যাফিক জ্যামে আটকে গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনে বৃষ্টির ফোঁটা দেখতে দেখতে ‘আহা রিম ঝিম কে ইয়ে পিয়ারে পিয়ারে গীত লিয়ে’র সুরটা পেয়েছিলেন। আর সুরে সুরে সেই বৃষ্টির ফোঁটা ফোটানোর জন্য পছন্দ করেছিলেন তালাত ও লতার নির্ভার কণ্ঠযুগল। ছবির নাম ‘উসনে কহা থা’।
আর তৃতীয় গানটাও ‘ছায়া’ ছায়াছবির। তিনটে গানের মধ্যে সব চেয়ে কম শোনা, তবে তালাতের সব গানের মধ্যে সেরার লড়াইয়ে থাকবে। সলিলেরও সেরা কম্পোজিশনের মধ্যে। তালাতের গজলের ট্যালেন্টকে যে কী ব্যাপক বিস্তারে কিন্তু সূক্ষ্ম মাত্রায় ব্যবহার করা হয়েছে তা আশ্চর্যবোধের সীমা লঙ্ঘন করে। গানটার কবিতাও আশ্চর্য করে— ‘আঁসু সমঝ কে কিঁউ মুঝে আঁখসে তুমনে গিরা দিয়া’। অশ্রু মনে করে কেন চোখ থেকে ঝরিয়ে দিলে। আরও আক্ষেপ: ‘যো ন চমনমে খিল সকা ম্যাঁয়নে ও ফুল হুঁ’। যে বাগানে ফুটে উঠতে পারল না আমি সেই ফুল। রাজিন্দার কৃষণের কথায় ধরা এই গানের বাংলা ভার্সানে সলিল কথা বসিয়েছিলেন, ‘কী যে করি, কী যে করি/দূরে যেতে হয় তাই/ সুরে সুরে কাছে যেতে চাই’। লতাকে দিয়ে গাওয়ানো সে গান বাংলায় ক্ল্যাসিক হয়ে আছে।
মাঝে মাঝে নিজেকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়, সলিলের কথায় ধরা বাংলা গানটা কি তালাত মাহমুদের মনের কষ্টটাকেও ব্যক্ত করে? সলিলের তো করেই। কলকাতার মাটি, হাওয়া, শব্দ ছেড়ে যাওয়া। তাই সত্তর দশক অবধি বছর-বছর বাংলা বেসিক গান গেয়ে গেছেন। বম্বেতে সঙ্গ করেছেন, কাজ করেছেন বিমল রায়, অনিল বিশ্বাস, শচীনদেব, সলিল চৌধুরীর সঙ্গে। জীবনসঙ্গিনী করেছেন বাঙালি ললনা ললিতাকে। ছোট্ট ভাইয়ের মতো স্নেহ করেছেন বম্বেতে তখন আরেক প্রতিভাধর বাঙালি ভাগ্যান্বেষী সুবীর সেনকে।
মধুবালা
তালাত সম্পর্কে একটা সুন্দর অ্যানেকডোট আমায় দিয়েছিলেন সুবীর। প্রশ্ন ছিল: ‘‘তালাতের সঙ্গে আপনার আলাপ হয় কোথায়? বম্বে না লখনউ?’’ লখনউ প্রসঙ্গটা তুলেছিলাম কারণ তালাত ও সুবীর দু’জনেরই সঙ্গীতের ডিগ্রি লখনউয়ের ম্যারিস কলেজের। সুবীর বলছিলেন— ‘‘আমি যখন প্লে-ব্যাক করতে বম্বে গেলাম তখনই আলাপ হয়। উনি খুব ভদ্র মার্জিত মানুষ ছিলেন। মনে আছে, এক দিন সকালে ফিয়েট গাড়ি নিয়ে আমার বাড়িতে এলেন এবং বললেন, ‘আই অ্যাম ভেরি প্লিজড বিকজ ইউ হ্যাভ ব্রোকেন মাই রেকর্ড। আমার প্লে-ব্যাক করা দু’নম্বর গান হিট ছিল। তুমি প্রথম গানেই সেটা করলে।’ উনি আমায় এও বলেছিলেন, ‘লতার সাত নম্বর গান হিট। তুমি জানো, রফি সাহেবের মতো আর্টিস্ট আড়াই বছর কোরাস গেয়ে চার নম্বর গান হিট করান। আমি এ সব শুনে বললাম, ‘দেখুন এটা হয়ে গেছে, হয়ে গেছে।’ তালাতদা আমাকে নানারকম সাহায্য করেছেন। বিপদে আপদে।
সেই তালাতদা’র সঙ্গে সম্পর্কটায় একটু চিড় ধরে গেল। একেবারেই অকারণে। সে বার মধুবালা প্রোডাকশনের ছবি ‘মহেলা কে খোয়াব’-এর গান রেকর্ডিং আগেই হয়েছিল। এতে গেয়েছিলেন মহম্মদ রফি, তালাত মাহমুদ ও গীতাদি (দত্ত)। হঠাৎ আমায় স্টুডিয়োতে এক দিন মধুবালা ডেকে পাঠাল। গেলাম সেখানে। মধুবালা বলল, ‘‘সুবীরদা ইয়ে গানা গাইয়ে। গাইলাম দ্বৈতকণ্ঠে ‘অগর তুম বুরা না মানো’। সঙ্গে গাইল আশা ভোঁসলে।
তালাতদা এটা জানতে পেরে নিজেই এক দিন আমার বাড়ি এসে বললেন, এই গানটার রেকর্ডিং নাকি ওঁকে দিয়ে আগেই করানো হয়েছে। দ্বিধাগ্রস্ত, কিছুটা সঙ্কুচিত হয়ে বললাম, ‘তালাতদা, এই ঘটনা আমি জানতাম না। জানলে রেকর্ডিং করতাম না।’ আসলে ছবির সুরকার, প্রযোজক আমাকে আগে জানায়নি।’’
তালাত মাহমুদের ভদ্র, সুজন ব্যক্তিত্বের একটা তুলনা হতে পারে রাহুল দ্রাবিড়। নির্ভরশীল ও কীর্তিমান, কিন্তু প্রচারের আলোকবৃত্ত থেকে সরে। এই নির্জনতাটাই উনি ব্যবহার করেছেন ওঁর গানে। যেমন একটা গানের কথা মনে করতে পারি। শ্যামল গুপ্তের কথায় আর ভি বালসারার সুরে— ‘তুমি সুন্দর যদি নাহি হও, তায়/ বলো কী-বা যায় আসে/ প্রিয়ার কী রূপ সে-ই জানে, ওগো/ যে কখনও ভালবাসে’।
গানটা রেডিয়োতে এলেই তালাতের স্যুট-বুট পরা চেহারাতেই একটা মধ্যবিত্ত মাধুর্য শনাক্ত করতে পারতাম। ঠিক যে-ভাবখানা তৈরি হত ‘চাঁদের এত আলো’, ‘আলোতে ছায়াতে দিনগুলি ভরে রয়’, ‘এল কি নতুন কোনও গোধূলির বেলা’ বা ‘এই তো বেশ নদীতীরে’ শুনতে শুনতে।
সত্যি বলতে কী, এই সব গানের দাক্ষিণ্যেই পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে তালাত মাহমুদ বলতে বাঙালি শ্রোতার মনে একটা প্রেমিকের ছবিই এসে যেত। শোনা যায়, কী কলকাতা, কী বম্বেতে ওঁর এই গানের মূর্তি আর ব্যক্তি চরিত্রের মধ্যে তফাত কখনও তৈরি হয়নি। প্রচারে না এসেও সাতচল্লিশ বছরে ৮০০ গান রেকর্ড করা বা এক বিস্তীর্ণ ভক্তসমাজ গড়ে নিতে ওঁর কিন্তু অসুবিধে হয়নি। যে-জন্য রেকর্ড করা ছেড়ে দেবার পাঁচ বছর পরেও ১৯৯১-এ হল্যান্ড সফরে গিয়ে উপচে পড়া ভিড় পেয়েছেন হলে হলে। যে-বিদেশ যাত্রা শুরু হয়েছিল সুদূর ১৯৫৬-য়। গলায় সিনেমার গান নিয়ে প্রথম বিদেশ সফরকারী ভারতীয়ও তিনি। সেই প্রথম সফর পূর্ব আফ্রিকায়। পরে মার্কিন দেশ, ব্রিটেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ, কোথায় না কোথায়!
বড় আফশোসের এটাই যে এত বিশুদ্ধ বাংলা উচ্চারণ ও গভীর মেজাজের শিল্পীকে দিয়ে কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়ানো ও রেকর্ড করানো হল না। তাই ১৯৯৮-এ ৭৪ বছর বয়েসে ৯মে (২৫ বৈশাখ?) ওঁর প্রয়াণেও কি একটা নীরব অভিমান কাজ করেছে?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy