Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Personality

রবীন্দ্রনাথের এক আশ্চর্য আবিষ্কার

যিনি বাঙালিকে তাঁর সাধনার ধারার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, প্রথম শুনিয়েছিলেন সন্ত বাণী ও বাউল ফকিরের গান সেই রবীন্দ্রসাধক পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রীকে নিয়ে লেখা।

সুদেষ্ণা বসু
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৯ অক্টোবর ২০২২ ১০:১৩
Share: Save:

সময়টা ১৯০৮ সালের এক আষাঢ় মাস। মধ্যরাতে বোলপুর স্টেশনে নামলেন এক যাত্রী। তাঁর গন্তব্য রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন আশ্রম। কিন্তু বাইরে প্রচণ্ড বৃষ্টি। স্টেশন ছেড়ে বেরোনো অসম্ভব দেখে স্টেশনেই অপেক্ষা করতে লাগলেন তিনি। পরদিন ভোরে বৃষ্টি থামলে পায়ে হেঁটে তিনি রওনা দিলেন শান্তিনিকেতনের উদ্দেশে। জলকাদায় ভরা রাস্তা ধরে বিস্তীর্ণ প্রান্তর পেরিয়ে যতই তিনি আশ্রমের কাছাকাছি পৌঁছতে লাগলেন, কানে আসতে লাগল কে যেন গলা ছেড়ে গাইছেন, ‘তুমি আপনি জাগাও মোরে’। গান শুনেই বুঝলেন কে এই গায়ক, তাঁর গলার শক্তি দেখে বিস্মিত হলেন। সেই গায়ক হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পথিক ক্ষিতিমোহন সেন। তিনি লিখে গিয়েছেন, “শান্তিনিকেতনে তাঁহার দেহলী নামক গৃহের দোতলায় তিনি দাঁড়াইয়া গাহিতেছেন আর বোলপুরে তাহা শুনা যাইতেছে। অবশ্য তখন বোলপুরের পথ বড়ো নির্জন ও শান্ত ছিল।”

ক্ষিতিমোহন সেনের জন্ম ১৮৮০ সালের ২ ডিসেম্বর। আজকের বাংলাদেশের বিক্রমপুরের সোনারং গ্রামের নামকরা অধ্যাপক, কবিরাজ ও বহুশাস্ত্রবিদ পণ্ডিত রামমণি শিরোমণির বংশে। সংস্কৃতচর্চার বিশেষ ঐতিহ্য ছিল এই বৈদ্যপ্রধান গ্রামটির। পরিবারটির নিষ্ঠাবান ও আচারপরায়ণ বলে খ্যাতিও ছিল। তার চেয়েও বেশি খ্যাতি ছিল পাণ্ডিত্যের। তবে রক্ষণশীল এই পরিবারের আর্থিক প্রাচুর্য ছিল না। ক্ষিতিমোহনের পিতা ভুবনমোহন সেন ছিলেন চিকিৎসক। মা দয়াময়ী দেবী। এঁদের পুত্রকন্যারা হলেন অবনীমোহন, ধরণীমোহন, ক্ষিতিমোহন, মেদিনীমোহন ও প্রমোদিনী। অন্য দিকে, দয়াময়ীর বাবা ছিলেন বিচারক ও পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত আধুনিক মননের মানুষ। তাঁর পুত্ররা উচ্চশিক্ষার জন্য বিলেতে গিয়েছিলেন বলে গ্রামে একঘরে হন। দুই পরিবারই ছিল সোনারংয়ের বাসিন্দা। ফলে দুই পরিবার বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর ভুবনমোহনের পরিবারেরও ধোপা, নাপিত বন্ধ হয়ে যায়। যদিও দয়াময়ীকে দমানো যায়নি।

রামমণি শিরোমণি বাহাত্তর বছর বয়সে কোষ্ঠীতে মৃত্যুযোগের উল্লেখ দেখে শেষ বয়সে কাশীতে গিয়ে থাকবেন বলে নিজের গ্রাম ও অধ্যাপনা ছেড়ে নদীপথে কাশীযাত্রা করেন। পিতার সঙ্গে একত্রে থাকতে ভুবনমোহনও তাঁর স্ত্রী, পুত্রকন্যাদের নিয়ে সেই কাশীযাত্রার সঙ্গী হন। এর ফলে ক্ষিতিমোহনের শৈশব কাশীতেই বেশি কাটে। নিজেকে তিনি কাশীর মানুষ বলেই মনে করতেন।

ভারতসংস্কৃতির কেন্দ্রবিন্দু কাশী বা আজকের বেনারস। কাশীর গঙ্গা, তার ঘাট, বিভিন্ন অলিগলি, মন্দির, মসজিদ, নানা সাধকের আস্তানা, নানা সম্প্রদায়ের মঠ কিশোর বয়স থেকে ক্ষিতিমোহনকে তৈরি করে দিয়েছিল। মুক্ত মনে সব কিছু দেখার একটা দৃষ্টি তিনি পেয়েছিলেন। ধর্মতান্ত্রিকতার মোহ তাঁকে অন্ধ করে দেয়নি। কাশীর সাধুসন্ন্যাসী, ভক্ত, সন্তদের প্রতি ছোট থেকেই এক স্বাভাবিক আকর্ষণ বোধ করতেন। কাশীতে তখন বড় বড় পণ্ডিতরা থাকতেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন ক্ষিতিমোহনের শিক্ষাগুরু। গঙ্গাধর শাস্ত্রী নামে এক দক্ষিণী পণ্ডিতের চতুষ্পাঠীতে ক্ষিতিমোহনকে পাঠানো হয়। তাঁর পাঠ শুরু হয় হিন্দি ভাষায়। বাংলা অক্ষরজ্ঞান হয়েছে অনেক পরে। ক্রমশ সংস্কৃত, উর্দু ও ফারসি ভাষাও তিনি আয়ত্ত করে নেন।

ক্ষিতিমোহনের কলেজ জীবন কেটেছিল বেনারসের কুইন্স কলেজে। তাঁর জীবনীকার প্রণতি মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, কলেজের সাহেব অধ্যক্ষ একবার ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধে ধারাবাহিক বক্তৃতা দেন। কিন্তু তার পর মূল লেখাগুলি হারিয়ে ফেলেন। ডাক পড়ে ক্ষিতিমোহনের। তিনি সেই বক্তৃতাগুলি স্মৃতি থেকে আবার লিখে দেন। পরে মূল লেখাগুলি পাওয়া যায় ও দেখা যায় ক্ষিতিমোহনের স্মৃতি থেকে লেখা ও মূল লেখা কয়েকটি শব্দ ছাড়া হুবহু এক।

যে ব্রাহ্মণ্যবাদ নির্ভর শিক্ষামণ্ডলের পরিবেশে ক্ষিতিমোহন শিক্ষালাভ করছিলেন, সৌভাগ্যের বিষয় সেই পরিবেশ তাঁকে কোনও রকম ধর্মান্ধতার নিগড়ে বেঁধে ফেলেনি। এর কারণ তৎকালীন কাশীতে তিনি এমন সব বিরাট পণ্ডিত, শাস্ত্রজ্ঞ ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাধকের দেখা পেয়েছিলেন, যাঁরা তাঁকে তৈরি করে দিয়েছিলেন অন্য ভাবে। তিনি তাঁর ছাত্রজীবনে এই সব পণ্ডিত ও সাধকের মুখের কথা শুনতে কাশীর বিভিন্ন অলিগলিতে ঘুরে বেড়াতেন। এমনকি কাশীর বাইরেও বন্ধুদের দল তৈরি করে ছুটতেন কোনও সাধকের কথা জানতে। যে দু’জন অধ্যাপক ক্ষিতিমোহনের জীবনে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছিলেন, তাঁরা হলেন মহামহোপাধ্যায় সুধাকর দ্বিবেদী ও ঈশানচন্দ্র বিদ্যারত্ন। সুধাকর দ্বিবেদী ছিলেন বিরাট পণ্ডিত। ভারতের মধ্যযুগের সন্তদের বাণীতে যে গভীর আধ্যাত্মিক সাধনা ও উপলব্ধির প্রকাশ ঘটেছে, তার খবর তিনিই প্রথম ক্ষিতিমোহনকে দেন।

ক্ষিতিমোহন অবশ্য তাঁর ছোটবেলা থেকেই কাশীর সাধুমহাত্মাদের গলায় কবীর-দাদূর ভজন শুনেছিলেন। ঠিক যেমন করে হঠাৎই একদিন কাশীর একটি বাড়িতে বসে স্বামী বিবেকানন্দের গলায় রবীন্দ্রনাথের গান শুনে বুঝতে পারেননি সে গানের লেখক কে! কারণ তখনও অবধি বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে তাঁর ভাল ভাবে পরিচয় ঘটেনি। সন্তদের বাণী ক্ষিতিমোহনকে এতটাই আকৃষ্ট করেছিল যে, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদের কাছ থেকে পাঠ নিলেও তাঁর মন পড়ে থাকত কবীর, দাদূ, রজ্জাব, রবিদাসের বাণী সংগ্রহ ও শোনার জন্য। এক অমোঘ আকর্ষণ তাঁকে এক উদার ও গভীর ধর্মের জগতে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। ২ ফেব্রুয়ারি ১৮৯৫ সালে ক্ষিতিমোহন সন্তমতী সাধকের কাছে দীক্ষাও নিয়েছিলেন। এই দেখা ও চেনার চেষ্টাতেই ক্ষিতিমোহন মধ্যযুগের সন্তসাধনা ও ভক্তিগীতির পাশাপাশি বাংলার বাউলদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করেন। বাউলের সন্ধানে তিনি কেন্দুলিতে এসেছেন। যদিও কিছুটা দূরেই শান্তিনিকেতন আশ্রমের খবর তখন তাঁর কাছে ছিল অজানা।

রবীন্দ্রসাহিত্যর সঙ্গে ক্ষিতিমোহনের পরিচয় ঘটেছিল তাঁর উনিশ-কুড়ি বছর বয়সে। কাশীর গঙ্গার ঘাটে কলকাতা থেকে আসা বন্ধু কালীকৃষ্ণ মজুমদার ও বিপিন দাশগুপ্তর কাছেই প্রথম ক্ষিতিমোহন রবীন্দ্রকাব্যের পরিচয় পান। তিনি মধ্যযুগীয় সন্তবাণীর আলোয় রবীন্দ্রনাথকে চিনেছিলেন। তাঁর এই অনুসন্ধানের কারণেই শিক্ষিত শহুরে মানুষদের মধ্যযুগের সন্ত ও বাংলার বাউলদের ধর্ম সাধনা এবং সাধন সঙ্গীতের সঙ্গে প্রথম পরিচয় ঘটে। বিভিন্ন সন্ত ও বাউল সাধকের গান রবীন্দ্রনাথকেও তিনি শুনিয়েছেন। প্রসঙ্গত ক্ষিতিমোহন ভাল গাইতেনও।

১৯০২ সালে ক্ষিতিমোহন এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কুইন্স কলেজ থেকে সংস্কৃত নিয়ে এম এ পাশ করেন। এম এ পাশ করার পরে তাঁর সঙ্গে বরিশাল জেলার গৈলা গ্রামনিবাসী পেশায় ইঞ্জিনিয়র মধুসূদন সেনের বড় মেয়ে কিরণবালার বিয়ে হয়। ক্ষিতিমোহনের প্রথম কন্যাসন্তান রেণুকার জন্ম ১৯০৪ সালে। তবে দ্বিতীয় কন্যাসন্তান ফেণী মাত্র আড়াই বছর বসে মারা যায়। এর পর ১৯০৮ সালে পুত্র ক্ষেমেন্দ্রমোহন (কঙ্কর), ১৯১০ সালে কন্যা মমতা (লাবু) ও ১৯১২ সালে অমিতার জন্ম হয়। অমিতার পুত্র নোবেলজয়ী অমর্ত্য সেন তাঁর নাতি।

ক্ষিতিমোহন কলকাতার মেডিক্যাল কলেজেও ভর্তি হন। তাঁর সহপাঠী ছিলেন বিধানচন্দ্র রায়। কিন্তু বড় দাদা অবনীমোহন হঠাৎ মারা যাওয়ায় পরিবারের যাবতীয় দায়িত্ব এসে পড়ে তাঁর উপরে। ফলে ডাক্তার হওয়ার চেষ্টা ছেড়ে চাকরির সন্ধানে নামতে হয় তাঁকে। ১৯০৭ সালে তিনি হিমালয়ের কোলে পাহাড় ঘেরা ছোট করদ রাজ্য চম্বায় রাজা ভুরি সিংহের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকের কাজ পান। ১৯০৮ সালে কালীমোহন ঘোষ মারফত ক্ষিতিমোহনের খবর পান রবীন্দ্রনাথ। ক্ষিতিমোহন সম্পর্কে জেনে রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল ‘ইনি নিশ্চয় একজন প্রাচীন শাস্ত্রজ্ঞ এবং অত্যন্ত উদার’। সেই সঙ্গে আরও মনে হয়েছে, ‘তাঁর সাহিত্যানুরাগ ও বিদ্যাবুদ্ধির কথাতেই যে আমি উৎসাহিত হয়েছি তা নয়, এঁর মধ্যেও ঐ লোকপ্রেমের সংবাদ পেয়েছি’।

অন্য দিকে ক্ষিতিমোহন রবীন্দ্রসাহিত্য সম্পর্কে জানার পর থেকেই রবীন্দ্রনাথের প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করেন। সেই সঙ্গে ব্রাহ্মসমাজের সংস্পর্শে আসারও সুযোগ ঘটেছিল। মাঘোৎসবের উপাসনার প্রতি ছিল তাঁর তীব্র আকর্ষণ। এই উৎসবে যোগ দিতে তিনি কলকাতায় এসেছেন। আর রবীন্দ্রনাথকে স্বচক্ষে দেখার ইচ্ছে তাঁর এতটাই ছিল যে, ১৯০৪ সালে মিনার্ভা থিয়েটারে তিনি ‘স্বদেশী সমাজ’ পাঠ করবেন শুনে কাশী থেকে কলকাতায় এসে হাজির হন। ভিড়ের চাপে তাঁর জামা ছিঁড়ে যায়। সে যাত্রায় আর রবীন্দ্রনাথকে দেখা হয়নি। পরে আবার সেই প্রবন্ধ পড়েন কার্জন থিয়েটারে। সেখানে বন্ধুদের সাহায্যে স্টেজের পিছনে পৌঁছে রবীন্দ্রনাথকে দেখলেন। তাঁর মুখ দেখা গেল না। রবীন্দ্রনাথ যখন প্রবন্ধ পড়লেন ক্ষিতিমোহনের মনে হল, তিনি যেন ‘গান গাইছেন’।

চম্বায় থাকার সময়ে রবীন্দ্রনাথের চিঠি এসে পৌঁছেছিল ক্ষিতিমোহনের কাছে। প্রথম চিঠি তিনি পেয়েছিলেন ১৯০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে, যার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। পরে বন্ধু বিধুশেখরের কাছ থেকেও চিঠি এসেছিল একই খবর নিয়ে যে, শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের কাজে তাঁকে যুক্ত হওয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। ক্ষিতিমোহন স্বভাবতই খুশি হয়েছিলেন কিন্তু দ্বিধাও তাঁকে ঘিরে ধরেছিল। কারণটা ছিল আর্থিক। কিন্তু শেষ অবধি মনের সব দ্বিধা-দ্বন্দ্ব সঙ্কোচ কাটিয়ে, রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে নিন্দুকদের কথা কানে না নিয়ে শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন তিনি।

শান্তিনিকেতনে সন্ধ্যা নামার পরে আলোর অভাবে রবীন্দ্রনাথ পড়াশোনা করতেন না। তখন শুরু হত আশ্রমের ‘অনধ্যায়’ পর্ব। যখন বই রেখে রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বসতেন শিক্ষকেরা। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হত। এই আড্ডায় দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরও এসে যোগ দিতেন। ক্ষিতিমোহন এই আড্ডায় যোগ দিতে শুরু করেন। এই আড্ডায় ক্ষিতিমোহন যেমন রবীন্দ্রনাথের অগাধ পাণ্ডিত্যের খবর পেতেন, তেমনই রবীন্দ্রনাথের কাছেও ক্ষিতিমোহন কখনও কখনও উত্তেজনার বশে আচমকাই প্রকাশ করে ফেলতেন নিজের জ্ঞানের পরিধি, যা অবাক করত রবীন্দ্রনাথকে। বিভিন্ন সন্ত ও বাউল ফকিরদের গান রবীন্দ্রনাথ প্রথম শুনেছিলেন ক্ষিতিমোহনের কণ্ঠে। পরস্পরকে জানার এই পর্ব শুরু হয়েছিল শান্তিনিকেতনে পা রাখার পর থেকেই। শান্তিনিকেতনে ক্ষিতিমোহনের প্রথম আস্তানা ছিল রবীন্দ্রনাথের ‘নতুন বাড়ি’। ক্ষিতিমোহন যখন নতুন বাড়িতে থাকতে শুরু করেন তখন রবীন্দ্রনাথ পাশের ‘দেহলী’ বাড়িটির বাসিন্দা।

দেহলীতে ক্ষিতিমোহন দেখেছেন রাতের অন্ধকারে রবীন্দ্রনাথকে সুর সৃষ্টি করতে। নতুন বাড়ির বারান্দায় বসে ক্ষিতিমোহন সেই গানের কথা অগোচরে লিখে নিতেন। একজন ভক্তের ঐকান্তিকতায় ক্ষিতিমোহন আজীবন যেমন করে ভারতপথিক হয়ে নানা সন্তসাধকের কাছ থেকে তাঁদের বাণী ও সাধনতত্ত্ব সংগ্রহ করতেন, সেই ভাবেই রবীন্দ্রনাথের সাধনাকে বুঝে নিতে শুরু করেছিলেন। মুখ্যত সেই উদ্দেশ্যেই তো তাঁর রবীন্দ্রনাথের কাছে আসা।

১৯০৮ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে ক্ষিতিমোহনের অনুরোধেই রবীন্দ্রনাথ বলতে শুরু করেছিলেন তাঁর শান্তিনিকেতন বক্তৃতামালার আশ্চর্য কথাগুলি। ভোরবেলায় আশ্রমের মন্দিরের পুবদিকের সিঁড়িতে বসে ক্ষিতিমোহন ও উপস্থিত আরও কয়েকজন শিক্ষকের সামনে সূর্যোদয়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে রবীন্দ্রনাথ বলে যেতেন আপন খেয়ালে। এমন করে নিজের অন্তরাত্মাকে উজাড় করে আর কখনও দেননি রবীন্দ্রনাথ। বোধহয় ক্ষিতিমোহনকে যোগ্য মনে করেছিলেন বলেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর সাধকরূপ সেই একবারই উন্মুক্ত করেছিলেন।

১৯০৮ সালে ক্ষিতিমোহন ও বিধুশেখরের উদ্যোগে আশ্রমে শুরু হয় ‘বর্ষা উৎসব’ যা শান্তিনিকেতনের আদি উৎসব। ১৯১০ সালে রবীন্দ্রনাথের ‘গীতাঞ্জলি’ যেমন প্রথম প্রকাশিত হয় তেমনই রবীন্দ্রনাথের আগ্রহে ও উদ্যোগে ক্ষিতিমোহনের চারখণ্ডের আকরগ্রন্থ ‘কবীর’-ও প্রকাশিত হয়। কবীরের দোঁহা সংকলনের মাধ্যমে ক্ষিতিমোহন সকলের জন্য যেন এক রত্নভান্ডার খুলে দিয়েছিলেন। ক্ষিতিমোহনের সংগৃহীত কবীরের দোঁহা পড়ে উৎসাহিত হয়ে তার ইংরেজি অনুবাদে হাত দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

এর পর ধারাবাহিক ভাবে ক্ষিতিমোহনই শিক্ষিত শহুরে বাঙালিকে ভারতীয় মধ্যযুগের সুফিসন্তদের সাধনা ও সাহিত্যর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন যেমন, তেমনই বাংলার বাউলদের গুপ্ত সাধনার খবরও এনে দিয়েছিলেন। আবার ভারতে হিন্দু মুসলমানের যুক্ত সাধনার খোঁজ ক্ষিতিমোহনের কাছ থেকেই আমরা পেয়েছি। ১৯১১-১৩ সময়কালের দিকে তাকালে দেখা যাবে শান্তিনিকেতন আশ্রমে ক্ষিতিমোহনের উৎসাহ ও ব্যবস্থাপনায় রবীন্দ্রনাথের পঞ্চাশ বছরের জন্মদিন পালিত হচ্ছে। পরের বছর কবি চিকিৎসার প্রয়োজনে ইংল্যান্ড যান। আমেরিকাতেও গিয়েছিলেন। এই ভ্রমণের সময়ে রবীন্দ্রনাথ আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন ক্ষিতিমোহনকে নিয়ে যেতে, যাতে স্বামী বিবেকানন্দের পর একজন যোগ্য ব্যক্তি পাশ্চাত্যের সামনে প্রাচ্যের সাধনার খবর সঠিক অর্থে পৌঁছে দিতে পারেন। কিন্তু শেষ অবধি তা সম্ভব হয়নি। তবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে ক্ষিতিমোহনের চিন ও জাপান সফর সম্ভব হয়েছিল ১৯২৪ সালে, যা তাঁর জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য পর্ব। একই ভাবে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে গুজরাত ভ্রমণও তেমনই একটি পর্ব।

শান্তিনিকেতনে আসার মাত্র চার বছরের মধ্যে ক্ষিতিমোহন আশ্রমের একজন অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন। সকলের কাছে তিনি কালক্রমে আশ্রমের ‘ঠাকুর্দা’ এবং তাঁর স্ত্রী কিরণবালা হয়ে উঠেছিলেন ‘ঠানদি’। রবীন্দ্রনাথ ক্ষিতিমোহনকে কেবল শিক্ষক হিসেবে চাননি, ‘আপনি মনে করিতেছেন, আপনি কেবল আপনার ছাত্রদের লইয়াই কাজ করিবেন – সেটা আপনার ভুল। আমরাও আছি।... ছাত্রদের পাইয়া আমাদিগকে অবহেলা করিবেন না’।

ক্ষিতিমোহন অবহেলা করেননি। তাঁর মাধ্যমেই শান্তিনিকেতন আশ্রম জীবনে রূপ পেয়েছিল রবীন্দ্রনাথের ভাবনাপ্রসূত এক জীবনচর্যা, যেখানে তিনি গেঁথে দিয়েছিলেন বিভিন্ন অসম্প্রদায়িক প্রকৃতি বন্দনার উৎসব। আর ক্ষিতিমোহন সেই উৎসবের আঙ্গিকের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছিলেন বেদ-উপনিষদ থেকে চয়ন করা বিভিন্ন শ্লোক বা সূক্ত। রবীন্দ্রনাথ লিখে দিয়েছিলেন সেই উৎসবের উপযোগী গান এবং ক্ষিতিমোহনের সঙ্গে পরামর্শ করে নন্দলাল তাঁর ছবি ও আলপনা দিয়ে তৈরি করেছেন উৎসবগুলির অঙ্গসৌষ্ঠব ও লালিত্য। প্রসঙ্গত, শান্তিনিকেতনের প্রথম ঋতু উৎসব শুরু হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের অনুপস্থিতিতে। ক্ষিতিমোহন, দীনেন্দ্রনাথ, অজিতকুমারের উদ্যোগে। বৈদিক পর্জন্য উৎসবের আদলে সেই বর্ষাঋতুর উৎসব পরিকল্পনা করা হয়েছিল। এই ভাবেই বসন্ত, বর্ষা, শরৎ ঋতুর বন্দনার সূত্রপাত হয়।

শান্তিনিকেতনে এসে ক্ষিতিমোহন দেখেছিলেন এখানেও সভা সাজানো হয় বিজাতীয় চেয়ার টেবিল দিয়ে। কাশীতে তিনি দেখেছিলেন পুরাণকথকদের জন্য বেদি, মালা চন্দন দিয়ে সাজানো হত। প্রণতি মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, “শান্তিনিকেতনে এই রীতির প্রচলন করতেই সভার রূপ একেবারে বদলে গেল, প্রাচীন যুগের ঐশ্বর্যের আভাস ফুটে উঠল তাতে।”

যাকে আজ আমরা শান্তিনিকেতনের সংস্কৃতি বলে জানি, তার গোড়াপত্তন হয়েছিল এই ভাবে ক্ষিতিমোহনের উদ্যোগে। শান্তিনিকেতনের আলপনার সূচনাও ক্ষিতিমোহনের হাত ধরে। ক্ষিতিমোহন প্রাচীন শাস্ত্রবিধি মেনে ছাত্রদের দিয়ে আলপনা দেওয়াতেন। তাঁর লেখায় রয়েছে, ‘পঞ্চগুড়িকায় নানা রেখায় আলপনারও একটা নিজস্ব ভাষ্য একদিন ছিল। দুঃখের বিষয় তা আমরা ভুলে গেছি’।

আশ্রমে রবীন্দ্রনাথের ক্লাস ছাত্র ও শিক্ষকদের কাছে আকর্ষণের বিষয় ছিল। ক্ষিতিমোহনের ক্লাসও তেমনই প্রধান একটি আকর্ষণের বিষয় হয়ে উঠেছিল। তাঁর কাছে রবীন্দ্রকাব্যের ব্যাখ্যা শোনা ছিল এক অভিজ্ঞতা। অনেকেই তাই ক্ষিতিমোহনের ক্লাসে এসে বসতেন। অনেক ছাত্রছাত্রীর স্মৃতিকথায় শিক্ষক ক্ষিতিমোহনের ছবি ধরা আছে। তাঁকে ভয় ও সমীহ করলেও ক্ষিতিমোহনের স্নেহ ভালবাসাও পেয়েছে তারা। ছাত্রদের নিয়ে ক্ষিতিমোহন বেড়াতে যেতেন। বহু ছুটির অবকাশে ক্ষিতিমোহন যে কত জায়গায় তাঁর ছাত্রদের নিয়ে গিয়েছেন তার হিসেব নেই। ছাত্রদের সঙ্গে আড্ডা দিতে বসে এমন সব গল্প বলতেন যার তুলনা হয় না। সকলে সেই গল্প শুনে অভিভূত হত। আবার কখনও উল্টো উচ্চারণে জানা শব্দ এমন ভাবে বলতেন যেন মনে হত সংস্কৃত শ্লোক বলছেন। যেমন, ‘হবর্তাবা/কহিপ্তাসা/ টজেগেন/ শকেডুএ’। আসলে যা বললেন তা হল, ‘সাপ্তাহিক বার্তাবহ ও এডুকেশন গেজেট’। ক্ষিতিমোহনের রসিকতার নানা গল্প এক সময়ে শান্তিনিকেতনে লোকের মুখে মুখে ফিরত।

বিশ্বভারতী পর্বে ক্ষিতিমোহনের ব্যস্ততা অনেক বেড়ে গিয়েছিল। কিন্তু সমস্ত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি নিজের কাজ করে গিয়েছেন আশ্চর্য দক্ষতায়। যেমন প্রথম থেকেই আশ্রম বিদ্যালয়ে ছুটি পড়লে তিনি বেরিয়ে পড়তেন নিজের কাজে। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় সন্তকবিদের খোঁজে তিনি ঘুরে বেড়াতেন তাঁদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করতে। আর তাই আমরা তাঁর কাছ থেকে একে একে পেয়েছি কবীর, ভারতীয় মধ্যযুগে সাধনার ধারা, দাদূ, ভারতের সংস্কৃতি, জাতিভেদ, হিন্দু সংস্কৃতির স্বরূপ, প্রাচীন ভারতে নারী, বেদোত্তর সঙ্গীত, বাংলার সাধনা ও চিন্ময় বঙ্গ, বাংলার বাউল, বাংলার সাধনা, যুগগুরু রামমোহন, বলাকা-কাব্য ও হিন্দুইজম ইত্যাদি গ্রন্থ।

শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথের পরেই প্রধান ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠেছিলেন ক্ষিতিমোহন। জীবনের শেষ জন্মদিনে উদয়নের বারান্দায় বসে ‘সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধ পাঠের দায়িত্ব অসুস্থ রবীন্দ্রনাথ তুলে দেন ক্ষিতিমোহনের হাতে। জীবনের শেষ বছরগুলিতে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ যেমন উদ্বিগ্ন ছিলেন তেমনই শান্তিনিকেতনের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিও তাঁকে চিন্তায় রেখেছিল। মন্দিরের ভাষণে তিনি আশ্রমবাসীদের কাছে অনুরোধও জানিয়েছিলেন শান্তিনিকেতনকে বাঁচিয়ে রাখতে। তাঁর একান্ত আপনার জন দীনেন্দ্রনাথ ও বিধুশেখর শান্তিনিকেতন ছেড়েছিলেন চিরকালের জন্য। পরিস্থিতি ঘোরালো দেখে ক্ষিতিমোহনও কবির কাছে ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করলে রবীন্দ্রনাথ একটিই বাক্য উচ্চারণ করেছিলেন, “ক্ষিতিবাবু আপনিও আমায় ছেড়ে চলে যাবেন?”

জীবনে দ্বিতীয়বার আর ক্ষিতিমোহন সে চেষ্টা করেননি। কবিকে তিনি কথা দিয়েছিলেন, তাই জীবনের শেষ দিন অবধি তিনি শান্তিনিকেতনেই কাটিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথকে যে দিন চিকিৎসার জন্য শান্তিনিকেতন থেকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, সেই দিন কোনও প্রয়োজনে উদয়নের দোতলায় ক্ষিতিমোহনকে যেতে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করতে। ক্ষিতিমোহন লিখেছেন, ‘…কথা হয়ে গেল। বিদায় চাইলাম। কিন্তু তিনি দাঁড়াতে বললেন। আমার সর্বাঙ্গে তিনি হাত বোলাবার মত আশীর্বাদ-দৃষ্টি বুলিয়ে দিলেন। কি যেন তিনি বলতেও যাচ্ছিলেন…কি যেন তাঁর বলার ছিল বলতে পারলেন না। হয়তো কোনো দুঃখেরই কথা। তাই বড় দুঃখে তিনি একবার পিছনে ফিরে তাকালেন, তাঁর সেই কাতর দৃষ্টি কখনও ভুলব না’।

রবীন্দ্রনাথের সেই বেদনাভরা দৃষ্টি ক্ষিতিমোহন কখনও ভোলেননি। রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে ক্ষিতিমোহনকেই সকলে মেনে নিয়েছিলেন ‘আশ্রম গুরু’ হিসেবে। কিছু দিনের জন্য তিনি বিশ্বভারতীর উপাচার্যও হন। তাঁকে শান্তিনিকেতনের কুলস্থবির বলা হয়।

১৯৬০ সালের ১২ মার্চ আশি বছর বয়সে পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেনশাস্ত্রী আমাদের ছেড়ে চলে যান।

অন্য বিষয়গুলি:

Personality Rabindranath Tagore
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy