Advertisement
E-Paper

সীমিত পরিসরে বিস্তারের আস্বাদ

দেবভাষা প্রদর্শশালায় সম্প্রতি আয়োজিত শিল্পী প্রশান্ত রায়ের প্রদর্শনী তেমনই কিছু ডাকবিভাগের পোস্টকার্ডে, চিঠির সঙ্গে আঁকা ক্ষুদ্রাকারের ছবি দিয়ে আয়োজিত।

সোহিনী ধর

শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৯:০৪
Share
Save

আজ থেকে বেশ কয়েক দশক আগের কথা। তখনও প্রযুক্তির ভারে বিশ্ব সমাহিত হয়নি। কথোপকথনের মাধ্যম হিসেবে জন্ম নেয়নি ইমেল, এসএমএস অথবা হোয়াটসঅ্যাপ। দ্রুত আদানপ্রদানের ব্যস্ততায় তখনও মানুষ ব্যাকুল হয়নি। এমনই এক সময়ে শান্তিনিকেতনের শিল্পশিক্ষায় বহুবিধ মাধ্যম ও আঙ্গিকের মধ্যে এক অভিনব ধারা জন্ম নেয়। কলাভবনের তদানীন্তন অধ্যক্ষ নন্দলাল বসুর হাত ধরে, পোস্টকার্ডে ছোট ছোট ছবি এঁকে পত্রালাপের এক চমৎকার ভাবনা। কোনও বাধ্যতামূলক পাঠ্যক্রম অনুসরণে এই ধারা গড়ে ওঠেনি। বরঞ্চ সহপাঠী, বন্ধুবান্ধব ও গুরুজনদের সঙ্গে অত্যন্ত নান্দনিক ও সুচারু যোগাযোগের ভাষা হিসেবে দেখা দিয়েছিল পত্রালাপের এই ধারা।

দেবভাষা প্রদর্শশালায় সম্প্রতি আয়োজিত শিল্পী প্রশান্ত রায়ের প্রদর্শনী তেমনই কিছু ডাকবিভাগের পোস্টকার্ডে, চিঠির সঙ্গে আঁকা ক্ষুদ্রাকারের ছবি দিয়ে আয়োজিত। শিল্পী প্রশান্ত রায় (১৯০৮-১৯৭৩) ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সময়ে শান্তিনিকেতনের একজন একনিষ্ঠ ছাত্র ও পরে কর্মী। প্রাথমিক জীবনে রবীন্দ্রনাথের ছত্রছায়ায় পাঠভবনের পাঠ শেষে, জোড়াসাঁকোতে অবনীন্দ্রনাথ ও গগনেন্দ্রনাথের কাছে তাঁর শিল্পের হাতেখড়ি। ফলত, তথাকথিত নব্যবঙ্গীয় শিল্পশৈলীতে তাঁর দক্ষতা অচিরেই তাঁর গুরুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চিনা ও জাপানি শৈলী দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ওয়াশ, জলরং ও কালি-তুলির মাধ্যমে তাঁর নিসর্গচিত্র এক বিশেষ মাত্রা অর্জন করে। তার সঙ্গে গগনেন্দ্রনাথের কিউবিক স্পেস বিভাজন ও ক্যালাইডোস্কোপ রঙের খেলা তাঁকে বিশেষ ভাবে প্রভাবিত করে। কিন্তু দুইয়ের সমন্বয়ে তিনি তাঁর এক নিজস্ব শৈল্পিক ভাষা গড়ে তুলেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি কলাভবনের মিউজ়িয়াম কিউরেটর হিসেবে কর্মরত থেকে, তাঁর চিত্রচর্চা অব্যাহত রাখেন।

এই প্রদর্শনীতে সে রকমই অল্প কয়েকটি কাজ আমরা দেখতে পাই। কাজগুলির সময়কাল মোটামুটি ভাবে ১৯২৯ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত। পোস্টকার্ডে আঁকা এই কাজগুলিতে দেখা যায় কয়েক ছত্র করে আদানপ্রদানের সংক্ষিপ্ত অক্ষরমালা। এই চিঠিগুলির ঐতিহাসিক তাৎপর্য প্রভূত। কারণ প্রাপকদের মধ্যে আছেন তাঁর গুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এ ছাড়াও ঠাকুর পরিবারের আরও কিছু সদস্য যেমন অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর, সুজনেন্দ্রনাথ ঠাকুর, ব্রতীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে লেখা জন্মদিন অথবা বিজয়া দশমীর কিছু চিঠি বিশেষ ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। চিঠিগুলিতে উল্লেখ্য ডাকটিকিট ও ডাকঘরের তারিখের সিলমোহর, যা নাকি এর মান্যতা প্রমাণ করে।

পোস্টকার্ডগুলিতে মূলত সামনের বড় পরিসরের মধ্যেই ছবিগুলি আঁকা হয়েছে এবং পিছনের ঠিকানার দিকের সীমিত অংশে চিঠি লেখা। গুরু অবনীন্দ্রনাথকে লেখা তেমনই এক পোস্টকার্ডে সুদৃশ্য পর্বতমালার মাঝে সুললিত নদীর ধারা যেন এক আদিগন্ত ব্যাপ্তির চমৎকার দৃশ্যপট তৈরি করেছে। এ ছাড়া কোনও চিঠিতে শান্তিনিকেতনের মন্দির তো কখনও আদিগন্ত প্রকৃতি, কখনও তুষারাবৃত হিমালয় শৃঙ্গের সামনে প্রায় সিল্যুটে পাইন গাছের বন, অথবা জাপানি আঙ্গিকে পূর্ণিমা রাতে এক ধাবমান শৃগালের ছবি, কিংবা কালো-সাদা তুলির রেখায় মাছেদের ছবি দর্শককে এক অসাধারণ পরিবেশ ও সময়ের সঙ্গে যুক্ত করে। এ যেন আজকের দুনিয়ার সংক্ষিপ্ত ইমোজি, এসএমএস-এর পূর্ব যুগ— সংক্ষিপ্তের মধ্যে বিস্তারের অঙ্কুর যেখানে প্রোথিত।

এই কাজগুলিতে শিল্পীর সূক্ষ্ম পর্যবেক্ষণ, পরিবেশের নিজস্ব আমেজ ও কালি-তুলির সুচারু ব্যবহারের এক উৎকৃষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। এ ছাড়া দূরপ্রাচ্যের ধারায় নিজের নামে সিলমোহর, যা তাঁর গুরু অবনীন্দ্রনাথ দ্বারা সূচিত হয়েছিল, সেই রকম নান্দনিক সিলের ব্যবহারও কোনও কোনও ছবিতে লক্ষণীয়। ফলত কাজগুলি অণুচিত্রের পর্যায়ে পড়লেও, পরিবেশ উপস্থাপন ও ভৌগোলিক নথিকরণের গুণে এক বিরল স্তর অর্জন করে।

আজ ডিজিটাল পৃথিবীর চূড়ান্ত অস্থির জীবনযাত্রার মাঝে ছবি ও হাতে লেখা মুক্তাক্ষরে এ জাতীয় চিঠি পাওয়া এক অতীব দুর্লভ উপহারস্বরূপ। তাই শিল্পী প্রশান্ত রায়ের এই অনন্য প্রদর্শনী দর্শকদের কাছে সে কালের সঙ্গে এ কালের মধ্যে এক সেতুবন্ধনস্বরূপ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Art exhibition

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}