সমসময়ও বুঝেছিল, তিনি গড়পড়তা নন। কিন্তু কয়েক জন ছাড়া নীরব ছিল তথাকথিত সংস্কৃতি-পরিমণ্ডল। সে প্রবণতা ফর্মুলা-ফেনিল, প্রচার-পারদ সন্ধানী দীনতারই দান। এর বিপ্রতীপ অবস্থানের কারণেই প্রাপ্যটি পাননি ছকভাঙা দখিনা বাতাস অরুন্ধতী দেবী। আরও কারণ ছিল, সম্ভবত প্রধান কারণ— তিনি মেয়ে এবং ব্যক্তিত্বময়ী।
ব্যক্তিত্বে অন্তর্লীন চিন্তাশক্তির আভিজাত্য তাঁকে প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি করেছে, ব্যতিক্রমীও করেছে। পর্দায় অরুন্ধতীর সৌন্দর্য আকর্ষণের আগে সমীহ আদায় করে। তাঁর পরিচালিত প্রথম ছবিতেই মেলে নরম অনুভূতির আস্তর। স্বকণ্ঠের গানে মুদ্রিত থাকে বিস্ময়কর শ্রুতিশান্তি।
সুশিক্ষিত, সুন্দরী, রবীন্দ্রসান্নিধ্যপ্রাপ্ত— শুধু এগুলিই ব্যক্তিত্ব-বিভার কারণ? মনে হয় না। কারণ, কবির অগণন স্নেহধন্যের ভিড়ে তিনি হারিয়ে যাননি। তাঁর বিষয়ে যে ঢের কিছু জানা যায়, এমনও নয়। কারণ, গড়পড়তা তারকার মতো তিনি শিরোনাম হতে চাননি। সোনায় সোহাগার মতো কাজ করেছিল প্রচারবিমুখ পরিচালক তপন সিংহের সঙ্গে তাঁর দাম্পত্যও। প্রশংসায় অনুচ্ছ্বাস, সমালোচনায় নিরুত্তর— রাজযোটক মিল অরুন্ধতী-তপনের। মিল অন্য সূত্রেও— রবীন্দ্রপ্রেম।
সব হতে আপন
অরুন্ধতী গুহঠাকুরতা। বরিশালে পৈতৃক বাড়ি। জন্ম ঢাকায়, ১৯২৪ সালে। অনেক ভাই-বোন। আইনজীবী বাবা বিভুচরণ যশস্বী ধর্মচিন্তায়। মন্দির-গির্জা-মসজিদ-ব্রাহ্মসমাজ— সর্বত্রগামী। প্রতিটি উপাসনা-রীতির সঙ্গে সঙ্গীত অবিচ্ছেদ্য হওয়ায় নানা প্রকরণের সুর অরুন্ধতীতে ছোট থেকেই সঞ্চারিত। সঙ্গীতের প্রথাগত পাঠেরও শুরু ছোটবেলায়। ছ’বছর বয়সে এলাকায় অভিনীত রবীন্দ্রনাথের ‘ডাকঘর’-এ অরুন্ধতী গেয়েছিলেন— ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’। তখনও জানতেন না, রাঙা মাটির পথই একদিন তাঁকে বৈদুর্যমাত্রা এনে দেবে।
পড়াশোনা ঢাকায় শুরু হলেও বাবার মৃত্যুর পরে অরুন্ধতীর কলকাতায় চলে আসা। ম্যাট্রিক কলকাতা থেকেই। পিসি লাবণ্যলতা চক্রবর্তী, পিসেমশাই অজিতকুমার চক্রবর্তী রবীন্দ্রস্নেহধন্য। তাঁদের সূত্রেই ১৯৪০ সালে শান্তিনিকেতনে আসা মা চারুপ্রভার সঙ্গে এবং শৈলজারঞ্জন মজুমদারের কাছে গান শেখার সুযোগ মেলার কালেই প্রথম রবীন্দ্রযোগ। নতুন কেউ আশ্রমে এলে রবীন্দ্রনাথ তার গান শোনেন। এক দুপুরে তাই শৈলজারঞ্জন জানতে চেয়েছিলেন, গুরুদেবের কী গান জানা আছে? বাল্যে ‘গ্রামছাড়া’ গাইলেও কিশোরী অরুন্ধতীর মনে পড়ল— ‘এ বার উজাড় করে লও’। শুনলেন শৈলজারঞ্জন, ঠিকঠাক করে দিলেন। তুলিয়ে দিলেন আর একটি— ‘আমার কী বেদনা সে কি জানো’।
সে দিনই সন্ধ্যায় নাট্যঘরে রবীন্দ্রনাথের সামনে অরুন্ধতী। শুরু হল গান শোনানোর পালা। ‘এ বার উজাড় করে’ গাইতে গাইতে অরুন্ধতীর খেয়াল হল— গলা মেলাচ্ছেন আর এক জনও— রবীন্দ্রনাথ। গানশেষে কবি জানতে চাইলেন, তাঁর আর কোনও গান জানা আছে? ‘আমার কী বেদনা’ শুনলেন। পরে আরও শোনার আবদার। বলা হল, তাঁর আর কোনও গান জানা নেই অরুন্ধতীর। দ্বিতীয়টি সে দিনই শৈলজারঞ্জন তুলিয়ে দিয়েছেন। বিস্ময় কবির চোখে, ‘আজই শেখা?’ তার পরেই প্রশ্ন, ‘আশ্রমে থাকবে তো?’ অরুন্ধতীর আত্মস্মৃতির বয়ানে মেলে কবি বলেছিলেন, ‘কত মেয়ে আসে। গান শেখে। কী সুন্দর গায়। তার পর একদিন পাখির মতো ফুরুৎ করে উড়ে চলে যায়! তুমি যেয়ো না!’
উড়ে যাওয়ার ভাবনা ছিলও না। কবিপ্রয়াণের পরেও শান্তিনিকেতনে ছিলেন বেশ কিছু বছর। মাঝে গান-পড়াশোনা সূত্রে কলকাতা-বোলপুর করলেও বিয়ের পরে, ১৯৪৬ সালে পাকাপাকি ভাবে কলকাতায় চলে আসতে হয়। আশ্রমের দিনগুলিতে সঙ্গীতভবন-কলাভবন অরুন্ধতীকে আকর্ষে বেঁধেছিল। শৈলজারঞ্জন, ইন্দিরা দেবীর কাছে গান শেখা। বালকৃষ্ণ মেনন, ব্রজবাসীর কাছে নাচের তালিম। কলাশিল্পের পাঠ নন্দলাল বসুর কাছে। গানের পরীক্ষায় নুকু (অরুন্ধতী) প্রথম, দ্বিতীয় মোহর (কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়)। স্নাতকস্তর অবধি এ ভাবেই। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে এমএ পড়া। কিছুকাল সাংবাদিকতার শিক্ষানবিশিও। আশ্রমের সবাই নিশ্চিত ছিলেন, নুকু গানে নাম করবেনই। রেডিয়োর ডাক এসেছিল ১৯৪০ সালে। আপত্তি ছিল মায়ের— গান বিক্রির বস্তু নয়। রেডিয়োয় গাওয়ার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন শৈলজারঞ্জন। বেশ কিছুকাল রেডিয়োয় রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেন অরুন্ধতী। সতীর্থ পেলেন হেমন্ত-কণিকাদের। নুকু নাম করলেন।
ক্যামেরার সামনে
প্রভাত মুখোপাধ্যায়, পরে যিনি নামী চলচ্চিত্র পরিচালক, তখন রেডিয়োয়। লোকজন দেখতেন, অপেক্ষা করছেন এক তরুণী, পরে সপ্রভাত বেরিয়ে যাচ্ছেন। তখনও অভিনয়ে আসেননি অরুন্ধতী। তখনও গান, তখনও প্রভাতী প্রেমপর্ব। যে প্রেম গড়াবে বিয়েতে, যে বিয়ে সময়ের নিরিখে দুঃসাহসিক।
বিয়ের মতো অরুন্ধতী ছবিতে কাজ করতেও এলেন পরিবারের অনেকের অমতে। লক্ষ্য— স্বনির্ভরতা। ভাবনা ছিল সিনেমার পারিশ্রমিকে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিক্সে পড়তে যাওয়া। তবে শুরুতেই বাধা। ১৯৫০ সালে ‘মালঞ্চ’ ছবির ‘নায়িকা চাই’ বিজ্ঞাপন দেখে যোগাযোগে লাভ হল না। তাঁর কণ্ঠস্বরকে ‘অতি-অভিজাত’ মনে হল ছবি-কর্তাদের। সুযোগ এল ১৯৫২ সালে। নির্বাচিত হলেন কার্তিক চট্টোপাধ্যায়ের দ্বিভাষিক ছবিতে— বাংলায় ‘মহাপ্রস্থানের পথে’, হিন্দিতে ‘যাত্রিক’। বাল্যবিধবা চরিত্র, নাম রানি। নিউ থিয়েটার্সের সে ছবির মুক্তিমাত্রে দেশজয়। জয়যাত্রার শুরু অরুন্ধতীর, পরে উত্তমকুমার যাঁর প্রসঙ্গে বলবেন, অরুন্ধতীর সঙ্গে কাজের সময় আলাদা করে সচেতন থাকতে হয়।
পর পর ছবি। ‘নদ ও নদী’, ‘ছেলে কার’, ‘গোধূলি’, ‘দু’জনে’, ‘দস্যু মোহন’ পেরিয়ে দেবকীকুমার বসুর ‘নবজন্ম’, অসিত সেনের ‘চলাচল’, ‘পঞ্চতপা’। ‘মানময়ী গালর্স স্কুল’, ‘শশীবাবুর সংসার’-এ অন্য ধারার অভিনয়ে চমক। আগে-পরে আরও কিছু। তবে প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের ‘বিচারক’ ইতিহাস গড়ল উত্তম-অরুন্ধতী রসায়নে। অরুন্ধতীর বিচ্ছুরণ অব্যাহত রইল তপন সিংহের ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘ঝিন্দের বন্দী’তে। পীযূষ বসুর ‘শিউলিবাড়ি’তে আবারও উত্তম-অরুন্ধতীর দাপুটে যুগলবন্দি। বিজয় বসুর ‘ভগিনী নিবেদিতা’য় মিলল বহুস্তর সম্মাননা। এর পরে ১৯৬৪ সালে তপন সিংহের ‘জতুগৃহ’ আর ১২ বছর পরে ১৯৭৬ সালে ফের তাঁরই ‘হারমোনিয়াম’ ছবিতে অরুন্ধতী।
‘জতুগৃহ’ থেকে ‘হারমোনিয়াম’— মধ্যে ১২ বছর কেন, উত্তর অজানা।
ক্যামেরার পিছনে
শোনা যায়, প্রভাত মুখোপাধ্যায় বিবাহিত এবং বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি জেনেও তাঁকে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেন অরুন্ধতী। বেশ কিছু দিন একসঙ্গে কাজ, সন্তানজন্ম। যদিও সে সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে কিশোরী মেয়ে আর শিশুপুত্রকে নিয়ে সংসার ছাড়া। ক্রমে নিজের বাড়ি তৈরি, সিনেমায় ফেরা। অশান্ত এই পর্বের মধ্যেই তপন সিংহের সঙ্গে সখ্য এবং বিয়ে। এর পরে সংসার, অভিনয়, অঙ্কুরোদ্গম ছবি তৈরির বাসনারও।
অরুন্ধতী পরিচালিত ছবি চারটি— ‘ছুটি’, ‘মেঘ ও রৌদ্র’, ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’, ‘দীপার প্রেম’। রয়েছে টেলিছবি ‘গোকুল’। করেছেন ছবি প্রযোজনা, বানিয়েছেন প্রোডাকশন হাউস, লিখেছেন চিত্রনাট্য, সামলেছেন শিল্প নির্দেশনার দায়িত্ব। পরিচালিত ছবির মধ্যে ‘ছুটি’ আর ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’ তুমুল নন্দিত। ‘মেঘ ও রৌদ্র’ নিরীক্ষামূলক। শেষ ছবি ‘দীপার প্রেম’। অরুন্ধতীকে না জানিয়ে কাটছাঁটের অভিযোগে সে ছবির মুক্তি-বিতর্ক আদালত ঘুরে এসেছিল। আরও কিছু কাজের ইচ্ছে ছিল। চিত্রনাট্য তৈরি ছিল গৌরকিশোর ঘোষের ‘তলিয়ে যাওয়ার আগে’র। কাজ শুরু হয়েও থেমে যায় বনফুলের ‘মৃগয়া’র। স্বপ্ন ছিল মহাশ্বেতা দেবীর ‘হাজার চুরাশির মা’ নিয়ে ছবি করার। সুজাতা চরিত্রে ভেবেছিলেন সুচিত্রা সেনের কথা। সব থামিয়ে দিয়েছিল অসুস্থতা, ১৯৯০ সালে।

অরুন্ধতী দেবী।
স্মরণীয় ছবি
খুব বেশি ছবিতে অভিনয় করেননি অরুন্ধতী। পর্দা-তারকাদের তুলনায় নেহাতই কম। কিছু ছবি আজ আর মেলে না। কিছুর দশা-বেহাল। তবে ছোট পরিসরেও বিস্ময়কর বড় মাপের কাজ। সুচিত্রা সেনের মতো অবিসংবাদী নায়িকার কালে সহজ ছিল না আলাদা ভাবে চিহ্নিত হয়ে ওঠা। অরুন্ধতী পেরেছিলেন। তার বড় কারণ— গড় হতে না চাওয়া।
ছবি নির্বাচনে ত্রিশর্তকে ধ্রুব করেছিলেন অরুন্ধতী— সাহিত্য-নির্ভর ছবি, সূক্ষ্ম চিত্রনাট্য, তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মানানসই চরিত্র। ১৯৫৬ সালে অসিত সেনের ‘চলাচল’ বড় উদাহরণ। অরুন্ধতী তখন পরিচিত মুখ। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাহিনি নিয়ে ‘চলাচল’-এর চিত্রনাট্য লিখছেন স্টিল ফোটোগ্রাফার অসিত। অরুন্ধতী সরমা চরিত্রটি চেয়ে নিয়েছিলেন। চিকিৎসক সরমা বিবাহপূর্ব-বিবাহোত্তর দুই সম্পর্ককে প্রাপ্য সম্মান দিতে গিয়ে নিজে অকূল হয়। সে চরিত্রে অরুন্ধতীর কাজ অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছিল তাঁর অভিনয়-জীবন আর পরিচালক অসিতের অগ্রগমনকে।
চরিত্রের সঙ্গে একাত্মতার রসায়ন তাঁকে বার বার আলাদা করে তুলেছে। ১৯৫৯ সালে প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের ‘বিচারক’ যেমন। সরমা থেকে সুরমা। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি। প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের সেরা কাজ। তিন চরিত্রের টানাপড়েন। বিচারক জ্ঞানেন্দ্রনাথ (উত্তমকুমার), তার দ্বিতীয় স্ত্রী সুরমা (অরুন্ধতী) আর প্রথম স্ত্রী সুমতি (দীপ্তি রায়)। শুরুতে উত্তম-অরুন্ধতীকে প্রায়-প্রৌঢ়ত্বের ধীর-স্থিরতায় দেখা যায়। মেলে কুড়ি বছর আগের সময়ও— যখন জ্ঞানেন্দ্র মুন্সেফ আর সুরমা স্পেশাল জজের (পাহাড়ি সান্যাল) শিক্ষিত-শহুরে-উচ্ছ্বল মেয়ে। সুরমাকে পাওয়ার লোভেই প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর সুযোগ নেওয়া? অবিসংবাদী নিরাশ্রয় উত্তম। অতুলনীয় আশ্রয় অরুন্ধতী। ছবিতে প্রথম যে দিন জ্ঞানেন্দ্র সুরমাদের বাড়ি এল, সুরমা গাইছিল— ‘আমার মল্লিকাবনে’। চোখাচোখির পরে সাইকেল-সমেত পড়ে যাওয়ার উপক্রম জ্ঞানেন্দ্রর। পরের দৃশ্যেই যুবকের পরিচয় জানতে ‘তোমার কাছে এখন কে এসেছিল, বাপি’ বলে পাহাড়ি সান্যালকে করা অরুন্ধতীর ছদ্মপ্রশ্নের ভনিতাটি অমর। পরিচয় জানার পরে ভ্যাবাচ্যাকা যুবকের বিবরণ দিতে-দিতে ঝপ করে বসে পড়ার মুহূর্তটিও। অবিস্মরণীয় কুড়ি বছর পরের সুন্দর-মিতবাক সুরমাও— তারাশঙ্করের কলম থেকে উঠে আসা যেন— ‘সুরমা দেবীকে এখনও পরিণত বয়সের যুবতী বলে ভ্রম হয়’।
চরিত্রের সাহিত্যগুণ অটুট রাখারই পরিচয় রবীন্দ্রনাথের কাহিনি নিয়ে ১৯৬০ সালে তপন সিংহের ছবি ‘ক্ষুধিত পাষাণ’। ছবি বিশ্বাস, রাধামোহন ভট্টাচার্য, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের কিংবদন্তি কাজ। সমজ্যোতি অরুন্ধতীরও। প্রথম তিন জন আর সঙ্গীতই ছবির বাক-ধর্মের ভার নেয়। শেষের কিছু অংশ ছাড়া নীরবতাই সংলাপ অরুন্ধতীর। পরের বছর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাহিনি নিয়ে একই পরিচালকের ‘ঝিন্দের বন্দি’। সে ছবি তিন তুমুলের নান্দনিক প্রতিস্পর্ধা— ময়ূরবাহন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, গৌরীশঙ্কর-শঙ্কর উত্তমকুমার, কস্তুরীবাই অরুন্ধতী। সৌমিত্র ধারালো ছুরি। দ্বৈত উত্তম বিস্ময়। আলো-আঁধারি রূপকথা অরুন্ধতী। অবশ্য-স্মরণীয় ‘শিউলিবাড়ি’, ‘জতুগৃহ’ও। প্রথমটিতে অরুন্ধতী গ্রামীণ। দ্বিতীয়টিতে নগর-বয়ান। ১৯৬২ সালের ‘শিউলিবাড়ি’ সুবোধ ঘোষের ‘নাগলতা’ অবলম্বনে তৈরি। সেখানে দামোদর-সন্নিহিত একদা-পাণ্ডববর্জিত জায়গায় নিরাশ্রয়-অবহেলিতদের নিয়ে উপনিবেশ গড়ে তোলা মিট্টিসাব (উত্তমকুমার) একদিন খুঁজে পায় বাল্যবন্ধু নিরুপমাকে (অরুন্ধতী), সে তখন বিধবা। তাকে নিজের কাছে নিয়ে আসে মিট্টিসাব। কাহিনি শূন্য থেকে শুরুর। সেখানে অরুন্ধতীকে দেখে আন্দাজও অসম্ভব যে, তিনিই ‘বিচারক’-‘জতুগৃহ’ ছবির শহুরে-শিক্ষিত সুরমা-মাধুরী।
১৯৬৪ সালে সুবোধ ঘোষেরই কাহিনি নিয়ে তপন সিংহের ‘জতুগৃহ’ ছবিতে ফের নাক্ষত্রিক কাজ অরুন্ধতীর। শতদল উত্তমকুমার, মাধুরী অরুন্ধতী। স্বপ্ন বুনে বিয়ে, কিন্তু সম্পর্ক বিচ্ছেদলীন। অনেক পরে দু’জনের ফের দেখা রেলের প্রতীক্ষালয়ে। দু’জনের দু’দিকে গন্তব্য। ট্রেন আসার দেরি। সেই পরিসরে কিছু কথা, কিছু অভিব্যক্তি। ‘গেছে যে দিন, একেবারেই কি গেছে’— যেন তারই খোঁজ, মাধুর্যরেণু। বাঙালি শতদল যেমন উত্তম ছাড়া ভাবা যায় না, বাঙালি মাধুরীও শুধু অরুন্ধতী-সম্ভব। এ ছবিতে অরুন্ধতীর স্নায়ুরঞ্জন ব্যক্তিত্ব অভিব্যক্তি আর সংলাপকে শান্তিময় শূন্য পরিণামের পথিক করে তোলে।
অরুন্ধতী: আচ্ছা, মানুষের মনের কোনও ঠিকানা নেই না? (ক্যামেরার দিকে পিছন ফিরে) উত্তম: কেন বলছ এ কথা? অরুন্ধতী: (ক্যামেরার দিকে ফিরে) জানো, তোমার কাছে শেষ ক’টা দিন সত্যি বড় অসহ্যের হয়ে উঠেছিল। মুক্তি পাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিলাম। চলেও এলাম। (অল্প দূরত্বে গিয়ে) কিন্তু তার পর দেখলাম, আমি একা, একান্ত ভাবে একা। ওই যে ইংরিজিতে একটা কথা আছে না— ‘ইটস সো পেনফুল টু বি লোনলি ইন আ ক্রাউডেড সিটি’। জঙ্গলে হয়তো একা থাকা যায়। কিন্তু লক্ষ মানুষের মধ্যে একা, সে বড় কষ্টকর। উত্তম: আবার বিয়ে করলে না কেন? আইনত তো কোনও বাধা ছিল না। অরুন্ধতী: মনের বাধা ছিল। তোমাকে যা দিতে পারিনি, তা তো কাউকেই দিতে পারব না (এই ‘না’টা একটু টেনে বলা, যেন নিজের যুক্তিকে নিজেই সান্ত্বনা দেয় মাধুরী)। অরুন্ধতী: (এতক্ষণের গুমোট ভাব সরিয়ে, মৃদু হেসে) তুমিই-বা বিয়ে করলে না কেন? উত্তম: (লাজুক, মাথা হেঁট, মৃদু হেসে) কনে জুটল না! (মাধুরী হা-হা করে হেসে ওঠে)
প্রথম আলোর চরণধ্বনি
ছবি পরিচালনায় অরুন্ধতীর প্রথম চরণধ্বনি ‘ছুটি’। একই সঙ্গে, ১৯৬৭ সালে নির্মিত এই ছবি নারী-পরিচালিত বাংলা ছবির প্রথম আলোও। বিমল করের ‘খড়কুটো’ অবলম্বনে তৈরি ছবির দুই নবীন চরিত্র অমল (মৃণাল মুখোপাধ্যায়) আর ভ্রমর (নন্দিনী মালিয়া) একই ক্যানভাসে নববসন্তের দানের ডালি এবং অনপনেয় মৃত্যুগন্ধ। সে সময়ের বিহারের এক ছোট অঞ্চলে ছুটি কাটাতে এসে অমল ভ্রমর-গুঞ্জরিত। কিন্তু সে প্রেম কাকভোরেই অস্তাচলগামী ভ্রমরের অসুখে। ‘ছুটি’ বাঙালিকে ভিজিয়েছিল।
নিভৃত-কোমল অনুভূতির অকৃপণ রং-কোলাজ এই সাদা-কালো ছবি— সেখানে ভ্রমরের জ্বর আবিষ্কারের ছুতোয় অমলের তাকে ছোঁয়ার ছুতো, অমলের গন্ধ আছে বলে ভ্রমরের আবিষ্কার, দীপাবলির রাতে দু’জনে ‘এই লভিনু সঙ্গ তব’ গাওয়া আর পরের ভোরে উচ্চাবচ মাঠে প্রথম প্রেমের প্রসাদ পাওয়া ভ্রমরের মুক্তিনাচ।
নানা ভাবে পথিকৃৎ ‘ছুটি’। পরে একই আনন্দবিষাদ, বাঙালির ‘পশ্চিমের’ আবহে খ্রিস্ট্রীয়-ব্রাহ্ম উপাসনা-আমেজ, দেহাতি গানের প্রয়োগ বহু পরিচালকের ছবিতে পেয়েছি আমরা। ‘ছুটি’র হাত ধরেই জাতীয় স্তরে বাঙালি মহিলা চিত্র পরিচালকের স্বীকৃতি, সম্মাননা আর দিশারি হয়ে ওঠা।
গানের ভুবন
‘ছুটি’র সঙ্গীত পরিচালনা অরুন্ধতীরই। আঙুরবালার গলায় একদা-খ্যাত ‘আমার জীবন নদীর ওপারে’ আর ‘আমার হাত ধরে তুমি নিয়ে চলো সখা’ গানের ‘রিমেক’ এ ছবিতেই করিয়েছিলেন প্রতিমা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দিয়ে। ছবিতে ব্যবহার করা হয়েছে একাধিক গানের অংশ, মূলত রবীন্দ্রনাথের। নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতারের ব্যবহার এ ছবির সম্পদ। যদিও সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে এটা অরুন্ধতীর প্রথম কাজ নয়। ‘শিউলিবাড়ি’তে প্রথম সঙ্গীত পরিচালনা, যার শীর্ষলিপিতে ভেসে ওঠে ‘স্বরচিত সরোদ বাদ্য— আলি আকবর খান,’ যে ছবিতে সরোদ-শ্রীখোলের তুঙ্গ মূর্ছনা। নিজের বাকি ছবির সঙ্গীত পরিচালনাও তাঁরই। ‘মেঘ ও রৌদ্র’-এ প্রাপ্তি মান্না দে-র গলায় রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়’। এমনই নানা প্রাপ্তি ‘পদিপিসির বর্মিবাক্স’, ‘দীপার প্রেম’ ছবির সঙ্গীতেও।
কিন্তু তাঁর স্বকণ্ঠের গান? যা শুনে মুগ্ধ রবীন্দ্রনাথ? অনশনভঙ্গের সময় যে কণ্ঠে মহাত্মা গান্ধী শুনেছিলেন ‘আমায় ক্ষম হে ক্ষম’, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ’। পাওয়া যায় তাঁর গান, হাতে গোনাই। অরুন্ধতী রেকর্ড করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘তোমার খোলা হাওয়া’, ‘পথে যেতে ডেকেছিলে মোরে’, ‘আকাশতলে দলে দলে’, ‘আমার মনের মাঝে যে গান বাজে’, ‘ওগো আমার চির-অচেনা’। ছবিতে গান গেয়েছেন হাতে গোনা, যার মধ্যে রয়েছে ‘সুরের আগুন’ ছবিতে ‘তোমার সুর শুনায়ে’, এ টি কানন আর আরতি মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘আমি অন্ধকারে থাকি’ এবং ‘হারমোনিয়াম’ ছবিতে রজনীকান্তের ‘কেন বঞ্চিত হব চরণে’ ও তপন সিংহের কথা-সুরে ‘মন বলে আমি মনের কথা জানি না’।
অরুন্ধতীর গাওয়া যে সব গান আজও মেলে, তাতে গায়কির স্পষ্ট বিবর্তন ধরা পড়ে। শুরুর দিকে তাঁর কণ্ঠ-প্রয়োগ আশ্রমিক ধাঁচে, পরে যা ক্রমশ রাঙা আপন ব্যক্তিত্বের আঁচে।
শেষের কথা
সাফল্যের শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছেও পর্দার প্রতিফলক-তল থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখা। শাস্ত্রীয় গানের পাঠ নিলেও, হিমাংশু দত্তের কাছে নজরুল-অতুলপ্রসাদের গান শিখলেও, রবীন্দ্রগানে মাত করলেও পরে প্রকাশ্য গান বন্ধ রাখা। অরুন্ধতী সেই অবিশ্বাস্য নক্ষত্রের নাম, যিনি নিজের গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
অত বছর আগে এক নারীর সিদ্ধান্ত, নিরীক্ষা, আত্মসম্মাননা, প্রগতিশীলতাকে বাঁকা চোখেও দেখেছেন অনেকে। তাঁকে বন্ধু বলেও মনে করেছেন অনেকে। কারণ, কাজে তাঁকে পেলে লাবণ্যের পাশাপাশি মেধা-মস্তিষ্কটিও মিলত।
কাজের সংখ্যাগত ভারে নয়, তিনি স্মরণসম্পদ সূক্ষ্মতার ঐশ্বর্যগুণে। অ-সরলরৈখিক ব্যক্তিত্ব কিংবা সুচিত্রা-স্বাক্ষরিত যুগেও নীরবে ইতিহাস হয়ে ওঠার অর্জন-জাদু— তাঁর পরিচালক তিনি নিজেই।
তথ্যঋণ: পুরনো পত্রপত্রিকা, সন্ধ্যা সেনের ‘সুরের আগুন’, রবি বসুর ‘সাতরঙ’
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)