তিনি ছিলেন যৌবনের দূত। বাংলার ‘দামাল ছেলে’। অভিনয় করবেন বলে বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়েছিলেন। নিজের বেকারত্বকে পাত্তা না দিয়ে কলেজ পড়ুয়া প্রেমিকাকে বিয়ে করেছিলেন জেদের বশে। অনুমতির তোয়াক্কা না করে, তপন সিংহের মতো নামী পরিচালকের ঘরে ধাক্কা দিয়ে ঢুকে বলেছিলেন, “অভিনয় করতে চাই।” সুযোগ আসতেই ‘ছেনো’ হয়েও আপামর বাঙালির হৃদয় জয় করে নিয়েছিলেন। আসলে অভিনেতা হিসেবে তাঁর জায়গা হওয়া উচিত ছিল হলিউডের ক্লিন্ট ইস্টউড, লি ভন ক্লিফ বা ডেনজেল ওয়াশিংটনের মতো অভিনেতাদের পাশেই। কিন্তু কপালদোষে বাংলা সিনেমার প্রথম ‘আধুনিক নায়ক’কে সে দিন চিনতে পারেননি কেউ। উত্তম মোহে তখনও বিভোর বাংলার পরিচালক থেকে দর্শককুল। তবু হতাশা তাঁকে গ্রাস করতে পারেনি। মারণ রোগের সঙ্গে যুঝতে যুঝতে শেষ ছবি ‘আবার অরণ্যে’তে অভিনয়ের ডাক পেয়ে অবশ্যম্ভাবী মৃত্যুকে থমকে দিয়ে বলে উঠেছিলেন, “ফ্যান্টাস্টিক!”
শমিত ভঞ্জর জন্ম ২ জানুয়ারি ১৯৪৪, মেদিনীপুরের তমলুক শহরে। তাঁর বাবা প্রীতিময় ভঞ্জ ও মা শীলা। শমিতরা তিন ভাই— অমিত, সবিত, শমিত ও এক বোন কৃষ্ণা। তমলুকে জন্মালেও শমিতের স্কুলে যাওয়া শুরু হয়েছিল জামশেদপুরের লয়েলা স্কুলে। কারণ, তখন কর্মসূত্রে তাঁর বাবা জামশেদপুরেই থাকতেন। বোন কৃষ্ণার মতে, যে ‘ছেনো’ চরিত্রের জন্য তিনি জনপ্রিয় হয়েছিলেন, তার ইঙ্গিত নাকি ছিল ছেলেবেলায় তাঁর ডাকাবুকো স্বভাবের মধ্যেই। লয়েলা স্কুলে শমিতের সঙ্গে কৃষ্ণাও পড়তেন। এক বার ক্লাসের এক সহপাঠী কৃষ্ণাকে চড় মারে। সেই খবর কানে আসতে “বুবুদা এত রেগে গিয়েছিল যে ও করেছিল কী, একটা বালি ভর্তি চৌবাচ্চা ছিল আমাদের স্কুলে। সেখানে আমরা খেলতাম। বুবুদা ওই ছেলেটিকে ধরে এনে সেই বালির মধ্যে পুঁতে দিয়ে বালি চাপা দিয়ে দিয়েছিল। শিক্ষকরা এসে অবশ্য ছেলেটিকে উদ্ধার করেছিল। ওর বয়স তখন ছয়-সাত হবে।”
শমিত ভঞ্জর এই বেপরোয়া মনোভাব চিরকাল বজায় থেকেছে। কৃষ্ণা বলে চলেন, “পেয়ারা গাছ থেকে পড়ে গেল এক বার। মাথা ফেটে রক্ত বেরোচ্ছে। ওর পরোয়া নেই। কিছুটা মাটি খাবলে তুলে ফাটা জায়গাটায় ঘষে দিল। ব্যস, আবার খেলা শুরু। এই রকম ছিল।” ছাত্রজীবনে রাজনীতির সঙ্গে কোনও সম্পর্ক ছিল না, কিন্তু স্বভাবের মধ্যে একটা লড়াকু মেজাজ ছিল বরাবরই। কৃষ্ণার মনে পড়ে, “এক বার তমলুক থেকে আমাদের সবাইকে নিয়ে বুবুদা জামশেদপুরে আসছে। চলন্ত ট্রেনের দরজা ধরে দাঁড়িয়েছিল। মাথায় লাগল লাইনের একটা পোস্ট। মাথা ফেটে চৌচির, তবু গেট ধরে আছে। শেষে আর না পেরে সহযাত্রীদের বলেছিল, ‘আমায় একটু ধরুন, আমি পড়ে যাচ্ছি।’ তখন তাকে ট্রেনের অন্য যাত্রীরা ধরে কামরার ভেতর টেনে নেয়। পরের স্টেশনে ট্রেন থামলে ওকে নামিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।”
লয়েলা স্কুলের পর শমিত ভর্তি হন তমলুকের হ্যামিলটন হাই স্কুলে। লেখাপড়ার পাশাপাশি ভাইবোনেরা সকলেই গাইতে পারতেন। শমিত গান শিখেছিলেন নিজের চেষ্টায়। ছোট থেকে সুন্দর তবলা বাজাতেন। কেরামতুল্লার কাছে তালিম নিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে তিনি তাঁর তৃতীয় চলচ্চিত্রে আবির্ভূত হন একজন তবলাবাদক রূপেই, বলাই সেনের ‘সুরের আগুন’ ছবিতে ১৯৬৫ সালে। তাঁর প্রথম দু’টি ছবি ‘নিশাচর’ ও ‘বাদশা’য় তিনি ছিলেন ভিড়ের দৃশ্যে।
স্ত্রী রঞ্জা, মেয়ে রাখি ও বিদিশা এবং আর এক মেয়ে সহেলী
অভিনয় করার ঝোঁকটা ছিল ছোট থেকেই। আর সিনেমায় অভিনয় করার ইচ্ছেটা তাঁর পাড়া বা স্কুলের নাটকে অভিনয় করতে করতেই জন্ম নেয়। তাই স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে ঝাড়গ্রাম পলিটেকনিক কলেজে পড়ার সময়ই কলকাতায় আসার ইচ্ছেটা ক্রমশ প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। পলিটেকনিকে পড়া শেষ না করেই শমিত কলকাতায় চলে আসেন। তার পর পড়াশোনাই ছেড়ে দেন। শমিতের নিজের কথায়, “বাবার ইচ্ছে ছিল আমি এঞ্জিনিয়র হই। এই নিয়ে আমার আর বাবার মধ্যে প্রচণ্ড টানাপড়েন ছিল। শেষে বাবার সঙ্গে প্রায় ঝগড়া করেই তমলুক ছেড়ে চলে এলাম কলকাতায়। কলকাতায় এসে সবিতাব্রত দত্তর দল ‘রূপকার’-এ ঢুকে পড়লাম। ওদের বেশ কয়েকটা নাটকে আমি অভিনয়ও করেছিলাম। তার পর সিনেমা পাড়ায় ঘুরতে শুরু করলাম।”
সময়টা ১৯৬০-’৬১ সাল। কলকাতায় তখন শমিত গড়িয়ায় একজনের বাড়িতে ভাড়া থাকতে শুরু করেন। শমিতের কথায়, “নাটক করি আর স্টুডিয়োয় গিয়ে সকলকে ধরি কাজের জন্য। একদিন একটা ভিড়ের দৃশ্যে অভিনয়ের সুযোগ জুটল। ভূমেন রায়ের ‘নিশাচর’ ছবিতে। এই ছবিতে অন্য যারা ছিল ভিড়ের মধ্যে, তাদের থেকে আমাকে একটু বেশি খাতির করা হল। সকলের যা লাঞ্চ ছিল, আমাকে তার চেয়ে বেশি দেওয়া হল। একটা দানাদার আর একটা লাড্ডু, সঙ্গে পাঁচ টাকা। কারণটা হল, আমি একটা স্যুট পরেছিলাম। সেটা ছিল আমার নিজস্ব।” এর পর বিভূতি লাহার ‘বাদশা’ ছবিতে আবার একটি ভিড়ের দৃশ্যে হাজির হওয়ার সুযোগ পান শমিত। কিন্তু সিনেমায় অভিনয় বলতে যা বোঝায়, তা কিছুতেই হয়ে উঠছিল না। একদিন মরিয়া হয়ে তপন সিংহের অফিসে ঢুকতে চেষ্টা করলেন তিনি। কিন্তু তাঁর সহকারী বলাই সেন তাঁকে ভাগিয়ে দিলেন। কিন্তু সহজে হাল ছাড়ার পাত্র ছিলেন না শমিত। একদিন সুযোগ বুঝে টেকনিশিয়ান্স স্টুডিয়োয় তপনবাবুর ঘরে জোর করে ঢুকে পড়েছিলেন। সটান তপন সিংহর সামনে গিয়ে হাজির হয়ে বলে বসলেন, “কাজ করব, কাজ দিন।” ভদ্র অমায়িক তপনবাবু বলেছিলেন, “এখন তো ছবি আরম্ভ হয়ে গেছে। পরে যোগাযোগ কোরো।”
তপন সিংহ তাঁকে হতাশ করেননি। শমিতকে ‘হাটে বাজারে’ ছবিতে একজন মোটর মেকানিকের চরিত্রে নির্বাচন করেছিলেন। ভিড়ে দাঁড়িয়ে আর কেবল তবলা বাজিয়ে চলচ্চিত্রের অভিনয়ের কিছুই তখনও শেখা হয়নি শমিতের। কিন্তু এই ছবিতে অশোককুমার ও বৈজয়ন্তীমালার মতো তারকার সঙ্গে যে সাবলীল অভিনয় তিনি করেছিলেন, তা দেখলে অবাক হতে হয়! এই ছবি করতে এসেই আলাপ হয় ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। কলকাতায় শমিতের চালচুলোহীন অবস্থার কথা জেনে তিনি নিজের বাড়ির মেজেনাইন ফ্লোরের একটি ঘরে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করে দেন। কৃতজ্ঞ শমিতের মুখে প্রায়ই শোনা যেত, “ভানুদা না থাকলে হয়তো আমি হারিয়েই যেতাম।”
এই পর্বেই কলকাতা ও তমলুক যাতায়াতের সময়ে রঞ্জার সঙ্গে বন্ধুত্ব গভীর হয় শমিতের। রঞ্জা তখন তমলুক কলেজের ছাত্রী। থাকেন এমন একটি মেয়েদের হস্টেলে যেখানে পুরুষদের প্রবেশাধিকার একেবারেই নিষিদ্ধ। ফলে যে দিন লোকাল গার্জেনের বাড়ি যাওয়ার সুযোগ ঘটত, সেই দিনগুলোতেই কেবল দু’জনের দেখা হত। কলেজে পড়তে পড়তেই রঞ্জার সঙ্গে শমিতের বিয়েটা হয়ে যায়। বলা ভাল, শমিতের বাবা বাধ্য হয়েই সেই বিয়েতে মত দেন পরিস্থিতি সামাল দিতে। শমিতের জেদের কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিল দুই পরিবারই। বিয়ের সময় শমিত বেকার ও রঞ্জা কলেজছাত্রী। রঞ্জার কথায়, “সে এমন অবস্থা হয়েছিল যে, আমি কিছুই বলতে পারলাম না। বাবা আমার নীরবতা দেখে ভাবলেন, বুঝি আমারও মত আছে। আসলে তা ছিল না। আমি লেখাপড়া চালিয়ে যাব বলে মনস্থির করেছিলাম। তবে আমার শ্বশুরমশাই কথা দিয়েছিলেন, বিয়ের পর আমার লেখাপড়ায় ব্যাঘাত ঘটবে না। আমি যখন পার্ট ওয়ান পরীক্ষা দিই তার পনেরো দিন পর আমাদের প্রথম কন্যার জন্ম হয়। শ্বশুরমশাই পরীক্ষার হলে আমার জন্য সোফায় বসে পরীক্ষার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পরবর্তী কালে ওঁর জন্যই আমি কলকাতায় এসে মুরলীধর কলেজে ভর্তি হই। ওখান থেকেই আমি পার্ট টু পরীক্ষা দিই। তার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হই। যদিও সেটা শেষ করতে পারিনি।”
পরিচালক দীনেন গুপ্তর সঙ্গে
সে ছিল এক অন্য রকম দাম্পত্য। গড়িয়ার ভাড়াবাড়ি থেকে রঞ্জা মুরলীধর কলেজে পড়তে যেতেন আর শমিত চলে যেতেন টালিগঞ্জের স্টুডিয়ো পাড়ায় কাজের খোঁজে। ছয়-সাত বছর তিনি এ ভাবেই চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। একদিন ঘুরতে ঘুরতে টালিগঞ্জ পাড়ায় দেখা হয়ে যায় সাংবাদিক রবি বসুর সঙ্গে। যিনি নিজেও তমলুকের বাসিন্দা। তিনিই খবরটা দেন, “তুই এখানে কী করছিস? তোর তমলুকের বাড়িতে তো বলাই সেন ‘কেদার রাজা’র শুটিং করছে।” শমিত অবাক! যে সিনেমায় অভিনয় করার জন্য তিনি কলকাতায় মাটি কামড়ে পড়ে আছেন, যার জন্য বাবার সঙ্গে ঝগড়া করে বাড়ি ছেড়েছেন, যাঁর সিনেমায় অভিনয় করার জন্য হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছেন, সেই তিনিই নিজের সিনেমা নিয়ে হাজির তাঁরই পৈতৃক ভিটেয়? শমিত দৌড়লেন তমলুকে।
শুটিং চলছে। হাজির স্বয়ং তপন সিংহ। শমিতকে দেখে তপনবাবু বললেন, “তুমি এখানে কী করতে এসেছ?” এর মধ্যে ওঁর সঙ্গে ‘হাটে বাজারে’ ছবিতে শমিতের কাজ করা হয়ে গিয়েছে। বলাই সেনও পাশে দাঁড়িয়ে। তিনি অবাক। শমিতের উত্তর ছিল, “আপনি যে ঘরে বসে আছেন, সেটা আমার শোওয়ার ঘর।” ওঁরা শুনে চমকে উঠলেন। ফলে ‘কেদার রাজা’য় শমিতের জন্য পুলিশ ইনস্পেক্টরের চরিত্র না দিয়ে আর উপায় ছিল না। কিন্তু চরিত্র ছোট হলেও তপনবাবুর ইউনিটের সঙ্গে এই সখ্য শমিতের ভবিষ্যৎকে এগিয়ে দিয়েছিল। তপন সিংহ লিখেছেন, “ছটফটে, সুন্দর চেহারার ছেলেটিকে দেখেই ভালো লেগেছিল। জানতে পারলাম, সে রীতিমতো নাট্যচর্চা করে। ‘আপনজন’ ছবির জন্য শমিত আর স্বরূপকে বেছে নিলাম মুখ্য দুই চরিত্রের জন্য।”
‘রবি’ ও ‘ছেনো’ এই দুই চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে শমিত ভঞ্জ ও স্বরূপ দত্তর মধ্যে এমন গাঢ় বন্ধুত্ব হয়েছিল, যা ওঁর জীবনের শেষ দিন অবধি বজায় ছিল। স্বরূপ জানালেন, “বেশ মনে আছে, ‘হাটে বাজারে’ ছবির প্রিমিয়ার শোয়ের পর তপন সিংহর সঙ্গে ভারতী সিনেমা হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় অতি সুপুরুষ, লম্বা একটি ছেলে ও তাঁর স্ত্রী আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন। তপনদাকে প্রণাম করলেন দু’জনে। তপনদা আলাপ করিয়ে দিলেন, ‘স্বরূপ, এই হচ্ছে ‘আপনজন’-এর ছেনো, তোমার প্রতিপক্ষ’।”
‘ছেনো’ শমিতের অভিনয়ের গুণে বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একটি আইকনিক চরিত্র হিসেবে অমর হয়ে আছে। ‘আপনজন: মিনার, বিজলী, ছবিঘর ও রাধা সিনেমায় মুক্তি পায় ৬ ডিসেম্বর ১৯৬৮ সালে। যদিও এই ছবির জনপ্রিয়তা তাঁর ভাগ্যকে বদলে দিতে পারেনি বলে ধারণা ছিল শমিতের। “প্রচুর স্ট্রাগল করতে হয়েছে আমাকে ‘আপনজন’ করার পরও। কাজ পাচ্ছিলাম না। পরিচালকরা ‘আপনজন’-এ আমার কাজের খুব প্রশংসা করতেন। কিন্তু তাঁদের ছবিতে আমায় কাজ দেবার ব্যাপারে চুপ করে থাকতেন। ছবিটা এতই জনপ্রিয় হয়েছিল যে আমি যেখানেই যেতাম পাবলিক আমায় ঘিরে ধরত। অথচ আমার তখন কোনও কাজ নেই, খাবার পয়সা নেই। বেশি সমস্যা হয়েছিল যে, আমি আর বাসে ট্রামে ঘুরে বেড়াতে পারতাম না। দেখলেই পাবলিক ছুটে আসত। আমাকে তখন বাধ্য হয়ে ট্যাক্সি চড়তে হত, অথচ সেটা আমার কাছে খুবই খরচসাপেক্ষ ছিল।” এই সময়ের শমিতের জীবনের ছবি ফুটে ওঠে ‘আপনজন’-এর আর এক অভিনেত্রী রোমি চৌধুরীর স্মৃতিতে, “প্রায় দিনই শুটিং না থাকলে বুবুদা আমাদের বাড়িতে চলে আসত। কারণ, আমার মায়ের রান্নার আকর্ষণ কাটানো কঠিন ছিল। তখন গড়িয়ার ভিতরে কোথাও ভাড়া থাকত ওরা কয়েক জন। ভাড়া বাকি পড়ত নিয়মিত।”
একটি অনুষ্ঠানে ছায়াদেবীর পাশে
দীনেন গুপ্তর কন্যা সোনালির (বসু) মনে আছে, “যখন উনি ‘আপনজন’-এর পর আমাদের বাড়িতে আসতেন, রাত অবধি লোক দাঁড়িয়ে থাকত ওঁকে দেখার জন্য। কখন উনি আমাদের বাড়ি থেকে বেরোবেন! বাবার প্রথম ছবি ‘নতুন পাতা’র নায়ক ছিলেন শমিতকাকু। পরপর আমাদের অনেক ছবিতে কাজ করেছেন। আমাকে ‘মা গো’ বলে ডাকতেন। বড় হয়ে যখন ‘সানাই’ করছি, সে ছবির নায়কও ছিলেন উনি। আমাদের সঙ্গে একটা পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।’’
শচীন অধিকারীর ‘শপথ নিলাম’ ছবিতে বিপ্লবী শহিদ দীনেশ মজুমদারের চরিত্রে অভিনয় করার পরই শমিতের অবস্থার বদল ঘটতে শুরু করেছিল। এই ছবিতে শুটিং করার সময়ই একদিন তাঁকে রবি ঘোষ খবর দিয়েছিলেন, “মানিকদা তোকে খুঁজছেন”। সত্যজিতের সঙ্গে শমিতের পরিচয় ছিল না। কোথায় থাকেন তাও জানতেন না। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় শমিতকে সত্যজিতের লেক টেম্পল রোডের বাড়িতে পৌঁছে দিয়েছিলেন। এর পরই বাংলা সিনেমায় আরও একটি অনবদ্য চরিত্র ‘হরি’র জন্ম হয়েছিল। শমিত ভঞ্জ ‘আপনজন’-এর পর তাঁর অভিনয় জীবনের আরও এক মাইল ফলক ছুঁয়ে ফেলেছিলেন। শমিতের নিজের কথায়, “যে মুহূর্তে খবর ছড়াল সত্যজিৎ রায় আমাকে নিয়েছেন, অমনি যেন টালিগঞ্জের লোকেরা নড়েচড়ে বসল।”
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’তে কাজ করার স্মৃতি শমিতকে জড়িয়ে রেখেছিল আজীবন। ছবিতে কাজ করতে গিয়ে আনন্দ যেমন হয়েছিল, তেমনই বিপাকেও পড়তে হয়েছিল তাঁকে। যতই বেপরোয়া হন না কেন, সিমির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয় করবেন কী ভাবে, বুঝে উঠতে পারছিলেন না। রবি ঘোষ সাবধান করে দিয়েছিলেন, “নিজে থেকে কিছু করতে যাবি না। মানিকদা কী করে দেখবি। তার পর করবি।” ‘সঞ্জয়’ শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় মুচকি হেসেছিলেন। ‘অসীম’ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সেরা মুহূর্তটির জন্য মতামত মুলতুবি রাখেন। শমিতের কথায়, “পরদিন মানিকদাকে বললাম, চিত্রনাট্যটা একটু পড়ে দেখবেন, কী ভাবে করব? উনি দেখিয়ে দিলেন কী করতে হবে। সিমির সঙ্গে শুটিং হচ্ছে। সৌমিত্রদা, রবিদা, শুভেন্দুদা সকলেই দেখছেন। শেষ হল। সৌমিত্রদা জিজ্ঞেস করলেন মানিকদাকে, ‘কী রকম করল বুবু?’ মানিকদা বললেন, ‘ছেলে খুব চালু। যা দেখিয়েছি তার চেয়ে বেশি করেছে।”
‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭০ সালে। সেই বছর অজিত গঙ্গোপাধ্যায় পরিচালিত ‘রূপসী’ও মুক্তি পায়। ১৯৭১-এ শমিতের মুক্তি পাওয়া ছবির সংখ্যা চার। যার মধ্যে ‘জননী’, ‘আটাত্তর দিন পরে’, দীনেন গুপ্তর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ যেমন রয়েছে, তেমনই আছে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের হিন্দি ছবি ‘গুড্ডি’। এই ‘গুড্ডি’ দিয়েই শমিতের হিন্দি সিনেমার জগতে প্রথম পা রাখা। এর পর আরও তিনটি হিন্দি ছবিতে তিনি কাজ করেন। ‘ওহি রাত ওহি আওয়াজ’, ‘অনজানে মেহমান’ ও ‘কিতনে পাস কিতনে দূর’।
ছেনোর ভূমিকায়
১৯৭২-এর পর থেকে ’৯৫ পর্যন্ত প্রতি বছরই শমিতের চার থেকে পাঁচটি করে ছবি মুক্তি পেতে থাকে। তার মধ্যে তপন সিংহের ‘হারমোনিয়াম’, ‘সবুজ দ্বীপের রাজা’, তরুণ মজুমদারের ‘ফুলেশ্বরী’, ‘গণদেবতা’, বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর ‘ফেরা’ যেমন রয়েছে, তেমনই আছে সাধারণ বাংলা বাণিজ্যিক ছবিও। একটি সাক্ষাৎকারে শমিত জানিয়েছেন, “ছবির অফার গন্ডায় গন্ডায় আসতে শুরু করে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’র পর। আর আমি কোনও ছবির প্রস্তাবই ফিরিয়ে দিইনি। আমি নায়ক, ভিলেন সব রকম চরিত্রেই তখন অভিনয় করে গেছি।”
‘আপনজন’-এর সাফল্যের পরপরই শমিতের গোটা পরিবার তমলুক ছেড়ে চলে এসেছিলেন কলকাতার ইন্দ্রাণী পার্কের বাড়িতে। সেই বাড়িতেই বাবা মা, বড় ভাই, স্ত্রী রঞ্জা, বড় মেয়ে রাখিকে (শাওনা) নিয়ে ভরা সংসার তখন শমিতের। সে বাড়িতে বারো মাসে তেরো পার্বণ লেগেই থাকত। আরও পরে শমিতরা চলে আসেন বালিগঞ্জ গার্ডেন্সের বাড়িতে। এই বাড়িতে আসার পর তাঁর মেজ মেয়ে বিদিশা (মউ) ও ছোট মেয়ে সহেলী (পিঙ্কি) জন্মায়। সেখানেও আনন্দ উৎসবে কোনও ভাটা পড়েনি। দোল উৎসব, কালীপুজো, গানের জলসা ঘিরে আনন্দ সকলের কাছে আজও সুখস্মৃতি হয়ে আছে। শমিত নিজে যেমন খেতে ভালবাসতেন, তেমনই খাওয়াতেও। বাস্তব জীবনে তিনিও ছিলেন একজন ‘ভজহরি মান্না’। শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় মনে করিয়ে দেন, “এই খাওয়া-দাওয়াই কাল হয়েছিল বুবু কাকুর জীবনে। ভাত খেয়ে খেয়ে চেহারাটা একেবারে নষ্ট করে ফেলেছিল।”
তিন মেয়ে ছিল শমিতের জীবনের সবচেয়ে মহার্ঘ। তাঁদের তিনি চোখে হারাতেন। স্ত্রী রঞ্জার উপর তাঁর বিরাট নির্ভরতা যেমন ছিল, তেমনই মেয়েদের জন্য ছিল কঠোর শাসন। মেয়েরাও তাঁকে খুব ভয় পেত। যদিও বড় হয়ে শমিত মেয়েদের বন্ধুর মতো হয়ে গিয়েছিলেন। বড় মেয়ে রাখি জানালেন, “বাবা খুব কনজারভেটিভ ছিলেন। আমাদের প্রচণ্ড শাসনের মধ্যে রাখতেন। কিন্তু কোনও দিন পড়াশোনা করে ভাল রেজাল্ট করতে হবে বলে চাপ দেননি। বরং রেজাল্ট খারাপ হলে বলতেন, ‘পরের বার দেখবি, ভাল হবে।’ আমার বন্ধুরা বাড়িতে এলে তাদের সঙ্গেও ক্যারম খেলায় মেতে যেতেন। উনি কিন্তু তখন খুবই নামী একজন অভিনেতা। কিন্তু বাড়িতে সেটা কাউকে বুঝতে দিতেন না। ভীষণ ফ্যামিলিম্যান ছিলেন। কাজ হয়ে গেলে বাড়ি ফিরে আসতেন। যত আড্ডা, সেটা হত বাড়িতেই। আমার বিয়ে নিয়ে বাবার সঙ্গে প্রথমটায় মতান্তর হয়েছিল। কিন্তু পরে জামাইকে ছেলের মতো ভালবেসেছিলেন।”
‘আবার অরণ্যে’ ছবিতে সৌমিত্র ও শুভেন্দুর সঙ্গে
মেজ মেয়ে বিদিশার মনে আছে, “স্কুল থেকে ফেরার সময় একদিন দেখি, রাস্তায় বাবার শুটিং চলছে। আমাকে দেখতে পেয়ে স্কুলবাস থেকে নামিয়ে নিয়েছিলেন। এমন করতেন যে, ‘না’ বলার উপায় থাকত না। শত ব্যস্ততার মধ্যেও মাঝেমাঝে আমাদের সকলকে নিয়ে বেড়াতে যেতেন। খেতে নিয়ে যেতেন। আমরা ছোটবেলা থেকে বাবাকে ‘বুবুদা’ আর মাকে ‘বউদি’ বলে ডাকতাম। আর ঠাকুমাকে বলতাম ‘মা’। বাইরের লোক শুনে মজা পেতেন। আমাদের তিন বোনেরই ভাল বিয়ে হওয়ায় শেষ জীবনে তিনি খুব নিশ্চিন্তবোধ করতেন।’’
শমিতের জীবনের শেষ ছবি ২০০৩ সালে মুক্তি পাওয়া ‘আবার অরণ্যে’। পরিচালক গৌতম ঘোষ। ইতিমধ্যে তিনি সিনেমার বাইরে ওয়ান-ওয়াল থিয়েটার ও যাত্রায় অভিনয় করেছেন। ১৯৯৫ সালে তাঁর মুক্তিপ্রাপ্ত দু’টি ছবির নাম যথাক্রমে ‘প্রতিধ্বনি’ ও ‘মোহিনী’। কিন্তু পরবর্তী বছরগুলিতে মুক্তি পাওয়া ছবির কোনও খবর নেই। একটি ছবি তিনি নিজেই পরিচালনা করছিলেন। সেটি হল ‘উলটো পালটা’। ছবিটি শেষ করা হয়নি। হয়তো এই সময় থেকেই তাঁর শরীর তেমন ভাল যাচ্ছিল না। ১৯৯৮-’৯৯ সাল নাগাদ তাঁর কোলন ক্যানসার ধরা পড়ে।
শমিত ভঞ্জের খুব ইচ্ছে ছিল বন্ধু গৌতম ঘোষের কোনও ছবিতে অভিনয় করার। গৌতম ঘোষেরও সেই একই ইচ্ছা ছিল। কিছুতেই সেটা আর হয়ে ওঠেনি। শমিতের জীবনের শেষ দিনগুলো যখন ঘনিয়ে আসছিল, তখনই গৌতম ‘আবার অরণ্যে’ ছবির পরিকল্পনা করছিলেন হয়তো কাকতালীয় ভাবেই। ছবিটি করতে গেলে ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ ছবির অভিনেতাদের ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছিল, শমিত আদৌ শুটিং করতে রাজি হবেন কি না? দেখা গেল, গৌতম যে দিন শমিতের বাড়ি গিয়ে ছবিতে অভিনয় করার প্রস্তাব দিলেন, মৃত্যুকে ‘দাঁড়াও’ বলে শমিত চিৎকার করে বলে উঠেছিলেন, “ফ্যান্টাস্টিক!” শমিতের ডাক্তার প্রশ্ন করেছিলেন, “আপনি কি শুটিং করতে যাবেনই?” শমিতের উত্তর ছিল, “অবশ্যই। এটাই হয়তো আমার শেষ অভিনয়।” অভিনেতা শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় ডাক্তার ছিলেন বলে গৌতমকে সাবধান করেছিলেন, “বুবু কিন্তু টারমিনাল পেশেন্ট। কিছু হয়ে গেলে তুমি ডুবে যাবে।’’ তবু গৌতম এগিয়েছিলেন।
গৌতমের কথায়, “আমি চেয়েছিলাম শুটিংয়ে একটা বেড়াতে যাওয়ার পরিবেশ গড়ে উঠুক। সবাই যেন বেড়াতে এসেছে। আনন্দে, আড্ডায় শুটিং হত। বুবুকে ঘিরে সবাই খুব মেতে উঠেছিল। টাবু তো সব সময় বুবুর খেয়াল রাখত। সারা শুটিংয়ে বুবু কাউকে বুঝতেই দেয়নি যে, ও কতটা অসুস্থ। বেশি যত্নআত্তি করলে আপত্তি করত। ওর মধ্যে যেন নতুন প্রাণের ছোঁয়া লেগেছিল।”
সত্যজিতের ছবিতে যে ‘হরি’কে আমরা দেখেছিলাম প্রাণবন্ত, দুর্বার— অরণ্যের পথে চলতে চলতে টারজানের মতো যিনি হুঙ্কার ছেড়েছিলেন, সেই ‘হরি’ গৌতমের ছবিতে এসে অরণ্যের পথে হাঁটতে-হাঁটতে বলছেন, “এখন আমার এক পা সংসারে আর এক পা শ্মশানে।” গৌতম জানালেন, “যে দিন আমরা শর্মিলা ও বুবুর সেই শটটা নিলাম, যেখানে বুবু কেঁদে বলছে, ‘সব থাকবে শুধু আমিই থাকব না’, শটটা শেষ হওয়ার পর ইউনিটের আমরা সবাই কেঁদেছিলাম।”
শেষ হওয়ার পর ছবির প্রথম প্রিন্ট শমিত দেখেছিলেন। খুব ইচ্ছে ছিল, মুক্তির পর একশো দিনের শোয়ে যাবেন দর্শকের সঙ্গে বসে ছবিটা দেখতে। তা আর হয়নি। বোন কৃষ্ণার কথায়, “চলে যাওয়ার আগে বিছানায় শুয়ে বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে নমস্কার করেছিল বুবুদা।” ২৪ জুলাই উত্তমকুমারের মৃত্যুদিন। ২০০৩ সালের একই দিনে আমাদের ছেড়ে চলে যান শমিত ভঞ্জ, যিনি বাংলা ছবির দ্বিতীয় উত্তম হয়ে উঠতে পারতেন।
ঋণস্বীকার: আনন্দবাজার আর্কাইভ, নীলাঞ্জনা ঘোষ, সুচেতা দত্ত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy