Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

মহীরুহ সুকুমার

তাঁর কাছে বাঙালি জাতির ঋণ অনেক। তিনি সুকুমার সেন। ব্যক্তি-সুকুমারের নানা অলিন্দের খোঁজে নাতি সুনন্দনকুমার সেন। সঙ্গী অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়তাঁর কাছে বাঙালি জাতির ঋণ অনেক। তিনি সুকুমার সেন। ব্যক্তি-সুকুমারের নানা অলিন্দের খোঁজে নাতি সুনন্দনকুমার সেন। সঙ্গী অর্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়

সুকুমার সেন।

সুকুমার সেন।

শেষ আপডেট: ১৪ অক্টোবর ২০১৭ ০০:৩৭
Share: Save:

ছেলে এসেছেন বাড়ি, বর্ধমানে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নিয়ে, শুক্রবার। ঘরে ঢুকেই, সামনে বাবা। তরুণ অধ্যাপক তাঁর লেখা সাধের বইটি বের করলেন, ‘হিস্ট্রি অফ ব্রজবুলি লিটারেচার’। দিলেন বাবাকে।

ছেলে প্রতীক্ষায়, বাবা কী বলেন। উল্টেপাল্টে বইটি দেখলেন ভদ্রলোক। ছেলেকে বইটি ফেরত দিয়ে বললেন, ‘চৈতন্যকে নিয়ে ব্যবসা কোরো না।’ না, উনি ব্যবসা করেননি, আত্মস্থ করেছিলেন। তাই বোধহয় শোনা যেত তাঁর সিদ্ধান্ত, ‘চৈতন্যদেব শ্রেষ্ঠ বাঙালি’। সে দিনের তরুণ অধ্যাপক, আমার দাদা (ঠাকুরদা) সুকুমার সেন। বইটি দিয়েছিলেন তাঁর বাবা হরেন্দ্রনাথ সেনকে। দাদার জন্ম ১৯০০ সালে। পূর্ব বর্ধমানের গোতান গ্রামে। মা, নবনলিনীদেবী। বাড়িতে পূজিতা হন অভয়াদুর্গা। গোতানের পারিবারিক সমৃদ্ধি ও পরে অনটনের মাঝে সংসারের নানা চরিত্র দাদাকে তৈরি করেছে নানা ভাবে।

দাদার বয়স তখন পাঁচ-ছ’বছর। দাদার দাদা অন্নদাপ্রসাদ সেনের কোমরে একটা ছোট্ট চাবি ঝোলানো। দাদার সঙ্গে খেলতে খেলতে সুকুমারের হাত গেল সেই চাবিতে। মুহূর্তে জিজ্ঞাসা, ‘এটা কী দাদা?’ অন্নদাপ্রসাদের জবাব, ‘ভুনে, (দাদার ডাকনাম) তুই তো ঠিক জিনিসটাই ধরেছিস। চাবিকাঠিটাই তো জীবনের আসল রে!’

দাদামশাই জাদু-চাবিটা পেয়েছিলেন। আর তা দিয়ে খুলেছিলেন ভাষাতত্ত্ব থেকে ভারত সংস্কৃতি, সব ক’টির সিন্দুক।

সেই জাদু-চাবির হদিশ তিনি পেয়েছিলেন তাঁর পরিবার ও গুরুকুলের কাছে। ‘গুরু’ প্রধানত তিন জন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, আইজেএস তারাপুরওয়ালা এবং বর্ধমানে স্কুলের শিক্ষক হেমেন্দ্রমোহন বসু।

‘স্যর’ সুনীতিবাবুর সঙ্গে দাদার বহু সুখ-দুখের স্মৃতি জড়িয়ে। এই সম্পর্কটা খোলা জানালার মতো। ছাত্রাবস্থায় এক বার পরীক্ষায় সুনীতিকুমারের দেওয়া প্রশ্নের ‘একটু ভুল’ ধরলেন দাদা। পরে ‘স্যর’ ছাত্রের সঙ্গে এক পণ্ডিতের পরিচয় করালেন, ‘এই যে ইনি আমার প্রশ্নে ভুল দেখিয়েছিলেন।’ পণ্ডিতটি মুহম্মদ শহীদুল্লাহ!

মগ্ন সুকুমার সেন, ছবি: দেবীপ্রসাদ সিংহ

গ্রাম, মফস্‌সলের ছেলে দাদার তখনও বোধহয় সিনেমাপ্রীতি ছিল না। একদিন কী কথা প্রসঙ্গে সুনীতিবাবুর জিজ্ঞাসা, ‘দ্য কিড দেখেছেন?’ দেখেননি দাদা। সুনীতিবাবু বললেন, ‘আপনার তো পড়াশোনার অর্ধেকটাই ব্যর্থ।’ শুনেই দাদা চললেন নিউ এম্পায়ারে, চার্লি চ্যাপলিনের সেই সিনেমা দেখতে।

ঘরোয়া কথায় একবার দাদাকে, তখন তিনি প্রবীণ, প্রিয় অভিনেত্রী কে, তা জানতে চাই। ‘মেরি পিকফোর্ডকে দেখে মাথা ঘুরে গিয়েছিল’, বললেন দাদা। আর উত্তমকুমার? ‘দেখেছি, নিশিপদ্ম।’ সিনেমা নিয়ে একটি দৃশ্যের কথা বড্ড মনে পড়ে। টেলিভিশনে সিনেমা হচ্ছে, তপন সিংহের ‘কাবুলিওয়ালা।’ চোখে তখন প্রায় কিছুই দেখেন না। সিনেমা শেষ। দেখি, কালো ফ্রেমে আঁট হয়ে বসা মোটা কাচের ওপার থেকে তখন জল গড়িয়ে পড়়ছে। অঝোরে।

সুকুমার সেন কাঁদছেন, বিশ্বাসই হয় না।

দাদা কাঁদতে পারতেন, কাঁদাতেও। এ প্রসঙ্গে একজন বন্ধুর কথা বলি। অনেক দিন আশি ছাড়িয়েছেন তিনি।

হঠাৎ একদিন ১০ রাজকৃষ্ণ স্ট্রিটে বিদ্যাসাগর ভবনের ৩২ নম্বর ফ্ল্যাটের দরজার ওপার থেকে ভেসে আসে ‘সুকুমার কেমন আছিস রে?’ দাদা, ‘ও যতি, আয় আয় আয়। তুই উঠতে পারলি সিঁড়িতে!’ আড্ডা শেষে ছেলেবেলার বন্ধু, যতীন চক্রবর্তী দাদার হাত ধরে বলছেন, ‘মন বলছে, এটাই তোর সঙ্গে আমার শেষ দেখা। যত কষ্টই হোক, দোতলার সিঁড়িটা ভাঙলাম।’ টপটপ করে জল গড়িয়ে পড়ল দুই সখার চোখ দিয়ে।

চোখ! এ নিয়ে দাদার সারা জীবনের সমস্যা। ভীষণ স্পর্শকাতরও। বাঁ চোখে পাওয়ার, মাইনাস ১৭। ডান চোখে প্রায় অন্ধত্ব। প্রবীণ বয়সে চোখের ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন। সঙ্গে আমিও রয়েছি, খুবই ছোট। ডাক্তার চোখ পরীক্ষা করছেন। পরে শুনেছি, উনি নাকি আমার হাতটা ধরে আছেন। হয়তো ভয়ে, কিছুর আশঙ্কায়। শিহরন জাগে, ওই হাতের স্পর্শ আমার হাতে। ওই হাত দিয়েই বেরিয়েছে ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’, ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’, ‘বুৎপত্তি সিদ্ধার্থ শব্দকোষ’-এর মতো মহাগ্রন্থ।

চোখ নিয়ে ভয় পেলেও, একটি বিষয়ে তিনি নির্ভীক, আত্মবিশ্বাসী, কখনও বা জেদিও। বিষয়টা সাহিত্য-ভাষা-সংস্কৃতি। সেই আত্মবিশ্বাসের ভিত্তি, অধীত বিদ্যা। কয়েকটা উদাহরণ, আত্মবিশ্বাসের। তাঁর সাহিত্যের ইতিহাসের ‘আনন্দ’ সংস্করণের কাজের অন্যতম সহায়ক শোভন বসু ও মহীদাস ভট্টাচার্য। তখন দেখেছি, চোখে দেখতে পান না। কিন্তু অবলীলায় বলে দিচ্ছেন, ঘরের কোথায় কোন র‌্যাকে কী বই রয়েছে।

সাহায্য করা ছিল তাঁর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আর তা করতে গিয়ে বহু বার অপ্রীতিকর পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে। একদিন যেমন, দাদার বলা কিছু একটা বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে পরবর্তী সময়ের কৃতী অধ্যাপক মহীদাসদা’র। ব্যস, দাদা গালমন্দ শুরু করলেন। এমনকী ছেলে সুভদ্রকুমারকে ডেকে বললেন, ‘দ্যাখ দ্যাখ, এই তোর ছাত্র!’ বাবা বিনীত ভাবে বললেন, ‘তোমার না পোষালে ওঁকে ছেড়ে দাও।’ সময় কাটে। এ বার দাদা মহীদাসদা’কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘যাবেন কোথায়?.. যেখানেই যান, খেয়ে যাবেন। আসলে, আপনাকে বকিনি। বকেছি এখনকার এই সময়টাকে। যেখানে লেখাপড়া শুধুই চাকরি পাওয়ার জন্য।’

বাড়ির লোকজনও এমন সঙ্কটে পড়েছেন দাদার কাছে। আমার দিদি, সুনৃতাবরী এবং মা কৃষ্ণা সেনের মাঝেসাঝেই ডাক আসে, মনিয়র উইলিয়মসের গাবদা সংস্কৃত অভিধান থেকে শব্দের অর্থ খোঁজার জন্য। তাতে বিলম্ব স্বাভাবিক। সঙ্গে সঙ্গে দাদার ভর্ৎসনা, ‘দেখতে পাচ্ছিস না? আমি দেখতে পাই না বলে এটুকু দেখে দিবি না! ওই তো ওখানে আছে।’ আবার কখনও বা লেখার সূত্র মাথায় এলে আবদার, ‘কৃষ্ণা, একটা পাতা লিখে দাও।’

একবার অবশ্য দাদামশাই উল্টে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। তাঁরই সুহৃদ ঐতিহাসিক প্রতুলচন্দ্র গুপ্তের সঙ্গে ফোনে কী নিয়ে যেন কথা কাটাকাটি হল। প্রতুলবাবুও রেগে গিয়েছেন, বললেন মানহানির মামলা ঠুকবেন। দাদা ভয় পেয়ে বাবাকে বললেন, ‘বাবাসাহেব, প্রতুলবাবু যদি কিছু করেন। কী হবে!’ কিছুই অবশ্য হয়নি, পরে আবার ভাব।

আসলে এই সব রাগ-মেজাজের কারণ, দাদা বিদ্যাচর্চায় কোনও রকম ‘ফাঁকি’ বরদাস্ত করতেন না। তাই যথেচ্ছ চলে শাণিত ভাষা ব্যবহারের সুকুমার-ট্রেডমার্ক।

ওঁর এক ছাত্রের লেখায় দেখি, দাদা ক্লাসে ঢুকেছেন। জিজ্ঞেস করলেন, ‘বলুন ‘চীন’ বিশেষণ কী হবে? গুরুগম্ভীর বিষয়ে?’ একজন আচমকা বললেন, ‘চৈনিক’ স্যর। রেগে গিয়ে চিৎকার করে বললেন, ‘চৈনিক কোথায় পেয়েছেন? বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ... কেউ তাঁদের গম্ভীর প্রকৃতির রচনায় লিখেছেন? গম্ভীর বিষয়ে হবে চীনীয়, হাসির ব্যাপারে চৈনিক।’

আবার এই দাদাই ছাত্রের কৃতিত্বকে স্বীকৃতিও দিয়েছেন।

চাকরির পরীক্ষা। ইন্টারভিউ বোর্ড। ছাত্র শুকদেব সিংহ চাকরিপ্রার্থী। কিন্তু তা বলে রেয়াত নেই। ধেয়ে আসে প্রশ্ন, নানা বিষয়ে। ৪৫ মিনিটের মাথায় দাদা জানালেন, তিনি ভট্টি-কাব্য থেকে একটি শ্লোক উচ্চারণ করবেন। তাতে দু’টি চরণে প্রায়-সমোচ্চারিত শব্দ রয়েছে। দু’টির বানান বলতে হবে। এবং তা পারলে আর প্রশ্ন করবেন না। শুকদেববাবু সেই বানান দু’টিই বলতে পেরেছিলেন। এর পর গোটা সময়পর্বে সত্যিই আর কোনও কথা বলেননি দাদা।

আবার দেখি, আর একজন ছাত্র তিনি তখনও এমএ পাশ করেননি। প্রকাশিত হচ্ছে দাদার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস। ছাত্র ‘রিভিয়ু’ লিখলেন। দাদা প্রকাশ্য সভায় অভিনন্দিত করলেন ছাত্রকে।

ছাত্রদের ‘আপনি’ সম্বোধন, একটি পরম্পরা। একবার কিছু ছাত্র বিনীত ভাবে এর কারণ জিজ্ঞেস করায় দাদা বলেন, ‘ও আমাদের সুনীতিবাবুর স্কুলের ব্যাপার, ও নিয়ে মাথা ঘামাবেন না।’

আসলে দাদা ভাবতেন, আমি সুনীতিকুমারের ছাত্র হয়ে যদি এতটা জানতে পারি, তবে আমার ছাত্ররা জানবেন না কেন। ওই সব শাণিত বাক্যের পিছনে তাই একটাই যুক্তি, সেটা ‘প্রত্যাশা’।

ব্রিটেনের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি স্বর্ণপদক দিয়ে সম্মানিত করছে সুকুমার সেনকে, ছবি: তপন দাস

এ প্রসঙ্গে একজন ছাত্রের নাম আসে, তারাপদ মুখোপাধ্যায়। দাদার প্রিয় ছাত্রদের তালিকায় একেবারে উপরের দিকে তিনি। কিন্তু সেই তারাপদবাবুও একবার বিরক্ত হয়েছিলেন এবং তা রবীন্দ্রসঙ্গীতের সূত্রে।

ঘটনাটা এ রকম। গান চলছে ‘লহ লহ তুলে লহ নীরব বীণাখানি’। উপস্থিত জনকে গানের কথার মানে জিজ্ঞেস করলেন তিনি। কারও উত্তরই পছন্দ হল না। কারণ তিনি গানের মধ্যে ‘অহল্যা মিথ’ খুঁজছেন। অন্য একদিন, শোনা হচ্ছে ‘মেঘ বলেছে যাব যাব’ গানটি। একই ভাবে নানা প্রশ্ন করছেন দাদা গান নিয়ে। বিরক্ত তারাপদবাবু বললেন, ‘স্যর, গান শুনছি। এ রকম ভাবে অর্থ আবিষ্কার করার চেষ্টা কি ঠিক?’ দাদার উত্তর, ‘রসগোল্লা খাবেন ছিবড়ে বাদ দিয়ে?’

আসলে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে নাড়ির যোগ দাদার। তা যেন আলোর পাশে ছায়ার মতো অনুসরণ। সাক্ষাতের ঘটনাটিও বেশ রোমাঞ্চকর। সময়টা ১৯২৩-২৪ হবে। স্থান, বর্ধমান স্টেশন। চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম। দেখা গেল, প্রথম শ্রেণির কামরায় বসে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। দাদা আর দেরি করলেন না। কামরায় ঢুকে প্রণাম রবীন্দ্রনাথকে। কবি মুখ তুলতেই ছুটে ট্রেন থেকে নেমে এলেন দাদা।

রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে অন্য কোনও রকম কথা শোনাতেও আপত্তি দাদার। একবার জামশেদপুরে ‘নিখিল ভারত বঙ্গসাহিত্য সম্মেলন’ চলছে। দাদা মূল সভাপতি। সেখানে ‘সাহিত্য-শাখার সভানেত্রী’র বক্তৃতায় হঠাৎ রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ এল। তা শুনে দাদা বললেন, ‘সব সহ্য করব। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের বিষয়ে— না, না...’

আসলে রবীন্দ্রনাথের মধ্যে জীবনীশক্তি খুঁজতেন তিনি। সে শক্তি কেমন, তা বোঝা যায় টুকরো টুকরো ঘটনা থেকে।

শঙ্খ ঘোষ এসেছেন গোয়াবাগানের বাড়িতে। এসে দেখলেন, দাদা পড়ছেন শঙ্খবাবুদের প্রায় সমসাময়িক কবি আনন্দ বাগচীর ‘স্বগত সন্ধ্যা’। শঙ্খবাবু বিস্মিত, ‘পণ্ডিতজনেরা কি সমকালীন কবিতাও পড়েন তা হলে?’ তাও সাহিত্যের ইতিহাসের কাজ করার সময়ে! শঙ্খবাবুর আরও একবার বিস্ময়, এই ঘটনার ৩৭ বছর বাদে।

১৯৯২-এর ৩ মার্চ দাদার মৃত্যুর এক-দু’মাস আগের ঘটনা। বন্ধু সূত্রে শঙ্খবাবু জেনেছেন, স্যর ‘হাল আমলের কিছু কবিতার বই’ চেয়েছেন। ফোন করলেন শঙ্খবাবু। কার বই পাঠাবেন, জয় গোস্বামীর? দাদার উত্তর, ‘তার কবিতা পড়েছি কিছু। তারও পরে যারা লিখছে আশির দশকের শেষ পর্যন্ত…’ আসলে দাদামশাই চেয়েছিলেন ৮০-র দশকের শেষ পর্যন্ত সাহিত্যের ইতিহাস লিখবেন। তা আর হল না মৃত্যুর কারণে।

দাদামশায়ের অধীত বিদ্যা সবটাই এই বাংলায় বসে। পড়েছেন বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল বয়েজ হাইস্কুল, সংস্কৃত কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। দাদামশায়ের বিলেত না যাওয়ার পিছনেও একটি গল্প আছে। সুনীতিবাবুর কথা মতো, তাঁরই সঙ্গে ‘বায়োডেটা ছাপিয়ে’ দাদা গেলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কাছে। সুনীতিবাবু বললেন, ‘ইনি আমার সুযোগ্য ছাত্র। এঁকে বিদেশ পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।’ উপাচার্য নিমরাজি। বললেন, ‘পরের সপ্তাহে পটনা যাচ্ছি। ফিরে ব্যবস্থা করছি।’ পটনা গিয়ে সেখানেই মৃত্যু উপাচার্য আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের। দাদার বিলেত যাওয়া হল না। তবে বিদেশ ছুটে এসেছে দাদার কাছে।

তেমনই ছোট্ট একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন আমার পিসি সুনন্দার স্বামী, পিসেমশাই অধ্যাপক বিজিতকুমার দত্ত। বিজিতবাবু বাড়িতে ঢুকেলেন। লোডশেডিং। দেখলেন, দাদা টেব্‌লে ঝুঁকে। টর্চ জ্বেলে পড়ছেন ‘চৈতন্য চরিতামৃত’। পাশে এক বিদেশিনি, মুগ্ধ শ্রোতা। জীবনে বিদেশ থেকে বহু সম্মান, আমন্ত্রণ পেলেও কখনও মাটি ছাড়েননি। তাই প্রায়ই শুনেছি ওঁর গর্ব, ‘আমি হোম বেক্‌ড স্কলার।’

সেই ‘স্কলার’ চ্যালেঞ্জ নিতেও ভালবাসতেন। একবার সুনীতিবাবুর ঘরে নগেন্দ্রনাথ বসু নামে এক প্রাজ্ঞ জন মিথিলা থেকে প্রাপ্ত পাণ্ডুলিপি দিয়ে একটি বই ছাপিয়েছেন মৈথিলীতেই। বিষয় গোবিন্দদাস। সব দেখেশুনে সুনীতিবাবু বললেন, ‘গোবিন্দদাসকে আপনারা বলেন বাঙালি কবি, তিনি বাঙালি নন, তিনি মৈথিল কবি।’ শুনেই দাদামশায়ের জবাব, ‘না স্যর, ও তো বাঙালিই, বাপ-মা বাঙালি।’ সুনীতিবাবুর পরামর্শমতো এ বার দাদা লিখেও ফেললেন একটি প্রবন্ধ, ‘গোবিন্দদাস কবিরাজ’। দাদার কথায়, ‘এই হল আমার বাংলা সাহিত্যে প্রথম নামা।’

দাদামশাই বিরাট ‘স্কলার’ হলেও আমার স্মৃতি এবং শোনার অনেকটা জুড়েই রয়েছেন পারিবারিক সুকুমার সেন।

ছেলেবেলায় ঝড়বাদল হলেই বড্ড উতলা হতেন দাদা। নাতি, নাতনি তখনও স্কুল থেকে ফেরেনি যে। বারবার মাকে জিজ্ঞাসা, ‘ওরা কখন ফিরবে?’ সকাল সাতটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে নাতি-নাতনিকে ‘গুড মর্নিং’ বলা চাই-ই। তার পর ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’-সহ দু’টি বাংলা এবং একটি ইংরেজি দৈনিকের শিরোনাম পড়ে শোনানো আমার কাজ। ইংরেজি উচ্চারণে হোঁচট খেলেই তিরস্কার, ‘আহ বাংলা মিডিয়ামে পড়ছিস বলে ইংরেজিটা শিখবি না!’ তার পর বেলা আটটা, সাড়ে আটটা থেকে ‘ডিকটেশন’ দিয়ে লেখার কাজ, দেড়টা নাগাদ খাওয়াদাওয়া, খাওয়া শেষে জর্দা ছাড়া একটি পান, তার পর ঘণ্টা দুয়েকের বিশ্রাম। দাদার রুটিন এটাই। সন্ধে সাতটা থেকে আবার পড়াশোনা।

খাওয়াদাওয়া শেষ দিকে সামান্যই। তবে দাদার এক সময়ের খাদ্যাভ্যাসে পুরোপুরি এদেশি ছাপ। এক বার একটি বিশেষ দোকানের সন্দেশ তৈরির উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করল তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। সেই সময়ে উনি ভীষণ রেগে প্রমথনাথ বিশীকে, যিনি আবার কংগ্রেস ভক্ত, যাচ্ছেতাই গালমন্দ করলেন। শুনে বিশী মহাশয়ের উত্তর, ‘আমি সরকার নই মশায়।’

এ ছাড়া আলু দিয়ে তৈরি নানা পদ ভীষণ প্রিয় ছিল। একবার কচুরি ও লুচির মাঝামাঝি একটা পদ তৈরি করতে বললেন। সেটার নামও দিলেন, ‘লুচুরি’। এ ছাড়া গিমে শাক, গুগলির চচ্চড়ি, ছাতুর তরকারি এ সবও বিশেষ প্রিয়।

প্রতিদিনের রুটিনের মাঝে সময় পেলে মুখে মুখে অন্ত্যমিলযুক্ত ও যুক্তব্যঞ্জনে সমৃদ্ধ ছড়া বলতেন নাতি-নাতনিকে। আমরা মন দিয়ে তা লিখেছি। পরে বুঝেছি, ওটা ছিল স্রেফ আমাদের বাংলা বানানে দড় করার জন্য।

ছেলেবেলায় অসুস্থতার সময়ে বাবা হরেন্দ্রনাথের কাছ থেকে পাওয়া ‘রাক্ষস খোক্কস’ এবং ‘হাসিখুশি’ বই দু’টি তাঁকে সাহায্য করল সাহিত্য জগতে প্রবেশে।

দাদার ৫৫ বছরের সঙ্গী স্ত্রী সুনীলা সেনের তেমন প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা ছিল না। কিন্তু স্বামীর খুঁটিনাটি বিষয়ে নজর সর্বদা। কোনও এক কারণে সুনীতিবাবুর সঙ্গে মন কষাকষি হল দাদার। বিষয়টা আঁচ করে ঠাকুমা বললেন, ‘এটা হবে না। তুমি যাবে ওঁর কাছে।’ মিটল মন কষাকষি।

দাদার একটা স্বভাবে নিশ্চয় বিরক্তও হতেন ঠাকুমা। ঠাকুমা রান্নাঘরে গলদঘর্ম হয়ে সবে ফ্যানটা চালিয়ে বসলেন ঠাকুমা। দাদা তা দেখে দিলেন ফ্যানটা বন্ধ করে। বললেন, ‘ঠান্ডা লাগবে।’

স্ত্রীর মৃত্যুর পরে হয়তো একাকিত্ব থেকেই বাড়িতে ভূতের গল্পের আসর বসালেন দাদা। তবে সে আসর বেশি দিন জমল না। পরে জন্ম নিল বিখ্যাত ক্লাব ‘হোমসিয়ানা’। দাদার নিজের গোয়েন্দা কালিদাস। কেন? তাঁর যুক্তি, প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতিতে কবিরাই সবথেকে ‘দূরদৃষ্টিসম্পন্ন’। তাই গোয়েন্দা কালিদাস।

দাদামশাইয়ের রসিকতাগুলোও চমৎকার। প্রায়ই তাঁর দাবি, ‘আমরা লক্ষ্মণ সেনের বংশধর!’

কর্মস্থলেও আমুদে তিনি। ৪০-এর দশক। পরীক্ষার খাতা দেখা চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। দাদামশাই প্রধান পরীক্ষক। নাভিশ্বাস উঠছে তাঁর এবং উপস্থিত অন্যান্য পরীক্ষকদের। আচমকা লুচি-মাংস এল। কলের রেকর্ডে দাদা বাজিয়ে দিলেন, নবদ্বীপ হালদারের রসিকতা। গল্পটা শুনিয়েছেন সে দিনের এক পরীক্ষক, অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়।

তবে রসিকতার মাঝেও উনি পড়াশোনার সূত্রটা ছাড়তেন না। একদিন আমি পিংপং বল নিয়ে দাপাদাপি করতে করতে জিজ্ঞেস করি, ‘আচ্ছা, রামের বাবা কে? তাঁর বাবা?’ উনি ‘রামায়ণ’ নিয়ে একটা লেখার সূত্র পেয়ে গেলেন।

কথাপ্রসঙ্গে দাদা প্রায়ই বলতেন, উনি নাকি ছোটবেলায় রেলের ইঞ্জিন ড্রাইভার হতে চেয়েছিলেন। পরে চেয়েছিলেন গণিতজ্ঞ হতে। তাই বোধহয় ইন্ডিয়ান ম্যাথমেটিক্যাল সোসাইটির এস কে বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে অঙ্ক নিয়ে প্রায়ই পত্রালাপ হতো।

পড়াশোনা ছাড়া খেলাতেও আগ্রহ তাঁর। একবার মোহন-ইস্ট ডার্বি দেখতেও যান। প্রিয় ক্রিকেটার গাওস্কর, কপিল নন। ভারতের খেলা থাকলেই তাঁর জিজ্ঞাসা, মহিন্দর অমরনাথ আর রজার বিনি কেমন খেলেছে রে?

জীবনে একবারই দাদা প্রত্যক্ষ রাজনীতির সংস্পর্শে এসেছিলেন। প্রাথমিকে ইংরেজি তুলে দেওয়ার প্রতিবাদে। এই সমসাময়িক পর্বে উপস্থিত সভ্যমণ্ডলীর কাছে বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘বন্ধুগণ, আমি বৃদ্ধ হয়েছি। তাই আমাকে নিয়ে পরিহাস চলছে।’ আসলে উনি বোঝাতে চেয়েছিলেন অতীতকে ‘পরিহাস’ করে বর্তমান সময় কখনও ভবিষ্যতের যাত্রী হতে পারে না।

ঋণ: ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘দিনের পরে দিন যে গেল’ (আনন্দ), ‘সুখের স্মৃতি’ (সূত্রধর): সুকুমার সেন, ‘কথাসাহিত্য’ (আষাঢ়-শ্রাবণ ১৩৮৯), ‘নিরহং শিল্পী’: শঙ্খ ঘোষ (তালপাতা)।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE