Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

কার্পেট সাহেব

জিম করবেট। অরণ্যের বাঘ যাঁর চোখে এক উদারহৃদয় ভদ্রলোক। আদ্যন্ত ভারতপ্রেমী এই মানুষটির শেষজীবন কেন কাটল আফ্রিকায়? মৃত্যুর ষাট বছরে তাঁর কথা লিখছেন অরণি বন্দ্যোপাধ্যায়নভেম্বরের শেষে রীতিমতো কড়া শীত নৈনিতালে। আর শেষরাতেই ঠান্ডার কামড়টা সবচেয়ে প্রবল। রাম সিংহকে তৈরি থাকতে বলেছিলেন সাহেব। সময়মতোই এসে গিয়েছিল সে। দ্যাখে, বাংলোর বারান্দায় পায়চারি করছেন সাহেব। হাতের টর্চটা জ্বেলে একটা বস্তার উপর ফেললেন। ইঙ্গিত করলেন বস্তাটা তুলে নিতে। কাঁধে তুলে রাম সিংহ বুঝল, বেশ ভারী বস্তাটা। কিন্তু কী আছে এতে, প্রশ্ন করল না। প্রভুর আদেশ চিরদিন বিনা প্রশ্নে পালন করে এসেছে সে। কুয়াশা মোড়া ম্লান জ্যোৎস্নায় থমথম করছে নির্জন বনস্থলী। এই গাছপালা, এই নির্জনতা আর কত দিন থাকবে কে জানে?

শেষ আপডেট: ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৩
Share: Save:

নভেম্বরের শেষে রীতিমতো কড়া শীত নৈনিতালে। আর শেষরাতেই ঠান্ডার কামড়টা সবচেয়ে প্রবল।
রাম সিংহকে তৈরি থাকতে বলেছিলেন সাহেব। সময়মতোই এসে গিয়েছিল সে।
দ্যাখে, বাংলোর বারান্দায় পায়চারি করছেন সাহেব। হাতের টর্চটা জ্বেলে একটা বস্তার উপর ফেললেন।
ইঙ্গিত করলেন বস্তাটা তুলে নিতে। কাঁধে তুলে রাম সিংহ বুঝল, বেশ ভারী বস্তাটা। কিন্তু কী আছে এতে, প্রশ্ন করল না।
প্রভুর আদেশ চিরদিন বিনা প্রশ্নে পালন করে এসেছে সে। কুয়াশা মোড়া ম্লান জ্যোৎস্নায় থমথম করছে নির্জন বনস্থলী। এই গাছপালা, এই নির্জনতা আর কত দিন থাকবে কে জানে?
সব কিছু বড় দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আর সে জন্যই তো তিন পুরুষের বাস উঠিয়ে চলে যাওয়ার কঠোর সিদ্ধান্তটা নিতে হল।
বারান্দায় সিঁড়ি বেয়ে নেমে সাহেব একটা সিগারেট ধরালেন। রাম সিংহ তার এক সঙ্গীকে নিয়ে সাহেবের পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়।
সাহেব আঙুলটা তুলে ইঙ্গিত করলেন বনের দিকে। শীতের শেষরাতে ভিজে ঘাসপাতা মাড়িয়ে তিন জোড়া পা চলল জঙ্গলের গভীরে।
অ্যাকাশিয়া, ওক আর বার্চের আড়ালে কুয়াশার জাল ছিঁড়ে কখনও-সখনও উঁকি মারছে কৌতূহলী শুকতারা। সূর্য উঠে আকাশ রাঙা হতে এখনও অনেক দেরি।
প্রায় মিনিট চল্লিশ হাঁটার পর জঙ্গল যেখানে বেশ ঘন, একটা বড় গাছের নীচে রাম সিংহদের দাঁড়াতে বললেন সাহেব।
আরও একটু ভিতরে ঘন ঝোপের মধ্যে টর্চের আলো ফেললেন। দুটো বড় পাথর দিয়ে জায়গাটা চিহ্নিত করাই ছিল।
সাহেব এ বার বললেন বস্তাটা খুলতে। ভিতর থেকে বেরোল শাবল, কোদাল, তিনটে রাইফেল ও দুটো শটগান। অনেক দিন আগে সেই ১৯২৬ সালে এরই একটা রাইফেল অবসান ঘটিয়েছিল রুদ্রপ্রয়াগের চিতাবাঘের আতঙ্কের।
গর্তটা বেশ গভীর করে খোঁড়ার পর সাহেব একবার দেখে নিলেন। হাতে তুলে নিলেন একটা একটা করে আগ্নেয়াস্ত্র। পরম আদরে চুমু খেলেন। তার পর নিজের সন্তানের মতো যত্নে সেগুলোকে একে একে নামিয়ে দিলেন গর্তের মধ্যে। রাম সিংহ হাউহাউ করে কাঁদছিল। সাহেব ওর মাথায় হাত রাখলেন।

গর্তটা ভরাট করা হল। সাহেব এ বার গার্নি হাউস-এর দিকে পা বাড়ালেন দুই সঙ্গীকে নিয়ে।

ইনিই সেই বিখ্যাত শিকারি এডওয়ার্ড জেমস করবেট, ১৮৭৫ সালে নৈনিতালে যাঁর জন্ম। জিম করবেট নামেই যিনি সমধিক খ্যাত। আর কুমায়ুন-গাড়োয়ালের মানুষের কাছে যাঁর পরিচয় ‘কার্পেট সাহেব’।

শিকার করা, শিকার-কাহিনি লেখা ছাড়াও তিনি লিখেছেন ‘মাই ইন্ডিয়া’র মতো বই। যে বইয়ের ছত্রে ছত্রে মিলবে ব্রিটিশ রাজের গুণকীর্তন নয়, দুঃখী ভারতবাসীর কথা।

তাঁর মৃত্যুর ছয় দশক পরে তাই বারবারই প্রশ্ন গুঞ্জরিত হয়—জিম যদি ভারতবর্ষকে এতটাই ভালবেসে থাকেন, তবে কেন ‘বানপ্রস্থ’ নিয়ে আফ্রিকায় চলে গেলেন তিনি?

তাঁর শিকার ও ভারতের বন্যপ্রাণী সম্পর্কে যে বিপুল অভিজ্ঞতা, সে তুলনায় জিমের লিখিত রচনার পরিমাণ বেশ কমই মনে হয়। নৈনিতালে তাঁর বন্ধুর ছোট্ট প্রেসে ছাপা প্রথম বই ‘জাঙ্গল স্টোরিজ’-এর কথা বাদ দিলে (ছাপা হয়েছিল মাত্র ১০০ কপি, তাও বিক্রিই মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না) জিমের গ্রন্থের সংখ্যা মাত্র ছ’টি। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর ষাট বছর পরেও জিমের শিকার-কাহিনিগুলি এখনও বেস্ট সেলার! অথচ সে অর্থে পেশাদার লেখক হয়ে ওঠার তেমন কোনও বাসনাই ছিল না জিমের। অধিকাংশ রচনাই ঘটনার কুড়ি, তিরিশ বা চল্লিশ বছর পর লেখা।

তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠকেরা প্রশ্ন না তুললেও নামজাদা কিছু শিকারি কিন্তু সন্দেহের কাঁটা বিদ্ধ করতে ছাড়েননি জিম করবেটকে।

ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরীর একটি লেখায় পাই ১৯৫৬ সালে নৈনিতালে গিয়ে মিস্টার বেনসন নামে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান শিকারির দেখা পান তিনি। জিমের খ্যাতি তখন তুঙ্গে। বই বিক্রি হচ্ছে হু হু করে।

জানা গেল, বেনসন জিমের থেকেও বেশি সংখ্যায় বাঘ মেরেছেন এবং ভারত সরকার নরখাদকের উপদ্রব হলেই তাঁকে ডাকেন।

এই সাহেবের কাছে জিম করবেটের নাম করতেই বিদ্রুপের স্বরে তিনি বলে উঠলেন—‘‘ইয়েস করবেট। হি রাইটস আ লট। হাঃ হাঃ হাঃ।’’

অর্থাৎ জিমের লেখায় অনেক জল আছে। আর তাতেই তাঁর জনপ্রিয়তা। শুধু বেনসন নয়, ভারতে ব্যাঘ্র প্রকল্পের প্রথম অধিকর্তা কৈলাস সাংখালাও জিম করবেটকে প্রকারান্তরে ধাপ্পাবাজ বলতে ছাড়েননি।

জিমের জোর তাঁর মিতকথন ও অরণ্যের প্রতি, অরণ্যসংলগ্ন সকল প্রাণীর প্রতি একশো শতাংশ প্রেম। কয়েক বছর ধরে মাইলের পর মাইল দৌড় করানো রুদ্রপ্রয়াগের চিতা যে দিন তাঁর রাইফেলের গুলিতে মারা পড়ল তখন তাঁর লেখায় কোথাও নেই জয়ীর গর্ব। সাফল্যের উল্লাস।

শুধু তাঁর মনে হল, নিরীহ দরিদ্র পাহাড়ি মানুষগুলিকে নরখাদকের আতঙ্ক থেকে তিনি মুক্তি দিতে পেরেছেন। এটা ছিল তাঁর ‘কর্তব্য’।

নিরাবেগ কলমের আঁচড়ে জিম লিখছেন— ‘‘রাত দশটায় গুলি চালিয়েছি। কয়েক ঘণ্টা পরে চাঁদ উঠল। গাছের মগডালে উঠলাম, কিন্তু ছড়ানো ডালপালার জন্য ঠিক দেখতে পেলাম না। আবার মাচানে নামলাম।

কিন্তু এখান থেকেও পাহাড়ের যে দিকে চিতা বাঘটা গেছে বলে মনে হল সে দিকটা দেখা যাচ্ছিল না। তখন বাজে রাত তিনটে।

দু’ঘণ্টা পরে চাঁদ অস্ত যেতে থাকল। গাছ থেকে নামলাম। ছাগলটা বন্ধুসুলভ গলায় ডেকে আমাকে অভ্যর্থনা করল। ছাগলটার পিছনে একটা লম্বা পাথরের উপর এক ইঞ্চি চওড়া রক্তের দাগ। যে সতর্কতা সাধারণত মাংসাশী পশুর রক্তের দাগ অনুসরণ করতে অবলম্বন করতে হয়। আমি তা উড়িয়ে দিলাম।

রাস্তা থেকে নামলাম, পাথরের অন্য পাশে রক্তের দাগ দেখলাম। পঞ্চাশ গজ অবধি অনুসরণ করলাম। দেখলাম চিতাবাঘটা মরে পড়ে আছে।

শনাক্ত করার মতো কোনও দাগ দেখা যাচ্ছিল না। তবুও আমার এক মুহূর্তের জন্যও সন্দেহ হয়নি যে এটাই সেই নরখাদক। এ কোনও পিশাচ নয় যে রাতের প্রহর ধরে আমাকে লক্ষ করছে।

ওকে কাবু করার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় নিঃশব্দ পৈশাচিক হাসিতেও গড়াগড়ি দিয়েছে। সেই সুযোগের আশায় ঠোঁট চেটেছে, যখন আমাকে অসতর্ক অবস্থায় পেয়ে আমার গলায় দাঁত বসাবে।

এখানে পড়ে আছে একটা বুড়ো চিতাবাঘ। ভারতে সবার চেয়ে ঘৃণ্য ও সন্ত্রাস সঞ্চারকারী জন্তু। যার একমাত্র অপরাধ প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে নয়, কিন্তু মানুষের নিয়মের বিরুদ্ধে—সে মানুষের রক্তপাত করেছে। মানুষকে আতঙ্কিত করার জন্য নয়, শুধু নিজের প্রাণরক্ষার জন্য।

সে এখন গর্তের ধারে থুতনি রেখে শুয়ে আছে। চোখ দুটি আধবোজা, তার শেষ ঘুমে শান্তিতে মগ্ন।’’

১৯০৭ থেকে ১৯৩৮ দীর্ঘ তিন দশক ধরে রাতের পর রাত হিংস্র শ্বাপদের সন্ধানে কেটেছে জিম করবেটের। একাধিকবার প্রায় অলৌকিক ভাবে রক্ষা পেয়েছেন তিনি। কিন্তু তাঁর যুক্তিতে শিকার তখনই মান্যতা পায় তা যখন সাধারণ নিরীহ মানু‌ষের প্রাণরক্ষার স্বার্থে।

বাঘকে ‘নিষ্ঠুর ও রক্তপিয়াসী’ বলতে ঘোরতর আপত্তি তাঁর।

জিমের কথায়, ‘‘বাঘ উদারহৃদয় ভদ্রলোক। সীমাহীন তার সাহস। যে দিন বাঘকে বিলোপ করে দেওয়া হবে, যদি বাঘের সপক্ষে জনমত গড়ে না ওঠে বাঘ লোপ পাবেই, তা হলে ভারতের শ্রেষ্ঠতম প্রাণীর বিলোপে ভারত দরিদ্রতরই হবে।’’

ভারতে দেশীয় রাজন্যদের ‘শিকার খেল’ নতুন কিছু নয়। এ দেশে ব্রিটিশরাজ কায়েম হওয়ার পর লাট-বেলাটের দলও শৌর্যের প্রতীক হিসাবে বিরাট দলবল নিয়ে গিয়ে অরণ্যে শ্বাপদ নিধনে মেতেছেন। পরবর্তী জীবনে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে উঠেপড়ে লাগলেও তথ্য হিসাবে উল্লেখ করা দরকার যে এমন শিকারে রাজপুরুষদের সঙ্গ দিতে হয়েছে জিমকেও।

‘ডোমিসাইল্ড ইংলিশ’ জিম নিজের প্রভাব বাড়াতে রাজপুরুষদের তুষ্ট রাখতে চাইতেন এমন কথাও উঠেছে। তবে জিম ব্যাপারটা যে পরবর্তী জীবনে প্রসন্ন চিত্তে মানতে পারেননি সেটাও সত্য।

জিমের নামেই এ দেশে প্রথম ন্যাশনাল পার্ক। ১৯৫৭ সালে (আগে ছিল হেলির নামে)। অরণ্য ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের অনেকেই আজ মনে করেন ভারতে এই সংরক্ষণের অগ্রপথিক জিম করবেটই। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে জিমের আগে সংরক্ষিত অরণ্যের প্রস্তাব দিয়েছিলেন দুই ব্রিটিশ ফরেস্ট অফিসার। ই আর স্টিভেন্স এবং তার পর ই এ স্মাইথস। যথাক্রমে ১৯১৬ এবং ১৯১৭ সালে। কিন্তু তদানীন্তন ব্রিটিশ রাজপুরুষ পারসি উইন্ডহ্যাম সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন।

জিম করবেটকে নিয়ে বিতর্ক থাক। তবে তাঁর মৃত্যুর দীর্ঘ ষাট বছর পর জিমের রচনা ও তাঁর জীবনী নতুন করে নেড়েঘেঁটে মনে হচ্ছে ‘কার্পেট সাহেব’-কে নিয়ে নতুন করে চর্চা হওয়া প্রয়োজন। শুধু শিকার-কাহিনির লেখক হিসাবে জিমের পরিচয় খণ্ডাংশ মাত্র।

শিকারি জিমের আড়ালে কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে এক চিরকিশোর। ফাটা নল গাদা বন্দুক নিয়ে যে একাই ঘুরে বেড়ায় বনে-পাহাড়ে। নকল করে পশুপাখির ডাক। আয়া-খানসামাদের কাছ থেকে শেখে হিন্দুস্থানি ও দেশি পাহাড়ি ভাষা।

স্কুলের পর আর উচ্চশিক্ষার সুযোগ হয়নি। ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। কিন্তু বাড়িতে একগাদা লোকের অন্ন সংস্থানের জন্য যেতে হয় বিহারের মোকামাঘাটে।

২১ বছর ধরে মোকামাঘাটে রেল কোম্পানির হয়ে কুলির ঠিকাদারি। বয়সের ধর্মে ভাল লেগেছিল শ্বেতাঙ্গিনী এক কিশোরীকে। কিন্তু মা ও দিদির প্রবল বাধায় শুকিয়ে যায় সেই প্রেমের কলি।

ব্যক্তিগত ভাবে আমার সেরা মনে হয় ‘মাই ইন্ডিয়া’য় তাঁকে ঘিরে থাকা দরিদ্র-অন্ত্যজ মানুষগুলিকে নিয়ে তাঁর লেখাগুলি।

অন্ত্যজ শ্রেণির কুলি সর্দার চামারি শেষ নিঃশ্বাস ফেলে জিমেরই হাত ধরে। বলে, ‘পরমেশ্বর, আমি আসছি’।

শেষযাত্রায় উপস্থিত কাশীর এক মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। এই ২০১৫ সালেও এ ঘটনাকে মনে হয় ‘বিপ্লব’। এ ছাড়া ‘লালাজি’, বুদ্ধু, ডাকু সুলতানা—প্রতিটিই যেন উজ্জ্বল হীরক খণ্ড।

কেউ কেউ মোকামাঘাট ও গাড়োয়াল-কুমায়ুনে দরিদ্র অন্ত্যজনের প্রতি জিমের দরদকে প্রশংসা করলেও সেটাকে ‘দরদী প্রভু ও অনুগত প্রজা’ সম্পর্কেই বেঁধে রাখার পক্ষপাতী।

মনে রাখতে হবে ছোটা হলদিওয়ানি-কালাধুঙ্গি সাধারণ মানুষ জিমকে ‘শ্বেতাঙ্গ সাধু’ হিসাবেই দেখত। খুব গোঁড়া পরিবারেও জিমের সামনে মহিলাদের আসায় কোনও ‘পর্দা’ ছিল না।

মোকামাঘাটে থাকার সময় স্থানীয় কুলিদের সঙ্গে মিশেছেন। স্কুল করে দিয়েছেন তাদের ছেলেদের পড়ার জন্য। হকি ও ফুটবল টিম গড়ে খেলেছেন এই ‘নেটিভ’-দের সঙ্গেও।

নৈনিতাল, কালাধুঙ্গি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় ঘর-জমি দিয়ে গিয়েছেন তাদের, এমনকী মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তার খাজনা পর্যন্ত দিয়ে এসেছেন।

স্থানীয় মানুষরা কষ্ট পাবে ভেবে প্রায় নীরবে নিঃশব্দে এ দেশ ছাড়েন জিম ও তাঁর দিদি ম্যাগি।

ভারত স্বাধীন হল ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট। আর তাঁরা ভারত ছাড়লেন ওই বছরই নভেম্বরে।

২১ নভেম্বর গার্নি হাউস বিক্রি হয়ে গেল। তার ক’দিনের মধ্যেই বাড়ির বাগানে একটি গাছের চারা রোপণ করে ও জঙ্গলে বন্দুকগুলি ‘সমাধিস্থ’ করে চিরদিনের মতো ভারত ছাড়লেন জিম ও ম্যাগি।

প্রথমে লখনউ।

সেখান থেকে মুম্বই।

মুম্বই বন্দর থেকে ‘এস এস অ্যারোন্দা’ জাহাজে মোম্বাসা।

লখনউ স্টেশনে সাহেবকে বিদায় জানাতে এসে কেঁদে ফেলে রাম সিংহ।

জিম ও ম্যাগির চোখও শুষ্ক ছিল না। সাগরপাড়ি দিয়ে জাহাজ মোম্বাসা পৌঁছায় ১৫ ডিসেম্বর।

করবেটরা এখান থেকে যান নাইরোবি।

পরে আস্তানা গাড়েন নিয়েরে। জার্মানদের হাত থেকে দখলমুক্ত হয়ে ওই অঞ্চল তখন ব্রিটিশ উপনিবেশ।

দু’টি বিশ্বযুদ্ধের সূত্রে ও পরে লন্ডন-সহ ব্রিটেন সফর করলেও জিম বা ম্যাগি কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না খাঁটি ইওরোপিয়ানদের সঙ্গে। আসলে ‘ডোমিসাইল্ড ইংলিশ’ হিসাবে কোথাও একটা হীনমন্যতা হয়তো ছিল।

কারও কারও অভিমত, সিপাহি বিদ্রোহের ‘ভূত’ ঘাড় থেকে নামেনি। আশঙ্কা ছিল, স্বাধীন ভারতে নতুন শাসক শ্রেণি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে। সাত-পাঁচ ভেবে সে জন্যই ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্ত।

বন্ধু ব্র্যান্ডারকে চিঠিতে লিখছেন, ‘‘দ্য ইন্ডিয়া দ্যাট ইউ অ্যান্ড আই লাভড হ্যাজ বিন স্যাক্রিফাইজড অন দ্য অলটার্স অফ অ্যাম্বিশান অ্যান্ড গ্রিড।’’ এ চিঠি গার্নি হাউস ছাড়ার এক মাস আগে লেখা।

শান্তি পুরো পাননি নিয়েরেতে গিয়েও। ১৯৫৪ সালের ১৭ নভেম্বর জেফরি জে কাম্বারবেলকে লিখছেন, ‘‘দ্য জ্যাকারান্ডাজ আর ইন ফুল ব্লুম, অ্যান্ড আ ফিউ মাইলস অ্যাওয়ে— বম্বস আর বার্স্টিং। হিউম্যান বিয়িংস আর নেভার হ্যাপি আনলেস দে আর ফাইটিং .....।’’

নিজের রাইফেলগুলো নৈনিতালের জঙ্গলে পুঁতে এলে কী হবে, আফ্রিকাতে এসেও গুলিগোলার আওয়াজ থেকে নিষ্কৃতি নেই জিমের।

মাঝে মাঝে মনে হয়, ভারতই ভাল ছিল। ম্যাগিকে বলেন। কিন্তু যাওয়া আর হয়নি।

ভোরের পঞ্চচুল্লি, নন্দা, ত্রিশূলে আলোর অভিষেক দেখে বড় হয়ে ওঠা জিম ১৯৫৫ সালের ১৯ এপ্রিল ঘুমিয়ে পড়েন চিরদিনের জন্য। ‘আমার ভারত’ থেকে অনেক দূরে। আফ্রিকায়।

এ ট্র্যাজেডি শুধু জিমের নয়। প্রতিটি ভারতবাসীর।

তিনি জিম করবেট

আয়ার্ল্যান্ড থেকে ভাগ্যান্বেষণে ভারতে এসেছিলেন করবেটের পূর্বপুরুষ। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের আঁচ লেগেছিল এই পরিবারের গায়েও।

সেই সূত্রেই নিতান্ত স্বল্পবিত্ত এই পরিবার চলে আসে কুমায়ুনের নৈনিতালে। করবেটের মা মেরি জেন ছিলেন আগরার চার্লস জেমস ডয়েলের স্ত্রী।

বিদ্রোহী সিপাহি সেনাদের হাতে চার্লসের মৃত্যু ঘটে। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনটি শিশুসন্তান নিয়ে অকূলপাথারে পড়েন মেরি। কিছু দিন পর মুসুরিতে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ক্রিস্টোফার উইলিয়াম করবেটের।

ক্রিস্টোফারও তখন তিনটি সন্তান নিয়ে বিপত্নীক। ১৮৫৮ সালে ক্রিস্টোফার ও মেরি দু’তরফের ছ’টি সন্তান নিয়ে শুরু করেন নতুন সংসার।

মুসুরি ও মথুরায় দু’বছর কাটিয়ে ১৮৬২ সালে করবেট পরিবার চলে আসে নৈনিতালে। তত দিনে সেনার চাকরি ছেড়ে পোস্টমাস্টারের চাকরি নিয়েছেন ক্রিস্টোফার। পরে বাড়ি করেন নৈনিতালে। জিম জন্মগ্রহণ করেন নৈনিতালেই।

বিশ্বযুদ্ধে যোগদান ও ব্যবসার সূত্রে বছরে মাস তিনেকের জন্য আফ্রিকায় যাওয়া ছাড়া জিমের জীবনের ৯০ ভাগই কেটেছে ভারতের (তৎকালীন সংযুক্ত প্রদেশ) নৈনিতাল অঞ্চলে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE