তাঁর প্রিয় হাতি জঙ্গবাহাদুরের পিঠে বসে শিকারে চলেছেন, অসমের গৌরীপুরের জঙ্গলে। পিছনে আরও হাতি। অনেক লোক। হরেক রকমের বন্দুক, তাঁবু, খাবারদাবার কত কী! তিনি অসমের গৌরীপুরের বড় রাজকুমার প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া। তবে এই পরিচয়কে ছাপিয়ে গিয়েছিল তাঁর অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার ও পরিচালক সত্তা। ভারতীয় চলচ্চিত্র জগতের কিংবদন্তি পুরুষ।
শুরু করা যাক তাঁর শিকারের গল্প দিয়ে। প্রমথেশের ভাই প্রকৃতীশচন্দ্র বড়ুয়ার (লালজি) ডায়েরি থেকে জানা যায়, ১৯১৫ সালে ১৩ বছর বয়সে প্রথম বাঘ শিকার করেন প্রমথেশ। সারা জীবনে তিনি প্রায় ৫০টির বেশি রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার, ২৩টি চিতা এবং একটি গন্ডার শিকার করেছিলেন! এখন এই তালিকা দেখে বন্যপ্রাণ প্রেমিকরা মাথায় হাত দেবেন নিশ্চয়। কিন্তু এই রাজ পরিবারে সব চেয়ে কম সংখ্যক পশু শিকার করেছিলেন প্রমথেশই। ‘‘আমাদের গৌরীপুর রাজবাড়ির কাছে শিকার বিরাট ব্যাপার ছিল,’’ বললেন প্রমথেশ বড়ুয়ার নাতনি রাই বড়ুয়া। তিনি প্রমথেশের বড় ছেলে অলকেশ বড়ুয়ার মেয়ে। রাজবাড়ির ছেলেদের হাতে বালক বয়সেই বন্দুক তুলে দেওয়া হত। প্রমথেশ ও তাঁর দুই ভাই প্রকৃতীশ এবং প্রণবেশের ক্ষেত্রেও অন্যথা হয়নি।
প্রমথেশ কিন্তু কোনও দিনই শিকার পছন্দ করতেন না। তাঁর এই মনোভাবের জন্য দায়ী তাঁর মা সরোজবালা। মা ছিলেন প্রমথেশের চোখের মণি। মাও ‘মণি’ (প্রমথেশের ডাকনাম) বলতে অজ্ঞান! প্রমথেশের বাবা গৌরীপুরের রাজা প্রভাতচন্দ্র বড়ুয়া শাক্ত হলেও, তাঁর স্ত্রী সরোজবালা ছিলেন বৈষ্ণব। তিনি খুব সুন্দর গান গাইতেন। ক্ষমা, স্নেহ, ভালবাসা মা’র কাছ থেকেই পেয়েছিলেন প্রমথেশ। মা প্রাণিহত্যা পছন্দ করতেন না। কিন্তু একেই বোধ হয় বলে আয়রনি! মায়ের শ্রাদ্ধের দিন শ্রাদ্ধের কাজ শেষ না করেই, হাতে বন্দুক নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন প্রমথেশ। বাঘ মারতে। রাজবাড়ির বাইরে তখন প্রজাদের ভয়ার্ত চিৎকার। লোকালয়ে বাঘ বেরিয়েছে। সেই বাঘ হত্যা করে রাজবাড়ি ফিরে এসে শ্রাদ্ধের কাজ শেষ করেছিলেন সরোজবালার আদরের মণি।
যমুনা দেবীর সঙ্গে প্রমথেশ বড়ুয়া
শিকারে যাওয়া নিয়ে প্রায়ই মতানৈক্য হত বাবা-ছেলের। একবার অশান্তি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, তাঁর বাবা বার্ষিক শিকার অসমাপ্ত রেখেই চলে আসেন। শোনা যায়, শিকারে যাওয়ার সময় প্রমথেশের সঙ্গে থাকত ছোট-বড় বিভিন্ন ধরনের পাথর। ইজেল, রং, তুলি, প্যালেট, কাগজ, পেনসিল। শিকারের জন্য যখন অপেক্ষা করতে হত, তখন তিনি ছবি আঁকতেন। তাঁর মন চাইত না কোনও ঘুমন্ত জীবকে হত্যা করতে। তাই পাথর ছুড়ে ঘুমন্ত শিকারকে জাগিয়ে দিতেন। আত্মপক্ষ মোকাবিলা করার সুযোগ দিতেন। এর জন্য অনেক সময় ফসকে গিয়েছে শিকার। ‘‘পছন্দ না করলেও তিনি ছিলেন বড় শিকারি। কিন্তু একটা প্রাণী তাঁর আত্মারাম খাঁচাছাড়া করে দিত। তা হল আরশোলা! গৌরীপুর থেকে কলকাতায় আসার ট্রেনে রাজবাড়ির লোকেদের জন্য একটা আলাদা কামরা থাকত। প্রমথেশ যাত্রা করলে সেই কামরায় মশারি টাঙানো হত। ট্রেনে উঠে উনি মশারির মধ্যে ঢুকে পড়তেন। পাছে আরশোলা উড়ে এসে তাঁর গায়ে বসে!’’ হাসতে হাসতে বললেন প্রমথেশের বোন নীহারবালার নাতি সুদীপ্ত বড়ুয়া।
শুধু বন্যপ্রাণ নয়, গরিব প্রজাদের প্রতিও তিনি ছিলেন উদার। এদের সাহায্য করার জন্য গৌরীপুরে সমবয়সি ছেলেদের নিয়ে একটা দল তৈরি করেছিলেন। প্রমথেশের বাবা বড় রাজকুমার হিসেবে তাঁকে জমিদারি দেখার দায়িত্ব দিলে তিনি বাবাকে বলেছিলেন, তিনি কাবুলিওয়ালা হতে পারবেন না। যারা দু’বেলা পেট পুরে খেতে পায় না, তাদের থেকে তিনি টাকা চাইতে পারবেন না। এই মেজাজই বোধ হয় প্রমথেশকে পরে রাজনীতিতে এনেছিল।
১৯২৬ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ‘অসম ব্যবস্থা পরিষদ’-এর সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেই সময় গভর্নর লরি হ্যামন্ড তাঁকে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সাহেবের এই উপহার নিতে রাজি হননি তিনি। তার বদলে চিত্তরঞ্জন দাশের স্বরাজ পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন প্রমথেশ। কিন্তু সিনেমার নেশার কাছে রাজনীতিক প্রমথেশ হারিয়ে গেলেন।
‘অধিকার’ ছবির দৃশ্যে অভিনেত্রী মেনকার সঙ্গে
‘‘প্রমথেশ বড়ুয়া আপাদমস্তক শৌখিন মানুষ ছিলেন। সব সময় পরিপাটি থাকতেন। শুনেছি ওঁর ঘোড়া ও গাড়ির শখ ছিল। ছ’টা রেসের ঘোড়া ছিল। আর যখন যে গাড়ি বাজারে আসত, তিনি কিনে নিতেন। ওঁর সংগ্রহে অনেক বিদেশি গাড়ি ছিল। তার মধ্যে অন্যতম স্পোর্টস কার ইসোত্তা ফ্রাসকিনি। কিন্তু ভোজনের ব্যাপারে তিনি মোটেই শৌখিন ছিলেন না। মানুষটি ছিলেন স্বল্পাহারী। অধিকাংশ সময়ে নিরািমষ খেতেন। মাছ ছুঁতেন না। মাঝেমধ্যে মাংস খেতেন,’’ বললেন রাই। ‘‘শুনেছি, উনি লন্ডনে গিয়ে মুরগি খাওয়া শিখেছিলেন,’’ বললেন সুদীপ্ত বড়ুয়া। নিরামিষ খাওয়ার অভ্যেসটাও তিনি পেয়েছিলেন তাঁর মা’র কাছ থেকে। প্রমথেশ আট বছর অবধি শুধুমাত্র দুধ খেতেন! ন’বছরে প্রথম ভাত খেয়েছিলেন। তিনি পছন্দ করতেন কাঁচা সরষের তেল ছড়িয়ে ফ্যানভাত, কড়াইশুঁটি আর বাঁধাকপি সেদ্ধ, শাকভাজা, আলুভাজা এবং ডাল। তবে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় ছিল কুড়মুড়ে গরম জিলিপি শিকার বা জমিদারি দেখা নিয়ে মনোমালিন্য থাকলেও ছেলের প্রতি বাবা বেশ দুর্বল ছিলেন। বড় ছেলের কথা তিনি ফেলতে পারতেন না। শোনা যায়, সেই সময় প্রতি মাসে প্রমথেশকে তিনি হাতখরচ দিতেন প্রায় আড়াই হাজার টাকা! গৌরীপুরের রাজারা ছেলেদের পড়াশোনার চেয়ে শিকারের উপর গুরুত্ব দিতেন বেশি। কিন্তু প্রভাতচন্দ্র চাইতেন তাঁর তিন ছেলে প্রমথেশ, প্রকৃতীশ, প্রণবেশ এবং দুই মেয়ে নীহারবালা ও নীলিমাসুন্দরী শিক্ষিত হোক। সন্তানদের জন্য গৃহশিক্ষক হিসেবে আশুতোষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে রেখেছিলেন। তিনি পড়া শুরু করার আগে কীর্তন গাইতেন। মা এবং শিক্ষকের প্রভাবে প্রমথেশও ভাল গান গাইতেন। যদিও সর্বসমক্ষে গাইতে লজ্জা পেতেন। প্রমথেশ তখন নিউ থিয়েটার্সের নামী পরিচালক। সেই সময় এক দিন বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের গৌরীপুর হাউজ়ে পার্টিতে হাজির কুন্দনলাল সায়গল, পঙ্কজকুমার মল্লিক, কৃষ্ণচন্দ্র দে প্রমুখ। সকলে এক এক করে গাওয়ার পরে প্রমথেশকে ধরলেন ওঁরা। তিনি তো পালাতে পারলে বাঁচেন। কিছুতেই তিনি গান গাইবেন না। কিন্তু ওঁরাও নাছোড়বান্দা। অগত্যা চোখ বন্ধ করে প্রমথেশ ধরলেন, ‘গ্রামছাড়া ওই রাঙা মাটির পথ’। গান শেষ হতেই সায়গল ছুটে এসে তাঁর হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘‘এমন একখানা কণ্ঠ নিয়ে আপনি চুপচাপ বসে আছেন! আর আমরা কতো কম মশল্লা নিয়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে বেড়াই।’’ এস্রাজ ও পিয়ানো বাজাতেন প্রমথেশ।
**
কলেজের পাঠ শেষ হওয়ার পরেও প্রমথেশ ভাবেননি, তিনি রুপোলি পর্দার সঙ্গে জড়িয়ে যাবেন। তিনি চাইতেন ডাক্তার হয়ে গৌরীপুরের গরিব প্রজাদের সেবা করতে। বাড়িতে প্রাথমিক শিক্ষার পরে কলকাতায় হেয়ার স্কুলে পাঠিয়ে দেওয়া হয় তাঁকে। পড়াশোনায় মেধাবী, উচ্চশিক্ষার জন্য প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিজ্ঞানে ভর্তি হন। অতঃপর স্নাতক, ইচ্ছে বিদেশে গিয়ে আরও পড়বেন। কিন্তু মায়ের আপত্তিতে হল না। কলেজে পড়ার সময়েই শিশির ভাদুড়ীর অভিনয়ে মুগ্ধ হলেন প্রমথেশ। বন্ধুদের নিয়ে তৈরি করেন ‘ইয়ং ম্যানস ড্রামাটিক ক্লাব’। এই ক্লাবের ছেলেদের নিয়ে করেছিলেন ‘নূরজাহান’, ‘কারাগার’, ‘প্রফুল্ল’, ‘বিবাহবিভ্রাট’ ইত্যাদি নাটক। পরিচালনা ও অভিনয় দুটোই সমান তালে করতেন তিনি। ‘ষোড়শী’ নাটকটি এগারো বার করেছিলেন। এই নাটকে জীবানন্দের চরিত্রটি করতেন তিনি। কারণ শিশির ভাদুড়ীও জীবানন্দের চরিত্রই করতেন। শুধু নাটক নয়, ক্লাবের ছেলেদের নিয়ে ফুটবল, ক্রিকেট খেলে বেড়াতেন। প্রমথেশ নিজে ভাল ফুটবল, ব্যাডমিন্টন, টেনিস ও বিলিয়ার্ড খেলতেন। কলকাতায় বিলিয়ার্ড টুর্নামেন্টে সাহেবদের হারিয়ে একাধিক বার চ্যাম্পিয়নও হয়েছেন তিনি।
**
পরোক্ষ ভাবে শিকারের প্রশিক্ষণই তাঁকে অভিনয়ে টেনে আনল। তখন নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগ। ১৯২৯ নাগাদ ধীরেন গঙ্গোপাধ্যায়, দেবকীকুমার বসু, নীতীশ লাহিড়ী প্রমুখ মিলে তৈরি করেছিলেন ‘ব্রিটিশ ডোমিনিয়নস ফিল্ম কোম্পানি’। ওঁদের প্রথম ছবি ‘পঞ্চশর’। পরিচালনা করেছিলেন দেবকী বসু। ধীরেনবাবুই প্রমথেশকে ডেকেছিলেন শুটিং দেখতে। দৃশ্যটা ছিল নায়িকাকে পাশে নিয়ে নায়ক বন্দুক ছুড়বে। প্রমথেশ লক্ষ করলেন, নায়ক বন্দুকটা ঠিক মতো ধরতে পারছেন না। ভুলটা বাকিরা ধরতেও পারছেন না। প্রমথেশ আর না পেরে বলেই ফেললেন। নায়ককে দেখিয়েও দিলেন, ট্রিগার ধরার প্যাঁচপয়জার। পরিচালক ওই দৃশ্যে নায়কের জায়গায় প্রমথেশকেই তখন অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন। শুরু হল ফিল্মের প্রতি তাঁর আগ্রহ।
‘দেবদাস’ ছবির একটি দৃশ্যে অমর মল্লিক ও চন্দ্রাবতী দেবীর সঙ্গে
যা হোক, সেই ব্রিটিশ ডোমিনিয়নের পরের ছবি ‘টাকায় কি না হয়’। এই ছবিতে প্রমথেশ ছোট একটি চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। দৃশ্য মানে নায়িকা সবিতা দেবী ওরফে আইরিশ গ্যাসপারের সঙ্গে গাড়িতে যেতে যেতে অন্তরঙ্গ হওযার মুহূর্ত। ড্রাইভারের ভূমিকায় ছিলেন প্রমথেশের বন্ধু নির্মল বরকাকতি। কিন্তু ওই ছোট্ট একটা দৃশ্য সাত দিনেও পারফেক্ট হল না! পরিচালক পড়লেন ফাঁপরে। কিন্তু কেন যে হচ্ছে না, তা ড্রাইভারের সিটে বসেই বুঝে ফেলেছিলেন নির্মলবাবু। অন্তরঙ্গতা বেড়ে চলেছে আইরিশ ও প্রমথেশের মধ্যে।
১৯৩০ -এ প্রমথেশের যকৃতে পাথর ধরা পড়ে। চিকিৎসা করাতে যান ইউরোপে। ওখানে গিয়েই একটা স্বপ্ন দেখলেন। তৈরি করতে হবে ফিল্ম কোম্পানি। উঠেপড়ে লাগলেন ফিল্ম মেকিং শিখতে। সেই সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ইউরোপে। প্রমথেশ গিয়ে ধরলেন তাঁকে। ফ্রান্সে রবীন্দ্রনাথের চিঠি নিয়ে প্রমথেশ দেখা করলেন সেই সময়ের নামী ক্যামেরাম্যান রোজার্সের সঙ্গে। হাতেকলমে শিখলেন সিনেমায় কৃত্রিম আলোর ব্যবহার, যা তখন ভারতীয় সিনেমায় অজানা। প্রমথেশ কলকাতায় ফিরলেন শুটিংয়ের জন্য বিস্তর আলো ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি কিনে। তখন দিনের বেলাতেই শুটিং হত। ইউরোপ থেকে ফিরে প্রমথেশ ‘বড়ুয়া ফিল্ম ইউনিট’ তৈরি করেন। সঙ্গে নিলেন পরিচালক দেবকী বসু ও ক্যামেরাম্যান কৃষ্ণগোপালকে। প্রথম ছবিটি নির্বাক, ‘অপরাধী’। কাহিনি ও পরিচালনায় দেবকী বসু। অভিনয়ে প্রমথেশ, রাধিকানন্দ মুখোপাধ্যায়। এবং সেই আইরিশ গ্যাসপার! বাংলা চলচ্চিত্রে সেই প্রথম কৃত্রিম আলোর ব্যবহার। চিত্রা টকিজ়ে ২৮ নভেম্বর, ১৯৩১ সালে মুক্তি। বসুমতী পত্রিকা প্রশংসা করে ‘অপরাধী’র। এর পরে আরও দুটি নির্বাক ছবি, ‘একদা’ এবং ‘নিশির ডাক’। কাহিনি প্রমথেশের। কলকাতার গৌরীপুর হাউজ়ের একটা অংশ নিয়ে শুরু করলেন বড়ুয়া স্টুডিয়োর কাজ। সেখানে ‘একদা’র কিছু অংশ শুটিংও হয়েছিল। পঞ্চাশ বছর পরে বাংলার অবস্থা ভেবে লেখা নিজস্ব কল্পকাহিনি নিয়ে ছবি করলেন ‘বেঙ্গল নাইন্টিন এইট্টি থ্রি’। সুপারফ্লপ হল। সিনেমার জন্য জলের মতো টাকা খরচ করছিলেন তিনি। টাকা আসত গৌরীপুর রাজবাড়ির এসেস্ট থেকে। কিন্তু সেটাও বন্ধ হল। এস্টেটের দেওয়ান প্রমথেশের বাবাকে সাবধান করেছিলেন ছেলের এ ভাবে টাকা ওড়ানোর ব্যাপারে। প্রথমে রাজি না হলেও পরে দেওয়ানের কথা মেনে নেন রাজা। কারণ বাবা তত দিনে বুঝে গিয়েছেন, ছেলের দ্বারা আর যা-ই হোক, ব্যবসা হবে না। ফলে অর্থাভাবে বন্ধ হয়ে যায় বড়ুয়া ফিল্ম কোম্পানি। এতে মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েন তিনি।
সুসময় এল ১৯৩৩ সালে। নিউ থিয়েটার্সে যোগ দিলেন তিনি। সেখানে তাঁর প্রথম সবাক ছবি ‘রূপলেখা।’ নায়িকা যমুনা দেবী। সেটি ছিল যমুনার ডেবিউ ছবি।
যে ছবি থেকে প্রমথেশ-যমুনার প্রেমপর্ব শুরু।
১৯৩৫ সালে বাংলা ও হিন্দিতে পরিচালনা করলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘দেবদাস’। বাংলায় দেবদাসের চরিত্রে তিনি আর পার্বতীর চরিত্রে যমুনা। হিন্দিতে দেবদাস হলেন কে এল সায়গল। শুধু মাত্র টেকনোলজি নয়, শট নিয়েও বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষা করলেন এই ছবিতে। ক্যামেরায় শট নেওয়ার ধরনধারণে, অনুপুঙ্খে ‘দেবদাস’ তখন নিঃসন্দেহে বৈপ্লবিক। চলন্ত ট্রেনের কামরায় উদ্ভ্রান্ত দেবদাস। কাট। পরের দৃশ্যে পার্বতী নৈবেদ্য নিয়ে ঠাকুরঘরে ঢুকছে। কাট। দেবদাস বলছে, ‘ধর্মদা, রক্ত’। কাট। পার্বতীর হাত থেকে থালা পড়ে গেল। মন্তাজ, ইন্টারকাটিং, ক্লোজ়আপ শট ব্যবহার করে নাটকীয়তা তৈরি করতেন ছবির পরতে পরতে। ‘দেবদাস’ ইতিহাস তৈরি করল। শোনা যায়, উত্তমকুমার দেবদাসের চরিত্রটি পেয়ে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন স্রেফ বড়ুয়া সাহেবের ইমেজটা ভাঙতে পারবেন না বলে। উত্তমকুমার মনে করতেন, ‘দেবদাস’ মানেই প্রমথেশ বড়ুয়া। ১৯৩৬ সালে প্রমথেশের ‘গৃহদাহ’ ও ‘মায়া’ও বেশ হিট করল। এর পরে আর এক ঐতিহাসিক ছবি ‘মুক্তি’। এক বোহেমিয়ান শিল্পীর জীবন। এই ছবিটেও শট নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করেছিলেন। ‘মুক্তি’ই প্রথম ছবি, যেখানে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করা হয়েছিল। এর জন্য সানন্দ অনুমতি দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছবির নামকরণও তিনিই করেছিলেন। পঙ্কজ মল্লিক প্লেব্যাক করেছিলেন। আউটডোর হয়েছিল গৌরীপুরের জঙ্গলে। যেখানে তিনি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর প্রিয় হাতি জঙ্গবাহাদুরকে। ‘মুক্তি’ প্রমথেশ ও কাননদেবীর জুটিকেও হিট করে। সুপারহিট হয় ছবিটি। এর পরে পরিচালনা করেন ‘অধিকার’। তার পর মাত্র ২১ দিনে শুটিং শেষ করেছিলেন কমেডি ছবি ‘রজত জয়ন্তী’র। যা সেই সময়ে অকল্পনীয়। এত সাফল্যের পরেও ১৯৩৯ সালে নিউ থিয়েটার্স থেকে বেরিয়ে আসেন তিনি। চুক্তিবদ্ধ হন কে মুভিটোনের সঙ্গে। এই ব্যানারে তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি ‘শাপমুক্তি’। রবীন মজুমদার ও পদ্মাদেবী নায়ক নায়িকা। প্রমথেশ বড়ুয়ার হাত ধরে এই জুটিও বিখ্যাত হয়েছিল।
‘মুক্তি’ ছবিতে কানন দেবীর সঙ্গে
স্বপ্নভঙ্গ হলেও তিনি দমে যেতেন না। ১৯৪০ সালে মুরলীধর চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে একত্রে এম পি প্রোডাকশন তৈরি করেন। এই ব্যানারে প্রথম ছবি ‘মায়ের প্রাণ’। এর পরে ‘উত্তরায়ণ’। নায়িকা যমুনা দেবী। তার পর ‘শেষ উত্তর’। নায়িকা কানন দেবী। ছবিটি সুপারহিট হওয়ায় একই গল্প নিয়ে হিন্দিতে করেন ‘জবাব’। কিন্তু এম পি প্রোডাকশনের সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক টিকল না। পরিচালক, অভিনেতা হিসেবে সফল হলেও ব্যবসায় তিনি টিকে থাকতে পারছিলেন না। অন্তরায় হয়ে দাঁড়াত তাঁর মেজাজ। রাজরক্ত যে তাঁর শরীরে!
এম পি থেকে বেরিয়ে দু’বছর তিনি কোনও ছবি করেননি। আবার পরিচালনায় ফিরলেন ১৯৪৪-এ। করলেন ‘চাঁদের কলঙ্ক’। হিন্দি ভার্সন ‘সুবহ সাম’। ইন্দ্রপুরী স্টুডিয়োয় শুটিং হল। এ ছাড়াও প্রমথেশ ‘আমীরী’ এবং ‘রানী’, দুটি হিন্দি ছবি করেছিলেন। বাংলা ছবি ‘অগ্রগামী’-র পরে তিনি হাত দিলেন ‘মায়াকানন’-এ। ওটাই শেষ ছবি।
**
শিকার ও সিনেমার মতো প্রমথেশ তুখড় ছিলেন প্রেমেও। এই সুপুরুষ রাজপুত্রের জীবনে প্রেম এসেছে বারেবারে। আইরিশ, যমুনা দেবী, কানন দেবী...সেই সময়ের অধিকাংশ নায়িকার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়েছে একাধিকবার।
গৌরীপুরের জঙ্গলে, হাতির পিঠে শিকার
স্কুল পাশ করার পরেই প্রমথেশের মা ছেলের বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগেন। অত ছোট বয়সে বিয়ে নিয়ে আপত্তি ছিল প্রমথেশের। কিন্তু মা’র কথা তিনি অমান্য করতে পারলেন না। ‘‘প্রমথেশ বড়ুয়ার প্রথম স্ত্রী মাধুরীলতা। তিনি বাগবাজারের মিত্র পরিবারের মেয়ে। এই বিয়ের ঘটকালি করেছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসের আশীর্বাদধন্য মা গৌরীদেবী। ১৯২১ সালে বিয়ে হয়েছিল তাঁদের,’’ বললেন রাই। এর পরে আরও দু’বার বিয়ে করেছিলেন প্রমথেশ। মাধুরীলতা কিন্তু বন্ধুর মতো সারা জীবন পাশে থেকেছেন। সব রকম বিপর্যয়ে উদারতা দেখিয়েছেন। মেনে নিয়েছিলেন স্বামীর একাধিক পরকীয়া। অর্থাভাবে যখন প্রমথেশের শখের স্টুডিয়ো বন্ধ হয়ে গেল, মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। সেই সময়ে তাঁর জীবনে এসেছিলেন অসমের লক্ষ্মীপুরের জমিদারবাড়ির মেয়ে অমলাবালা। ‘‘অমলাবালার পরিবারের সঙ্গে গৌরীপুর রাজবাড়ির যোগাযোগ পুরনো। ওঁরা পরস্পরকে চিনতেন। অমলাবালাকে তিনি আদর করে ‘ক্ষিতি’ ডাকতেন। কিন্তু সেই ক্ষিতির সঙ্গে বিয়ে প্রমথেশের বাবা মেনে নেননি। কারণ মাধুরীলতা ছিলেন রাজবাড়ির সেরা বধূ। তা ছাড়া সে সময় প্রমথেশ দুই পুত্রের জনক। ক্ষিতিকে বিয়ে করায় বাবার সঙ্গে সম্পর্কের ইতি ঘটে। যা জোড়া লাগেনি আর কখনও। পরবর্তী কালে ক্ষিতি অসুস্থ হলে তাঁকে গৌরীপুরে রেখে গিয়েছিলেন প্রমথেশ। নিজে যেতেন কম। িক্ষতি মারা যাওয়ার পর তাঁর ছেলে অরূপকুমারকে মাধুরীই বড় করেছিলেন,’’ বললেন রাই। প্রমথেশের তৃতীয় স্ত্রী যমুনা বড়ুয়া। যাঁকে কোনও দিনই গৌরীপুরের রাজ পরিবার স্বীকৃতি দেয়নি। প্রমথেশের সঙ্গে পরিচয় ছিল যমুনার দিদির। যিনি প্রমথেশের দুটি ছবিতেও অভিনয় করেছিলেন। কিন্তু একদিন দিদির সঙ্গে বোনকে দেখে প্রমথেশ ঠিক করেন, এঁকেই অভিনেত্রী হিসেবে গড়েপিটে নেবেন। শুরু হল আর এক প্রেমের অধ্যায়। ‘‘প্রমথেশ বড়ুয়ার মৃত্যুর অনেক পরে কলকাতার বাড়িতে যমুনাদেবীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। তখন আমি কলেজে পড়ি। বাড়ির অজান্তেই গিয়েছিলাম। তিনি আমাকে দেখে খুব অবাক হয়ে বলেছিলেন, ‘গৌরীপুর থেকে আমাকে কেউ দেখতে আসবে ভাবতেই পারিনি।’ সেই সময়ে তাঁর আর্থিক অবস্থা ভাল ছিল না। ওঁদের তিন ছেেল, দেবকুমার, রজত ও প্রসূন,’’ স্মৃতি রোমন্থন করলেন প্রমথেশের ভাগ্নি অনিতা বড়ুয়ার ছেলে বিক্রম গ্রেওয়াল।
একাধিক প্রেমের প্রসঙ্গে ভাইকে প্রমথেশ বলেছিলেন, ‘‘আমি তো এক-দু’জনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছি। বাকিরা হুমড়ি খেয়ে আমার উপর পড়লে আমার কী দোষ?’’
**
‘মায়াকানন’-এর শুটিং শেষ হওয়ার আগে বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রমথেশ। ১৯৪৮ সালে আবার চিকিৎসার জন্য যমুনা দেবীকে নিয়ে সুইৎজ়ারল্যান্ড গিয়েছিলেন। জানা গেল চরম রক্তাল্পতায় ভুগছেন তিনি। চিকিৎসার দরকার। েসখান থেকে ফেরার পথে গেলেন লন্ডন। তখনও তাঁর মাথায় রুপোলি পর্দা।
মাটিয়াবাগে গৌরীপুর রাজবাড়ির আউটহাউস
এ বার ‘এ জে আর্থার র্যাঙ্ক’ সংস্থার সঙ্গে পরিকল্পনা করলেন ইন্দো-ব্রিটিশ ছবি পরিচালনার। ১৯৫১ সালে চিকিৎসা করাতে তিনি আবার ইংল্যান্ড গেলেন।
লাভ হল না। সেই বছরেই ২৯ নভেম্বর লাইট, ক্যামেরা, সেট সব ফেলে চলে গেলেন প্রমথেশ। গৌরীপুর নয়, আরও দূরে। সেখানে প্রেম, কুয়াশা, প্রজাপতি আর নৈঃশব্দ্য একাকার হয়ে যায়। বাকিরা জানতে পারে না।
ঋণ: রবি বসু (বড়ুয়া সাহেব)
অমিয় সান্যাল (চলচ্চিত্রকার প্রমথেশচন্দ্র বড়ুয়া)
ছবি (বিক্রম গ্রেওয়াল ও আনন্দবাজার আর্কাইভ)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy