বাবু মস্ত হাতি আর বাবু দানা দু’জনের বাংলা-ইংরেজি নিয়ে কথা হচ্ছে।
মস্ত হাতি বললেন, ইংরেজির থেকে বাংলা ভাষা ঢের ভালো, বাংলা সুপিরিয়ার ইংরেজি ইনফিরিয়ার। ইংরেজি হল হাফ ডজন ভাষা থেকে তৈরি। আর বাংলা হল সংস্কৃতের বাচ্চা। সোজা সংস্কৃত থেকে তার জন্ম।
পাঁচমিশেলি হ-য-ব-র-ল ইংরেজির সঙ্গে কুলীন বাংলার তুলনাই চলে না ।
তাছাড়া ইংরেজ এই ভারতে আর ক’জন? গুটিকয় মাত্র। তাঁরা বাংলাটা শিখে নিলেই পারেন।
শুনে আংরেজ বাবু দানা কী আর করেন! ইংরেজিতে ‘ও রাম রাম’ বলতে লাগলেন।
রামনামে যদি বাংলার ভূতের হাত থেকে কোনওক্রমে বাঁচা যায়!
এই মস্ত হাতি আর বাবু দানার স্রষ্টা রাজা রামমোহন রায়। হাতি-দানা এই দু’জন রামমোহনের ইংরেজিতে লেখা কৌতুক নাটিকার চরিত্র, লেখার নাম ‘দ্য ইংলিশ ইন ইন্ডিয়া শ্যুড অ্যাডপ্ট বেঙ্গলি অ্যাজ দেয়ার ল্যাঙ্গুয়েজ’।
ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় পরে ‘মডার্ন রিভিউ’-তে রামমোহনের এই পুরনো লেখাটি খুঁজে-পেতে ছেপেছিলেন।
রামমোহন নিজে বহুভাষী, আরবি-ফারসি-উর্দু-সংস্কৃত-বাংলায় চোস্ত। ইংরেজি রপ্ত করেছিলেন পরে।
জন ডিগবির দেওয়ান হিসেবে কাজ করার জন্য তাঁর ইংরেজি শেখা। ক্ষমতা, টাকা-পয়সা ক্রমে ক্রমে ইংরেজদের হাতে চলে গেছে। ভারতীয়রা বুঝতে পেরেছে ইংরেজি না শিখে উপায় নেই। রামমোহনও এই দলেই। দেশজ দর্শন আধ্যাত্মিকতার চেয়ে পশ্চিমি জ্ঞান-বিজ্ঞান যে ঢের কাজের সে কথাও মানেন রামমোহন। তবে মনের ভেতর কোথাও থেকে যায় উলটপুরাণের বাসনা। রাম রাম বলতে বলতে ইংরেজরা বাংলা শিখছে, এ ছবি আঁকেন।
• • •
রামমোহন যে সময়ের লোক সে সময় এ কাণ্ড যে একেবারে হত না, তা কিন্তু নয়।
রামমোহন তো পুরোপুরি উনিশ শতকের নন, তাঁর জীবনযাপনের অনেকটাই অষ্টাদশ শতকের।
অষ্টাদশ শতক। পলাশি-বক্সারের পর কোম্পানির দেওয়ানি লাভ। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের পরিকল্পনা ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিচ্ছে ।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তখন ভারতবর্ষের নানা মুলুকে ধীরে ধীরে রয়ে-সয়ে কৌশলে বাণিজ্যবিস্তার করছে।
খ্রিস্টধর্ম প্রচারের জন্য নানা মাপের ধর্ম-যাজকদের যাতায়াত শুরু হয়েছে। কোম্পানির কর্তাদের আর ধর্ম-যাজকদের কনফিডেন্স তখন বেশ কম। নেটিভ ভারতীয়দের কাছে ‘সাহেবরা’ তখন সবাই তেমন কেউ-কেটা নন।
ভারতীয় অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থাতেও কোম্পানির প্রভাব তেমন পড়তে শুরু করেনি। ফলে নেটিভরা সাহেবি ইংরেজি ভাষা শিখতে যাবে কোন দুঃখে! বরং সাহেবরাই একটু লো-প্রোফাইল।
স্থানীয় লোকেদের মন না পেলে ব্যবসা মার খাবে। তাঁদের চটিয়ে তো আর ব্যবসা করা যায় না।
তার থেকে দেশজ ভাষা শিখে স্থানীয় লোকদের মন রাখলে শ্যাম-কুল দুই বজায় থাকবে।
এই প্রয়োজন থেকেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে কিংবা স্বাধীন ভাবে ভাগ্যান্বেষণে আসা সাহেবরা ভারতীয় ভাষা শিখতে শুরু করেন।
• • •
এমনিতে ভারত তো নানা ভাষার দেশ। সব ক’টা ভারতীয় ভাষা সাহেবদের পক্ষে রপ্ত করা শক্ত।
ভারতীয় ভাষার মধ্যে যে ভাষাগুলো বেশি লোকে বলে, যে সমস্ত ভাষার প্রভাব প্রতিপত্তি বেশি সেই ভাষাগুলোই শেখার চেষ্টা করলেন তাঁরা।
রীতিমতো মাস্টার রেখে কলেজ তৈরি করে সাহেবদের ভারতীয় ভাষা শিখতে হত।
আরবি, ফারসি, হিন্দুস্থানি, সংস্কৃত আর বাংলা— এই কয়েকটি ভাষা সাহেবদের ভাষা শিক্ষার প্রয়োজনের তালিকায় বিশেষ ভাবে জায়গা করে নিয়েছিল ।
• • •
বিদেশের মাটিতে বহু ভারতীয় অষ্টাদশ শতকে ভারতে আসতে চাওয়া সাহেবদের ভারতীয় ভাষা শিখিয়েছেন।
এঁদের কীর্তি-কলাপ নিয়ে চমৎকার বই লিখেছিলেন মাইকেল ফিশার— কাউন্টার ফ্লোস টু কলোনিয়ালিজম।
মুনশি মাহমেত লন্ডনের খবরের কাগজে রীতিমতো বিজ্ঞাপন দিতেন— ফারসি ও আরবি শেখান তিনি। সে বিজ্ঞাপনের টানে ভারতমুখী সাহেবরা লন্ডনে তাঁর কাছে লাইন দিতেন।
আবু তালিব ফারসি গৃহশিক্ষক হিসেবে লন্ডনে ছিলেন। ভারতে এশিয়াটিক সোসাইটির কর্ণধার উইলিয়াম জোন্সের ওপর তখন তিনি বেশ বিরক্ত।
জোন্সের লেখা ফারসি ব্যাকরণ বই পড়ে তাঁর কাছে যে সাহেবরা আসতেন, তাঁদেরকে তাঁর পক্ষে ফারসি শেখানো মুশকিল হত।
জোন্সের ব্যাকরণ নানা ভুলে ভরা। ফলে ভুলগুলোকে প্রথমে শুধরে তারপর ফের নতুন করে শেখানো। তার থেকে যাঁরা কিছুই পড়েননি তাঁদের প্রথম থেকেই ঠিক মতো ভাষা শেখানো যায়।
জোন্সের ভাষাবিদ হিসেবে যতই নাম-ডাক থাকুক না কেন, আবু তালিবের মতো তো আর জোন্স নেটিভ স্পিকার নন।
• • •
আবু তালিব আর মুনশি মাহমেত বঙ্গবাসী। লখনউ থেকে সেকালে বিলেতে গিয়েছিলেন মির্জা মহম্মদ। তিনিও বিলেতে ভাষা শিক্ষকের কাজ জুটিয়ে নিয়েছিলেন।
সুসংস্কৃত ব্রিটিশরা ভারতে যাওয়ার আগে চাইলেই লখনউয়ের মির্জা মহম্মদের কাছে আরবি-ফারসি-হিন্দুস্থানি শিখে নিতে পারেন এই মর্মে কাগুজে বিজ্ঞাপন।
বিলেতের এই ভারতীয় ভাষা শিক্ষকেরা ভারতীয় ভাষা শেখাবেন বলেই কিন্তু বিলেতে আসতেন না। তাঁরা ভারত থেকে দেশে ফেরা কোনও না কোনও সাহেবের সঙ্গ নিতেন— সাহসী ভাগ্যান্বেষী সেই ভারতীয়রা তারপর বিলেতে পেট চালাতে ভাষা শিক্ষক হয়ে উঠতেন।
মির্জা মহম্মদ জন মারির সঙ্গে ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে বিলেতে আসেন।
• • •
ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্ক কখনও কখনও খুবই গভীর। কর্নেল গ্রাহামের কাছে ফারসি ভাষার অনুবাদক হিসেবে কাজ করতেন হিন্দু বাঙালি ঘনশ্যাম দাস। ইসলামি ও হিন্দু আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি বিলেতে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। স্যার এলিজা ইম্পের খুবই আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন ঘনশ্যাম।
মহারাজ নন্দকুমারকে অন্যায় ভাবে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে বলে যখন বিচারক এলিজা ইম্পে অভিযুক্ত, তখন ঘনশ্যাম ইম্পের পক্ষ নিয়েছিলেন।
হিন্দুধর্ম ছেড়ে পরে তিনি খ্রিস্টান, নাম বদলে হন রবার্ট ঘনশ্যাম দাস। কৃতজ্ঞ ইম্পে রবার্ট ঘনশ্যামের পেনশনের ব্যবস্থাও করেছিলেন।
• • •
বিলেতেই যে সাহেবরা সব সময় ভারতীয় ভাষা শিখতেন তা নয়। ভারতে গিয়েও ভারতীয় ভাষা শিখতে হত।
ভাষা শেখার জন্য সাহেবদের ব্যাকরণ বই ভরসা। সে ব্যাকরণ বই লেখা হত ইংরেজি ভাষায়। সঙ্গে থাকত বাংলা ভাষার নানা উদাহরণ। সেই উদাহরণ বাংলা হরফে লেখাই দস্তুর ।
ইংরেজিতে লেখা ভারতীয় ভাষার ব্যাকরণ নেটিভদের সব সময় পছন্দ হত না— আবু তালিব জোন্সের লেখা ফারসি ব্যাকরণের ওপর খাপ্পা। তবু ব্যাকরণের প্রয়োজন অস্বীকার করার উপায় নেই।
১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে হ্যালহেড লিখলেন তাঁর ‘আ গ্রামার অব দ্য বেঙ্গল ল্যাঙ্গুয়েজ’।
সেই ব্যাকরণ বইয়ের আখ্যাপত্রে বাংলা হরফে লেখা ছিল ‘বোধপ্রকাশং শব্দশাস্ত্রং ফিরিঙ্গিনামুপকারার্থং ক্রিয়তে’। ফিরিঙ্গি অর্থাৎ সাহেবদের উপকারের কথা ভেবেই এই শব্দশাস্ত্রের বোধপ্রকাশকারী বইটি লেখা।
বলে নেওয়া দরকার, এই বইয়ের জন্যই কিন্তু প্রথম বাংলা সচল টাইপের সৃষ্টি। পঞ্চানন কর্মকার ছাপার জন্য বাংলা হরফের সাঁট বানিয়ে দিয়েছিলেন।
• • •
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সিভিলিয়ানদের ভারতীয় ভাষা শেখানোর জন্য ওয়েলেসলির উদ্যোগে গড়ে তোলা হয়েছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ।
সেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে বাংলা বিভাগের দায়িত্ব নিলেন উইলিয়াম কেরি।
১৮০১-এর ৪ মে কেরি কলেজে যোগ দিলেন। কেরি ধর্মপ্রচারক। শ্রীরামপুর মিশনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
১৮০১-এ শ্রীরামপুর মিশন থেকে বাইবেলের নিউ টেস্টামেন্টের বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হল।
ওয়েলেসলি বুঝলেন এই কেরিকে তাঁর দরকার।
কেরি খুবই কাজের মানুষ, বাংলা ছাড়াও মরাঠি ভাষা জানতেন তিনি। ১৮০৪-এ কেরির বেতন সাতশো টাকা। তখনকার দিনে সে অনেক অনেক টাকা।
উইলিয়াম জোন্স অক্সফোর্ডের গ্র্যাজুয়েট। বহুভাষাবিদ। ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রাচ্যবিদ্যাচর্চার জন্য এশিয়াটিক সোসাইটি গড়ে তুললেন।
জোন্স তো সংস্কৃত ভাষার মহিমায় মুগ্ধ। এ ভাষা ইউরোপের লাটিন গ্রিকের থেকেও নাকি ভালো, অনুকরণযোগ্য।
সংস্কৃত ভাষাকে পছন্দ করলেও জোন্স বাংলা ভাষাকে মোটেই পছন্দ করে না। সে ভাষা নাকি ভুলে ভরা, পাতে দেওয়ার যোগ্যই নয়। রামমোহনের মস্ত হাতি ইংরেজি সম্বন্ধে দানাকে যে কথা বলেছে সে কথাই জোন্স বাংলা সম্বন্ধে বলেছেন। তবে কেরি বুঝে ফেললেন মুখের ভাষা হিসেবে বাংলা ভাষাকে ‘ওয়াক থু’ করলে মোটেই চলবে না।
বাণিজ্য ও প্রশাসন চালাতে গেলে বাঙালির মুখের ভাষা তা ভুলে ভরা হোক আর যাই হোক, সাহেবদের শিখতে বুঝতে হবে বইকী!
লেখার ভাষা আর মুখের ভাষার চরিত্র আলাদা। তবে মুখের বাংলা ভাষাও রপ্ত করা চাই। মুখের ভাষা রপ্ত না করলে নেটিভদের সঙ্গে যোগাযোগই তো করা যাবে না। কেরি ‘কথোপকথন’ নামে চমৎকার একটি গ্রন্থ সংকলন করলেন।
বঙ্গভাষীদের নানা জনের মুখের ভাষার নমুনার সংকলন সে বই। জমিদার-রাইয়ত, মাইয়া কন্দল, ভিক্ষুকের কথা, ঘটকালি, মজুরের কথাবার্তা, ভোজনের কথা —স্পোকেন বাংলা শেখার নানা আয়োজনের সে বই।
সাহেবরা কেমন বাংলা বলত?
‘বেহারা চৌকি মেজ মার্জ্জন কর।’
‘মসারিটা চিরিয়াছে।’ ‘কল্য সরকারকে হুকুম দেহ আর একটার কারণ।’
‘তুমি আমাকে প্রথমে বাঙ্গালি কথা ও কায কামের লেখা পড়া শিক্ষা করাও।’
‘আমার পরিতোষ হইয়াছে।’
সাহেবের মুখের বাংলা একটু সংস্কৃত ছোঁয়া— মার্জ্জন, কল্য, শিক্ষা করাও, পরিতোষ, এসব সাধু বাংলা।
কেরির বইয়ের দেশজদের বাংলা কিন্তু অনেক সময়েই সংস্কৃতের ধারপাশ দিয়ে যায়নি।
মেয়েদের কোন্দল কান পেতে শোনার মতো।
পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে একজন বাড়ি ফিরেছে, বাড়ির অন্য বৌটিকে কাজ করতে হয়েছে বলে সে বেজায় খাপ্পা। ‘পাড়াবেড়ানি’ মেয়েটি ঘরের মেয়েটিকে বলেছে, ‘তোর যে বড় ঠেকারা হইয়াছে এক দিন কায করিয়া এত কইস। আমি তোর সকল জানি।’
আর যায় কোথায়। ঘরের মেয়েটি গলা তুলেছে।— ‘পুতখাকী তুই আমার কি জানিস। তোর মত পাড়া২ মরদের কাছে আমি যাই না।’ কেরির ‘কথোপকথন’ ১৮০১-এর বই থেকে পাওয়া।
জোন্সের মতো সংস্কৃতের শুচিবায়ুগ্রস্ততা কেরির নেই। তবে সাহেবদের মুখের ভাষাকে তিনি ভদ্র-সভ্য সংস্কৃত মাখা করে তুলতে চান, দেশজদের জন্য সে বালাই নেই । তারা যেমন-তেমন বলুক। পাড়ায় পাড়ায় মরদের কাছে ঘোরার মতো কুঁদুলে মেয়েলি কথা তিনি সংকলন করেছিলেন, যে কোনও ভাষার জ্যান্ত চেহারা তো মুখের ভাষাতেই ধরা পড়ে।
শাশুড়ি কেরির বইতে মুখ শানিয়েছিলেন।— ‘সকল কাজি বড় বৌ করে ছোট বৌডা বড় হিজল দাগুড়া অঙ্গ লাড়ে না’।
বাঙালির ঘর-সংসারের ছবি উঠে আসছে এই সাহেবি সংকলনে।
• • •
তবে কেরি লেখার বাংলার শরীরে শিষ্টতা বজায় রেখেছিলেন। ১৮১২-য় কেরির ‘ইতিহাসমালা’ প্রকাশিত হল।
ইতিহাসমালার গল্পগুলো মোটেই মুখের ভাষায় লেখা নয়। আর কেরি তার বাংলা ব্যাকরণের গোড়ায় চতুর্থ সংস্করণের ভূমিকায় স্বীকারই করে নিলেন বাংলা অন্যান্য ভারতীয় ভাষার থেকে সংস্কৃত ভাষার অনেক কাছাকাছি।
এটা বলে দিলে বাংলা ভাষার মান-মর্যাদা ফুলে ফেঁপে ওঠে। জোন্স সংস্কৃতকে লাটিন গ্রিকের থেকেও উত্তম বলেছেন। সুতরাং সংস্কৃতের কাছ-ছোঁয়া বাংলাও কুলীন না হয়ে যায় না।
বাংলাকে সংস্কৃতের কাছাকাছি ভাষা প্রমাণ করলে সাহেবদের আরেকটা উদ্দেশ্যও সফল হয়। মুসলমান শাসকদের কাছ থেকে সাহেবরা ক্ষমতা দখল করেছিল। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে বঙ্গদেশে সাহেবদের কাছাকাছি যাদের বেশি ঘোরাফেরা তাদের মধ্যে উচ্চবর্ণীয় হিন্দুদের সংখ্যাই বেশি। মুসলমানরা সাহেবি শিক্ষা ও সাহেবি ব্যবস্থাপনা থেকে তখন একটু দূরেই ছিলেন। এই সুযোগে হিন্দু বাঙালিরা কেউ কেউ বাংলা ভাষাকে ‘সংস্কৃতায়িত’ করে তুলতে চাইলেন। সাহেবদের কাছে চাকরি-বাকরি তাঁরাই পাচ্ছেন ।
কেরির বইতে সাহেব একটা মোক্ষম কথা বলেছিলেন, ‘তুমি আমার চাকর থাকিয়া শিক্ষা করাইবা আমাকে।’
মুনসি চাকর কাম শিক্ষক কিংবা শিক্ষক কাম চাকর। বাঙালি মুনসি আর পরবর্তী ভদ্রলোকেরা অনেকেই এই চাকরত্ব মেনে নিয়ে সাহেবি মতলবে তাল মিলিয়েছিলেন ।
জয়গোপাল তর্কালঙ্কার ছিলেন বিদ্যাসাগরের মাস্টারমশাই। সংস্কৃত কলেজে ষাট টাকা বেতনের চাকুরে। তিনি মনে করতেন মুসলমান শাসনের থেকে সাহেবদের শাসন ভাল।
সাহেবদের আমলে বাংলা ভাষা থেকে তাই যতটা সম্ভব ‘যবন’ শব্দ বাদ দেওয়া চাই। এতেই সাহেবদের মন পাওয়া যাবে। ১৮৩৮-এ লিখলেন ‘পারসীক অভিধান’।
দাওয়াই দিলেন ‘খরচ’ লেখা চলবে না, ‘ব্যয়’ লিখতে হবে। ‘কম’-এর বদলে লিখতে হবে ন্যূন। সে বিধান অবশ্য চলেনি। সাধারণ বাঙালি জয়গোপালি দাওয়াই মানেনি ।
এমনিতে ব্যবসা প্রশাসন চালানোর জন্য, ধর্ম প্রচারের জন্য সাহেবদের নিজের স্বার্থেই এই বাংলা চর্চা।
আইনের অনুবাদ করে, দলিল দস্তাবেজ ধর্মগ্রন্থ পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞানের বই বাংলায় লিখে অনেক দিনই বাংলা চর্চায় মনোযোগী হয়েছিলেন তাঁরা।
তারপর রাজনীতির গতিতে ঘটনাক্রমে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাত থেকে রানির হাতে ক্ষমতা চলে গেল।
বাঙালি হিন্দুরা কোম্পানির শাসনের শেষের দিকে ও রানির শাসনের গোড়া থেকে চাকরির জন্য সাহেবদের ভাষা শিখে নিল। ফলে সাহেবদের কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া বাংলা শেখার তত দায় আর রইল না।
বাঙালি নেটিভরা গদ্যচর্চায় হাত দিলেন। সাহেবদের থেকে তাঁদের বাংলা চর্চার উদ্দেশ্য বিধেয় আলাদা। তবে সাহেবরাই তো নেটিভদেরকে শিখিয়েছিলেন নিজেদের ভাষা শিক্ষার পদ্ধতি স্থির করতে হবে, নানা কাজের জন্য গদ্য চর্চা করতে হবে।
সংস্কৃত ভাষার মতো বিপুল জ্ঞানভাণ্ডার বাংলা-হিন্দি-অসমিয়া-ওড়িয়ার মতো নব্যভারতীয় ভাষাগুলির ছিল না । সাহেবদের দেশি ভাষা চর্চার প্রকার-পদ্ধতি তাদেরকে পরবর্তী কালে সাহায্য করেছিল সন্দেহ নেই। তবে যে কোনও পদ্ধতিরই তো সীমাবদ্ধতা থাকে, সাহেবি ভাষাচর্চার পদ্ধতি যেমন বাংলাকে সাহায্য করেছে, তেমনই কোনও কোনও ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার চরিত্র সাহেবরা ধরতে পারেননি। গণ্ডগোল পাকিয়েছেন।
আবার তাঁরা সাদামানুষ বলে, যত দিন গেছে, এদেশের কালোমানুষেরা তাঁদের সিদ্ধান্তকেই শিরোধার্য করেছেন।
সবাই তো আর রবি ঠাকুর নন যে সোজা সাপটা বলবেন, ‘‘বাঙালির ইংরেজি-ভুলে ইংরেজরা সাধারণত দেবত্ব প্রকাশ করেন না।’’
সুতরাং যে ইংরেজরা বাংলা শেখার সুযোগ পেয়েও বাংলা ভুল করেন ‘‘তাঁহাদের প্রতি হাস্যরস বর্ষণ করিয়া পালটা জবাবে গায়ের ঝাল মিটাই।’’
পুনশ্চ: রবীন্দ্রনাথের থেকে এখনকার সময় অবশ্য আলাদা। ইংরেজ উপনিবেশ আর অবশিষ্ট নেই। রানির ইংরেজির দেমাক গিয়েছে। ইংরেজি এখন নানারকম। আর আমরাও নানারকম বাংলা মেনে নিয়েছি। শুদ্ধ ‘একরকম’ বাংলা আর কতজনই বা বলেন। এমন করেই চলছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy