স্পেক্টঅ্যাক্টরস প্রযোজিত এবং সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় নির্দেশিত সাম্প্রতিকতম প্রযোজনা ‘ভাদ্রজা’র দ্বিতীয় অভিনয় প্রদর্শিত হল সম্প্রতি মিনার্ভা মঞ্চে। মানভূমের জাদু-আখ্যান অবলম্বনে রীতিমতো গবেষণা ও ক্ষেত্রসমীক্ষার মধ্য দিয়ে সুদীপ্ত নির্মাণ করেছেন এর কাহিনি। সাদামাঠা বর্ণনাংশের চেনা পথে তাই তিনি হাঁটেননি। আঠেরো শতকের তীব্র টালমাটাল রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে মানভূমের রাজা মাহতাব সিংহ দেও কর্তৃক ভাদুপুজো প্রতিষ্ঠার ইতিবৃত্তের সঙ্গে সমান্তরালে রেখেছেন এই রাজবংশেরই আধুনিক সময়ের উত্তরপুরুষ রাজা প্রতাপ সিংহ দেওর কাহিনিকে।
ভাদু আখ্যান কতটা সত্যি, কতটাই বা মিথ? সেই আখ্যানে সামন্ততন্ত্রের নির্লজ্জ আধিপত্য থেকে পুরুষতন্ত্রের নৃশংস প্রতাপ কী ভাবে প্রজন্মবাহিত রক্তের ভিতর বাসা বেঁধে, আধুনিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় নারীকে ‘দেবী’ বানিয়ে পুরুষেরই কামনা ও লালসা পূরণের পথ প্রশস্ত করে, তার আশ্চর্য বয়ান নির্মাণ করেছেন সুদীপ্ত। অতীতের আখ্যান থেকে বর্তমানের বাস্তব— কখনও ফ্ল্যাশব্যাকে, কখনও ফ্ল্যাশফরওয়ার্ডে ঘন ঘন ওভারল্যাপে মিথ ও বাস্তবের দ্বান্দ্বিকতায় টানটান হয়ে ওঠে এর নাট্যশরীর।
নাট্য পরিবেশনে একই অভিনেতা বা অভিনেত্রীকে দিয়ে একাধিক চরিত্রে অভিনয়ের কৌশলে ওই দ্বান্দ্বিক বিন্যাস আরও চমৎকার এবং দুর্দান্ত এফেক্টিভ হয়ে ওঠে। খুব দক্ষ অভিনেতা-অভিনেত্রী ছাড়া এ ধরনের নাট্য বয়ানকে রূপায়িত করা বেশ বিপদের। যদিও সুদীপ্তর হাতে তৈরি হয়েছেন এমনই ক’জন দক্ষ কুশীলব। পার্বতী, রানিমা এবং রাজবধূ নিরুপমা—একই সঙ্গে তিনটি চরিত্রে অভিনয় করা অরিজিতা মুখোপাধ্যায় যেন এই দলের নিউক্লিয়াস। তাঁর অভিনয়দক্ষতা, বৈচিত্র, বিশেষ করে অনায়াস শরীরী সঞ্চালন ও সংলাপ উচ্চারণ দর্শককে নিছক মুগ্ধই করে না, বরং অভিনয়ের অতলস্পর্শী এক গভীরতায় তাঁর মগজকে ক্রিয়াশীল করে। তেমনই শক্তিশালী রূপায়ণ সৌম্য সেনগুপ্তর দুই প্রজন্মের রাজার ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় অভিনয়ের দক্ষতা। একই ভাবে নবীন অভিনেতা শ্রমণ চট্টোপাধ্যায়ের মাতান রীতিমতো শিহরন জাগায়। অথচ সেই তুলনায় ভাদু এবং সহেলির দুই স্বতন্ত্র চরিত্রে আর্যা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রাণপণ চেষ্টা সত্ত্বেও দর্শকমন ছুঁতে পারেননি শুধু তাঁর পরিশীলিত নাগরিক চেহারা ও অতি মার্জিত অ্যাপিয়ারেন্সের জন্য।
এই প্রযোজনায় চমৎকার কিছু ভাদু গান— রেকর্ডেড নয়, লাইভ পারফরম্যান্স— বুঝিয়ে দেয়, নির্মাণের দিক থেকে নির্দেশক কোনও ফাঁক রাখেননি। মৃগনাভি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গীত, বরুণ করের আলো যোগ্য সঙ্গত দিয়েছে। প্রায় সেটহীন মঞ্চে অসম পঞ্চভুজ একটি সাদা পর্দা পিছন থেকে প্রোজেকশনের সাহায্যে আলো প্রক্ষেপণে পুতুল-ছায়ায় তৈরি হওয়া ব্যঞ্জনা নিশ্চয়ই এফেক্টিভ। কিন্তু ওই পর্দাতেই যখন অরণ্য ও রাজবাড়ির প্রতিচ্ছবি, দৃশ্যরূপের সঙ্গে মিলিয়ে প্রায়শই আসে এবং চলে যায়, তখন মনে হয়— নির্দেশক এ সব ক্ষেত্রে দর্শকের কল্পনাশক্তির উপরে বিন্দুমাত্র বিশ্বাস করেন না!
মলয় রক্ষিত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy