ছবি: কুনাল বর্মণ
হলুদ মলাটের উপরে বড় লাল হরফে লেখা নাম। পাতা ওল্টালে ছবির সঙ্গে অক্ষর চেনার পালা। একটু এগোলেই মনের মধ্যে ছন্দের সুর তুলবে, ‘চেয়ে দেখ ঘন মেঘ ছেয়ে গেছে আকাশে। পাখিরা বাসায় ফেরে ডানা নেড়ে বাতাসে...’
বাচ্চাদের বইয়ে জাতীয় পতাকার বর্ণনা তো কতই থাকে! ক’জন আর লেখেন, ‘এতে তিনটি রং আছে। ঘাসের মতো সবুজ রঙ। দুধের মতো সাদা রঙ। আর গেরি মাটির মতো লাল রঙ’?
সুখলতা রাও লিখতেন। আর লিখতেন বলেই ‘সহজ পাঠ’ আর ‘হাসিখুশি’র সঙ্গে তাঁর ‘নিজে পড়’ আর ‘নিজে শেখ’-ও বাংলার শৈশবের সঙ্গে মাখামাখি হয়ে আছে। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বড় মেয়ে বলে নন, সুকুমার রায়ের দিদি বলে নন, সুখলতা তাঁর বহুমুখী কাজকর্ম আর লেখালিখির জন্য সাহিত্য, শিশুশিক্ষা আর নারীজাগরণের ইতিহাসে স্বমহিমায় উজ্জ্বল।
হাসি-তাতা আর ছোটবেলা
উপেন্দ্রকিশোর আর বিধুমুখীর প্রথম সন্তান সুখলতার জন্ম ১৮৮৬ সালে। সুখলতার নামকরণটির মধ্যেই উপেন্দ্রকিশোর সে আমলের চলতি ধারার তুলনায় অনেকখানি স্বকীয়তা নিয়ে এসেছিলেন। নরেন্দ্র দেব পরে লিখেছেন, ‘‘নামকরণের মধ্যেই উজ্জ্বল হয়ে উঠছে তাঁর মহান পিতার কল্পনার অভিনব ঐশ্বর্য। ...এ নাম কি এ পর্যন্ত আর দ্বিতীয় কারুর শোনা গেছে?’’ পরের বছর, অর্থাৎ ১৮৮৭-তে সুকুমারের জন্ম। সেই বছরই বেরোল রবীন্দ্রনাথের ‘রাজর্ষি’ উপন্যাস। সুখলতা আর সুকুমারের ডাকনাম তাই স্থির হল, হাসি আর তাতা।
সুখলতার পাঁচ-ছয় মাস বয়সেই ১৩ নম্বর কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের (এখন বিধান সরণি) বাড়িতে উঠে আসে উপেন্দ্রকিশোরের সংসার। তিনতলা বাড়ির বাইরের দিকে ব্রাহ্ম বালিকা শিক্ষালয়। ভিতরে বসতবাড়ি। প্রথমে ওঁরা থাকতেন তিনতলায়। তখন, সুখলতা লিখেছেন, বারান্দায় একটা পোষা চন্দনা খাঁচায় ঝোলানো থাকত। উপেন্দ্রকিশোর খাঁচার সামনে দাঁড়িয়ে বেহালা বাজালে চন্দনা ঘাড় কাত করে শুনত আর নিজে নিজে টুং টুং শব্দ করত! পরে ওঁরা সবাই নেমে এলেন দোতলায়, তিনতলায় রইলেন দ্বারকানাথ আর কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়। অতিথি-অভ্যাগত-আত্মীয়পরিজন আর ব্রাহ্ম বন্ধুসমাজের আসা যাওয়ায় বাড়িটা সব সময় গমগম করত।
গান, বেহালা, সেতার, পিয়ানো, অর্গান, ছবি আঁকা— সন্তানদের জন্য সব রকম শিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। সুখলতা আজীবন বলতেন, ‘‘আমার সব প্রেরণার মূলে তিনি।’’ সুখলতা-সুকুমাররা মোট ছ’ভাইবোন (পুণ্যলতা, সুবিনয়, শান্তিলতা, সুবিমল), তার সঙ্গে কাদম্বিনীর ছেলেমেয়েরা আর রামচন্দ্র বিদ্যারত্নের মেয়ে সুরমা (লীলা মজুমদারের মা)— এঁরা একসঙ্গে বড় আনন্দের মধ্য দিয়ে বড় হয়েছিলেন। লম্বা বারান্দায় প্রায়ই বসত ম্যাজিক, ছায়াছবি, হাসি-কৌতুকের আসর। পরবর্তী জীবনে সুখলতাও ছোটদের জন্য সেই সব হাসিখেলার আয়োজনের ধারাটি বজায় রেখেছিলেন।
সুখলতা নিজে অবশ্য সেই ছোট থেকেই একটু গম্ভীর। ‘ছেলেবেলার দিনগুলি’তে পুণ্যলতা লিখছেন, ‘‘দিদি সবার বড় আর খুব শান্তশিষ্ট। ছেলেবেলায়ও দিদিকে কখনও চেঁচামেচি করতে কিম্বা হুড়োহুড়ি করে খেলতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। শুনেছি ছোটবেলায় নাকি দিদির খুব অসুখ করেছিল। হাঁটতে এবং কথা বলতে শিখেও অসুখের জন্য ভুলে গিয়েছিল। আবার দাদার সঙ্গে সঙ্গে শিখতে শুরু করল।’’ সুখলতার স্বভাবটি তাই ছিল এক অদ্ভুত বৈপরীত্যে ঘেরা। লীলা মজুমদারের বর্ণনায় সুখলতা সেই মেয়ে, যাঁর সিংহীর মতো মনের জোর, অথচ আরশোলা দেখলে অজ্ঞান! এর পূর্ণ সুযোগটি নিতেন সুকুমার। সুখলতা স্কুলে যাওয়ার জন্য স্নান সেরে যেই ভাত খেতে বসলেন, সুকুমার এ ধার ও ধার তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘‘ডুলির নীচে লালচে ওটা কী?’’ ব্যস, ভাত খাওয়া মাথায় উঠল।
ময়মনসিংহ থেকে কলকাতায় ফেরা হচ্ছে একবার। সুকুমার বায়না ধরলেন, দেশের বাড়ি থেকে একটা হাতি নিয়ে যাওয়া হোক সঙ্গে করে। আঁতকে উঠেছেন সুখলতা, হাতি উঠলে নৌকা ডুবে যাবে তো! শুধু কি হাতি? তখন এখানে-ওখানে যেতে ঘোড়ার গাড়ির চলই বেশি। যদি এক ঘোড়ায় টানা গাড়ি এল তো চিন্তা হল— ঘোড়াটা কি পাগল? তাই ওর সঙ্গে আর কাউকে জোতা হয়নি? যদি দু’ঘোড়ায় টানা গাড়ি এল, তা হলে আবার ভয় ধরল— অত বড় দুটো ঘোড়ায় মিলে গাড়ি যদি উল্টে ফেলে?
সন্তান-সহ সুখলতা রাও
এ হেন সুখলতাকে একবার কী কারণে বকেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। বকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও।’’ ছোট্ট সুখলতা অমনি হাত দুটো উঁচু করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘এই বালা দুটো কি খুলে রেখে যাব?’’ আর দেখতে হল না! যে উপেন্দ্রকিশোর সেলাই কলে মেয়েদের জন্য নিজের হাতে জামা বানিয়ে দিতেন, তাঁর মনে কথাটা কোথায় গিয়ে বাজল, বুঝতে অসুবিধে হয় না। দু’হাত বাড়িয়ে মেয়েকে কোলে তুলে নিলেন, তাঁর চোখ ততক্ষণে ছলছল করছে।
ওড়িয়া সমাজের ভক্তকবি
সুখলতার পড়াশোনা শুরু হয় ব্রাহ্মবালিকা শিক্ষালয়েই। সেখান থেকেই এন্ট্রান্স পাশ করে ভর্তি হলেন বেথুন কলেজে। বৃত্তি পেয়ে এফ এ পাশ করলেন যখন, খুব খুশি হয়েছিলেন উপেন্দ্রকিশোর। মেয়েকে আনন্দে জড়িয়ে ধরে ছুটে গিয়েছিলেন বিধুমুখীকে খবরটা দিতে। তবে বি এ পরীক্ষাটা শেষ পর্যন্ত সুখলতার দেওয়া হয়নি। বি এ পড়তে পড়তেই তাঁর বিয়ে হয়ে যায় ১৯০৭ সালে। বিয়ে হল কটকের সুখ্যাত ডাক্তার জয়ন্ত রাওয়ের সঙ্গে। জয়ন্তর বাবা মধুসূদন রাও ছিলেন ওড়িশায় ব্রাহ্মসমাজ আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, কবি ও লেখক। বাংলায় যেমন ‘বর্ণপরিচয়’, ওড়িয়া ভাষায় তেমন মধুসূদনের লেখা ‘বর্ণবোধ’, ‘শিশুবোধ’। ওড়িয়া সমাজ তাঁকে ডাকত ভক্তকবি বলে। সুতরাং সুখলতা পিতৃগৃহে যে ভাবে মানুষ হয়েছিলেন, বিয়ের পরেও অনুরূপ একটি আলোকিত পরিবেশই পেলেন। এক দিকে সিভিল সার্জন স্বামীর সঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে তাঁর অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রটি প্রসারিত হল। বিভিন্ন ধরনের সমাজসেবামূলক কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার সুযোগ এল।
সেই সঙ্গে তাঁর আঁকা এবং সাহিত্যকর্মে জয়ন্তর পূর্ণ সহযোগিতা সুখলতা পেলেন। বরং বিবাহসূত্রেই বাংলা, ইংরেজির পাশাপাশি ওড়িয়া সাহিত্য এবং সংস্কৃতির সঙ্গে গভীর পরিচয় স্থাপন এবং বাংলা-ওড়িয়া মেলবন্ধনে
খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পেরেছিলেন সুখলতা।
লেখারও আগে আঁকার জন্য পরিচিতি
সুখলতার পাঠকেরা জানেন, সুখলতা আর সুকুমারের একটা বড় মিল ছিল। দু’জনেই ছোটদের জন্য প্রাণ খুলে লিখেছেন যেমন, সেই সঙ্গে নিজেরা ছবিও এঁকেছেন। উপেন্দ্রকিশোর নিজে ছবি আঁকতেন। ছেলেমেয়েদের মধ্যে আঁকার নেশাটি ধরিয়েছিলেন তিনিই। শশী হেস আর অবনীন্দ্রনাথের আঁকাও সুখলতাকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। লেখারও আগে আঁকার জন্য পরিচিতি পেতে শুরু করেছিলেন সুখলতা। ১৯০৬-০৭ সালেই কলকাতায় ভারতীয় কৃষি ও কারিগরি প্রদর্শনীতে তিনি তেল রং বিভাগে পদক পান। ১৯১০ সালে ইলাহাবাদে ইউনাইটেড প্রভিন্সেসের (এখনকার উত্তরপ্রদেশ) প্রদর্শনীতে জল রং বিভাগে পদক জেতেন। ওই বছরই ‘প্রবাসী’তে ছাপা হয় সুখলতার আঁকা ‘পূজারিণী’। পরের বছর ‘সাবিত্রী’।
আরও একটা তথ্য এখানে খেয়াল করার মতো। ১৯১৩ সালে ‘সন্দেশ’-এর আত্মপ্রকাশ। তার আগেই, ১৯১২ সালে কিন্তু সুখলতার প্রথম বই ‘গল্পের বই’ বেরিয়ে গিয়েছে। কুড়িটি ভিনদেশি রূপকথাকে সেখানে বাংলার ছেলেমেয়েদের উপযোগী করে উপস্থাপন করেছেন তিনি। ‘ভারতী’তে সে সম্পর্কে লেখা হয়েছিল, ‘‘গল্পগুলি টাটকা ফুলের মতোই সুন্দর, উপভোগ্য। লেখিকার ভাষাটিও বেশ সহজ— তাহাতে একটি সুর আছে— সুরটুকু একেবারে গিয়া প্রাণের তারে আঘাত দেয়... গ্রন্থে অনেকগুলি সুন্দর ছবি আছে, সেগুলি আবার গ্রন্থকর্ত্রীর স্বহস্তরচিত। বঙ্গনারীর হস্তে এমন চিত্র রচিত হয়— ইহা দেখিয়া শুধু আনন্দে নহে গৌরবেও আমাদিগের চিত্ত ভরিয়া উঠে।’’ অর্থাৎ ‘সন্দেশ’ বেরোনোর আগেই সুখলতা লেখক হিসেবে সমাদৃত। সাহিত্য গবেষক বারিদবরণ ঘোষ জানাচ্ছেন, উপেন্দ্রকিশোরের ‘সন্দেশ’ বেরোনোর আগে সুখলতা কিছু দিন ‘মুকুল’ সম্পাদনার কাজেও সাহায্য করেছিলেন। তবে ‘মুকুল’-এ লেখেননি কখনও। ‘গল্পের বই’-এর গল্পগুলো প্রথম থেকেই বই আকারে বেরোয়। এর পরে উপেন্দ্রকিশোর থেকে সত্যজিৎ রায়— ‘সন্দেশ’ যখন যে ভাবে বেরিয়েছে, সুখলতা সব সময়েই তার জন্য লিখেছেন।
‘সন্দেশ’-এর পাতাতেই তো একবার সুকুমার লিখলেন, ‘প্রফেসর হেশোরাম হুঁশিয়ারের ডায়েরি’। তার অল্প ক’দিন পরেই বেরোল সুখলতার ছবি আর কবিতা, ‘ঘুমের ঘোরে’ (১৯২৩)। ‘‘...স্বপ্ন দেখে সে হেন—/দেয়ালেতে চড়ে/ মন দিয়ে পড়ে/ ‘সন্দেশ’ নিয়ে যেন।/ হঠাৎ পিছনে তার,/ গলাটা বাড়িয়ে।/ হুবহু দাঁড়িয়ে/ গল্পের জানোয়ার...।’’ সঙ্গে ছবি, হেশোরামের ছবির আদলেই। ‘ছবিতে গল্প’ নামে এই কবিতা সিরিজ়টি অনেকের মতে বাংলার প্রথম কমিক স্ট্রিপ। রবীন্দ্রনাথ খুবই পছন্দ করতেন সুখলতার ছবি। ‘সন্দেশ’-এ তাঁর কবিতার জন্যও ছবি এঁকেছেন সুখলতা। আবার সুখলতা যখন ইংরেজিতে ‘বেহুলার গল্প’ অনুবাদ করলেন, সঙ্গে ছবি— বইয়ের ভূমিকা লিখে দিলেন রবীন্দ্রনাথ। পরবর্তী কালে কবির শতবর্ষে নিউ ইয়র্ক থেকে প্রকাশিত ‘রাজা ও রানী’ এবং ‘জাপান যাত্রী’র ইংরেজি অনুবাদ সুখলতারই করা। ‘ডিভায়োরিং লাভ’ এবং ‘আ ভিজ়িট টু জাপান’, বারিদবরণ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘‘অতি উচ্চ মানের অনুবাদ।’’
শিশুদের লেখা নয় শুধু, ছিল শিশুশিক্ষার ভাবনাও
ছোটদের লেখার ক্ষেত্রে সুখলতার বিচরণ ছিল নানা শাখায়— মৌলিক গল্প (‘দুই ভাই’, ‘খোকা এল বেড়িয়ে’, ‘আলিভুলির দেশে’), অনুবাদ গল্প (‘নানান দেশের রূপকথা’, ‘গল্প আর গল্প’, ‘সোনার ময়ূর’, ‘হিতোপদেশের গল্প’, ‘ঈশপের গল্প’), কবিতা (‘নূতন ছড়া’, ‘বিদেশি ছড়া’), গান, নাটক (‘বনে ভাই কত মজাই’, ‘বীর হনুমান’, ‘আজবপুর’, ‘পাখির দেশ’, ‘যাত্রাপথে’) পাঠ্যপুস্তক, জ্ঞানবিজ্ঞানের নিবন্ধ... সুখলতার মৃত্যুর পরে বঙ্গীয় সাহিত্যজগৎ তাই অনুভব করেছিল, সুখলতাকে হারিয়ে বাংলার শিশুসাহিত্য মাতৃহীন হল।
আক্ষরিক অর্থেই মাতৃহীন। সুখলতা তো ছোটদের জন্য শুধু গল্প বা ছড়া লিখে ক্ষান্ত হননি। সারা জীবন ধরে শিশুশিক্ষার উপযোগী নানা ধরনের লেখা লিখে যাওয়ার পরিশ্রম তাঁর মতো খুব কম লোকেই করেছেন। শুধু মাত্র বর্ণশিক্ষার জন্যই সাতটি বই লিখেছেন সুখলতা! এ বিষয়ে তাঁর প্রথম বই ‘পড়াশুনা’ প্রকাশিত হয় ১৯১৭ সালে। সেটি সম্পর্কেও ‘ভারতী’ লিখেছে, ‘‘শিশুর চিত্তবৃত্তি বুঝিয়া সহজ সরল ভাবে নারী যেমন শিশুর প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করিতে পারেন, পুরুষ কখনই তেমনটি পারেন না। সেই জন্যই এই গ্রন্থে মহিলা লেখিকা শিশুকে বর্ণ পরিচয় দিবার যে পন্থা নির্দেশ করিয়াছেন, তাহা শুধুই অভিনব নহে, তাহা সহজ হইয়াছে এবং কাজের হইয়াছে।’’ একই কথা প্রযোজ্য ‘স্বাস্থ্য’ (১৯২২) বইটি সম্পর্কেও। এই ধারাটি বজায় রেখেই এসেছে ‘নূতন পড়া’ (১৯২২), ‘নিজে পড়’ (১৯৫৬), ‘নিজে শেখ’ (১৯৫৭), ‘খেলার পড়া’ (১৯৬১), ‘নিউ স্টেপস’ (১৯৬৪), ‘নিজে পড়’-র ওড়িয়া সংস্করণ ‘আপে পড়’ (১৯৬৪)।
আসলে সুখলতা শুধু ছোটদের জন্য লিখতে ভালবাসতেন তা-ই নয়, ছোটদের সাহিত্য কেমন হওয়া উচিত বা উচিত নয়, এ বিষয়ে তিনি যথেষ্ট ভেবেছেন। এ নিয়ে তাঁর নির্দিষ্ট মতামত ছিল। সুখলতা চাইতেন, ‘শিশুসাহিত্য নির্মল হবে। তাতে কোনও প্রকার মন্দ ভাবের প্রশ্রয় বা গুরুজনদের প্রতি অশ্রদ্ধার ভাব থাকবে না। কারও প্রতি বিদ্বেষের বা অবজ্ঞার ভাব থাকবে না এবং মনে ব্যথা দিয়ে উপহাস বা আমোদ করা থাকবে না...।’ ‘প্রবাসী’তে ‘শিশুসাহিত্যে সুরুচি’ (১৯৩২) প্রবন্ধে যেমন তিনি লিখছেন, ‘‘আমাদের দেশে সেকালে কাঁটা দিয়া পুঁতিয়া ফেলার নিষ্ঠুর শাস্তি ভোগ করিতে হইত। সেই শাস্তির কথা শুনিয়া অনেক কোমলমতি বালক-বালিকার প্রাণ যে শিহরিয়া উঠে, তাহা আমি জানি। ‘বেশ হল, যেমন কর্ম তেমনি ফল’ এ কথায় তাহাদের মন সায় দেয় না, দেওয়া বাঞ্ছনীয়ও নয়।’’ স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র কাহিনি কথনরীতির সবটা তিনি অনুমোদন করতে পারছেন না। ‘রাজা তখনি বড়রাণিদিগে হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়া পুঁতিয়া ফেলিতে আজ্ঞা দিয়া সাত রাজপুত্র, পারুল মেয়ে আর ছোটরাণীকে লইয়া রাজপুরীতে গেলেন’— এমন বর্ণনা ছোটদের লেখায় না রাখাই ভাল বলে সুখলতা মনে করছেন। পরবর্তী কালে শিশু মনস্তত্ত্ব নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেছেন, তাঁরা অনেকেই এ ব্যাপারে সহমত।
রাশভারি ব্যক্তিত্বের আড়ালে ছোটদের খেলার সঙ্গিনী
শুধু বই পড়া নয়, ছোটদের দিয়ে নাচগান, নাটক করানোর উপাদানের কথাও সুখলতা সমান গুরুত্ব দিয়ে ভেবেছেন। লিখেছেন। পারিবারিক জীবনে এমন অনেক খেলা-নাটিকা ইত্যাদি তিনি ছোটদের দিয়ে করিয়েছেন। কল্যাণী কার্লেকরের লেখায় তার বিশদ বর্ণনা আছে। পর্দার পিছনে আলো দিয়ে কাগজের পুতুল নাড়ানো হত। তার ছবি পর্দায় ফুটে উঠত চলচ্চিত্রের মতো। আবার কখনও দেওয়ালে ছবি টাঙিয়ে সামনে রাখা হত মোমবাতি। আর সাবানজল দিয়ে বড় বুদবুদ তৈরি করে মোমবাতি আর ছবির মাঝে বসানো হত। মোমের আলো বুদবুদের মধ্য দিয়ে গিয়ে ছবির উপরে রামধনু তৈরি করত। ছোটরা ভারী মজা পেত। কল্যাণী লিখছেন, ‘‘আমাদের খেলার সঙ্গিনী মাসিমার সঙ্গে লোকপ্রসিদ্ধির রাশভারি সুখলতা রাওয়ের কোনও মিল ছিল না।’’
ছোটদের নিজেদের দিয়েও কি কম আনন্দ-অনুষ্ঠান করাতেন সুখলতা! যেমন একটা ছিল গুটিপোকা থেকে প্রজাপতি হয়ে ওঠার খেলা। ‘‘দড়িতে সার দিয়ে কোঁচানো কাপড় ঝোলানো হত। উপর দিকটা জড়ো করে দড়ির সঙ্গে বাঁধা আর নিচটা খোলা। একেক জন মেয়ে একেকটা ঘেরাটোপে গুটিপোকা হয়ে দাঁড়াবে। সঙ্গে গান, ‘পরাণ পুলকিত, দেহমন চমকিত/আজি কোন শুভক্ষণে ভাঙ্গিল এ ঘুমঘোর...।’ তার পর গুটি থেকে বাইরে এসে নতুন গান, ‘শোভন বিশ্বের শোভার মাঝে/ ফিরিয়া আইনু নতুন সাজে...’ এর জন্য নির্দিষ্ট সাজও ছিল। ওড়নার মাঝখানটা জড়ো করে আটকে দেওয়া হত পিঠে। দু’দিকের খোলা প্রান্তটার দুই কোণ সেফটিপিন দিয়ে আটকে দেওয়া হল চুড়ির সঙ্গে। এ বার হাত দু’টো পাশে তুললেই ডানা হয়ে গেল!’’
আর একটা ছিল প্রদীপ ভাসানোর নাচ। ওড়িশার লোকাচার বলে, মেয়েরা নদীতে প্রদীপ ভাসালে যার প্রদীপ যত দূরে যাবে, তার মনের ইচ্ছে ততখানি পূর্ণ হবে। এর জন্য মেয়েদের নিজস্ব গানও ছিল। সুখলতার অনুবাদে সেই গান হল— ‘আজি কি যামিনী আইল ওই/ আকুল মনপ্রাণ ধাইল ওই/
কম্পিত দীপখানি শঙ্কিত করে ধরি/ সঙ্গিনী সবে মিলি চলি গো যাই।’
অন্ধকার ঘরে পিরিচের উপরে মোমবাতির টুকরো বসিয়ে সে গানের সঙ্গে সার বেঁধে ছোটরা যখন নাচত, খুবই সুন্দর দেখাত।
ভাবনা আর লেখনী জুড়ে ওড়িয়া সংস্কৃতি
সুখলতার লেখায়, ভাবনায় সামগ্রিক ভাবেই ওড়িশার সংস্কৃতি অনেকটা জায়গা করে নিয়েছিল। সেখানকার প্রচলিত বহু ছড়া, গান সুখলতা অনুবাদ করে বাংলার শিশুসাহিত্যের পরিধিটি বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর একটি গোটা প্রবন্ধই আছে ‘উড়িয়া ছড়া’ নামে। ১৯৫২ সালে কটকে অনুষ্ঠিত প্রবাসী বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে তাঁর যে অভিভাষণ, তারও বিষয় ওড়িয়া শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাস, বাংলার সঙ্গে তার সাদৃশ্য এবং পারস্পরিক আদানপ্রদানের প্রয়োজনীয়তা। কালিন্দীচরণ পানিগ্রাহির ‘মাটির মনিষ’ উপন্যাস বাংলায় অনুবাদ করছেন সুখলতাই। তিনি বিশ্বাস করেছেন, প্রাদেশিকতা দোষে দুষ্ট হওয়াটা দেশের পক্ষে ক্ষতিকারক। ‘‘আমরা স্বার্থপর হয়ে পড়ছি, নিজের দেশের লোককেও সব সময়ে প্রসন্ন দৃষ্টিতে দেখতে পারছি না, প্রসন্ন মনে গ্রহণ করতে পারছি না। এতে করে আমাদের মনুষ্যত্বই ক্ষুণ্ণ হচ্ছে’’— সুখলতার এই কথাগুলো আজও যে কত প্রাসঙ্গিক, তার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন।
নিপুণা গৃহিণী অথচ সংসারী
ছিলেন না মোটেই
সুখলতার মননে আসলে ব্রাহ্ম মূল্যবোধের ভূমিকা অপরিসীম। বৃহতের সঙ্গে মিলনের আকাঙ্ক্ষাটি তাঁর অন্তর্গত। জীবনের অনেক শোকতাপ তিনি সামলেছেন সেই তদ্গত মনটি দিয়ে। ছয় সন্তানের মধ্যে তিন জনের মৃত্যু, ভাই সুকুমারের মৃত্যু— সহ্য করেছেন।
মেজ মেয়ে মণিকার মৃত্যুর সময়ে এক আশ্চর্য ঘটনার কথা লিখে রেখেছেন— সে দিন সকালে তিনি গৃহকর্মে ব্যস্ত। কানে এল পাখির ডানার শব্দ। পরিচারক একটি পায়রা এনে তাঁর হাতে দিলেন। সুখলতা লিখছেন, ‘‘ক্ষণপরেই একটা ধাক্কা এসে লাগল বুকের ভিতর এবং একটি নরম আলোর রশ্মি চোখের সামনে শূন্যে উদ্ভাসিত হল। সে আলোর ভিতর ফুটে উঠল ছবি— রোগশয্যায় কে শুয়ে আছে, মুখ দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তার কাপড়ের পাড় ভাঁজে ভাঁজে পড়েছে দেখা যাচ্ছে। সে হাত তুলল, তার হাতের চুড়িগুলি ঝিকমিক করে উঠল। বোধ হল সে হাত তুলে ডাকল আমায়, একান্ত আগ্রহে। অমনি ছবিখানা যেন কে টেনে সরিয়ে নিল। মিলিয়ে গেল আলোর রশ্মি।’’ একটু পরেই টেলিগ্রাম এল মণিকার শ্বশুরবাড়ি করিমগঞ্জ থেকে। শেষকৃত্যের পরে সুখলতা আর জয়ন্ত যখন ফিরছেন, স্টেশনে আবার এক ঘটনা। ‘‘অকস্মাৎ অন্ধকারের গায়ে দেখা দিল চাঁদের আলোয় গড়া সেই দেহ, ভেসে যাচ্ছে। তারপর ঠিক আগেরই মতো, ছবিখানা কে যেন সরিয়ে নিল। চকিতে একটি প্রখর আলো ছুটে এল আমার দিকে। ওঁকে ঠেলে দিয়ে বললাম, ও কিসের আলো? উনি বললেন, কই? দেখতে পেলেন না।’’
পরমের এই সাধনার পাশাপাশি আর এক মুক্তির জগৎও সুখলতার ছিল। সেটা, বলা বাহুল্য, তাঁর কাজের জগৎ। শুধু লেখালিখি নয়, আরও নানা ধরনের কাজে জড়িয়ে ছিলেন সুখলতা। কটকে ‘শিশু ও মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র’ গড়ে তোলা, ‘উড়িষ্যা নারী সেবা সঙ্ঘ’ প্রতিষ্ঠা করা, মহাযুদ্ধে আহতদের সেবার দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে রেড ক্রস সেবক বাহিনী গঠন করা। কাইজ়ার-এ-হিন্দ পদক (১৯৪৫-৪৬) তাঁর সেই সেবারই স্বীকৃতি। আবার সংসারের কাজেও তাঁর নৈপুণ্য বহুজনবিদিত ছিল। তিন রঙের থাক করা কেক-পুডিং-সন্দেশ বা ফুলপাতার নকশা অতিথিদের মুগ্ধ করত। কুশলতার সঙ্গে সংসার করেও কী করে সাংসারিকতায় নিমজ্জিত না থাকা যায়, সুখলতা যেন সারা জীবন ধরে সেটাই দেখিয়ে গিয়েছেন। লীলা মজুমদারের পর্যবেক্ষণ, ‘‘নিপুণা গৃহিণী হলেও বড়দি একটুও সংসারী ছিলেন না। চমৎকার রাঁধতেন, অতিথিসেবা করতেন, ঘর সাজাতেন। কিন্তু মন পড়ে থাকত লেখাপড়ায়, ছবি আঁকায়।’’
১৯৫৬ সাল থেকে সুখলতা আর জয়ন্ত কলকাতানিবাসী হলেন। কিড স্ট্রিটে বড় মেয়ে সুজাতার সঙ্গেই তখন থাকতেন ওঁরা। ‘নিজে শেখ’, ‘মাটির মানুষ’, ‘আলিভুলির দেশে’, ‘ঈশপের গল্প’র মতো আরও বহু বই কলকাতা পর্বেই বেরিয়েছে। রাষ্ট্রীয় পুরস্কার, ভুবনেশ্বরী পদকের মতো সম্মান এসেছে। ‘সন্দেশ’ নতুন করে বেরোতে শুরু করেছে। সুখলতার কর্মব্যস্ততায় কোনও দিন ছেদ পড়েনি। ১৯৬৫-তে মারা গেলেন জয়ন্ত। ক্যানসারে ভুগতে ভুগতে ১৯৬৯-এ সুখলতা। মৃত্যুর মাসখানেক আগেও লীলাকে বলেছিলেন শেষ না হওয়া লেখার কথা। বলেছিলেন, ‘‘যেখানে যা আছে, যার যা কাজে লাগে, দিয়ে দে। নষ্ট হলে আমার কষ্ট হবে।’’
৯ জুলাই ঘনিয়ে এল ঘুমের ঘোর। উপেন্দ্রকিশোরের কাহিনি অবলম্বনে তৈরি ছবি ‘গুপি গাইন বাঘা বাইন’ তখন শহরে রমরম করে চলছে। সুখলতার মৃত্যুরও পঞ্চাশ বছর পার হচ্ছে এ বার।
ঋণ:
(‘সুখলতা রাও রচনা সংগ্রহ’, ‘সুখলতা শতবর্ষ স্মারক পুস্তিকা’: যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, মানবীবিদ্যাচর্চা কেন্দ্র
‘ছেলেবেলার দিনগুলি’: পুণ্যলতা চক্রবর্তী, ‘আর কোনোখানে’:
লীলা মজুমদার)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy