আমার বাড়ির কাছে আরশিনগর
সেথা এক ঘর পড়শি বসত করে
আমি একদিনও না দেখলাম তারে...
লালন ফকিরের এই গানের মুখড়া আমাদের অনেকেরই জানা। জানি বাড়ির কাছে আছে এক আরশিনগর। কিন্তু সেখানে ক’জন যায়? ক’জনই বা খোঁজে আরশিতে তার নিজের মুখ?
লালনের গানে আরশিনগর ছিল মনের মানুষের সাকিন। আর এই লেখায় সেই আরশিনগর হল আমাদেরই শেকড়। ভারতীয় দরবারি সঙ্গীত থেকে মেঠো গান থেকে ভক্তিগীতি সব মিলিয়ে যে বিরাট ব্যাপ্তি, তারই শেকড় খুঁজতে ১ থেকে ৪ অগস্ট চলবে ‘সহজ পরব দ্য রুট মিউজিক ফেস্টিভ্যাল’।
রাজস্থানী লোকগান থেকে ছৌ দক্ষিণী তালবাদ্য থেকে গিরিজা দেবীর শিষ্যাশিষ্যদের চৈতী কাজরী থেকে কীর্তন, দুই বাংলার বাউল গান, থেকে লোকনাট্য— মিলেমিশে যাবে ভারতের এক রাজ্যের মাটির সুর, রং, ভাষার সঙ্গে আর এক রাজ্যের বর্ণাঢ্য শিল্পচেতনা। এটাই উৎসবের সবচেয়ে বড় লক্ষ্য?
রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণ, রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহ, এবং গগনেন্দ্র প্রদর্শশালা জুড়ে এই বিরাট উৎসবের আয়োজক এমন দু’জন শিল্পী বস্তুত যাঁরা সঙ্গীত ভাবনায় একে অপরের প্রতিবেশী হতে পারেন, কিন্তু সতীর্থ নন। এক জনের দীক্ষা রবীন্দ্রসঙ্গীতে। অন্য জনের সংগ্রহে পাঁচ হাজার লোকগান। প্রথম জনের নাম লোপামুদ্রা মিত্র। দ্বিতীয় জন ‘দোহার’ লোকগানের দলের কালিকাপ্রসাদ। ফলে যা দাঁড়াল এই অনুষ্ঠানের যুগ্ম আয়োজক হয়ে উঠেছে লোপামুদ্রা প্রোডাকশন ও দোহার।
কী ভাবে ‘সহজ পরব’-এ সামিল হলেন দু’জনে যখন তাঁদের সঙ্গীত ধারাই আলাদা? লোপামুদ্রা বললেন, “আমার অনেক দিন ধরে ইচ্ছে ছিল এই রকম এক উৎসব করি। নানা আলোচনার মাধ্যমে একদিন মনে হল কালিকার সঙ্গেই ‘সহজ পরব’ করা যায়। আমি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ছাত্রী হলেও লোকগান, লোকবাদ্য, লোক শিল্পের অনুরাগী। আমাদের নাগরিক সঙ্গীত চর্চার পাশে তাঁদেরও একটা ধারা শতাব্দীর পর শতাব্দী বয়ে চলেছে। আগামী প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের তার সঙ্গে পরিচিত করতে চাই। চাই নিজেও নিজের শেকড়ের বাঁধনে জড়াতে।”
অন্য দিকে লোকগানের শিল্পী কালিকাপ্রসাদের মতে, লোপামুদ্রা নিজেও তো ‘ছাতা ধরো’ ‘মাহুত বন্ধু রে’, ‘তোমায় হৃদমাঝারে’র মতো লোকগান, ভক্তিগান গেয়েছেন। তাঁর সঙ্গে লোকসঙ্গীত জীবনের একটা পরিচয় আছে। তাই ‘সহজ পরব’-এ লোপামুদ্রাকে অন্যতম আয়োজক ভাবতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা হয়নি তাঁর।
প্রশ্ন হল, এমন শিকড় সন্ধানী উৎসব কি ভারতে এর আগে হয়নি? “হয় তো প্রায়শই কিন্তু সেখানে যেটা বলা হয় তা হল সব সুর, সব গানই কোথাও গিয়ে একই বিন্দুতে মিলে যায়। আমরা বলতে চাইছি বহুত্বের কথা। যত রাজ্য তত সুর, তত ভাষা, তত শিল্প। রঙের বহুত্বের মধ্যেই আমাদের সাঙ্গীতিক শেকড়ের বিস্তার। ভারতের একই বৃক্ষে নানা রঙের ফুল ফুটে আছে,” বলছেন কালিকাপ্রসাদ। কথার রেশ ধরেই লোপামুদ্রা জানালেন, উদ্বোধনের দিন রবীন্দ্রসদন প্রাঙ্গণে হবে ‘সহজ যাত্রা’ বলে একটা অনুষ্ঠান, যেখানে সব রাজ্যের শিল্পীরা অনুষ্ঠান করবেন। কোথাও হবে বিহু নাচ গান, কোথাও বা হবে ছৌ। কোথাও বাউল গান, কোথাও বা ঝুমুর। “যাকে বলে ভিশু্যায়াল গ্র্যাঞ্জার,” বললেন লোপামুদ্রা।
‘মনের মানুষ’ ছায়াছবিতে লালনের গান গান-গাওয়া লতিফ শাহ্, মনসুর ফকির বাউল গান, সরস্বতী দেবীর কীর্তন-বাউল, সালাবাত মাহাতোর ঝুমুর গান, বাংলা দেশের চন্দনা মজুমদারের বাউল গান, লোকগান, থেকে দক্ষিণী তালবাদ্য, অসমের মঠনৃত্য বা সত্রীয় নাচ, রাজস্থানের মামে খান ও তাঁর শিল্পী-গোষ্ঠীর লোকগানের পরিবেশনে সাজানো এই চারদিন ব্যাপী আসরে বিশেষ সম্মাননা জ্ঞাপন করা হবে পূর্ণদাস বাউল, অমর পাল সহ পশ্চিমবঙ্গের নানা প্রান্তের লোকশিল্পীদের। কলকাতার সেলিব্রিটিদের মধ্যে উপস্থিত থাকবেন ‘মনের মানুষ’ য়ের স্মৃতিবাহী নায়ক প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, পরিচালক গৌতম ঘোষ ও পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়।
সারা ভারতের মোট দুশো শিল্পীকে নিয়ে আয়োজিত ‘সহজ পরব’ উদ্বোধন করবেন সেই শুভা মুদগল, যাঁর ইন্দো-ওয়েস্টার্ন মেঠো গান ‘ঘটা শাওন কি’ শুনলে মরুভূমির আকাশে এসে জমে চেরাপুঞ্জির মেঘ।
শুভা বললেন, “আমি ‘বাজা গা-জা’ বলে এই ধরনের অনুষ্ঠান শুরু করেছিলাম যার উদ্দেশ্যও ছিল ভারতীয় সঙ্গীতের শেকড়ের খোঁজ। কিন্তু চালাতে পারিনি টাকাপয়সার অভাবে। এই ধরনের অনুষ্ঠান করা কঠিন কাজ। আশা করি নানা প্রদেশের শিল্পীদের আমন্ত্রণ জানিয়ে লোপামুদ্রা ও কালিকাপ্রসাদ যে এই অনুষ্ঠান করছেন তা যেন চলতে থাকে। কোনও ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানি আয়োজিত লোকসঙ্গীতের অনুষ্ঠান আর দু’জন শিল্পীর আত্মিক প্যাশন থেকে ‘সহজ পরব’ করায় তফাত থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট।”
অন্য দিকে এই অনুষ্ঠানের সমাপ্তি দিনে আসছেন কৈলাস খের। যাঁর ‘তেরি দিওয়ানি’, ‘তওবা তওবা’ ‘সঁইয়া’, ‘চান্দন সে’-র মতো নন ফিল্মি সুফি গান ভারতের জনহৃদয় মাত করেছে, সেই সুফি বলবেন, নিজের জীবনের কথা। “আমি বলব যে আমি কেন আসলে বলিউডি শিল্পী নয়, একজন মেঠো শিল্পী। সুফি গান আমার ঈশ্বর সাধনা, সুফি গানই আমার জীবন। সেই সঙ্গে উত্তর প্রদেশের লোকগান কী ভাবে আয়ত্ত করলাম, কেমন ভাবে ভালবাসলাম বাংলাদেশের বাউল ফকিরের গান সে সব কথা। কলকাতা সংস্কৃতির শহর। এখানে দশ জন বিজ্ঞানী জন্মালে হাজার শিল্পী জনমামন। এমন শহরে আমাকে ব গান গাওয়ার বদলে বক্তব্য রাখতে ডাকায় আমি ভীষণ আনন্দ পাচ্ছি।”
গগনেন্দ্র প্রদর্শশালা সাজানো হবে বিভিন্ন ধরনের লোকায়ত বাদ্যযন্ত্র দিয়ে, যার মধ্যে বহু যন্ত্রই আজ বিলুপ্তপ্রায়।
এক কঠিন এক উৎসবের নাম কী করে হল সহজ পরব? প্রশ্ন করায় কালিকাপ্রসাদ বললেন, “একে তো আমাদের গানে, ভক্তিতে সহজিয়া সাধনার একটা ব্যাপার আছেই। সেই সঙ্গে সহজ মানে যা সহজাত। যা আমরা নিয়ে জন্মেছি। আমরা নিয়ে জন্মেছি গ্রামগ্রামান্তের মেঠো পথের গান। কত রকম সঙ্গতের বাদ্যযন্ত্র। সহজ ভাবে ভাবা এই পরব। মানুষের সহজ মনটাকে খুঁজে বের করার জন্যই এই পরব।”
ঘরের কাছে আরশিনগরের আয়নায় কলকাতা কি দেখতে পাবে তার নিজের লোকায়ত আত্মার মুখ? আগামী প্রজন্ম কী কৌতূহলী হবে সেই মাটির আদলে গড়া মুখ দেখতে? সেই কৌতূহল কি গড়ে দিতে পারবেন কালিকাপ্রসাদ আর লোপামুদ্রা?
উত্তর দেবেন দর্শকেরা। উত্তর দেবে আগামী দিন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy