পিকে-আরতি, ‘মেড ফর ইচ আদার’
পঁচাত্তরের আইএফএ শিল্ড। সদ্য জ্বর থেকে সেরে ওঠা সুরজিৎ সেনগুপ্ত কিছুতেই পুরোপুরি রিকভার করতে পারছে না। জ্বরটাও একটু গোলমেলে। টাইফয়েড গোছের।
আমার পঁচিশ বছরের দীর্ঘ কোচিং জীবনে অনেক ফুটবলারকেই বাড়িতে এনে এক বেলা কিংবা এক রাত রেখেছি। কিন্তু যে ক’জন হাতে গোনা মাত্র শিষ্য বেশ কয়েক দিন থেকেছে, তাদের মধ্যে এক জন সুরজিৎ। বোধহয় টানা পাঁচ দিন ছিল। ওকে স্পেশ্যাল ডায়েট আর শুশ্রূষার জন্য দিনকয়েক রাখার প্ল্যানটা সত্যি বলতে কী ছিল আমার স্ত্রী আরতির।
আমার ছোট মেয়ে পিক্সি তখন একেবারেই ছোট। কোলে কোলে ঘোরে। এখনও স্পষ্ট মনে আছে, সুরজিৎ কাইজার স্ট্রিটের বাড়িতে থাকার সময় আমার বড় মেয়ে পলাকে মজা করে বলত, চল্, পিক্সিকে জিজ্ঞেস করি মোহনবাগানকে আমরা ক’গোল দেব শিল্ডে?
পিক্সিকে জিজ্ঞেস করলেই অত ছোট্ট মেয়ে আধো-আধো গলায় বলত, পাঁচ! যত বার সুরজিৎ জিজ্ঞেস করত, পিক্সির সেই এক কথা— পাঁচ!
এক গোল নয়। দু’গোল নয়। তিন...চারও বলেনি পিক্সি। যত বার সুরজিৎ জিজ্ঞেস করেছে— পাঁচ-ই বলেছে আমার অত ছোট্ট মেয়ে! শুনে সুরজিৎ খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলত, না-না। ও রকম কখনও মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল ম্যাচে হয় না কি? দ্যাখ পলা, কী বলছে পিক্সি!
কিন্তু পঁচাত্তরের শিল্ড ফাইনালের রেজাল্ট কী হয়েছিল সেটা আজ ঊনচল্লিশ বছর পরেও নিশ্চয়ই এখনও সবার মনে আছে। ইস্টবেঙ্গল-৫ : মোহনবাগান-০!
এটাই বোধহয় এক্স ফ্যাক্টর।
যার কোনও ব্যাখ্যা নেই। যার কপালে ঘটছে তারও বোধগম্যের বাইরে। কেবল নিজের মনে মনে উপলব্ধি করা ছাড়া!
আমি যেমন জীবনের প্রত্যেকটা প্রতিযোগিতামূলক টুর্নামেন্টে আমার প্রথম ম্যাচেই গোল পেয়েছি। সে সেই উনিশশো বাহান্নয় মাত্র ষোলো বছর বয়সে জামশেদপুর ইয়ং মেন্স অ্যাসোসিয়েশন মানে জেওয়াইএমএ-র হয়ে জামশেদপুর ফার্স্ট ডিভিশন লিগে বলুন, কিংবা তার পর একে-একে কলকাতা লিগ, শিল্ড, রোভার্স, ডুরান্ড, সন্তোষ ট্রফি, ভারতের হয়ে কোয়াড্রাঙ্গুলার, এশিয়াড...বলুন। এর কী ব্যাখ্যা আজ এই আটাত্তরে পৌঁছেও খুঁজে পাইনি আমি।
আসলে আমার ফুটবলজীবন জুড়েই যেন এক্স ফ্যাক্টরের উপস্থিতি রয়েছে। সৌভাগ্যক্রমে সেগুলোর বেশির ভাগই আশীর্বাদ। অভিশাপ খুব কম।
আবার সেই বাহান্ন সালে ফিরে যেতে হচ্ছে। আমার ষোলো বছর বয়সে। জামশেদপুরের বাড়িতে এক দিন একটা চিঠি এল। বাবা ডেকে চিঠিটা হাতে দিয়ে বললেন, যাও। পটনায় ডেকে পাঠিয়েছে। ভাল করে খেললে হয়তো বিহারের হয়ে কোনও দিন খেলতে পারো। আমার কাছে তখন সেটাও ভাবনার অতীত। কিন্তু জামশেদপুর থেকে পটনা যেতে তো খরচা আছে। সেই সময় আমাদের পরিবারে তীব্র অনটন। দশটা টাকাও বিরাট ব্যাপার। তা সত্ত্বেও বাবা ন’টাকা তিন আনা দিয়ে ট্রেনের টিকিট কেটে সঙ্গে তেরো আনা আমার পকেটে গুঁজে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, এটা রাখো। বাজে খরচ কোরো না।
পরিবারের ওই প্রচণ্ড আর্থিক সঙ্কটের সময়ও আমার পটনায় যাওয়ার খরচ বাবার দিতে পারাটাও এত বছর পরে মনে হয়, আর একটা এক্স ফ্যাক্টর এই অধমের ফুটবল কেরিয়ারে। যে-হেতু অত কম বয়সে বিহার স্টেট ফুটবল ক্যাম্পে যেতে পারাটা আমার খেলোয়াড়-জীবনের একটা অন্যতম টার্নিং পয়েন্ট।
ওই ষোলো বছর বয়সেরই আর একটা ঘটনা মনে পড়ছে। জামশেদপুর লিগে একটা ম্যাচ খেলেছিলাম তার আগের তিন দিনের বৃষ্টিতে কার্যত ডুবে যাওয়া কিনান স্টেডিয়ামে। অপোনেন্টের পোস্টের নীচে সেই সময় বিহারের শ্রেষ্ঠ গোলকিপার পুলিন বসু। তাঁকেও ওই ভয়ঙ্কর জলকাদার মাঠে প্রায় ৬০ গজ বল একা নিয়ে গিয়ে বাঁ পায়ের ভলিতে গোল দিয়েছিলাম।
কিন্তু এখনও মনে পড়লে অবাক লাগে, কী ভাবে সে দিন গোলটা করেছিলাম আমাকে কেউ ব্যাখ্যা দিতে বললে আজও পারব না। ব্যাখ্যা নেই যে! কেউ তার আগে আমাকে শেখায়নি জলকাদার মাঠে কী ভাবে বল তুলে খেলে অ্যাটাক করতে হয়! ভারী হয়ে ওঠা বলে দূরপাল্লার শট নিতে হলে কী ভাবে, বলের কোন অংশে সজোরে বুটের কন্ট্যাক্ট দরকার।
সবটাই সে দিন কোন অজানা এক শক্তি একটা ষোলো বছরের কিশোরকে দিয়ে করিয়ে দিয়েছিল! যেটা অভিজ্ঞতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বুঝেছি— এক্স ফ্যাক্টর।
৬০-এর রোম অলিম্পিক থেকে ফিরে মরণাপন্ন আমার বাবাকে শেষ বার দেখতে পাওয়াটাও যেন একটা এক্স ফ্যাক্টর নিজের জীবনে!
রোম অলিম্পিকে আমি ইন্ডিয়া ক্যাপ্টেন হয়েছি শুনে বাবা বলেছিলেন, “ভয় নেই, তুই যা। তুই অলিম্পিক থেকে ফেরা না পর্যন্ত আমি মরব না।”
ঠিক সেটাই হয়েছিল। রোম থেকে ফেরার পর বাবা আর তিন দিন বেঁচেছিলেন। যে দিন ফিরলাম, সে দিনই রাতে গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত বাবার ভোকাল কর্ড ছিঁড়ে যায়। আমার সঙ্গে বাবা এক-আধটা কথা খুব চাপা গলায় বলার কয়েক ঘণ্টা পর। কী ব্যাখ্যা এরও!
আসলে এক-এক সময় মনে হয়, আমি বরাবরের ঈশ্বরভক্ত বলে সেই পরমশক্তিমানের আশীর্বাদই হয়তো এ রকম নানা রূপে আমার ওপর ঝরে পড়েছে গোটা জীবন।
একাত্তরে জাপান থেকে ফিফা কোচিং কোর্স করে ফিরছি। সঙ্গে চুনী গোস্বামী। আমাদের দু’জনের সঙ্গে কয়েকটা মাত্র ডলার নিয়মমাফিক সর্বোচ্চ পরিমাণের তুলনায় বেশি ছিল। এখানে কাস্টমস আমাদের আটকাল। ব্যাস! মিডিয়ায় নিন্দেমন্দ। সমালোচনা। কটাক্ষ। এমনকী তখনকার দিনের কুখ্যাত ব্ল্যাকমার্কেটার...আন্ডারওয়ার্ল্ড ডনের সঙ্গে পর্যন্ত আমাদের তুলনা হয়েছিল। আরতি আমার সেই বিপদের সময় এমনকী বাড়িতে ন’দিন-রাত মা বগলামুখীর যজ্ঞের ব্যবস্থা করেছিল! নিজে টানা ন’দিন উপোস ছিল!
’৭৮-এর সেই বড় ম্যাচ অবশেষে শুরু। রেফারির সঙ্গে সুরজিৎ-প্রসূন
তো ওই ঘটনার আশপাশে আমার একটা সাংবাদিক সম্মেলন। আর তার তিরিশ বছরেরও পর দু’হাজারের গোড়ায় আমি যখন বড় ক্লাব বা ইন্ডিয়া টিমে টেকনিক্যাল ডিরেক্টর ছিলামটিলাম, তখন আর একবার। ওই সময় কোচ হিসেবে আমার খুব খারাপ সময় যাচ্ছিল। দু’টো সাংবাদিক সম্মেলনেই আরতি এক্স ফ্যাক্টর হিসেবে দেখা দিয়েছিল আমার জীবনে।
দু’টো প্রেসমিটই মনে হয় প্রেস ক্লাবে। প্রথমবার আরতি বলল, তুমি আজ একা যেও না। আমি সঙ্গে যাব। আজ মনে হচ্ছে, তোমার দিকে গোলাগুলি ছুটবে মিডিয়া থেকে। কিন্তু জানো তো, আমি কোনও অবস্থায়ই তোমাকে ডিফিটেড দেখতে চাই না!
আর পরেরটায় আরতি তখন যথেষ্ট অসুস্থ। আমার বড় মেয়ে সে দিনই ট্রেনে করে (এখন মনে নেই ঠিক কোথা থেকে যেন) কলকাতা ফিরছে। আরতি আমাকে না জানিয়ে পলাকে ট্রেনে মোবাইলে ধরে বলে দিয়েছিল, তুই সোজা স্টেশন থেকে প্রেস ক্লাবে চলে যাবি বাবার প্রেস কনফারেন্সে। আমার শরীর ভাল থাকলে আমিই যেতাম। পারব না বলে তোকে বলছি। কিছুতেই ও যেন একা মিডিয়াকে আজ মিট না করে। সে দিনও সাংবাদিকদের আমাকে কড়া-কড়া প্রশ্ন করার সম্ভাবনা ছিল।
দুটো ক্ষেত্রেই কেন জানি না, যতটা ভাবা গিয়েছিল আমাকে ততটা মিডিয়ার আক্রমণের সামনে পড়তে হয়নি। এটাও তো এক্স ফ্যাক্টর।
যে কোনও পেশাতেই সফল মানুষের জীবনে এক্স ফ্যাক্টরের একটা অবদান থাকে। সেটা তার স্ত্রী হতে পারে। পরিবার হতে পারে। তাবিজ-আংটি-মালাটালা হতে পারে।
তবে এখানে একটা ব্যাপার আমি পরিষ্কার করে দিতে চাই। খেলোয়াড় কিংবা কোচ— কোনও অবস্থাতেই আমি কোনও দিন তুকতাকের আশ্রয় নিইনি। নিজের টিমের ম্যাচ শুরুর ঠিক আগে গোপনে মাঠে প্রসাদী ফুল রেখে আসিনি কোনও বিশেষ গোলপোস্টের ধারে বা কোনও বিশেষ সাইডে!
তবে হ্যা।ঁ ঈশ্বরের কাছে মানত করেছি দু’-একবার। পঁচাত্তরে ইস্টবেঙ্গলের সামনে যখন টানা ছ’বার লিগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে বিরল রেকর্ড গড়ার সুযোগ, টিমের কোচ হিসেবে মানত করেছিলাম দল রেকর্ড করলে ঠাকুরের সামনে নিজের বুক চিরে রক্ত দেব। সে বার লিগের পর তারকেশ্বরের মন্দিরে গিয়ে ঠিক সেটা করেওছিলাম।
আবার পরের বছর যখন মোহনবাগানের দায়িত্ব নিলাম, আমার নতুন টিম লিগ জেতার পর আরতি বলল, তোমার কাছে তো সব ধর্ম সমান। তা হলে ইস্টবেঙ্গলে রেকর্ড গড়ার পর যেমন নিজের বুক চিরে মন্দিরে রক্ত দিয়েছিলে, তেমনি মোহনবাগানকে প্রথমবারই লিগ জিতিয়ে কেন সে রকমটা করবে না? সে জন্য ছিয়াত্তরে লিগের পরেও আমি তারকেশ্বরের মন্দিরে গিয়ে নিজের বুক চিরে রক্ত দিয়েছিলাম।
তবে বিশ্বাস করুন, এগুলোর সঙ্গে কোনও তুকতাকের সম্পর্ক নেই।
বরং আটাত্তরে লিগের বড় ম্যাচে ইডেনে আগে ইস্টবেঙ্গল টিম ঢুকবে, না কি মোহনবাগান আগে ঢুকবে— তা নিয়ে আধঘণ্টারও বেশি ড্রেসিংরুমে দু’দলে কাজিয়া চলার পিছনে আমি যত না তুকতাক, তার চেয়ে ঢের বেশি মনস্তাত্ত্বিক অ্যাডভান্টেজের কারণ খুঁজে পেয়েছিলাম। এখনও পাচ্ছি প্রসঙ্গটা বলতে বসে।
সে বার ওই বড় ম্যাচের আগে লিগ টেবিলে আমার মোহনবাগান আগে ছিল ইস্টবেঙ্গলের থেকে। মোহনবাগানের সে মরসুমে ক্যাপ্টেন প্রসূন। ইস্টবেঙ্গলের সুরজিৎ। মাঠের বাইরে দু’জন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অথচ সে দিন নিজেদের দলের আগে-পরে মাঠে নামা নিয়ে ওদের দু’জনের মধ্যেই সবচেয়ে বেশি মতভেদ ঘটেছিল।
আমাদের যুক্তি ছিল সে দিন—যে-হেতু পয়েন্ট টেবিলে আমরা মানে মোহনবাগান ওই মুহূর্তে আগে, সে জন্য আমাদের দল মাঠে পরে নামার সুযোগ পাক।
আসলে যে ম্যাচে মনস্তাত্ত্বিক ফ্যাক্টরটা খুব বেশি, সে রকম ম্যাচে বিপক্ষের পরে নিজের দলের মাঠে নামা মানে তোমার হাজার হাজার সমর্থকদের শব্দব্রহ্ম সহ্য করতে হবে অপোনেন্টকে। অথচ তোমার বিপক্ষ আগে মাঠে নামায় গ্যালারিতে তাদের বিশাল সমর্থক বাহিনীর চিলচিৎকার তোমাকে আর মাঠের ভেতরে থেকে সহ্য করতে হল না। তুমি তো পরে নামায় সেই সময় ড্রেসিংরুমের ভেতর কাটাচ্ছ!
ইস্ট-মোহনের মতো কঠিন যুদ্ধ শুরুর কয়েক মিনিট মাত্র আগে এ রকম কিছু ব্যাপারস্যাপার অবশ্যই দলের ওপর মনস্তাত্ত্বিক ভাবে প্রভাব ফেলে। একটু হলেও ফেলে।
সে দিন কিন্তু মোহনবাগান শেষমেশ মাঠে ইস্টবেঙ্গলের পরে নেমেছিল আর শ্যাম থাপার সেই দুর্দান্ত ব্যাকভলি গোলে বড় ম্যাচ জিতেওছিল। মজার ব্যাপার, তার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই ফুটবলে নিয়ম হয়ে যায়, দু’টো দলই একসঙ্গে রেফারি-লাইন্সম্যানকে সামনে রেখে মাঠে নামবে।
আবার অনেক ম্যাচে এক জন ফুটবলারকে নামাব একেবারে ঠিক করে ফেলেও শেষ মুহূর্তে সিদ্ধান্ত পাল্টে অন্য প্লেয়ার নামিয়েছি। তাতে ক্লাবকর্তারা গজগজ করেছেন। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দিনের শেষে দেখা গিয়েছে, আমার সেই অপ্রত্যাশিত পরিবর্তনই ম্যাচের নায়ক!
পিন্টুকে (সমরেশ চৌধুরী) শেষ মুহূর্তে বসিয়ে মোহন সিংহকে নামিয়েছি। মোহনই ইস্টবেঙ্গলের উইনিং গোল করেছে সেই ম্যাচে!
সুব্রত ভট্টাচার্যকে কত ম্যাচে যে শেষের দিকে স্টপার থেকে সেন্টার ফরোয়ার্ডে তুলে এনে মোহনবাগানে গোল পেয়েছি!
কৃশানুকে গুরুত্বপূর্ণ মহমেডান ম্যাচে প্রথম দলে না রেখে এক গোলে পিছিয়ে থাকা অবস্থায় হাফটাইমের পরে নামিয়ে ওর প্রথম তিনটে পাস থেকেই দু’টো গোল তুলে নিয়েছি ইস্টবেঙ্গলে।
আরারাত ম্যাচে সবাইকে অবাক করে বিদেশকে পরে নামিয়ে শিল্ড ফাইনালে প্রচণ্ড শক্তিশালী রাশিয়ান টিমের সঙ্গে মোহনবাগানকে যুগ্ম চ্যাম্পিয়ন করেছি।
এমনকী এশিয়াডে চন্দ্রেশ্বর প্রসাদকে বসিয়ে সুধীরকে অনভ্যস্ত স্টপারে খেলিয়ে ব্রোঞ্জ-ম্যাচ জিতেছি জাপানের বিরুদ্ধে।
কিন্তু সবগুলোর পিছনেই যে একশো ভাগ ফুটবলীয় চিন্তাভাবনা ছিল আমার, সত্যি বলতে কী দাবি করব না আজ। সেটা মিথ্যে বলা হবে। বরং কোথাও নিজের একটা ‘গাট ফিলিং’ হয়েছে। যার কোনও কারণ অথবা ব্যাখ্যা সে দিন খুঁজে পাইনি। আজও পাই না। এক্স ফ্যাক্টর!
তবে আমার কোচিং জীবনে আরতি-ফ্যাক্টর বোধহয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এক্স ফ্যাক্টর।
কত-কত বছর ধরে যে নিঃশব্দে আমার জয়-রথের সারথি ছিল ও!
কত বার যে সকালের প্র্যাকটিসের পর পনেরো-ষোলো জন ফুটবলার নিয়ে সটান বাড়িতে এসে আরতিকে অর্ডার করেছি, সবাই লাঞ্চ করব। রান্না করো। কিংবা হঠাৎ করে কোনও সন্ধেয় আমার টিমের দশ-বারো জন প্লেয়ার বাড়িতে এসে আব্দার জুড়েছে— বৌদি, আজ ডিনার করে ফিরব কিন্তু! প্রতিবার আরতি এক-দেড় ঘণ্টার ভেতর লাঞ্চ বা ডিনার টেবিল রেডি করে আমাদের খেতে ডাকত।
প্রবীণদের জন্য খেলাতেও স্বপ্নের ডজ পিকের
পিন্টু এক বার এ রকম খেতে খেতে আরতিকে বলে বসল, ইলিশ মাছের ভাপে করসেন। ইলিশের মাথাটা কী করল্যান? পুঁইশাক ঘরে নাই? মাথা দিয়া চচ্চড়ি বানান না! গরম ভাত দিয়া দারুণ লাগব খাইতে!
সে দিন আমারও প্রায় ধৈর্যচ্যুতি ঘটার উপক্রম। আরে, পিন্টু বলে কী? এখন আরতি পুঁইশাক কেটে ইলিশের মাথা দিয়ে চচ্চড়ি রাঁধবে!
আরতি কিন্তু সে দিনও আমরা খেতে খেতেই পিন্টুর অর্ডারি ডিশ বানিয়ে ওই পনেরো-ষোলো জনের ব্যাচকে সার্ভ করেছিল!
এই বুড়ো বয়সেও বলতে লজ্জা নেই আমার। বা একটু রোম্যান্টিক হওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না— আরতি যত দিন বেঁচে ছিল, মাঝেমধ্যে আমি যখন একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছি আমার জন্য ওর অফুরান আত্মত্যাগ দেখে, বলে বসতাম, আমি আর তুমি মেড ফর ইচ আদার। পলা-পিক্সি কথাটা এখনও আমাকে ইয়ার্কির ছলে মনে পড়িয়ে দেয় মাঝেসাঝে।
অথচ আরতির একটা অদ্ভুত আলাদা আইডেন্টিটি ছিল। পৃথক সত্তা। এ দেশের মেয়েদের ফুটবল আর ক্রিকেটের জন্য অজস্র ভাল-ভাল কাজ করার জন্যই তো আইওসি আর ফিফার যুগ্ম সার্টিফিকেট পেয়েছিল ও। সামারাঞ্চ আর ব্লাটারের একই সার্টিফিকেটে সই করা! যেটা ওকে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী নিজে হাতে দিয়েছিলেন।
ম্যাডাম গাঁধী আরতিকে নামে চিনতেন। যতবার আমার সঙ্গে কথা হয়েছে, জানতে চেয়েছেন, হাউ ইজ ইওর ওয়াইফ? আরতি?
আর একবার নব্বইয়ের দশকে এক মোহনবাগান শীর্ষকর্তার বাড়িতে আমি সস্ত্রীক ডিনারে গিয়েছি। সেখানে সেই সময়ের পশ্চিমবঙ্গের মুখমন্ত্রী জ্যোতি বসুও আমন্ত্রিত। বাংলার মেয়ে ফুটবলার-ক্রিকেটারদের নিয়ে আরতির প্রচুর কাজ করার কথা সেখানে শোনার পর জ্যোতিবাবু ওকে বললেন, তোমার ফোন নম্বরটা আমাকে দিও। তোমার কাজে সাহায্য করতে পারলে করব।
আসলে জ্যোতি বসুর কাছে আরতি ছিল ‘গেনু’-র ভাইঝি হিসেবে পরিচিত। মানে বিখ্যাত জ্ঞানরঞ্জন মজুমদারের ভাইঝি। যাঁর রাজনৈতিক দর্শন ছিল— কমিউনিজম।
তো সে দিন আরতির কাছে ফোন নম্বর চাওয়ার আগেই জ্যোতিবাবু আমার কাছে নম্বরটা নিয়েছিলেন। আরতি সেটা দেখেওছিল। ফলে ও একটু অবাক হয়ে জ্যোতিবাবুকে বলল, আপনি তো ওর কাছে আগেই ফোন নম্বর নিয়েছেন! জ্যোতিবাবু আরও অবাক হয়ে আরতিকে বলেছিলেন, তাতে কী? তুমি কি সারা দিন প্রদীপের বাড়িতে থাকবে না কি? নিজের বাড়ির ফোন নম্বরটা দাও!
আসলে আরতির এতটাই বেশি আলাদা সত্তা ছিল এবং সেটা এতটাই বেশি ভারী যে, আমরা স্বামী-স্ত্রী, সে দিন অতক্ষণ আমাদের সঙ্গে কথা বলেও জ্যোতি বসু ধরতে পারেননি!
আমাকে যে কোনও বড় কিংবা গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের আগে আরতি বলত, কী স্কোর হবে মনে হয় এই ম্যাচটার? তুমি কী ভিসুয়ালাইজ করছ? আমি হয়তো গোটা ম্যাচটাকে কল্পনায় যে ভাবে ভেবেছি, সব ওকে বলায় আরতি যে ভবিষ্যদ্বাণী করত, বেশির ভাগ সময় মিলে যেত।
অথচ আমার সবচেয়ে তীব্র সমালোচক ছিল আমার স্ত্রী। আমার কোচিংয়ের সব কিছু কাটাছেঁড়া করত নিষ্ঠুর ভাবে। কোনও দিন আমার মন রাখা কথা বলেনি।
আবার এই আরতিই আমাকে যারা পছন্দ করতেন না, তাঁদের কাছে প্রিয় ছিল। আমার দুই মেয়েই এ নিয়ে রসিকতা করে বলে, ড্যাডি, তোমার শত্রুরা মার ফ্যান কেন বলো তো?
এক-এক সময় মনে হয়, আমাকে যাঁরা পছন্দ করেন না, তাঁদেরও আরতির চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলার হিম্মত হত না!
ভাগ্যিস, দীর্ঘ কোচিং জীবনে এমন একটা এক্স ফ্যাক্টর ছিল আমার!
হা ঈশ্বর! আমার গোটা জীবন জুড়েই ওই পরম প্রিয় এক্স ফ্যাক্টরটা রেখে দিলে না কেন!
(চলবে)
সংশোধন
পিকে-চুনী-বলরাম তাঁদের আগের জেনারেশনের মতো গায়ের ভেতরে ঢুকে থাকা বল নিয়ে খেলতে পছন্দ করার চেয়ে বরঞ্চ সামান্য ‘অ্যাহেড’ বল-এ আক্রমণ তৈরি করতে ভালবাসতেন। ২০ ডিসেম্বর-এর ‘পত্রিকা’-য় ‘আমার সেরা ভারতীয় দলে নিজের মাত্র একজন ছাত্রই সিওর ঢুকবে’ শিরোনামের লেখায় ‘অ্যাহেড’-এর বদলে ভুলবশত ‘আউট অফ রিচ’ লেখা হয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy