এবার থেকে নিরাপদে করুন নেট ব্যাঙ্কিং।
আর শুধুই একে অন্যের কথা বলাবলি বা মন চালাচালি নয়! একই সঙ্গে অনেকের মধ্যে ‘বাতচিত’ হবে এ বার। বহু দূর থেকেও। হবে অনেক বেশি তথ্যের দেওয়া-নেওয়া। অনেক বেশি দ্রুত গতিতে। আলোর মাধ্যমে।
বহু দিনের জমাট বাঁধা অন্ধকারে আলো ফেললেন অদিতি। ভিটেমাটি, পরিজন ছেড়ে দূরে থেকে দূরকে এই ভাবেই করলেন আরও ‘আপন’। আলোর ‘বার্তা’ পাঠিয়ে। সেই দূর-সংযোগে যাতে কেউ আড়ি পাততে না পারে, তারও উপায় বাতলালেন বঙ্গতনয়া। অদিতি সেন দে। ইলাহাবাদের হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এইচসিআরআই)-এর পদার্থবিজ্ঞানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর।
দূরকে আরও সহজে, আরও নিরাপদে, আরও দ্রুত ‘কাছে টানা’র পথ দেখিয়েই এ বছর পদার্থবিজ্ঞানে দেশের সেরা সম্মান শান্তি স্বরূপ ভাটনগর পুরস্কার পেলেন অদিতি। গত ৬ দশকের ইতিহাসে পদার্থবিজ্ঞানে দেশের আর কোনও মহিলা ভাটনগর পুরস্কার পাননি। বাঙালির হাত ধরেই পদার্থবিজ্ঞানে ভাটনগর পদক এই প্রথম ঝুলল কোনও মহিলার গলায়।
তা সে ডেস্কটপ, ল্যাপটপ হোক বা ট্যাব, সব ধরনের কম্পিউটারকেই অন্য নিয়মে চালানোর ‘মন্ত্র’ রয়েছে অদিতির কাছে। কম্পিউটারকে আরও বেশি বুদ্ধিমান, আরও বেশি অঙ্কে তুখোড়, আরও বেশি করিৎকর্মা করে তোলার ‘ওষুধ’ও রয়েছে অদিতির হাতে।
অদিতির আরও কৃতিত্ব, সেই ‘ওষুধ’টা অদিতি বানিয়েছেন একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুতে। একটি আয়নে। চেহারায় যা কোনও পরমাণুর চেয়েও ছোট।
আয়ন কী জিনিস?
কোনও পরমাণুর একেবারে বাইরের খোল (আউটারমোস্ট শেল) থেকে এক বা একাধিক ইলেকট্রন খসে গেলে তা ধনাত্মক বা পজিটিভ আয়ন হয়। আর পরমাণুর বাইরের খোলে ইলেকট্রনের সংখ্যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়ে গেলে সেই আয়নটা হয় নেগেটিভ বা ঋণাত্মক।
খুব ছোট আয়ন নিয়ে অদিতিরা কাজ করেছেন বলে তা কম্পিউটারের ‘মগজ’কে আরও ক্ষুরধার করে তুললেও গায়ে-গতরে তার ওজন বাড়াবে না। বরং কম্পিউটারের চেহারাটাকে আরও স্মার্ট করবে। যাতে তাকে পকেটে নিয়েও ঘোরাফেরা করা যায়।
গুগলের কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মডেল। ছবি সৌজন্যে গুগল।
‘চলতি হাওয়ার পন্থী’ হননি অদিতি
তাই অদিতি ও তাঁর সহযোগী গবেষকরা হেঁটেছেন অন্য পথে। ক্লাসিকাল ফিজিক্সের ধরা-বাঁধা পথ ছেড়ে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ‘ভুতুড়ে’ (স্পুকি) জগতে। আনকনভেনশনাল! তাই যথেষ্টই থ্রিলিং!
স্বামী উজ্জ্বল সেন ও মেয়ে অনুস্যূতার সঙ্গে অদিতি
যাপনেও অদিতি তেমনটাই। সহজ ছেড়ে জটিলকে বেছেছেন। বেহালার ঈশান মণ্ডল গার্ডেন রোডের অদিতি তাই শ্রী সারদা আশ্রম বালিকা বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর বেথুন কলেজে অনার্সের সাবজেক্ট হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন অঙ্ককে। জটিল অঙ্কের সাধনার সঙ্গে সঙ্গেই ১০ বছর ধরে ভিজেছেন সুরের ঝর্ণাধারায়। গানের তালিম নিয়েছেন। রাজাবাজার সায়েন্স কলেজ থেকে অ্যাপ্লায়েড ম্যাথামেটিক্সে এমএসসি করার পর অদিতি পিএইচডি করতে যান পোল্যান্ডের গ্বনস্ক বিশ্ববিদ্যালয়ে। তার পর জার্মানির হ্যানোভার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল করে অদিতি তাঁর দ্বিতীয় পোস্ট ডক্টরালটি করেন স্পেনের বার্সিলোনায় ইনস্টিটিউট অফ ফোটোনিক সায়েন্সে। ভারতে পেরেন ২০০৮-এ। দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার কাজ নিয়ে। পরের বছরেই যোগ দেন ইলাহাবাদের হরিশচন্দ্র রিসার্চ ইনস্টিটিউটে।
আরও পড়ুন- বাতাসের বিষ থেকেই বিকল্প জ্বালানি! উপায় বাতলে ভাটনগর পেলেন দুই বাঙালি
আরও পড়ুন- অর্ধশতাব্দী পর পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল মহিলার, সঙ্গী আরও দুই
অনেক পিছিয়ে ক্লাসিকাল কম্পিউটার
এখনকার কম্পিউটার অঙ্কে যথেষ্ট তুখোড় নয় বলে অনেক সমস্যারই সমাধান করতে পারে না। ই-মেলের গতি আরও বাড়ানো যায় না। তার মাধ্যমে আরও অনেক বেশি তথ্য পাঠানো যায় না। অনেক বেশি তথ্য ‘স্টোরেজ’-এর ক্ষেত্রেও তার দুর্বলতার কথা কারও অজানা নয়। সেই দুর্বলতা আছে বলেই নেট ব্যাঙ্কিংয়ের নিরাপত্তা ১০০ শতাংশ নিশ্ছিদ্র হয় না। হ্যাকিং-এর আশঙ্কা থেকেই যায়। যুদ্ধক্ষেত্রে কর্নেল বা মেজরদের জওয়ানদের দূর-সংযোগে শত্রু পক্ষের আড়িপাতায় ততটা বাধাও দিতে পারে না এখনকার কম্পিউটার। অদিতি এই সমস্যাগুলিই মেটানোর চেষ্টা চালিয়েছেন কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে। কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্টের তত্ত্ব প্রয়োগ করে।
কী ভাবে চলে ক্লাসিকাল ও কোয়ান্টাম কম্পিউটার? দেখুন ভিডিয়ো। সৌজন্যে: ইনস্টিটিউট অফ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং
নেট ব্যাঙ্কিং এখন চলে কী ভাবে?
অদিতি জানালেন, ইন্টারনেট বা নেট ব্যাঙ্কিং এখন বিশ্বের প্রায় সর্বত্রই চলে ক্লাসিকাল কম্পিউটারের মাধ্যমে। তাই চিন যদি অনেক বেশি কোয়ান্টাম কম্পিউটার বানিয়ে ভারতের নেট ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার গলি-ঘুঁজির হদিশ পেতে চায়, চিনা সাইবার ক্রিমিনালরা যদি চায় ভারতের নেট-ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে ‘হ্যাক’ করতে, তা হলে তারা তা করতে পারে খুব সহজেই। অনায়াসে। কিন্তু ভারত যদি আগামী দিনে দেশের নেট-ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে পুরোপুরি কোয়ান্টাম কম্পিউটার- নির্ভর করে তুলতে পারে, তা হলে এখানকার নেট-ব্যাঙ্কিংয়ের যাবতীয় আশঙ্কাই কর্পূরের মতো উবে যাবে।
ক্লাসিকাল ও কোয়ান্টাম কম্পিউটার চলে কীসের ভিত্তিতে?
দু’টি সংখ্যা ০ এবং ১ দিয়ে চলে সব কম্পিউটার। এগুলিকে বলে ক্লাসিকাল বিট্স। পক্ষান্তরে, কোয়ান্টাম কম্পিউটার চলে কোয়ান্টাম বিট্স বা কিউবিট্স দিয়ে। একই সময়ে একই জায়গায় ০ এবং ১-এর ধর্ম ও লক্ষণগুলি তার মধ্যে দেখা যায়। এর জন্যই কোয়ান্টাম কম্পিউটার অনেক জটিল সমস্যার দ্রুত সমাধান করতে পারে। যা ক্লাসিকাল কম্পিউটার পারে না। আলোর কণা ফোটন বা কোনও পরমাণুর নিউক্লিয়াস অথবা কোনও পরমাণুর একেবারে বাইরের খোলে থাকা ইলেকট্রন ওই ‘কিউবিট’ হিসেবে কাজ করতে পারে।
কোনও চৌম্বক ক্ষেত্রের সাপেক্ষে তাদের ঘূর্ণি (স্পিন)-র জন্য দু’টি ইলেকট্রনের ৪টি কিউবিট হয়। সেগুলি- ০১, ১০, ০০ এবং ১১। যেখানে ক্লাসিকাল কম্পিউটারের বিট্স দুই (০ এবং ১)-এর বেশি হতে পারে না। তার মানে, দু’টি কিউবিট থেকে কোয়ান্টাম কম্পিউটারে আমরা চারটি তথ্য পাচ্ছি। যদি ঘূর্ণির সংখ্যা ৪ হয়, তা হলে আমরা ৮টি তথ্য পাব। এটা সম্ভব হচ্ছে কোয়ান্টাম বিট্সগুলি একে অন্যের সঙ্গে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট অবস্থায় রয়েছে বলে। ক্লাসিকাল কম্পিউটার সে ক্ষেত্রে আমাদের ৪টি-র বেশি তথ্য কোনও দিনই দিতে পারবে না।
বহু দূরে থাকা কণাদের ‘ভুতুড়ে আচরণ’টা কী? দেখুন ভিডিয়ো। সৌজন্যে: ইনস্টিটিউট অফ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং
কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট কী জিনিস?
অনেক দূরে থেকেও যখন দু’টি কণা বা পদার্থ একে অন্যের আচার-আচরণগুলির প্রতিফলন ঘটায়, তখন তাকেই বলে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট। বহু দূরে থাকলেও যেন তারা আত্মার আত্মীয়! ধরুন, রাম আর শ্যামের মধ্যে এক সময় খুব বন্ধুত্ব হয়েছিল। তাদের মধ্যে গড়ে উঠেছিল দারুন একাট নৈকট্য। তার পর তারা যে কোনও প্রয়োজনেই হোক, একে অন্যের থেকে অনেকটা দূরে চলে গেল। এমন দূরত্বে, যেখানে আমরা রামকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু শ্যামকে দেখতে পাচ্ছি না। রাম আর শ্যামের মধ্যে কোয়ান্টাম এনট্যাঙ্গলমেন্ট হলে, রাম একটু একটু করে বদলালে, তাকে দেখে শ্যামও নিজেকে বদলে ফেলবে। তা সে যতই দূরে থাকুক না কেন রামের থেকে। তার ফলে, দূরে থাকা শ্যামকে না দেখা গেলেও, কাছে থাকা রামের আচার-আচরণের রদবদলগুলি দেখে শ্যামের আচার-আচরণগুলি আর তার পরিবর্তনগুলি বুঝে ফেলা যাবে। এর মানেটা হল, বহু দূরে থেকেও রাম আর শ্যামের ‘হৃদয়ের বন্ধন’ অটুট রয়েছে। তারা একে অন্যের ‘মন পড়তে’ পারছে! যেন আত্মার আত্মীয়!
অদিতি দেখিয়েছেন, দূর-সংযোগকে আরও সহজ, আরও দ্রুত ও নিরাপদ করে তুলতে এই ‘আত্মার আত্মীয়’দেরই কাজে লাগানো যায়। শুধু তাই নয়, তার পর আরও একটু এগিয়ে গিয়েছেন অদিতি। একই সময়ে রাম যাতে বহু দূরে থাকা শ্যাম, যদু, মধু ও ভোদুর সঙ্গেও জড়িয়ে থাকতে পারে ‘আত্মীয়তার বন্ধন’-এ, তারও উপায় বাতলেছেন অদিতি।
অদিতিরা দেখিয়েছেন, এই ভাবেই বহু দূরে থাকা আট জন হয়ে উঠতে পারেন আত্মার আত্মীয়!
অদিতি বললেন, একটা সংবাদপত্র অফিসের কথা ভাবুন। সকালে প্রধান সম্পাদক চার জন রিপোর্টারকে ফোনে বা হোয়াটসঅ্যাপে আলাদা আলাদা অ্যাসাইনমেন্ট দিলেন। আলাদা আলাদা বিটের। ইচ্ছে করলে সেই সংখ্যাটা আরও বাড়াতে পারেন প্রধান সম্পাদক। আট বা তারও বেশি। বিকেলে সেই রিপোর্টাররা বহু দূর থেকে অনেক বেশি তথ্য অনেক দ্রুত হারে জানাতে থাকলেন প্রধান সম্পাদককে। তাঁকে ফোনে না পেলে রিপোর্টাররা সেই তথ্য তখন তড়িঘড়ি পাঠালেন নিউজ এডিটর বা ডেপুটি নিউজ এডিটরকে। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। বিভিন্ন বিট-এর। আমরা দেখিয়েছি, এই দূর-সংযোগে প্রেরক বা ‘সেন্ডার’-এর সংখ্যা আট বা তার বেশি করা যায় অনায়াসেই। আর প্রাপক বা ‘রিসিভার’-এর সংখ্যাটা কম পক্ষে হতে পারে দুই। চেষ্টা চলছে, যাতে রিসিভারের সংখ্যাটাও বাড়ানো যায়।
আরও ‘রিসিভার’ বানানোর লক্ষ্য অদিতিদের
এই এনট্যাঙ্গলমেন্টের নিয়মেই চিন পৃথিবী থেকে কক্ষপথে থাকা উপগ্রহ পর্যন্ত দূর-সংযোগ হাতে-কলমে করে দেখিয়েছে। দূরত্বের নিরিখে এটাই আপাতত দীর্ঘতম প্রয়াস। কিন্তু এটা ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ দূর-সংযোগ। তাতে তথ্য দেওয়া-নেওয়ার সুযোগ ততটা বাড়বে না।
অদিতি, তাঁর স্বামী উজ্জ্বল সেন, এইচসিআরআই-এর অধ্যাপক অরুণ কুমার পতি-সহ ২২ জন গবেষকের কাছে দূরত্বটা বড় কথা নয়। তাঁদের লক্ষ্য, তথ্য দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রেরক ও প্রাপকের সংখ্যা কতটা বাড়ানো যায়। তাঁরা ইতিমধ্যেই একই সময়ে আট জনের সঙ্গে দূর-সংযোগের রাস্তা দেখিয়েছেন।
অনেকের কাছে ঋণী: অদিতি
অদিতির কথায়, ‘‘অনেকের কাছেই আমি ঋণী। তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে বলতে হয় অধ্যাপিকা ইন্দ্রাণী বসু, রুপমঞ্জরী ঘোষ ও অধ্যাপক অশোক সেনের স্ত্রী সুমতি রাওয়ের কথা। ঠিকই, আমার আগে আর কোনও মহিলা পদার্থবিজ্ঞানে ভাটনগর পুরস্কার পাননি। তবে কেউ না কেউ এটা পেতেনই। অগ্রণী বাঙালি মহিলা বিজ্ঞানীর অভাব নেই।’’
ছবি ও ইনফোগ্রাফিক সৌজন্যে: অদিতি সেন দে ও উজ্জ্বল সেন
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy