গ্রাফিক: তিয়াসা দাস
বিজ্ঞান বরাবর যে পথে এগিয়েছে, ইসরো এখন সেই পথেরই পথিক! ভুলটা কোথায় হয়েছে, খুঁজছে। গন্ডগোলটা হল কী ভাবে, বুঝতে চাইছে। জানতে চাইছে, ভুলটা হয়েছে ঠিক কোথায়? প্রযুক্তিতে? নাকি বিজ্ঞানে?
ইসরোর এই খোঁজতল্লাশ ইতিমধ্যেই দেশের বিজ্ঞানীমহলকে কিন্তু কার্যত দু’টি ভাগে ভাগ করে দিয়েছে! এক দল বলছেন, পরিকল্পনামাফিক ল্যান্ডার ‘বিক্রম’-এর চাঁদে নামতে না পারার ঘটনাটি একেবারেই যান্ত্রিক গোলযোগ। ‘নাট-বল্টুর গন্ডগোল’। ‘রোখো রোখো, গাড়িটা থামাও’ বলা হলেও ল্যান্ডার ‘বিক্রম’ ঠিক সময়ে একেবারে সঠিক ভাবে তার ‘ব্রেক’টা কষতে পারেনি বলেই এত সব!
অন্য দলটি বলছেন, ‘চন্দ্রযান-২’-এর ল্যান্ডার বিক্রম ঠিক কতটা জোরে ব্রেক কষলে চাঁদের পিঠে আছড়ে পড়বে না, সেই হিসেবটা ইসরো ঠিকঠাক ভাবে কষেছিল তো? কারণ, চাঁদের পিঠে নিরাপদে নামার জন্য আমাদের উপগ্রহের কোন এলাকায় কতটা ‘মায়ার টান’ (অভিকর্ষ বল), তার ঠিকঠাক মাপজোখটাও তো একটা বড় ফ্যাক্টর। ইসরোর হাতে থাকা বিজ্ঞানের সেই সব তথ্য পুরোপুরি নিখুঁত ছিল তো? সেই তথ্যের ভিত্তিতেই তো বিক্রমকে নিরাপদে চাঁদে নামানোর হিসেবটিসেব কষেছিল ইসরো। সেই মতোই করা হয়েছিল বিক্রমের থ্রাস্টারের কম্পিউটার প্রোগ্রামিং।
ভুলের গোলকধাঁধায় আইনস্টাইন, নিউটনও!
তবে বিজ্ঞানীরাই বলছেন, ‘ফেল’ না করে বিজ্ঞান কোনও দিনই পাশ করতে পারেনি পরীক্ষায়! ‘ভুল’ না করে কখনই সঠিক হতে পারেনি। ভুলই বিজ্ঞানকে দেখিয়ে দিয়েছে, কোন পথটা সঠিক। দেখে আর ঠেকেই শিখেছে বিজ্ঞান। বরাবর। প্রযুক্তিও।
ভুলের গোলকধাঁধায় জড়িয়ে পড়েছেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন। আইজ্যাক নিউটনও। আরও কতশত বিজ্ঞানী, তার ইয়ত্তা নেই।
ঐতিহাসিক দ্বিতীয় চন্দ্র অভিযান
দেশের বিশিষ্ট সৌরপদার্থবিজ্ঞানী, বেঙ্গালুরুর ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স’ (আইআইএসসি)-এর অধ্যাপক অর্ণব রায়চৌধুরীর কথায়, ‘‘কখনও কখনও বিজ্ঞানী নিজেই তাঁর ভুলটা ধরতে পেরেছেন। পরে তা শুধরে নিয়েছেন। বা শুধরে নেওয়ার চেষ্টা চালিয়েছেন। আবার কখনও সেই ভুলটা নামীদামি বিজ্ঞানীরও নজর এড়িয়ে গিয়েছে। কখনও তা নিজের দোষে। কখনও বা তাঁর গাণিতিক সিদ্ধান্ত, আবিষ্কার পরীক্ষানিরীক্ষা করে যাচাই করে দেখার উপকরণের অভাবে। প্রযুক্তির অভাবে।’’
ভুল করেছিলেন, পরে শুধরেছিলেন বা মানতে চাননি বিজ্ঞানের যে দিকপালরা
পরে যখন সেই উপকরণ, প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি সভ্যতার হাতে এসেছে, তখন অন্য কেউ সেই ভুলটা শুধরে দিয়েছেন। আবার এমনও হয়েছে, নিজের ভুল অন্য কেউ শুধরে দিলে, সেটা পছন্দ হয়নি কোনও কোনও বিজ্ঞানীর।
আলো অতটা বেঁকে যায় মহাকাশে, ভাবতেই পারেননি আইনস্টাইন!
আইনস্টাইনের ভুল করে ভুল শুধরে নেওয়ার গল্পটা বলা যাক। সেটা ১৯১১ সাল। তার আগে পর্যন্ত আমাদের ধারণা ছিল, বিগ ব্যাং-এর পর আলো বা ফোটন কণা যখন বেরিয়ে এল, তখন থেকেই আলো ব্রহ্মাণ্ডে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে চলেছে সরলরেখায়। একবগ্গা। কিন্তু ১৯১১ সালেই আইনস্টাইন প্রথম বললেন, স্পেস বা মহাকাশটা আসলে কিছুটা ‘দোমড়ানো মোচড়ানো’ জিনিস। যাকে বলা হয় স্থান-কালের বক্রতা (স্পেস-টাইম কার্ভেচার)। তার মধ্যে দিয়েই আলো যায় বলে, তার পথটাও বেঁকেচুরে যায়। টানটান বিছানায় কোনও একটা ভারী লোহার বল গড়িয়ে দিলে যেমন বিছানার মাঝখানে একটা গর্তের সৃষ্টি হয় আর বিছানার চার পাশের চাদরটা কুঁচকে যায়, যে কোনও মহাজাগতিক বস্তুর জন্য সেটা হয় মহাকাশেও। ভারী মহাজাগতিক বস্তুর জন্য সেই স্থান-কালের বক্রতা হয় অনেকটাই বেশি। তার আশপাশের স্থান-কাল ভীষণ বেঁকেচুরে যায়। সেই জায়গা বা তার আশপাশ দিয়ে গেলে আলোর পথও বেঁকেচুরে যায় অনেকটাই। ওই মহাজাগতিক বস্তুর জোরালো মহাকর্ষ বলের (গ্র্যাভিটেশনাল পুল বা ফোর্স) জন্য।
ভুল শুধরে নিতে ভুল করেননি আইনস্টাইন
কোনও মহাজাগতিক বস্তুর মহাকর্ষ বলের টান আলোর চলার পথকে কতটা বাঁকিয়ে দিতে পারে, ১৯১১ সালেই তার একটা হিসেব কষে ফেলেছিলেন আইনস্টাইন। কিন্তু ৪/৫ বছর পর তাঁর বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদের পেপার তৈরি করতে গিয়ে আইনস্টাইন দেখলেন, আগের হিসেবে বড় ভুল ছিল। মহাকর্ষ বল আলোর গতিপথকে যতটা বদলে দেয় বলে হিসেব কষেছিলেন, আদতে তা বদলে যায় দ্বিগুণ।
‘‘আইনস্টাইন দেরি করেননি সে দিন দ্রুত তাঁর ভুল শুধরে নিতে। যেহেতু দু’টি পেপারই প্রকাশিত, তাই আইনস্টাইন নিজের ভুল শুধরে নেওয়ার কাজটি যে চুপচাপ, গোপনে করেছিলেন, তা নয়। ভুল হয়েছিল, স্বীকার করতে দ্বিধাও করেননি’’, বললেন অর্ণব।
‘ভুল’ ভেবে লজ্জায় জিভ কেটেছিলেন আইনস্টাইন
পরে তো নিজের ‘কসমোলজিক্যাল কনস্ট্যান্টে’ বড় ভুল থেকে গিয়েছে বলে লজ্জায় জিভই কেটে ফেলেছিলেন আইনস্টাইন। সেই ছবির প্রচারও তো কম হয়নি! পরে অবশ্য এও বুঝেছিলেন, না, তাঁর কোনও ভুল হয়নি কসোমলজিক্যাল কনস্ট্যান্টের হিসেব কষতে।
বড়সড় ভুল করেছিলেন নিউটনও। তাঁর সেই বিখ্যাত ‘করপাসকুলার থিয়োরি’তে নিউটন বললেন, ‘‘আলো আসলে কণার স্রোত।’’ সরলরেখায় চলা কণার স্রোত। অথচ ওই সময়ই আর এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্স বলেন, আলোর তরঙ্গ ধর্মও (ওয়েভ প্রপার্টি) রয়েছে।
আলো তরঙ্গও হতে পারে, মানতেই চাননি নিউটন
অর্ণবের কথায়, ‘‘সেটা অবশ্য নিউটন একেবারেই মানতে চাননি। তিনি তাঁর করপাসকুলার থিয়োরিতেই বিশ্বাস দৃঢ় রেখেছিলেন। সেই সময় নিউটনের নামডাক বেশি। তাই হাইগেন্সের কথাটা ততটা আমল পায়নি। পরে উনিশ শতকের গোড়ার দিকে আর এক বিখ্যাত বিজ্ঞানী টমাস ইয়াং পরীক্ষা করে দেখান, আলোর তরঙ্গ ধর্মও রয়েছে। আগে সেই পরীক্ষাটা করা যায়নি, প্রযুক্তির অভাবে। তবে সেটা নিউটনের পছন্দ হয়েছিল কি না, জানা নেই।’’
নিজের ভুল নিজেই শুধরেছিলেন অ্যান্ড্রু ওয়াইল্সও
তবে নিজের ভুল নিজেই শোধরানোর আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত রয়েছে। তিনি বিশিষ্ট গণিতজ্ঞ অ্যান্ড্রু ওয়াইল্স। ফার্মাটের শেষ থিয়োরেমটি, যার জট আগে কেউই খুলতে পারেননি, নয়ের দশকে তার জট খুলেছেন বলে দাবি করেছিলেন ওয়াইল্স। কিন্তু কিছু দিনের মধ্যেই ওয়াইল্স বুঝতে পারেন, জট খুলতে গিয়ে তিনি কিছু ভুল করেছেন। সঙ্গে সঙ্গে সেই ভুল শুধরে নেন তিনি। হ্যাঁ, তার পরেও ওয়াইল্সই প্রথম জট খুলেছিলেন ফার্মাটের শেষ থিয়োরেমটির। যা রীতিমতো অসাধ্যসাধন বলেই মনে কতরা হতো তার আগে।
আরও পড়ুন- কালামের জেদেই ভেঙে পড়েছিল ইসরো রোহিনী! ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করেছিলেন এক বছরের মধ্যেই
কলকাতার ‘ইন্ডিয়ান সেন্টার ফর স্পেস ফিজিক্স’ (আইসিএসপি)-এর অধিকর্তা সন্দীপ চক্রবর্তী অবশ্য আপত্তি তুলছেন এই ‘ভুল’ আর ‘ঠিক’ শব্দদু’টি নির্বাচন নিয়েই। তাঁর মতে, যেটা ভুল বলে এখন মনে হচ্ছে, সেটা পরে ঠিক প্রমাণিত হয়েছে। উল্টোটাও হয়েছে। বিজ্ঞানে বার বার এই ঘটনা ঘটেছে। ঘটে চলেছে। সেটাই দস্তুর বিজ্ঞানে।
আবার কাউন্টডাউনের সময় কম্পিউটার জানিয়েছিল ইসরোর ‘রোহিনী’ঔ উপগ্রহের উৎক্ষেপণ বন্ধ রাখা উচিত। সেটা ১৯৭৯ সালের ১০ অগস্ট। কাউন্টডাউন বন্ধও করে দিয়েছিল কম্পিউটার। কিন্তু যন্ত্রের কথায় আমলা না দিয়ে তাঁর নিজের সিদ্ধান্তে ‘রোহিনী’ উৎক্ষেপণের নির্দেশ দিয়েছিলেন ভারতের প্রয়াত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ‘মিসাইল ম্যান’ এ পি জে আবদুল কালাম। উৎক্ষেপণের মিনিট দেড়েকের মধ্যেই বঙ্গোপসাগরে ভেঙে পড়েছিল রোহিনী। তার ১১ মাসের মাথায় অবশ্য সেই কালামের তদারকিতেই সম্ভব হয়েছিল রোহিনীর সফল উৎক্ষেপণ।
ভুল নয়, সেটা সত্য থেকে সত্যতরে পৌঁছনো...
সন্দীপের কথায়, ‘‘আমি এগুলিকে ভুল বলে মানতে রাজি নই। অসার্থকতা বলব না। বরং বলব, সত্যের একটি স্তর থেকে আরও একটি স্তরে পৌঁছনো। সত্য যখন সত্যতর হয়ে ওঠে। তার পর পৌঁছয় সত্যতমে। তার পরেও সত্যতমের চেয়ে অধিকতর সত্যকে খুঁজে পাওয়া যায়। তখন আগে যাকে ‘সত্যতম’ ভাবা হচ্ছিল, তা ‘তম’ থেকে ‘তর’ হয়ে যায়। বিজ্ঞান এই ভাবেই এগিয়ে চলে। সত্যের একটি স্তর থেকে পৌঁছে যায় আরও একটি স্তরে। সত্য কোনও কনস্ট্যান্ট বা ধ্রুবক নয়। সত্যতম বলে কিছু নেই। এখনও আইনস্টাইনের সাধারণ ও বিশেষ আপেক্ষিকতাবাদে কোনও ভুল বা অসঙ্গতি রয়েছে কি না, তা খুঁজে চলেছেন বিজ্ঞানী, গবেষকরা।’’
বিজ্ঞানে এমন ‘ভুল’ তাই পরে সত্যেরই আরেকটি স্তরে পৌঁছে দিতে সাহায্য করে বিজ্ঞানকে।
যাচাই করে দেখার পদ্ধতির অভাবেও ভুল হয়েছে বিজ্ঞানে
উনিশ শতকের মাঝামাঝি বিজ্ঞানীদের আরও একটি ভুলের কথা মনে পড়ছে। দুই বিশিষ্ট বিজ্ঞানী জন কেলভিন ও হ্যেরমান হেলমহোলথ্জের ভুল! তাঁরা বলেছিলেন, সূর্য ক্রমশই চেহারায় ছোট হয়ে আসছে। তার ভিতরের জোরালো টানই তাকে ‘ফুলেফেঁপে’ না থাকতে দিয়ে ক্রমশই ‘চুপসে’ দিচ্ছে। তার ফলেই তার ভিতর থেকে বেরিয়ে আসছে আলো ও তাপশক্তি। কেলভিন, হেলমহোলথ্জ একেবারে হিসেবটিসেব কষে বলেছিলেন, ওই ভাবে সূর্যের ব্যাসার্ধ ফি-বছরে কমছে ৩০ মিটার করে।
অর্ণব বললেন, ‘‘সূর্যের চেহারাটা অত বড়। তার ব্যাসার্ধ বছরে ৩০ মিটার করে কমলে, তা মাপাটাও তো চাট্টিখানি কথা নয়! সেই সময় তেমন কোনও প্রযুক্তিও ছিল না আমাদের হাতে যাতে কেলভিন, হেলমহোলথ্জের হিসেবটিসেব সঠিক কি না, তা পরীক্ষা করে দেখা যায়। প্রায় সাড়ে পাঁচ দশক পর, ১৯৩০-এ বিখ্যাত বিজ্ঞানী হান্জ বেতে পরীক্ষা করে দেখান, সূর্য থেকে আলো ও তাপ বেরিয়ে আসার যে কারণ জানিয়েছেন কেলভিন, হেলমহোলথ্জ, তা সঠিক নয়। সূর্য থেকে বেরিয়ে আসা ওই বিপুল আলো ও তাপশক্তির উৎস তার ভিতরে থাকা একটি পরমাণু চুল্লির জন্য।’’
কিন্তু পরমাণু চুল্লিটা কী ভাবে চলে, তা বুঝতে গেলে তো পরমাণুর নিউক্লিয়াস বা তার কেন্দ্রের সম্পর্কে একটা ধারণা থাকতে হবে। কেলভিন, হেলমহোলথ্জের সময় যে ধারণাটাই ছিল না আমাদের। বিজ্ঞানী এডিংটনই যা প্রথম বলতে শুরু করেছিলেন বিশ শতকের গোড়ার দিক থেকে। বেতে পরীক্ষা করে দেখালেন, এডিংটনের বক্তব্যটাই সঠিক। কেলভিন, হেলমহোলথ্জের তত্ত্বে ভুল রয়েছে বড়সড়।
কিন্তু তখন তো পরমাণুর নিউক্লিয়াসের অস্তিত্বের সত্যটাই আমাদের জানা ছিল না!
তাই সন্দীপ মনে করেন, ল্যান্ডার বিক্রমকে চাঁদের মাটিতে পরিকল্পনামাফিক নামাতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা, বলব না। কারণ, চাঁদের মাটি, তার অভিকর্ষ বল, এলাকা ভেদে তার ভিন্নতা নিয়ে আমাদের কাছে এখনও পর্যন্ত যতটুকু তথ্য রয়েছে, তার ভিত্তিতেই বিক্রমের নিরাপদ অবতরণের পরিকল্পনা করেছিল ইসরো। সেই মতোই প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছিল।
ফলে, প্রযুক্তির যদি কোনও ব্যর্থতা হয়েও থাকে চাঁদের পিঠে বিক্রমের পা ছোঁয়ানোর ক্ষেত্রে, তা শুধুই প্রযুক্তির কারণে না-ও হতে পারে, এমনটাও বলছেন বিজ্ঞানীদের একাংশ।
বিক্রমের বিপত্তি হতে পারে সফ্টওয়্যারের ‘বাগ’-এর ফলেও!
অন্য অংশটি অবশ্য তা মানতে চান না। যেমন বেঙ্গালুরুর ‘রমন রিসার্চ ইনস্টিটিউট (আরআরআই)-এর অধ্যাপক বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিমান নাথ। তাঁর কথায়, ‘‘প্রযুক্তি ও বিজ্ঞান একেবারেই দু’টি আলাদা জিনিস। মানছি, তাদের মধ্যে পরস্পর নির্ভরতা রয়েছে। আবার সব সময়েই যে তা থাকে, তা কিন্তু নয়। বিজ্ঞানের কোনও তত্ত্ব (থিয়োরি) বা হাইপোথিসিস পরীক্ষানিরীক্ষায় সাফল্য না পেলে সেই তত্ত্ব বা হাইপোথিসিস বানানোর সময় যে ধারণাগুলিকে সত্য বলে ধরা হয়েছিল, তা কতটা সঠিক তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়। প্রয়োজনে সেই ধরাণাগুলিকে সংশোধন বা পরিবর্তন, পরিমার্জন করা হয়। পরিবর্ধনও করা হয়। প্রযুক্তির গলদ খতিয়ে দেখার ক্ষেত্রে ততটা প্রয়োজন হয় না। কোনও সফ্টওয়্যারে ‘বাগ’ ধরা পড়লে কি সফ্টওয়্যার তৈরির অ্যালগরিদম নিয়ে কাটাছেঁড়া হয় কখনও?’’
বিমানের মতে, বিক্রমকে নিয়ে সমস্যার কারণটা একেবারেই যান্ত্রিক গোলযোগ। নাট-বল্টুর ত্রুটি-বিচ্যুতিও বলা যায়! তা কম্পিউটার প্রোগ্রামিং-এর গলদের জন্যও হতে পারে।
ইউক্লিডের জ্যামিতিও ঠিক তাঁর সময়ে, সঠিক আইনস্টাইনের জ্যামিতিও
তবে সেটাই যে ধ্রুব সত্য, তা-ও নয়। কারণ, ইউক্লিডের জ্যামিতি জানিয়েছিল, একটি সরলেরেখা মানে একেবারেই সরল, সোজা একটি লাইন। যে কোনও তিনটি কোণকে যোগ করলে তার মান হয় ১৮০ ডিগ্রি। ইউক্লিডের জ্যামিতির সময় স্পেস সম্পর্কে আমাদের যে ধারণা ছিল, তাতে বাড়ির পড়ার টেবিলে একটি সরলরেখা টানা যা, মহাকাশেও ঠিক তা-ই। ইউক্লিডের জ্যামিতির ভিত্তিতে তৈরি হয় ক্লাসিকাল ফিজিক্স। যে পথের প্রধান পথিক ছিলেন নিউটন। আর আইনস্টাইনের জ্যামিতি দেখাল, পৃথিবীর ধারণায় আমরা যাকে সরলরেখা বলি, মহাকাশে তেমন কোনও সরলরেখা কখনই টানা সম্ভব নয়। কারণ, স্পেস-টাইমের বক্রতা (কার্ভেচার) রয়েছে। ফলে, সেখানে কোনও সরলরেখা টানা হলে, তা-ও বেঁকেচুরে যাবে।
আরও পড়ুন- চাঁদে নামার দিন বাছাইয়েই বোধহয় ভুল করল ইসরো, তবে আশা এখনও শেষ হয়ে যায়নি
তাই সন্দীপ বলছেন, ‘‘আমি বলব এটাকে লোয়ার ট্রুথ (সত্য) থেকে হায়ার ট্রুথে (সত্যতর) যাওয়া। ইউক্লিড পার্থিব ধারণায় ভুল ছিলেন না। আইনস্টাইনও এই ব্যাপারে ব্রহ্মাণ্ডের নিয়মকানুনের ব্যাখ্যা করতে ভুল করেছিলেন, সেই প্রমাণটা এখনও পর্যন্ত আমাদের হাতে আসেনি।’’
ইসরো এখনও নিশ্চিত নয়, গলদটা কোথায়?
বিক্রমের নিরাপদ অবতরণে বাধাটা কোথায় হয়েছিল, সে ব্যাপারেও তো নিশ্চিত নয় এখনও ইসরো। তার থ্রাস্টারের সমস্যা হতে পারে। গতি কমাতে গিয়ে নীচে নেমে আসার গতি বাড়িয়ে দিয়ে থাকতে পারে বিক্রমের। আবার এও হতে পারে, চাঁদের মাটিতে যেহেতু পদার্থের ঘনত্ব এলাকাভেদে খুব দ্রুত বদলে যায়, তাই তার অভিকর্ষ বলের তারতম্যও এলাকাভেদে হয় একটু বেশি পরিমাণেই। ফলে, যে জায়গায় বিক্রমের নামার কথা ছিল, কোনও কারণে গত ৭ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে ঠিক সেই জায়গাটায় যদি বিক্রম না নেমে থাকে, নেমে থাকে ধারেকাছের এমন কোনও জায়াগায় যেখানে চাঁদের অভিকর্ষ বলের টানটা বেশি, তা হলে সেই টানই আমাদের ল্যান্ডারকে আছড়ে ফেলতে পারে চাঁদের পিঠে। আবার বিমান যেমন বলেছেন, সমস্যাটা হতে পারে নিছকই নাট-বল্টুর বা সফট্ওয়্যারের ‘বাগ’জনিতও।
বিজ্ঞানে যতটা ‘ওপ্ননেস’, প্রযুক্তির গবেষণা কি ততটা খোলামেলা?
যদিও মোহনপুরের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স এডুকেশন অ্যান্ড রিসার্চ (আইসার-কলকাতা)-এর অধ্যাপক বিশিষ্ট সৌরপদার্থবিজ্ঞানী দিব্যেন্দু নন্দী মনে করেন, ‘‘বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণাটা ঠিক একই ভাবে চলে না। বিজ্ঞানে নতুন কোনও পেপার বেরলে তা আন্তর্জাতিক জার্নালে ছাপা হয়। তা বিশ্বের সব প্রান্তের গবেষক, বিজ্ঞানীরাই জানতে পারেন। কিন্তু নাসা মহাকাশ অভিযানে যে নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেছে, তা তো আর ভারতকে দেবে না। প্রচুর ডলারের বিনিময়েও দেবে না। আর সেই প্রযুক্তির খুঁটিনাটি কোনও আন্তর্জাতিক জার্নালেও প্রকাশিত হয় না। তাই সেখান থেকে সেই প্রযুক্তির খুঁটিনাটি জানাটাও সম্ভব হয় না।’’
ফলে, ইসরোকে নিজের মতো করেই এগতে হয়, হয়েছে। হবেও। মহাকাশ অভিযানকে সফল করার জন্য কোনও নতুন প্রযুক্তি আনতে গেলে তা নাসা বা ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির (ইসা) সঙ্গে কথা বলে আনা সম্ভব নয় ইসরোর পক্ষে। ইসরোকে এগতে হবে তার নিজের এলেমেই। নাসাকেও সেই ভাবেই এগতে হয়েছে, ইসা-কেও এগতে হয়েছে। এগতে হয়েছে রুশ মহাকাশ গবেষণা সংস্থা ‘রসকসমস’-কেও।
গ্রাফিক: তিয়াসা দাস ও শৌভিক দেবনাথ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy