Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Nirbhaya Case

সূর্য ওঠার আগেই ফাঁসি হয়ে গেল নির্ভয়ার চার ধর্ষক-হত্যাকারীর

অপরাধের সাত বছর তিন মাস চার দিন পর শাস্তি। মোট অপরাধী ছ’জন। এক জন জেলেই আত্মঘাতী। এক জন নাবালক বলে তিন বছরের সাজার পর মুক্ত।

ফাঁসি হয়ে গেল। (বাঁ দিক থেকে) বিনয়, পবন, অক্ষয়, মুকেশ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

ফাঁসি হয়ে গেল। (বাঁ দিক থেকে) বিনয়, পবন, অক্ষয়, মুকেশ। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

সংবাদ সংস্থা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২০ মার্চ ২০২০ ০৫:৪০
Share: Save:

দিন গুনছিল পরিবার। অপেক্ষায় ছিল প্রায় গোটা দেশ। অবশেষে, অপরাধের সাত বছর তিন মাস চার দিন পর, দিল্লির তিহাড় জেলে আজ সকাল হওয়ার আগেই ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হল দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের চার প্রাপ্তবয়স্ক অপরাধীকে। মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হল মুকেশ সিংহ, বিনয় শর্মা, পবন গুপ্ত এবং অক্ষয় কুমার সিংহের।

এই মামলায় মোট অপরাধী ৬ জন। বিচার চলাকালীন তিহাড় জেলেই আত্মহত্যা করে এক অপরাধী রাম সিংহ। নাবালক হওয়ায়, তিন বছর হোমে থেকেই সাজার মেয়াদ শেষ করে, ২০১৫ সালে মুক্তি মেলে আর এক অভিযুক্তের। যদিও পুলিশি তদন্তে উঠে এসেছিল, নির্ভয়ায় উপর সেই রাতে সবচেয়ে নির্মম ভাবে অত্যাচার চালিয়েছিল এই নাবালকই।

২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাতে, দিল্লির রাস্তায় চলন্ত বাসের মধ্যে গণধর্ষণ এবং ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হন প্যারামেডিক্যালের ছাত্রী, বছর ২৩-এর তরুণী। বাধা দিতে গিয়ে প্রচণ্ড মারধর খেতে হয় তাঁর পুরুষ সঙ্গীকেও। ঘটনার পৈশাচিকতায় শিউরে উঠেছিল গোটা দেশ। তরুণীর আসল নাম পরে প্রকাশ্যে এলেও, নির্ভয়া নামেই তিনি পরিচিত হয়ে গিয়েছিলেন তত দিনে। শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি নির্ভয়াকে। নির্মম অত্যাচারের ১৩ দিন পর, ২৯ ডিসেম্বর তাঁর মৃত্যু হয়।

নির্ভয়ার মা। ছবি: পিটিআই।

ঘটনার কয়েক দিনের মধ্যেই, দিল্লি পুলিশের হাতে একে একে ধরা পড়ে বাস চালক রাম সিংহ, মুকেশ সিংহ (রাম সিংহের ভাই), বিনয় শর্মা, পবন গুপ্ত, অক্ষয় সিংহ এবং এক নাবালক। শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। পুলিশ দাবি করেছিল, হেফাজতে থাকার সময় অপরাধের কথা কবুল করেছিল ৬ জনই।

নির্ভয়ার ধর্ষণ ও খুন দেশকে এতটাই আলোড়িত করেছিল যে, দ্রুত বিচারের জন্য প্রবল চাপ তৈরি হয় সরকারের উপর। ২০১৩ সালের ২ জানুয়ারি দিল্লির সাকেত আদালতে, ধর্ষণ মামলার জন্য দেশের প্রথম ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট চালু হয়। উদ্বোধন করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি আলতামাস কবির। পরদিনই সেখানে নির্ভয়া মামলার চার্জশিট পেশ করে দিল্লি পুলিশ। নির্ভয়াকে ধর্ষণ, খুন, অপহরণ, প্রমাণ লোপাট-সহ বিভিন্ন ধারায় এবং নির্ভয়ার বন্ধুকে খুনের চেষ্টার অভিযোগে চার্জ গঠন করে আদালত।

২০১৩ সালেই, ১০ সেপ্টেম্বর ধৃত ছ’জনকে দোষী সাব্যস্ত করেন ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক যোগেশ খন্না। তার আগেই, ১১ মার্চ জেলে আত্মহত্যা করে অন্যতম আসামী রাম সিংহ আর অগস্টে জুভেনাইল কোর্ট তিন বছরের সাজা দেয় নাবালক অপরাধীকে। ১৩ সেপ্টেম্বর বাকি চার সাবালক অপরাধীকে ফাঁসিতে ঝোলানোর নির্দেশ দেন ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক। আসামী পক্ষের আইনজীবীদের আর্জি খারিজ করে বিচারক খন্না বলেন, এই ঘটনা ‘‘ভারতবাসীর সমবেত বিবেককে ধাক্কা দিয়েছে। তাই আদালত চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে পারে না।’’

চার প্রাপ্তবয়স্ক ধর্ষক-খুনীই নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে দিল্লি হাইকোর্টে সাজা কমানোর আর্জি জানায়। ২০১৪ সালের ১৩ মার্চ উচ্চ আদালত অপরাধীদের আর্জি খারিজ করে মৄত্যুদণ্ডের আদেশই বহাল রাখে। হাইকোর্ট জানায়, যে ধরনের অপরাধ করেছে দোষীরা, তা ‘বিরলের মধ্যে বিরলতম’ শ্রেণিতে পড়ে, যার শাস্তি মৃত্যুদণ্ড।

জলকামানের মুখেই চলছিল প্রতিবাদ। ছবি: রয়টার্স।

এর পর, দোষীদের মধ্যে তিন জন— মুকেশ সিংহ, বিনয় শর্মা ও পবন গুপ্ত— ফাঁসির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করার আর্জি জানিয়েছিল সুপ্রিম কোর্টেও। কিন্তু ২০১৮ সালের ৯ জুলাই তৎকালীন প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বেঞ্চ সেই আর্জি খারিজ করে দেয়।

আদালতে তোলার সময় বিনয় শর্মা। ছবি: ফাইল চিত্র।

এর পর বিনয় শর্মার হয়ে তাঁর আইনজীবী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণ ভিক্ষার আর্জি জানিয়েছিলেন। কিন্তু বিনয় বলেছিল, তাকে না জানিয়েই এই প্রাণ ভিক্ষার আর্জি জানানো হয়। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সূত্রে জানা যায়, বিনয় তার প্রাণ ভিক্ষার আর্জি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।

অন্য দিকে অক্ষয় কুমার সিংহ গত ১০ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টে আলাদা আপিল মামলায় সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করার আর্জি জানায়। ১৮ ডিসেম্বর সে আর্জি খারিজ করে দেয় শীর্ষ আদালত।

এ বছর ৭ জানুয়ারি দিল্লির পাতিয়ালা হাউজ কোর্ট রায় দেয়, ২২ জানুয়ারি সকাল ৭টায় ফাঁসি দেওয়া হবে চার জনকে। এর পর ক্ষমা ভিক্ষা চায় বিনয় এবং মুকেশ। সে আবেদনও খারিজ হয়ে যায়। এর পর ফের রায় সংশোধনের আর্জি জানায় দু’জন। বিনয় দাবি করে, ঘটনার সময় সে নাবালক ছিল। কিন্তু সেই আবেদনও খারিজ হয় শীর্ষ আদালতে। এর পর দিল্লির পাটিয়ালা হাউজ কোর্ট জানিয়ে দেয়, চার জনের ফাঁসি হবে ১ ফেব্রুয়ারি।

কিন্তু ফাঁসি পিছতে এর পরেও আইনি কৌশল থামায়নি অপরাধীরা। শেষ পর্যন্ত ফাঁসির দিন ধার্য হয় ৩ মার্চ। এর মাঝে রায় সংশোধনের আর্জি জানায় পবন। ২ মার্চ তা খারিজ করে সুপ্রিম কোর্ট। ওই দিনই রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আর্জি করে পবন। এর জেরে ফের স্থগিত হয়ে যায় ফাঁসি। রাষ্ট্রপতি পবনের প্রাণ ভিক্ষার আর্জি খারিজ করে দেওয়ার পর, চতুর্থ বারের জন্য মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে আদালত। দিল্লির পটিয়ালা কোর্ট জানিয়ে দেয়, ২০ মার্চ ফাঁসি দেওয়া হবে চার জনকে।

এর পরও ফাঁসি রদ বা পিছনোর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন অপরাধীদের আইনজীবীরা। সুপ্রিম কোর্টে যেমন নতুন আবেদন করা হয়েছে, তেমনই আবেদন করা হয়েছে আন্তর্জাতিক আদালতেও। কিন্তু এ বার আর কোনও আইনি কৌশলই কাজে লাগেনি...

অবশেষে দীর্ঘ সওয়া সাত বছরের টানাপড়েনের পর, শুক্রবার ভোর সাড়ে পাঁচটায় ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হল চার জীবিত সাবালক অপরাধীকে। ১৬ ডিসেম্বর, ২০১২ থেকে ২০ মার্চ, ২০২০— সম্পূর্ণ হল অপরাধ থেকে বিচার হয়ে শাস্তিদানের বৃত্ত। দুর্বৃত্তদের মধ্যে একজনই বেঁচে রইল ঘটনার সময় সাবালক না হওয়ার কারণে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy