‘এলগার পরিষদ’-এর অনুষ্ঠানের পর মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকায় দলিত-মরাঠা সংঘর্ষ হয়।—ফাইল চিত্র।
মাওবাদী কাজকর্মের সঙ্গে কোনও ভাবে যুক্ত ছিলেন, নাকি সরকার বিরোধী অবস্থান নেওয়ায় খেসারত দিতে হচ্ছে? ভীমা কোরেগাঁও হিংসার ঘটনায় বৃহস্পতিবার ৮৩ বছরের স্টান স্বামী গ্রেফতার হওয়ার পর থেকেই এই প্রশ্ন উঠছে। তার মধ্যেই শুক্রবার এই মামলায় অতিরিক্ত চার্জশিট জমা দিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ। তাতে বলা হয়েছে, নিষিদ্ধ মাওবাদী সংগঠন কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া-মাওইস্ট (সিপিআই-মাওইস্ট)-এর কাজকর্মে সক্রিয় ভাবে যুক্ত ছিলেন স্টান স্বামী। শহুরে এলাকায় মাওবাদীদের হয়ে কাজকর্ম চালিয়ে যেতে ওই সংগঠনের কাছ থেকে মোটা টাকাও পেয়েছিলেন তিনি।
বৃহস্পতিবার রাতে রাঁচীর বাড়িতে হানা দিয়ে স্টান স্বামীকে গ্রেফতার করে দিল্লি থেকে যায় এনআইএ-র একটি দল। তাঁকে তুলে নিয়ে আসার আগে সেখানে প্রায় ২০ মিনিট তল্লাশিও চালান কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা। তাতে মাওবাদী সাহিত্য, তাদের সংগঠনের হয়ে প্রচার সংক্রান্ত বেশ কিছু নথিপত্র হাতে এসেছে বলে দাবি করেছে এনআইএ। ভীমা কোরেগাঁও মামলার অন্য অভিযুক্তদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ থাকার প্রমাণও মিলেছে বলে দাবি করেছেন কেন্দ্রীয় তদন্তকারীরা। এ দিন মুম্বইয়ের বিশেষ আদালতে তোলা হয় স্টান স্বামীকে। আগামী ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত তাঁকে জেল হেফাজত দিয়েছে আদালত।
ভীমা কোরেগাঁও মামলায় অভিযুক্ত মোট ৮ জনের বিরুদ্ধে এ দিন চার্জশিট জমা দিয়েছে এনআইএ। তাতে স্টান স্বামী ছাড়াও নাম রয়েছে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ তথা নাগরিক আইন কর্মী আনন্দ তেলতুম্বড়ে, সমাজকর্মী গৌতম নওলাখা, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হানি বাবু, সমাজকর্মী সাগর গোর্খে, সংস্কৃতিকর্মী রমেশ গাইচোর এবং সমাজকর্মী জ্যোতি জগতপের। বলা হয়েছে, ওই মাওবাদী সংগঠনের আদর্শ কী ভাবে জনমানসে ছড়িয়ে দেওয়া যায়, তার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন অভিযুক্তরা। বিভিন্ন গোষ্ঠী ও ধর্মাবলম্বী মানুষের মধ্যে শত্রুতায় উস্কানি জুগিয়েছিলেন তাঁরা। হিংসা ও পরস্পরের প্রতি ঘৃণায় মদত জুগিয়েছিলেন। সরকারের মানুষকে তাতিয়ে তোলার পরিকল্পনায় শামিল ছিলেন তাঁরা। এই মুহূর্তে পুলিশ ও তদন্তকারী সংস্থার থেকে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছেন মিলিন্দ তেলতুম্বড়ে। তিনি অভিযুক্তদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষ শিবিরের আয়োজন করেছিলেন বলেও দাবি করা হয়েছে চার্জশিটে।
আরও পড়ুন: ভীমা-কোরেগাঁও হিংসায় গ্রেফতার ৮৩ বছরের মিশনারি স্টান স্বামী
৮ জন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এ দিন ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২০-বি (অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র), ১১৫ (অপরাধমূলক কাজকর্মে উৎসাহ প্রদান), ১২১ (সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা), ১২১-এ (অপরাধের ষড়যন্ত্রে শামিল থাকা), ১২৪-এ (দেশদ্রোহ), ১৫৩-এ (ধর্মীয় রীতি নীতির উপর আঘাত), ২০১ (প্রমাণ লোপাট/ভুয়ো তথ্য প্রদান), ৫০৫-১বি (ভুয়ো তথ্য ছড়িয়ে জনমানসে আতঙ্কের সঞ্চার) এবং ৩৪ (একজোটে অপরাধে শামিল হওয়া) ধারায় অভিযোগ এনেছে এনআইএ। একই সঙ্গে ১৯৬৭-র বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইনের ১৩ (শাস্তিযোগ্য অপরাধ), ১৬ (নাশকতার প্রশিক্ষণ), ১৭ (সন্ত্রাসী কাজকর্মে আর্থিক মদত), ১৮ (জেনেশুনে সন্ত্রাসী কাজকর্মে লিপ্ত হওয়া), ১৮-এ (সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ শিবিরের আয়োজন), ১৮-বি (সন্ত্রাসবাদী সংগঠনের হয়ে লোক নিযুক্ত করা), ২০ (নাশকতামূলক কাজকর্মে জড়িত সন্ত্রাবাদী সংগঠনের সদস্যপদ নেওয়া), ৩৮ (সন্ত্রাসী সংগঠনের অংশ হলেও কোনও অপরাধে না করা), ৩৯ (মিটিং, মিছিল করে সন্ত্রাসী সংগঠনের পক্ষে সমর্থন জোগাড় করা) এবং ৪০ (টাকা বা সম্পত্তির সন্দেহজনক লেনদেন) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
তৃতীয় ইঙ্গ-মরাঠা যুদ্ধে পেশোয়াদের চূড়ান্ত পরাজয় উপলক্ষে প্রতি বছর ১ জানুয়ারি ভীমা কোরেগাঁওয়ের জয়স্তম্ভে দলিত মানুষরা জড়ো হন। ১৮১৮ সালে এই দিনেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পেশোয়া শক্তিকে পরাজিত করে। সেই সময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে সাহায্য করেছিল দলিত ‘মাহার’ জনগোষ্ঠী। সেই থেকে ওই দিনটিকে তাঁরা ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন। ২০১৭ সালের ৩১ ডিসেম্বর দলিতদের ‘এলগার পরিষদ’-এর এই অনুষ্ঠানের পর দিনই হিংসা ছড়িয়েছিল পুণে জেলার ভীমা কোরেগাঁও এলাকায়। ২০১৮-র ১ এবং ২ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের বিভিন্ন এলাকায় দলিত-মরাঠা সংঘর্ষ হয়।
আরও পড়ুন: আইপিএলে খারাপ ফর্মে ধোনি, কন্যা জিভাকে ধর্ষণের হুমকি ইনস্টাগ্রামে
শুরুতে এই মামলার তদন্তভার ছিল পুণে পুলিশের হাতে। ২০১৮-র ১৫ নভেম্বর এবং ২০১৯-এর ২১ ফেব্রুয়ারি জমা দেওয়া দু’টি চার্জশিটে ১৫ জন অভিযুক্তের নাম উল্লেখ করেছিল তারা। এ বছর ২৪ জানুয়ারি এনআইএ-র হাতে ওই মামলার তদন্তভার ওঠে। অভিযুক্তদের কাছ থেকে উদ্ধার নথিপত্র, বই, পরস্পরের সঙ্গে তাঁদের কথোপকথনের রেকর্ড এবং সাক্ষীদের বয়ান ঘেঁটে চার্জশিটটি তৈরি করা হয়েছে বলে এনআইএ-র তরফে জানানো হয়েছে। তাদের দাবি, শুধু দেশের মধ্যেই নয়, এই ষড়যন্ত্রের শিকড় ভারতের বাইরেও ছড়িয়েছে। যদিও তদন্তকারী সংস্থার দাবি নিয়ে ইতিমধ্যেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করে দিয়েছেন ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ এবং প্রখ্যাত আইনজীবী প্রশান্ত ভূষণের মতো বিশিষ্ট জনেরা। তাঁদের দাবি, সরকারবিরোধী অবস্থানের জন্য পরিচিত যাঁরা, বেছে বেছে তাঁদেরকেই নিশানা করা হচ্ছে। এনআইএ-কে সরকার নিজের স্বার্থে ব্যবহার করছেন বলেও অভিযোগ করেছেন অনেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy