Advertisement
০৩ নভেম্বর ২০২৪
আস্থানায় ডোভাল-নাম

মোদীর মন্ত্রী ‘কয়েক কোটি টাকা’ ঘুষ নিয়েছেন, সুপ্রিম কোর্টে বিস্ফোরক সিবিআই কর্তা

কেন্দ্রীয় এই তদন্তকারী সংস্থার এক অফিসার সুপ্রিম কোর্টে জানালেন— সিবিআইয়ের তদন্ত ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মোদী সরকারের মন্ত্রী হরিভাই পার্থিভাই চৌধরি ‘কয়েক কোটি টাকা’ ঘুষ নিয়েছেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল হস্তক্ষেপ করেছেন রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তে। এখানেই শেষ নয়।

হরিভাই পার্থিভাই চৌধরি, নরেন্দ্র মোদী এবং অজিত ডোভাল।

হরিভাই পার্থিভাই চৌধরি, নরেন্দ্র মোদী এবং অজিত ডোভাল।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৮ ০২:৩৮
Share: Save:

সিবিআইয়ের গৃহযুদ্ধের কাদা ছিটকে এ বার নরেন্দ্র মোদী সরকারের চোখে-মুখে।

কেন্দ্রীয় এই তদন্তকারী সংস্থার এক অফিসার সুপ্রিম কোর্টে জানালেন— সিবিআইয়ের তদন্ত ধামাচাপা দেওয়ার জন্য মোদী সরকারের মন্ত্রী হরিভাই পার্থিভাই চৌধরি ‘কয়েক কোটি টাকা’ ঘুষ নিয়েছেন। জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল হস্তক্ষেপ করেছেন রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তে। এখানেই শেষ নয়। সিবিআইয়ের ওই আইপিএস অফিসার, ডিআইজি মণীশ কুমার সিন্‌হা আঙুল তুলেছেন ক্যাবিনেট সচিব পি কে সিন্‌হা, আইন মন্ত্রকের সচিব সুরেশ চন্দ্র, মুখ্য ভিজিল্যান্স কমিশনার কে ভি চৌধরির দিকেও। অভিযোগ, প্রধানমন্ত্রী ও বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের আস্থাভাজন বলে পরিচিত আস্থানার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার মামলা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন এঁরা সকলে।

হায়দরাবাদের ব্যবসায়ী সতীশ বাবু সানা আস্থানার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ দায়ের করেছিলেন। মণীশের দাবি, তিনি সিবিআইয়ের স্পেশাল ডিরেক্টর আস্থানার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগের তদন্ত করছিলেন। সানা নিজে মাংস ব্যবসায়ী মইন কুরেশির বিরুদ্ধে মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত। জেরার মুখে সানা জানান, তিনি ২০১৮-র জুনে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হরিভাইকে কয়েক কোটি টাকা ঘুষ দেন। এর পর হরিভাই সিবিআইয়ের উচ্চপদস্থ কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে তিনি প্রধানমন্ত্রী দফতরের অধীন কর্মিবর্গ দফতরের মন্ত্রীর দফতরকে কাজে লাগান। কারণ সিবিআই ডিরেক্টর ওই মন্ত্রীরই অধীনে।

আরও পড়ুন: তিন শক্তি হাত ধরলে চাপ বাড়বে বিজেপির: রাজনাথ

নরেন্দ্র মোদী ‘না খাউঙ্গা, না খানে দুঙ্গা’ বলে দুর্নীতিমুক্ত সরকারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। সেই সরকারেরই এক মন্ত্রীর বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের এক অফিসার ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ তোলায়, প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে নতুন অস্ত্র পেয়ে গিয়েছে কংগ্রেস। বিশেষত, যে মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ, সেই হরিভাই চৌধরি গুজরাতের নেতা। বর্তমানে তিনি কয়লা ও খনি মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী। এর আগে তিনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন।

ডিআইজি মণীশ কুমার সিন্‌হা

কংগ্রেস নেতা রণদীপ সুরজেওয়ালার প্রশ্ন, ‘‘যদি রক্ষকই ভক্ষক হয়ে যায়, যদি প্রধানমন্ত্রীর দফতরে বসে চোরেদের বাঁচানো হয়, যদি প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সরাসরি ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ ওঠে, যদি প্রধানমন্ত্রীর দফতরের মন্ত্রী সেই ঘুষ নেওয়া মন্ত্রীকে সাহায্য করেন, যদি আইন সচিব তদন্তে প্রভাব খাটান, যদি ক্যাবিনেট সচিবের নাম জড়ায়, তা হলে আর দেশ চলবে কী ভাবে?’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘মোদীজি কী বলবেন, ওই মন্ত্রীরা কত টাকা ঘুষ পেয়েছেন?’’

আরও পড়ুন: শুধু কি মায়া! পরীক্ষা গুরুর কর্মভূমিতে

সিবিআইয়ের ডিআইজি মণীশ সিনহা দিল্লিতে নীরব-মেহুলের ব্যাঙ্ক প্রতারণা মামলার তদন্ত করছিলেন। সিবিআই ডিরেক্টর অলোক বর্মার সঙ্গে স্পেশাল ডিরেক্টর আস্থানার দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসার পরে তাঁদের দু’জনকেই ছুটিতে পাঠানো হয়। নাগপুরে বদলি করা হয় মণীশকেও। সেই সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েই সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন মণীশ।

অভিযোগকারী কে? সিবিআইয়ের ডিআইজি মণীশকুমার সিন্হা • নীরব মোদী-মেহুল চোক্সীদের ব্যাঙ্ক প্রতারণা, রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগের তদন্ত করছিলেন। কার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ? মন্ত্রী হরিভাই পার্থিভাই চৌধরি • ব্যবসায়ী সতীশ বাবু সানার থেকে ঘুষ নিয়েছেন। • সানা মাংস ব্যবসায়ী মইন কুরেশির বিরুদ্ধে আর্থিক নয়ছয়ের মামলায় অন্যতম অভিযুক্ত এবং আস্থানার বিরুদ্ধে অভিযোগকারী। • হরিভাই সিবিআইয়ের কর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি (প্রধানমন্ত্রীর দফতরের অধীন) কর্মিবর্গ দফতরের মন্ত্রীর দফতরকে কাজে লাগান। সিবিআই অধিকর্তা ওই মন্ত্রীর অধীনে। নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল • আস্থানার হয়ে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে ধৃত মনোজ প্রসাদের দাবি, ডোভালের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। • ডোভাল আস্থানাকে জানান যে তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে। • আস্থানা-তদন্তে তল্লাশিতে বাধা দেন ডোভাল। ক্যাবিনেট সচিব পি কে সিনহা • তিনি আইনসচিব সুরেশ চন্দ্রকে দিয়ে সানার কাছে বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে তাঁকে কেন্দ্রীয় সরকার বাঁচিয়ে দেবে। আইনসচিব সুরেশ চন্দ্র • সানাকে ক্যাবিনেট সচিবের বার্তা দেন। দেখা করতে বলেন। সিভিসি কে ভি চৌধরি • সানার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সেখানে কুরেশির বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে আলোচনা হয়।

মণীশের দাবি ছিল, মঙ্গলবার অলোক বর্মার মামলার শুনানির সঙ্গেই তাঁর মামলার শুনানি হোক। কিন্তু প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ সেই আর্জি খারিজ করে দেন। মণীশের আইনজীবী যুক্তি দেন, বিচলিত হওয়ার মতো তথ্য রয়েছে মামলার পিটিশনে। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘‘কিছুই আর আমাদের বিচলিত করে না!’’ তিনি জানান, মঙ্গলবার শুধু বর্মার মামলারই শুনানি হবে।

কেন্দ্রীয় ভিজিল্যান্স কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে শীর্ষ আদালত সোমবার দুপুর একটার মধ্যে বর্মার বক্তব্য জানতে চেয়েছিল। বর্মার আইনজীবী আজ আর্জি জানান, আরও সময় চাই। প্রধান বিচারপতি সময় বাড়িয়ে বিকেল ৪টে পর্যন্ত সময় দেন। শেষে বেলা ১টা ১০ মিনিটেই নিজের বক্তব্য জমা করেন বর্মা।

বর্মার নির্দেশেই আস্থানার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার তদন্ত করছিলেন মণীশ। মণীশের দাবি, আস্থানার হয়ে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে তাঁরা মনোজ প্রসাদ নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেন। ১৬ অক্টোবর গ্রেফতারের পরে ডোভালের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতার বড়াই করতে শুরু করেন মনোজ। মনোজের দাবি ছিল, তাঁরা বাবা, র (রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানাটিক্যাল উইং)-এর প্রাক্তন অফিসার দীনেশ্বর প্রসাদের সঙ্গে ডোভালের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। ডোভালকে ব্যক্তিগত সমস্যায় তাঁরা সাহায্যও করেছেন। ডোভাল ও র-এর স্পেশাল সেক্রেটারি সমন্ত গোয়েলের মাধ্যমে সিবিআই অফিসারদের উচিত শিক্ষা দেবেন বলে হুমকি দেন মনোজ।

মণীশের দাবি, ডোভালই আস্থানাকে জানিয়ে দেন যে তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর হয়েছে। আস্থানা অনুরোধ করেন, তাঁকে যেন গ্রেফতার করা না-হয়। তদন্তে তল্লাশি চালানোর দরকার পড়লে বর্মা জানান, ডোভালের থেকে সবুজ সঙ্কেত মিলছে না। তল্লাশির সময়েও ডোভালের নির্দেশে তা থামিয়ে দিতে হয়। বর্মার বিশ্বস্ত যুগ্ম অধিকর্তা এ কে শর্মাকেও ডোভাল ইন্টারপোলের পদের জন্য প্রতিযোগিতায় নামতে দেননি।

মণীশের অভিযোগ, আস্থানার বিরুদ্ধে তদন্তে নাক গলিয়েছিলেন আইন সচিব সুরেশ চন্দ্রও। তাঁর হয়ে অন্ধ্র ক্যাডারের অফিসার রেখা রানি যোগাযোগ করেন সতীশ সানার সঙ্গে। সানা আইনসচিবের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলেন। আইন সচিব তাঁকে জানান, তিনি নীরব মোদীর মামলা সংক্রান্ত কাজে লন্ডনে। ক্যাবিনেট সচিবের বার্তা পৌঁছে দিতে চার-পাঁচ দিন ধরে তিনি সানার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছেন। সেই বার্তা হল, সরকার সানাকে সব রকম সুরক্ষা দেবে। সানাকে তাঁর সঙ্গে দেখা করতেও বলেন সচিব। আইন সচিব অবশ্য এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তাঁর যুক্তি, ‘‘সবটাই মিথ্যে। কোনও দিন লন্ডনে যাইনি। সতীশ সানা বা রেখা রানিকেও চিনি না।’’

মণীশের দাবি— সানা সিবিআই অফিসারদের প্রশ্নের মুখে জানান, মুখ্য ভিজিল্যান্স কমিশনার কে ভি চৌধরির সঙ্গেও তিনি দেখা করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন চৌধরির এক আত্মীয়। মইন কুরেশির বিরুদ্ধে মামলা নিয়ে আলোচনা হয় সেই বৈঠকে।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE