বীরাপ্পনের ছবি দেখাচ্ছেন তাঁর শ্যালকের মেয়ে সৌমাইয়া। নিজস্ব চিত্র।
পাহাড়ের দিক থেকে আসা ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে লড়াই করে প্রদীপ জ্বালানোর চেষ্টা করছেন বছর সত্তরের এক বৃদ্ধ। বার বার নিভে যাচ্ছে। বেশ কয়েক বারের চেষ্টায় বাতি জ্বালিয়ে সমাধির মুখে একটা পাথরের টুকরো দিয়ে আড়াল করে উঠে দাঁড়ালেন।
তামিলনাড়ু-কর্নাটক সীমানা লাগোয়া ছোট্ট শহর মেত্তুর। সেখান থেকে কর্নাটকের দিকে আরও ১০ কিলোমিটার এগিয়ে গেলে মুলাকাড়ু গ্রাম। ওই গ্রামেরই এক প্রান্তে অনাড়ম্বরভাবে শায়িত কুখ্যাত চন্দন দস্যু বীরাপ্পনের দেহ।
মুলাকাড়ু গ্রামেরই বাসিন্দা ওই বৃদ্ধ আলাখাপ্পার। ভিন রাজ্যের এই সাংবাদিকের কথা না বুঝতে পারলেও, বীরাপ্পন নামটা শুনেই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, মাটি-পাথর দিয়ে তৈরি সমাধিটা। গত ১৫ বছর ধরে প্রতি দিন, দিনের শেষে ওই সমাধি ক্ষেত্রে এসে বাতি জ্বালিয়ে পরিষ্কার করে যেতে কখনও ভুলে যাননি বৃদ্ধ আলাখাপ্পার। বেঁচে থাকলে আলাখাপ্পারের থেকে বয়সে কয়েক বছরের ছোটই হতেন বীরাপ্পান। গোটা বিশ্বের কাছে কুখ্যাত হলেও, আলাখাপ্পারের দাবি, ‘‘খুব ভাল মানুষ ছিলেন চন্দন দস্যু। গ্রামের গরিব মানুষদের অর্থ দিয়ে সাহায্য করা থেকে শুরু করে, সবার খোঁজ খবর রাখতেন বীরাপ্পন। বিপদে পড়ে হাত পাতলে কোনও দিন ফিরিয়ে দেননি।” দূরে তামিলনাড়ু-কর্নাটক সীমানার জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়ের দিকে আঙুল তুলে বললেন বৃদ্ধ, ‘‘ওখানে বসে সব নজর রাখতেন তিনি।’’
কেবল আলাখাপ্পার নন, মুলাকাড়ু গ্রামের কলেজ পড়ুয়া স্মিতা বা তাঁর প্রতিবেশী সুদর্শন— সবারই দাবি উপকারী মানুষ ছিলেন কুখ্যাত চন্দন দস্যু। সুদর্শন বলেন, ‘‘সরকার এই সব গ্রামে পানীয় জলের ব্যবস্থা করার বহু আগে বীরাপ্পন ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন জলের।”
বীরাপ্পনের সমাধি।
আরও পড়ুন: টাইগার প্রভাকরণই আদর্শ, রাজীব হত্যার কারিগরের নামেই ভোট চান এঁরা
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
সরকারি নথি বলে, ১৮৪ জনকে খুনের অভিযোগ রয়েছে বীরাপ্পনের বিরুদ্ধে। গোটা জীবনে মেরেছেন কম করে হাজার খানেক হাতি। পাচার করেছেন কয়েক হাজার টন চন্দন কাঠ এবং হাতির দাঁত। তামিলনাড়ু-কর্নাটক সরকার তাঁর মাথার দাম ঘোষণা করেছিল ৪০ কোটি টাকা। মৃত্যুর ১৫ বছর পরেও সেই কুখ্যাত চন্দন দস্যুর ‘রবিন হুড’ ইমেজ কিন্তু বজায় রয়ে গিয়েছে গোটা এলাকায়। চেন্নাই থেকে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ে মেত্তুর শহরে হোটেল করেছেন তরুণ ইলাভারাসান। তাঁর কাছেও ‘হিরো’ বীরাপ্পন। তাঁর কথায়, ‘‘যাঁদের মেরেছেন তাঁরা হয় পুলিশ, নয় তো সরকারি লোক। সাধারণ মানুষের কোনও ক্ষতি করেননি তিনি। সর্বোপরি ভান্নিয়ারদের জন্য তিনি অনেক কিছু করেছেন।”
দুই রাজ্যের সীমানা লাগোয়া কর্নাটকের গোপিনাথম গ্রামে জন্ম বা বড় হলেও, আদতে তামিলনাড়ুর ‘পিছিয়ে থাকা’ ভান্নিয়ার সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন বীরাপ্পন। তাঁদের পরিবারের আদি বাড়িও মুলাকাড়ু। তাঁর শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী, মুলাকাড়ুতেই সমাধিস্থ করা হয়েছিল বীরাপ্পনকে। রাজ্যে ভান্নিয়ারদের জনসংখ্যা প্রায় ২৫ শতাংশ, তবে রাজ্যের উত্তর পশ্চিম দিকের ধর্মপুরী জেলায় প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষই ভান্নিয়ার সম্প্রদায় ভুক্ত। বীরাপ্পনের মুলাকাড়ু গ্রাম এই ধর্মপুরী জেলাতেই পড়ে।
মুলাকাড়ু গ্রামে বীরাপ্পনের সমাধিতে ১৫ বছর ধরে বাতি দেন আলাখাপ্পার। নিজস্ব চিত্র।
সেই কারণেই বোধহয়, সমাধিতে শুয়ে থেকেও, আজও প্রাসঙ্গিক রয়ে গিয়েছেন মৃত বীরাপ্পনও। ইলাভারাসানের কাছেই ঠিকানা পেলাম বীরাপ্পানের স্ত্রী মুথুলক্ষ্মীর। মেত্তুর থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে পোট্টানেরি গ্রামে প্রাসাদোপম না হলেও বেশ বড়সড় বাড়ি। দুই মেয়ে ব্রভাবতী এবং বিদ্যারাণী আইনের পড়ুয়া। মুথুলক্ষ্মী নিজে ব্যস্ত ভোটের প্রচারে।
ধর্মপুরীতে ডিএমকের চিকিৎসক প্রার্থী সেন্থিলকুমারের হয়ে তিনি প্রচার করছেন। উল্টো দিকে প্রার্থী এআইএডিএমকে জোটের পাত্তালি মাক্কাল কাচ্চি (পিএমকে)-র প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অন্বুমণি রামাডস। মুথুলক্ষ্মীর দাবি, ‘‘আম্মাই খুন করেছিল আমার স্বামীকে। আম্মার জমানাতেই মারা হয়। তাই আম্মা নয়, আন্নার হয়ে প্রচার করছি। আন্না (করুনানিধি) বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন আমার স্বামীকে। মানুষকেও সেই কথাই বোঝাচ্ছি।”
পট্টানেরির বাড়িতে বীরাপ্পনের স্ত্রী মুথুলক্ষ্মী। নিজস্ব চিত্র।
বীরাপ্পানের অর্থ এবং রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে গোটা রাজ্যে অনেক কাহিনী কিংবদন্তী হয়ে আছে। তামিলনাড়ুর এক পরিচিত পুলিশ কর্তা বলছিলেন, ‘‘এক বার পুলিশ বীরাপ্পনকে ঘিরে ফেলেছে। হঠাৎ পুলিশের কাছে নির্দেশ এল পিছিয়ে যেতে। পরে জেনেছিলাম, জঙ্গলে বসেই উনি স্যাটেলাইট ফোনে যোগাযোগ করেছিলেন কোনও এক শীর্ষ তামিল রাজনীতিবিদকে।” এই গল্প আদৌ সত্যি কি না জানি না, তবে রামাডসের বাবার হাতে তৈরি পিএমকে-ও এক সময় বীরাপ্পনের ঘনিষ্ঠ ছিল বলে দাবি করেন রাজ্যের অনেকেই। ভান্নিয়ারদের জন্য তৈরি সামাজিক সংগঠন থেকে জন্ম পিএমকে-র। রামাডস নিজেও সেই সম্প্রদায়ের। সেন্থিলের মত তাঁর প্রচারেও জায়গা করে নিয়েছেন বীরাপ্পন। তাঁদের পাল্টা দাবি, বীরাপ্পন আত্মসমর্পণ করে মূলস্রোতে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন। কিন্তু করুনানিধির ডিএমকে সরকার তা করতে দেয়নি। মুথুলক্ষ্মীও স্বীকার করেন, ১৯৯৩ সালে করুণানিধির সঙ্গে বীরাপ্পনের সাংবাদিক বন্ধু নক্কিরণ গোপাল মারফৎ আত্মসমর্পণের কথাবার্তা চলছিল। বীরাপ্পন দাবি করেছিলেন, সব মামলা তুলে নিতে হবে। কিন্তু গোপাল নিজেই পুরোপুরি ভরসা করতে পারছিলেন না আন্না সরকারকে।” তাই বীরাপ্পনকে সামনে রেখে পাল্টা তোপ দাগতে ছাড়ছে না পিএমকেও।
দেশের সবচেয়ে সফল স্বাস্থ্য যোজনা হিসাবে স্বীকৃত জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন (ন্যাশনাল রুরাল হেল্থ মিশন)-এর রূপকার অন্বুমণি রামাডস তামাক জাত পদার্থের বিক্রিতে বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছিলেন। কিন্তু নিজের কেন্দ্রে চন্দন দস্যুর ইমেজ আর জাতি সমীকরণেই আটকে তাঁর নির্বাচনী ভাগ্য!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy