গাঁধীনগরে বিজেপি কার্যালয়। —নিজস্ব চিত্র।
বিদায়ী সাংসদকে গাঁধীনগর থেকে একেবারেই বিদায় জানিয়ে দিয়েছে বিজেপি! আস্ত লোকসভা কেন্দ্রটা চষা হয়ে গেল। অথচ, একটা ছবি চোখে পড়ল না কোথাও। পোস্টার-ব্যানারে তো দূর অস্ত্, সতীর্থদের মুখে এক বারের জন্যও শোনা যাচ্ছে না তাঁর নাম। মোদী-শাহের আপন রাজ্যে লালকৃষ্ণ আডবাণী নামক ‘ব্র্যান্ড’টির দশা দেখে রবীন্দ্রনাথ মনে পড়তে বাধ্য, হেথা হতে যাও পুরাতন...
পুরনোকে সরিয়ে ফেলে নতুনের খেলা গাঁধীনগরে শুরু হয়েছে বটে, কিন্তু অমিত শাহকে নতুন বলতে ঘোর অনীহা বিজেপির। সরখেজ-গাঁধীনগর রোডের উপর ঝাঁ-চকচকে শপিং সেন্টারের একটা বড় অংশ জুড়ে বিজেপির নির্বাচনী কার্যালয়। এটা শুধুমাত্র গাঁধীনগরের জন্যই। হাজার হাজার লোকের আনাগোনা দিনরাতভর। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সেই কার্যালয়ের একটা ঘরে হর্ষদভাই পটেলকে যুক্তিটা শোনানো গেল— জীবনে প্রথম বার লোকসভা নির্বাচনে লড়ছেন অমিত শাহ— হতে পারেন তিনি বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি— কিন্তু, লোকসভার ময়দানে তো নতুন! জবাব এল, ‘‘সাধারণ কর্মী থেকে একটা মানুষ দলের সভাপতি হয়েছেন। এতগুলো নির্বাচন নিজের হাতে করেছেন। তাঁকে কোনও ভাবেই নতুন বলা যায় না।’’
কিন্তু গাঁধীনগর মানেই তো গোটা দেশ জানে লালকৃষ্ণ আডবাণী। সেই আডবাণীকে সরিয়ে এ বার অমিত শাহ। কোথাও কোনও ক্ষোভ বা চর্চা? হর্ষদভাইয়ের নরম জবাব, ‘‘আপনি গোটা গাঁধীনগর ঘুরে কোথাও এমনটা শুনলেন? শুনবেন না। মানুষের এটা নিয়ে কোনও উৎসাহ নেই। তাঁরা শুধু বিজেপিকেই চেনে। আর এ বারের নির্বাচনের প্রধান মুখই তো মোদীজি-অমিতভাই। তার থেকেও বড় কথা অমিতভাই আমাদের ঘরের ছেলে।’’
আরও পড়ুন: আজ থেকে শুরু ভোট পর্ব, লাভ-ক্ষতি মাপছে সব পক্ষ
ঘরের ছেলেই বটে। গাঁধীনগর কেন্দ্রের মধ্যেই পড়ে নারণপুরা বিধানসভা। সেখানেই অমিতের পুরনো মকান। পুরনো কারণ, সেখানে কেউই এখন থাকেন না। নারণপুরার যে সাংভি স্কুলে রাজনৈতিক জীবন শুরুর দিনে বুথ এজেন্ট হিসাবে কাজ করতেন অমিত, সেই স্কুলটাও রয়েছে। তবে বন্ধ। আমদাবাদ থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বিজয়নগর রোডের উপর সাংভি চার রাস্তার মোড়ের পাশেই কার্যত পরিত্যক্ত সেই স্কুল। এখানেই অমিতের হাতেখড়ি। বিকেলের ভিড় লেগে রয়েছে শরবতের দোকানটায়। স্কুলের ঠিক সামনেই রোজ ঠেলাগাড়ির উপর এই দোকান নিয়ে বসেন মধ্যবয়সী দীপক গেরা। জিজ্ঞেস করা গেল, এটাই কি সেই সাংভি হাইস্কুল? যেখানে অমিত শাহ... প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই জবাব এল, ‘‘কত ছোটবেলা থেকে ওঁকে চিনি। এই তো পাশেই বাড়ি। আসেন মাঝে মাঝে।’’
দীপকের দেখিয়ে দেওয়া পথেই চাররাস্তা থেকে একটু এগনো গেল। বাঁ দিকে তপোবন বিদ্যালয়। সাংভি স্কুলের পরিবর্তে তপোবনই এখন ভোটকেন্দ্র। স্কুলের একটা বাড়ি পরেই চওড়া গলিটা ঢুকে গিয়েছে। শিবকুঞ্জ সোসাইটি। গলির ডায়ে-বাঁয়ে সব মিলিয়ে ৩০টি বাড়ি। তারই ১০ নম্বরটা অমিত শাহের ‘মকান’। এক পুলিশকর্মী ছাড়া কেউই থাকেন না। অমিত পরিবার নিয়ে উঠে গিয়েছেন সরখেজ-গাঁধীনগর হাইওয়ের পাশে নতুন আবাসনে। তবে মাঝে মাঝে আসেন শিবকুঞ্জে। জীবনের প্রথম লোকসভা নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার পর এই নারাণপুরা থেকেই রোড শো করেন অমিত।
নারণপুরার এই সাংভি স্কুলে রাজনৈতিক জীবন শুরুর দিনে বুথ এজেন্ট হিসাবে কাজ করতেন অমিত। —নিজস্ব চিত্র।
১০ নম্বরের ঠিক উল্টো দিকেই ২৩ নম্বর। বাবুভাই গজ্জর তার মালিক। বছর তিয়াত্তরের বৃদ্ধ জানালেন, গত কয়েক বছরে হাতে গোনা কয়েক বারই দেখেছেন তিনি ১০ নম্বরের মালিককে। শেষ দুপুরে নিজের গাড়ি ধুচ্ছিলেন ভদ্রলোক। কলকাতা থেকে ভোট দেখতে এসেছি শুনে নিজেই ঘর থেকে এক গ্লাস জল এনে বললেন, ‘‘পি লিজিয়ে। ভীষণ গরম তো!’’ বাইরে একচল্লিশের গনগনে রোদ্দুর। কিন্তু, গাঁধীনগরে ভোটের উত্তাপ কেমন? বাবুভাই বললেন, ‘‘বিলকুল ঠান্ডা। অমিতভাই আছেন না। টেনশন নেই কোথাও!’’ কিন্তু, আডবাণীজি নেই বলে গাঁধীনগরের কি মন খারাপ? বাবুভাই এমন ভাবে তাকালেন, যেন প্রশ্ন করতে চাইছেন, কে আডবাণী? নাহ্, কথা আর এগলো না।
আরও পড়ুন: ডাকল সাদা গুঁড়োর মৃত্যুদূত
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
অমিত শাহের হয়ে প্রচারে ব্যস্ত বিজেপি কর্মীরা। —নিজস্ব চিত্র।
গাঁধীনগরের আনাচ-কানাচ ঘুরে এই প্রশ্নের কোনও জবাব মেলেনি। শহরাঞ্চল তো বটেই— সানন্দ, কোবা, বাবলা, পেথাপুর, কলোলের মতো গ্রামাঞ্চলেও সকলে কেমন যেন নীরব। সানন্দের চাষি পরিবারের ছেলে কিল্লোল পটেল বললেন, ‘‘রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে সাধারণ মানুষ কেন মন খারাপ করবে বলুন তো! আমাদের ন্যায্যটুকু বুঝে পেলেই খেল খতম। তবে আডবাণী পুরনো মানুষ ছিলেন। প্রবীণদের তো আর কেউ...’’ কথাটা শেষ করলেন না। চুপ করে গেলেন। পেথাপুরের বাজারে বসে হর্ষদ বরিসা বলছিলেন, ‘‘গত বারের ভোটেও তো আডবাণীর কত ছবি, কত প্রচার। কত নাম। আর এ বার একেবারে ফিনিশ।’’ কেন? জবাব, ‘‘সে সব জেনে আমাদের লাভ কি বলুন!’’
লাভের কথাটা শোনালেন নিশীথ পটেল। বিজেপির নির্বাচনী কার্যালয়ে বসে ওই নেতার কথা: মানুষ দল দেখে ভোট দেয়। ব্যক্তি দেখে লোকসভা নির্বাচন হয় না। আডবাণীজি গাঁধীনগর থেকে প্রতি বার জিততেন, কারণ দলের কর্মী-কার্যকর্তারা তাঁর হয়ে লড়াইটা লড়তেন। দল লড়ত। অমিত শাহের নির্বাচনী ম্যানেজমেন্ট কাজ করত। ব্যক্তি আডবাণীর সঙ্গে সাধারণ মানুষের কোনও লেনাদেনা নেই। নিশিথের যুক্তি, ‘‘এ বারের ভোটে প্রচারের মুখ মোদীজি, অমিত শাহ। তাই তাঁদের ছবি আছে। ওই ছবি প্রচার করেই দলের লাভ। তাই ওঁরাই আছেন।’’ আর আডবাণী? নিশীথের কথায়, ‘‘শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, দীনদয়াল উপাধ্যায়ের ছবি দিয়ে কি আমরা প্রচার করি? ওঁরা তো আমাদের সম্মানের আসনে থাকেন।’’
আরও পড়ুন: আজ কোথায় কোথায় ভোট, দেখে নিন
শিবকুঞ্জে অমিত শাহের বাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।
শেষ লোকসভা নির্বাচনে প্রায় ৪ লাখ ৮০ হাজার ভোটে জিতেছিলেন আডবাণী। এ বার তাঁকে সরিয়ে সেই ব্যবধান বজায় রাখা যাবে? বিজেপির দাবি, ৬ লাখেরও বেশি ভোটে জিতবেন অমিত। কী ভাবে? বিজেপি নেতা কিসান সিন সোলাঙ্কির কথায়, ‘‘সচিনের যেমন ওয়াংখেড়ে, অমিত ভাইয়ের তেমন এই গাঁধীনগর।’’ তবে এর ভিতরেও বিজেপির একটা চোরা ভয় আছে। সেটা যদিও প্রকাশ্যে কেউ বলছেন না। গাঁধীনগর লোকসভার মধ্যে সাতটি বিধানসভা কেন্দ্র। মানসা, কলোল, গাঁধীনগর উত্তর, সবরমতী, গাটলড়িয়া, নারণপুরা আর ভেজলপুর। এর মধ্যে প্রথম তিনটি আসন গত বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস জিতেছে। পরের চারটে বিজেপি। গাঁধীনগরের এ বারে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস প্রার্থী সি জে চাভড়া। গাঁধীনগর উত্তরের বিধায়ক। জেতা নিয়ে সংশয় নেই বিজেপির মধ্যে। তবে একটা অংশের আশঙ্কা চাভড়ার মতো কংগ্রেস প্রার্থীর কারণে জয়ের ব্যবধান কমে যেতে পারে। নেমে আসতে পারে আড়াই লাখেও। আডবাণীকে প্রচারের অংশ করে তুললে এই আশঙ্কা কি কমত? আশঙ্কার ‘খবর’টা দিয়ে প্রশ্নটা করা গেল কিসানজিকে। তিনি শুধু হেসে বললেন, ‘‘আডবাণীজির সঙ্গে এই ভোটের কোনও সম্পর্ক নেই। ৬ লাখটা মিলিয়ে নেবেন।’’
অমিত শাহের বাড়ির জানলায় মোদী-অমিত স্টিকার। —নিজস্ব চিত্র।
কিন্তু এত বছরের সাংসদ আডবাণী কেন এমন ভাবে ব্রাত্য গাঁধীনগরে? প্রচারে বিদায়ী সাংসদের নাম-নিশান কিছুই নেই কেন? রাজ্য বিজেপির সদর দফতর শ্রীকমলম-এ বিজেপির মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক প্রশান্ত বালাকে প্রশ্নটা করা মাত্রই কয়েক মুহূর্ত চুপ থাকলেন। তার পর বেশ নরম গলায় বললেন, ‘‘আমরা বিকাশে বিশ্বাসী, প্রচারে নই।’’ তাই বলে আডবাণীর মতো প্রাক্তন সাংসদের ছবি থাকবে না কোথাও? এ বার ভিন্ রাজ্যের সাংবাদিককে হাত ধরে প্রায় নিয়ে গেলেন শ্রীকমলমের একটা ঘরে। দরজা খুলে আলো জ্বালালেন। ‘‘ওই দেখুন!’’ ওঁর আঙুল অনুসরণ করে চোখ গেল দেওয়ালের একটা বিশাল ফ্লেক্সে। সেখানে নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহের সঙ্গে রয়েছেন আডবাণী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy