—ফাইল চিত্র।
মাত্র দেড় মিনিট! তার মধ্যেই পাকিস্তানে ঢুকে ভারতীয় বায়ুসেনার যুদ্ধবিমান নিখুঁত লক্ষ্যে বোমা ফেলে জইশ-ই-মহম্মদের জঙ্গি ঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়েছে বলে দাবি করল নরেন্দ্র মোদীর সরকার।
ভারতীয় সেনা সূত্রের দাবি, মঙ্গলবার ভোর সাড়ে তিনটে নাগাদ ১২টি মিরাজ-২০০০ যুদ্ধবিমান পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের বালাকোটে ১০০০ কেজি ওজনের বোমা ফেলেছে। তাতে মারা গিয়েছে প্রায় ৩০০ জন জঙ্গি। যাদের মধ্যে জইশ-প্রধান মাসুদ আজহারের শ্যালক মৌলানা ইউসুফ আজহারও রয়েছে। ১৯৯৯ সালে ভারতীয় বিমান ছিনতাই করে কন্দহরে নিয়ে যাওয়ার পিছনে এই ইউসুফই ছিল মূল মাথা। সে যাত্রা মাসুদ আজহারকে মুক্তি দিয়ে বিমানযাত্রীদের ফিরিয়ে আনে অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার।
দিল্লির দাবি অবশ্য পুরোপুরি খারিজ করে দিয়েছে পাকিস্তান। তাদের পাল্টা বক্তব্য, ভারতীয় বায়ুসেনা পাক আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছিল ঠিকই, কিন্তু তারা ঢুকেছিল পাক-অধিকৃত কাশ্মীরের ৪-৬ কিমি ভিতরে। পাকিস্তানি যুদ্ধবিমান তৎক্ষণাৎ তাদের চ্যালেঞ্জ করে। তড়িঘড়ি পালানোর সময় ফাঁকা এলাকায় বোমা ফেলে তারা। তাতে জান-মালের কার্যত কোনও ক্ষয়ক্ষতিই হয়নি। বস্তুত পাক-সেনার মুখপাত্র আসিফ গফুরই আজ ভোর সাড়ে পাঁচটায় প্রথম জানান, ভারতীয় বায়ুসেনা পাক আকাশ-সীমা লঙ্ঘন করেছে।
এই দাবি ও পাল্টা দাবির মধ্যেই বায়ুসেনা অভিযানকে ‘পুলওয়ামার বদলা’ হিসেবে দেখিয়ে লোকসভা ভোটের দৌড়ে বিরোধীদের পিছনে ফেলে দিতে চেয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। মোদী সরকারের দাবি, ভারতে আরও একটি ‘ফিদায়েঁ’ বা আত্মঘাতী হামলার জন্য বালাকোটের ওই শিবিরে জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছিল। মৌলানা ইউসুফ আজহার ওরফে ওস্তাদ ঘৌরির নেতৃত্বেই এই জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির চলছিল।
বিদেশসচিব বিজয় গোখলের দাবি, ‘‘আমাদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য ছিল যে, বালাকোটের ওই ঘাঁটিতে আরও একটি আত্মঘাতী হামলার জন্য জিহাদিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এই হানায় বিরাট সংখ্যক জইশ জঙ্গি, প্রশিক্ষক, সিনিয়র কম্যান্ডার, জিহাদির মৃত্যু হয়েছে।’’
আরও পড়ুন: মোদীর মুখে ‘ভোটের দম’
অভিযান
মঙ্গলবার ভোর ৩.৩০
• ১২টি মিরাজ-২০০০ বিমানের অভিযান।
• পাকিস্তানের মধ্যে ঢুকে খাইবার-পাখতুনখোয়ার বালাকোটে আক্রমণ।
• ২০-২১ মিনিটের অভিযান।
• দেড় মিনিটে বোমা
ফেলে নিরাপদে
ফেরে মিরাজ।
• ১ হাজার কেজি বোমা ব্যবহৃত হয়।
• বোমার কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত সামনের অংশ লক্ষ্য স্থির করে। পিছনে থাকে বিস্ফোরক।
* বায়ুসেনা সূত্রের দাবি
ফলে বিজেপি নেতারা দাবি করেছেন, একমাত্র মোদীরই এমন সাহসী সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা আছে। লক্ষ্য স্পষ্ট, লোকসভা ভোটের আগে আর সব বিষয় থেকে নজর ঘুরিয়ে জাতীয়তাবাদ ও দেশের নিরাপত্তাকেই প্রধান বিষয় করে তোলা। পুলওয়ামায় জওয়ানদের উপর জঙ্গি-হামলার পরে প্রধানমন্ত্রী মোদী জঙ্গি সংগঠনগুলোকে হুঙ্কার দিয়েছিলেন, ‘বিরাট বড় মূল্য’ চোকাতে হবে। আর এ দিন রাজস্থানে জনসভায় তাঁর ঘোষণা, ‘‘নিশ্চিত থাকুন, দেশ সুরক্ষিত হাতে রয়েছে।’’উরির হামলার পরে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-কে জবাব হিসেবে তুলে ধরে উত্তরপ্রদেশের ভোটে ফসল তুলেছিল বিজেপি। এ বার পুলওয়ামা কাণ্ডের ১৪ দিনের মাথায়, আরও এক ধাপ এগিয়ে পাকিস্তানের আকাশ-সীমা লঙ্ঘন করে বিমান অভিযানকে লোকসভা ভোটের প্রধান অস্ত্র করতে চাইছেন মোদী। বস্তুত, ১৯৭১-র বাংলাদেশ যুদ্ধের পর এই প্রথম ভারতীয় বায়ুসেনা পাকিস্তান বা অন্য দেশের আকাশসীমায় ঢুকল। কার্গিল যুদ্ধের সময় বাজপেয়ীর স্পষ্ট নির্দেশ ছিল, সীমানা লঙ্ঘন করা চলবে না। ২৬/১১-র পরে নিয়ন্ত্রণরেখার ও-পারে যুদ্ধবিমান পাঠানোর কথা ভেবেও পিছু হটে তৎকালীন ইউপিএ সরকার।
কিন্তু একইসঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলের কথা মাথায় রেখে, ভারত যুদ্ধ চাইছে না বলেও আজ বার্তা দিয়েছে মোদী সরকার। সন্ধ্যায় সর্বদলীয় বৈঠক ডেকে বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ জানিয়েছেন, লড়াই পাকিস্তানের সঙ্গে নয়। সন্ত্রাসের সঙ্গে। বিদেশসচিবও এই অভিযানকে ‘নন-মিলিটারি প্রিএম্পটিভ অ্যাকশন’ (অসামরিক প্রতিরোধমূলক অভিযান) আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এটা বদলা নয়। ভারতের নিরাপত্তার স্বার্থে করা পদক্ষেপ। ভারতের লক্ষ্য পাক সেনা বা নাগরিকরা ছিলেন না। শুধু ওই জইশ-ঘাঁটিই ছিল। বায়ুসেনার অভিযানে কোনও নিরীহ মানুষের মৃত্যু হয়নি। বস্তুত, সেই কারণেই একটি পাহাড়ের মাথায়, ঘন জঙ্গলের মধ্যে এই জঙ্গি-শিবিরকে নিশানা করা হয়। কারণ এর আশেপাশে কোনও সাধারণ মানুষের বসবাস নেই।
• মিরাজ ২০০০ যুদ্ধবিমান
• নির্মাতা: ফরাসি দাসো
• মাল্টিরোল যুদ্ধবিমান। অর্থাৎ আকাশে অন্য বিমানের সঙ্গে মুখোমুখি যুদ্ধ এবং আকাশ থেকে মাটিতে থাকা কোনও লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম।
• ক্ষেপণাস্ত্র, রকেট এবং লেসার নিয়ন্ত্রিত বোমা বহন ও নিক্ষেপণে সক্ষম।
• তিন দশকের বেশি সময় ধরে ভারতীয় বায়ুসেনার ভাঁড়ারে রয়েছে।
• কার্গিল যুদ্ধে টাইগার হিল, টলোলিং শৃঙ্গ জয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
• আকাশপথে সার্জিকাল স্ট্রাইকে বিশেষ নিপুণ।
• পাক বায়ুসেনার উপরে নজর রাখছিল ইজ়রায়েলি ‘অ্যাওয়াকস’ নজরদারি ব্যবস্থা।
• মিরাজে প্রয়োজনে তেল ভরার জন্য হাজির ছিল আইএল-৭৮ বিমান।
সেনা সূত্রের দাবি, মঙ্গলবার ভোররাত সাড়ে তিনটেয় সময় আলো ফোটার আগেই ওয়েস্টার্ন ও সেন্ট্রাল এয়ার কম্যান্ডের একাধিক বায়ুসেনা ঘাঁটি থেকে একসঙ্গে ১২টি মিরাজ-২০০০ যুদ্ধবিমান ওড়ে। পাকিস্তানকে বিভ্রান্ত করতেই একাধিক বায়ুসেনা ঘাঁটি থেকে বিমানগুলো উড়েছিল। একইসঙ্গে দিল্লি থেকে আকাশে ওড়ে ‘এয়ারবোর্ন আর্লি ওয়ার্নিং অ্যান্ড কন্ট্রোল সিস্টেম’ নামের একটি বিমান। যার কাজ ছিল মিরাজ-২০০০ বিমানগুলিকে নিখুঁত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া এবং পাকিস্তানের দিক থেকে কোনও জবাব দেওয়া হচ্ছে কি না, সে দিকে নজর রাখা। আগরা থেকে আকাশেই যুদ্ধবিমানে জ্বালানি ভরে দেওয়ার জন্য আইএল-৭৮ নামে একটি বিমানও উড়ে যায়। এই দু’টি বিমান অবশ্য নিয়ন্ত্রণরেখার ও-পারে যায়নি।
সামরিক সূত্রের দাবি, গোটা অভিযানে ২১ মিনিট মতো সময় লাগলেও নিয়ন্ত্রণরেখার ও-পারের হানা কার্যত দেড় মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে যায়। পাকিস্তানের এফ-১৬ বিমান আকাশে ওড়ার তোড়জোড় করেছিল। কিন্তু একসঙ্গে ১২টি মিরাজ থাকায় শেষ পর্যন্ত ঝুঁকি নেয়নি। প্রথমে জানা গিয়েছিল, তিনটি জায়গায় হামলা হয়। কিন্তু পরে বিদেশসচিব জানান, শুধু বালাকোটেই হামলা হয়েছে।
সরকারি সূত্রের দাবি, গোটা অভিযানের পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল। তিনি এবং বায়ুসেনা প্রধান বি এস ধানোয়া কাল সারা রাত বিমানবাহিনীর ওয়ার রুমে কাটিয়েছেন। অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন ‘ডিরেক্টর জেনারেল এয়ার অপারেশনস’ অমিত দেভ এবং তাঁর টিমের সদস্যরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy