Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

‘আরও একটা হেলিকপ্টার নেমে আসুক’, মুখ চেয়ে জয়সলমেরের গ্রাম

গোটা বিশ্বের পর্যটকেরা যেখানে ফি বছর ভিড় জমান ‘ডেজার্ট সাফারি’র টানে, সেই মরুভূমি সংলগ্ন সাম গ্রাম পরিষদে এখন জল আনতে পান্তা ফুরনোর দশা। 

অগ্নি রায় 
সাম (জয়সলমের) শেষ আপডেট: ০১ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:৪৪
Share: Save:

“ওইখান থেকে নেমেছিল দুটো হেলিকপ্টার। তার পর অনেকগুলো দিন যে কি ভাল কাটিয়েছি আমরা!”

হাত উঁচুতে তুলে যে অনির্দিষ্ট শূন্যতাকে হাতড়ে হাতড়ে ছুঁতে চাইছেন প্রবীণ হাজারা রাম মেঘাওয়াল, সেখানে তখন পাটে ওঠার আগে সূর্য সোনা গলিয়ে দিচ্ছে। অন্ধকারের দখলে যাওয়ার আগে শেষবারের মতো সেজে নিচ্ছে আদিগন্ত মরুভূমি ও তার ক্যাকটাসের গয়নারা।

গোটা বিশ্বের পর্যটকেরা যেখানে ফি বছর ভিড় জমান ‘ডেজার্ট সাফারি’র টানে, সেই মরুভূমি সংলগ্ন সাম গ্রাম পরিষদে এখন জল আনতে পান্তা ফুরনোর দশা।

দু’তিন শিফট কাজ সেরে সামনেই হাঁটু ভেঙে জিরোচ্ছে ‘রাজা হিন্দুস্তানি’। গম্ভীর হয়ে ইতিউতি পায়চারি করছে ‘আমীর খান’, ‘শরাব রুস্তম’, ‘হৃতিক রোশন’রা! সিজন লেগে গিয়েছে কিন্তু এখনও সেভাবে জমেনি সওদা। অনাবৃষ্টি গিয়েছে। ভোট-বাবুদের যাতায়াত শুরু হয়েছে। সব মিলিয়ে কিছুটা তিতিবিরক্ত হয়েই বোধহয় আকাশের দিকে মুখ তুলে দীর্ঘ ডেকে উঠল ‘রাজা হিন্দুস্তানি’। ওর গলার ঝুনঝুনিটা কষে বাঁধতে বাঁধতে কথার খেই ধরছেন হাজারা রাম। “সেই হেলিকপ্টার ছিল যেন এক স্বপ্নের দেশ থেকে আসা। গোটা গাঁ ভেঙে পড়েছিল। নেমে এসেছিলেন সনিয়া গাঁধী, অশোক গহলৌতকে সঙ্গে নিয়ে। প্রতিটি ঘরে গিয়ে বুড়ো, বুড়ি, মা বোনদের সঙ্গে কথা বলেছিলেন সনিয়াজি।”

আরও পড়ুন: মোদীর আমলে কিছুই হয়নি, দায়িত্ব নিয়েই একান্ত সাক্ষাৎকারে বললেন আজহার

জয়সলমের শহর থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরে মরুভূমি সংলগ্ন এই গ্রাম সমিতি। মেঘওয়াল সম্প্রদায়ের হাড় জিরজিরে (মেজাজটুকু শুধু রয়ে গিয়েছে রঙ বেরঙের পাগড়িতে) মানুষদের উটপালন এবং মরু পর্যটন বছরে চারমাসের সংস্থান এনে দেয়। বাকি আট মাস? জানা গেল, দশ বছর আগে সনিয়া গাঁধীর নির্দেশে উটপালকদের কাজের বিনিময়ে শস্যের ব্যবস্থা হয়েছিল। দেওয়া হতো টাকাও। তারই পোশাকি নাম জব কার্ড। পত্রকারকে দেখে ততক্ষণে ভিড় জমছে। তাছাড়া, দিনের কাজ সেরে সুটঠায় সুখটান দেওয়ার সময়ও বটে। গফুর খান বলছেন, “বছরের বাকি সময়টা নানা কাজের ব্যবস্থা থাকত। তালাব খুঁড়তাম, সরকার থেকে এসে মাটি নিয়ে যেত। দিনে ৬০ ফুট পর্যন্তও খুঁড়েছি। পঞ্চায়েতের মাধ্যমে হপ্তায় বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা আসত। ওই টাকা জব কার্ড দেখিয়ে ভাগ করে দেওয়া হত সব পরিবারের মধ্যে। টাকা ছাড়া, গেঁহুর বস্তাও এসেছে। বসুন্ধরাজি আসার পর সব বন্ধ হয়ে গেল।”

আরও পড়ুন: দাপটের ইতিহাসটুকুই সম্বল, পিঙ্ক সিটির কয়েক লাখ বাঙালির প্রায় ভূমিকাই নেই ভোটে

প্রায় ৮০টি গ্রাম এই মরুভূমিকে ঘিরে। ভরসা পঞ্জাব থেকে আসা ইন্দিরা গাঁধী ক্যানালের জল, তা-ও সে ৭০ কিলোমিটার দূরে। এখানে নল নেই, ট্যাঙ্কে মিঠা পানি নেই। মজদুরি করার মতো কোনও প্রকল্পও নেই। ভরসা কিছু বেসরকারি সংস্থার বিলাসবহুল তাঁবু-র ঠিকে কাজ। সিজনে সাহেব-মেমসাহেবরা এসে ‘প্যাকেজ ডিল’ নেন। দিনে সাফারি, রাতে রাজস্থানি নাচ-গান-খাওয়া। জানা গেল, বিএসএফ-এর অবসরপ্রাপ্ত কর্তারাও খুলছেন এমন প্রমোদ-তাঁবু। তবে এখানেও টাকা আসে বহু হাত ঘুরে। মোটা টাকা নিয়ে নেয় ওই সংস্থাগুলি। বছরের বাকিটা বহু ক্রোশ পাড়ি দিয়ে জয়সলমের শহরে গিয়ে পাথর ভাঙার মজদুরি করতে হাড় হিম হয়ে যায় মেঘওয়ালদের। ওই একবার হেলিকপ্টার অবতরণ ছাড়া কোনও বড় নেতার (রাজ্যস্তরেরও) মুখও দেখেনি এই মরুগ্রাম।

ঝুঁঝকো আঁধার নেমে আসছে। বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে ফেরার পথ ধরতে হবে। হিন্দি-দেহাতি মিশ্রিত সমস্বর কানে এল। “ভাল করে লিখে দেবেন। আমরা সবাই চাইছি, আবার একটা হেলিকপ্টার নেমে আসুক। সুদিনও আসবে তবে। এই গাঁয়ের বাচ্চারা খেয়ে-পরে বাঁচবে।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE