মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনে কংগ্রেসের ক্যাচলাইনকেই নিজেদের সবচেয়ে বড় সাফল্য বলছে বিজেপি। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
অতিথি কলকাতা থেকে এসেছেন শুনেই মহেন্দ্র সিংহ খিঁচি বলে উঠলেন, ‘‘অজিত পাঁজার কথা মনে পড়ে গেল।’’তাকালেন অশীতিপর অভয়জি ছজলানির দিকে— ‘‘আপনার মনে পড়ছে স্যর?’’ছজলানির মুখমণ্ডলে স্মিত হাসি, সম্মতিসূচক হালকা মাথা নাড়া।
‘‘অজিত পাঁজা তখন কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী। আমাদের ইনদওরে এসেছেন একটা অনুষ্ঠানে...’’ বলে চলেন মহেন্দ্র। ‘‘অনুষ্ঠান শেষ হতে একটু দেরি হচ্ছে। কিন্তু উড়ানের সময় হয়ে এসেছে। মাঝপথেই তাঁকে ফিরতে হবে। এ রকম একটা পরিস্থিতি। উনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ঠিকই। কিন্তু ওঁর জন্য তো আর উড়ান দেরি করবে না।’’এই পর্যন্ত বলে একটু দম নিলেন বক্তা। তার পরে একটা শ্লাঘার হাসি নিয়ে বললেন, ‘‘কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর জন্য দেরি করুক বা না করুক, আমাদের স্যরের জন্য তো দেরি করবেই। স্যর মন্ত্রীকে জানালেন, নিশ্চিন্ত থাকুন, যতক্ষণ আমি না চাইব, ইনদওর থেকে ততক্ষণ ওই বিমান উড়বে না। হলও তাই।’’
অভয়জি ছজলানি এতটাই প্রভাবশালী ছিলেন ইনদওরে। নামকরা হিন্দি সংবাদপত্রের মালিক ছিলেন সে সময়ে। পরে সে ব্যবসা বেচে দিয়েছেন। এখন মধ্যপ্রদেশের সবচেয়ে বড় ইন্ডোর স্টেডিয়াম তথা স্পোর্টস কমপ্লেক্স তথা প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালাচ্ছেন। নির্বাচনী প্রচারে ইনদওরে এসে কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী ডেকে পাঠিয়েছিলেন তাঁকে। মতামত জানতে চেয়েছেন। রাহুলকে ছজলানি বলেছেন, ‘‘আগে ইস্যু ঠিক করুন। বিজেপি-কে কেন ভোট দেওয়া উচিত নয়, এমন কয়েকটা মজবুত কারণ আগে দেখান। তার পরে জয়ের কথা ভাববেন।’’
কংগ্রেস ইস্যু ঠিক করে ফেলেছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নারীর সুরক্ষা— মধ্যপ্রদেশের নির্বাচনের বাজারে কংগ্রেসের ভাসিয়ে দেওয়া ক্যাচলাইন এখন এটাই। ১৫ বছর আগে উমা ভারতীকে সামনে রেখে বিজেপি যখন ক্ষমতা দখল করেছিল মধ্যপ্রদেশে, তখন বিজেপির তুলে ধরা ক্যাচলাইনটাও এ রকমই ছিল— সড়ক, বিজলি, পানি। কংগ্রেস সরকারের পতন ঘটে গিয়েছিল তাতে। সেই থেকে এই পর্যন্ত কংগ্রেসকে আর ক্ষমতায় ফিরতে হয়নি মধ্যপ্রদেশে। কিন্তু এ বার কংগ্রেস স্বপ্ন দেখছে। তিনটে নতুন দাবিকে সামনে রেখে ভোটের দিকে এগোচ্ছে। কৃষক অসন্তোষ নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। জিএসটি নিয়ে ক্ষোভের চর্চা হচ্ছে। তফসিলি জাতি/ উপজাতির উপরে অত্যাচার প্রতিরোধের জন্য যে কড়া আইন, তা নিয়ে উচ্চ বর্ণের মধ্যে ক্ষোভ জমাট হচ্ছে। কিন্তু স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও নারী সুরক্ষার প্রশ্নে বিজেপি সরকারের ব্যর্থতাকে খুব বড় করে তুলে ধরতে চাইছে কংগ্রেস।
আরও পড়ুন: রাহুলকে চাই, তবে প্রধানমন্ত্রী ভোটের পর: নায়ডু
কংগ্রেসের এই ক্যাচলাইনকেই নিজেদের সবচেয়ে বড় সাফল্য বলছে বিজেপি। সড়ক, বিজলি, পানি নিয়ে কোনও প্রশ্ন কি কংগ্রেস তুলতে পারছে? পারছে না। তার মানে আমরা যা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তা পালন করেছি— বলছে রাজ্য বিজেপি।
মধ্যপ্রদেশে ক্ষমতায় ফিরতে নতুন দাবিকে সামনে রেখে ভোটের দিকে এগোচ্ছে কংগ্রেস।
প্রতিশ্রুতি যে বিজেপি পালন করেছে, ১৫ বছরের বিজেপি রাজে মধ্যপ্রদেশের বিকাশ যে হয়েছে, তা সাধারণ জনতা পথেঘাটেই স্বীকার করেন। বিশেষত ইনদওর, উজ্জয়িনী, দেবস-সহ মালওয়া এবং নিমাড় অঞ্চলে তো বটেই। পর পর কয়েক বছর ধরে দেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন শহরের তকমা ধরে রেখেছে ইনদওর। চওড়া রাস্তা, আলাদা বাস লেন, ঝাঁ-চকচকে বাসস্টপ, বেআইনি নির্মাণের বিরুদ্ধে পুর নিগমের সক্রিয়তা— সবই চোখে পড়ার মতো।
রেওয়াতে একটি জনসভায় নরেন্দ্র মোদী।
বিহার থেকে কর্মসূত্রে ইনদওরে এসেছিলেন সোনু সিংহ। থেকে গিয়েছেন। সোনু গাড়ি চালান। বললেন, ‘‘ইয়ে যো চমন দিখা রহা হ্যায় শহর মে, ইয়ে থা কাঁহা পহলে! ভাজপা জমানে মে হি আয়া। লেকিন ফির ভি... বিজেপি জায়েগি ইস বার।’’কেন যাবে? ‘‘কুছ গলতিয়া হো গই হ্যায় শিবরাজজি সে।’’সোনুর মুখেও ফিরে আসে কৃষক বিক্ষোভে গুলিচালনার কথা। ফিরে আসে তফসিলি জাতি/ উপজাতি সংক্রান্ত কঠোর আইনের কথা। কথায় কথায় তিনি জানিয়েও দেন যে, তিনি বিজেপিরই সমর্থক, এ বারও ভোট বিজেপি-কেই দেবেন। কিন্তু তবু তিনি মনে করছেন না যে, বিজেপি জিতবে।
আরও পড়ুন: ‘মামা’র সেনার ভয়ে আদিবাসীরা
সাধারণ বিজেপি সমর্থক সোনু যেমন আত্মবিশ্বাস হারিয়েছেন, মালওয়া-নিমাড়ের বিজেপি নেতারাও তেমনই। প্রকাশ্যে স্বীকার করছেন না। কিন্তু ঘনিষ্ঠ আলাপচারিতায় মানছেন, ‘‘টক্কর ইস বার কাঁটে কি।’’
উজ্জয়িনী সফরে এসে মহাকাল মন্দিরে পুজো দিয়েছেন রাহুল গাঁধী।
এককালে এই এলাকায় কংগ্রেসের মজবুত দুর্গ ছিল। ১৫ বছর আগে সেই দুর্গের পতন এবং মালওয়া-নিমাড়ে বিজেপির উত্থান। ইনদওরের সংসদ এখন লোকসভার স্পিকার— সুমিত্রা মহাজন। ইনদওর জেলার মহু আসনের বিদায়ী বিধায়ক এখন বিজেপির সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক তথা অমিত শাহের বিশেষ ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত— কৈলাস বিজয়বর্গীয়। কৈলাস নিজে এ বার লড়ছেন না। ছেলে আকাশ লড়ছেন, তবে মহু থেকে নয়। ইনদওর-৩ আসনে আকাশ বিজয়বর্গীয়কে টিকিট দিয়েছে বিজেপি। ইনদওর-২ এর বিজেপি প্রার্থী রমেশ মান্ডোলাও বহু দিনের বিধায়ক। প্রবল দাপট তাঁর। হাতে গুন্ডা-বদমায়েশের সংখ্যাও নেহাৎ কম নয় বলে শোনা যায়। অর্থাৎ নরমে-গরমে মিশিয়ে মালওয়া-নিমাড়ে বিজেপির শিকড় এখন যথেষ্ট গভীরে। এলাকার ৬৬টি আসনের মধ্যে গতবার ৫৮টি গিয়েছিল বিজেপির ঝুলিতে। তাতেই অর্ধেক নিভে গিয়েছিল কংগ্রেসের ক্ষমতায় ফেরার স্বপ্ন। কিন্তু সেই অঞ্চলেই বিজেপি এ বার নড়বড়ে। আর মালওয়া-নিমাড়ে আসন বাড়িয়ে ভোপাল মসনদের কাছকাছি পৌঁছতে কংগ্রেস মরিয়া।
রাহুল গাঁধী উজ্জয়িনী সফর করেছেন ইতিমধ্যেই, মহাকাল মন্দিরে পুজো দিয়েছেন। ইনদওরে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে নিবিড় আলাপচারিতা সেরেছেন। বিশিষ্ট জনেদের মত নিয়েছেন। কংগ্রেস নেতারা চষে ফেলছেন মালওয়া-নিমাড়।
আত্মবিশ্বাসী না হলেও আসন্ন নির্বাচনে হাল ছাড়েনি বিজেপি।
বিজেপি আত্মবিশ্বাসী থাকতে না পারলেও হাল ছাড়েনি। নরেন্দ্র মোদী নিজে ইনদওরে সভা করেছেন। গত কয়েক দিনে ইনদওরের আশপাশে বেশ খানিকটা সময়ও দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ ছুটে বেড়াচ্ছেন। পড়ে রয়েছেন বিজেপির জাতীয় মুখপাত্র সম্বিৎ পাত্র। রয়েছেন যুব মোর্চার সর্বভারতীয় সভাপতি অনুরাগ ঠাকুর। মালওয়ায় ভারী লোকসান হলে ভোপাল মসনদ যে হাতছাড়া হতে পারে, তা বিজেপি নেতারা ভালই বুঝছেন। তাই মাটি কামড়ে পড়ে থাকার চেষ্টা।
দিনের শেষে বিজেপির গড়ে জনমতও যেন ঈষৎ বিভ্রান্ত। মধ্যবয়সি ধাবা মালিক থেকে, তরুণ আইটি প্রফেশনাল, প্রবীণ ব্যবসায়ী থেকে মাঝবয়সি লেখিকা, সবার মুখে এক কথা— কী হবে বলা খুব কঠিন। কেন কঠিন? রাহুল গাঁধীর সঙ্গে আলোচনায় বসে আসা অভয়জি ছজলানির ব্যাখ্যা, ‘‘শিবরাজ খুব মজবুত মুখ্যমন্ত্রী। ওটা বিজেপির খুব বড় প্লাস পয়েন্ট। তবু শিবরাজকে নিয়ে আর কেউ ধন্য ধন্য করতে রাজি নন। ১৫বছর বিজেপি মসনদে কাটিয়ে ফেলল তো। এটা স্বাভাবিক। কিন্তু উল্টো দিকে যাঁরা, তাঁদের হয়েই বা জয়ধ্বনী দেওয়ার মতো কী আছে? এলাকার মানুষ কারণ খুঁজছেন— কংগ্রেসকে যদি ভোট দিই, তা হলে কেন দেব? আসলে দিগ্বিজয় জমানা তো কেউ ভোলেননি।’’ ফের স্মিত হাসি ইনদওরের অশীতিপর প্রভাবশালী নাগরিকের মুখে। বললেন, ‘‘২৮নভেম্বরের আগে যদি কংগ্রেসকে ভোট দেওয়ার একটা মজবুত কারণ কেউ তুলে ধরতে পারেন সামনে,তা হলে ম্যান অব দ্য ম্যাচ রাহুল গাঁধী।’’
ছবি: পিটিআই।
(ভোটের খবর, জোটের খবর, নোটের খবর, লুটের খবর- দেশে যা ঘটছে তার সেরা বাছাই পেতে নজর রাখুন আমাদেরদেশবিভাগে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy