নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে অন্তাগড়ের বাঙালিরা। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
বরিশালের আকাশের রং এখনও মনে পড়ে তাঁর। হাওয়া এখনওদেশের মাটির ঘ্রাণ বয়ে আনে, পদ্মার কান্না এখনও শুনতে পান অনিলবরণ!
সেই ১৯৫৪ সালে বরিশালের ভিটে ছেড়ে বাবা-মায়ের সঙ্গেতিন ভাইবোন চলে আসেন এ পারে। হুগলির পাণ্ডুয়ার তিন্না ট্রানজিট ক্যাম্পে আশ্রয় পেয়েছিলেন তাঁরা। সেখানে কয়েক বছর থাকার পরে ’৬০ সালে তাঁরা চলে আসেন তৎকালীন মধ্যপ্রদেশের জগদলপুরে। সেখানে ওয়ার্কসাইড ৩ নম্বর ক্যাম্পে বছর দেড়েক থাকার সময়েই মেজ ভাই মারা যান অনিলবরণের। ’৬৩ সালে তাঁরা চলে আসেন এই পখাঞ্জুর ক্যাম্পে।
তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে আসা বিপুল পরিমাণ শরণার্থীর চাপ সামলানো পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের পক্ষে সামলানো সহজ ছিল না। উদ্বাস্তুদের সুষ্ঠু পুনর্বাসনের জন্য ’৫৮ সালে ভারত সরকার তৈরি করে দণ্ডকারণ্য প্রকল্প। সে সময়েই প্রচুর শরণার্থী পখাঞ্জুর চলে আসেন। তাঁদের পরিবার পিছু ৪ একর ১৬ ডেসিবেল জমি দেওয়া হয়। কিন্তু সে জমি সে সময় কার্যত কৃষিযোগ্য ছিল না। বছরের পর বছরপ্রচুর মেহনতের পর ফসল ফলাতে সক্ষম হন ক্যাম্পের মানুষজন।
আরও পড়ুন: ‘শহুরে নকশালদের বিপ্লবী বলছে কংগ্রেস!’, নির্বাচনী সভায় অভিযোগ মোদীর
এখন কেমন আছে পখাঞ্জুর? ভোট একেবারে দোরগোড়ায়। পখাঞ্জুর যে বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্ভুক্ত, সেই অন্তাগড়ে নির্ণায়ক শক্তি কিন্তু বাঙালিরাই। প্রায় ১ লক্ষ ৫৬ হাজার ভোটারের মধ্যে ৯৫ থেকে ৯৬ হাজার ভোটারই বাঙালি। সেই বাঙালিরাই কিন্তু এ বার মোটের উপর অসন্তুষ্ট বিজেপির উপর।
কেন?
অন্তাগড় বিধানসভা কেন্দ্র দীর্ঘ দিন ধরেই বিজেপির দখলে। ২০০৮ এবং ’১৩-র বিধানসভা ভোটে এই কেন্দ্রে জয়ী হন বিজেপির বিক্রম উসেন্ডি। ২০১৪-য় বিক্রম উসেন্ডি লোকসভা ভোটে প্রার্থী হওয়ায় এই কেন্দ্রে উপনির্বাচন হয়। সে বারেও বিজেপির ভোজরাজ নাগ জয়ী হন। বিজেপির এই নিশ্চিন্ত আসন এ বার অশান্ত। বাঙালিদের অভিযোগ, দীর্ঘ দিন ধরেই বাঙালিরা যে দাবি করে আসছেন, তা নিয়ে বিজেপি এখনও টালবাহানা করে চলেছে। তাঁরা চান, তাঁদের নমঃশুদ্র, অর্থাৎ অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি (ওবিসি) সম্প্রদায়ভুক্ত করা হোক। কারণ, এর ফলে তাঁরা চাকরি সমেত অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পাবেন। এই আন্দোলন আরও বাড়ানোর জন্য তৈরি হয় ‘নিখিল ভারত বঙ্গ সমুদয়’ নামে একটি গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীতে সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিও ছিলেন।
এই সংগঠনের উদ্যোগে বছর দু’য়েক আগে পখাঞ্জুরে বিশাল জনসভাও হয়েছিল। সেই জনসভায় বাঙালিদের নানা দাবির কথা তোলা হয়। এই জনসভার পরে রমন সিংহের সরকার উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করে। সেই কমিটিতে মুখ্যমন্ত্রী নিজেও ছিলেন। কিন্তু এখানকার বাসিন্দাদের অভিযোগ, কমিটি গঠনের দিন পনেরোর মধ্যেই গোপনে তা ভেঙে দেওয়া হয়। তার পর থেকে এ নিয়ে বিশেষ কাজ এগোয়নি।
পখাঞ্জুর বাজার।
আরও পড়ুন: ছত্তীসগ়ঢ়ে ক্ষমতায় এলে ১০ দিনের মধ্যেই ঋণ মকুব, আশ্বাস রাহুলের
খুব স্বাভাবিক ভাবেই কংগ্রেস নির্বাচনী প্রচারে এই ঘটনাকে ইস্যু করেছে। স্থানীয় কংগ্রেস নেতা রাজদীপ হালদারের অভিযোগ, ‘‘দীর্ঘ দিনের দাবিকে ধামাচাপা দিয়ে রেখে এখানকার বাঙালিদের সঙ্গেকার্যত প্রতারণা করা হয়েছে। ছত্তীসগঢ়ে বাঙালিদের জন্য কোনও চাকরি নেই। ওবিসি শ্রেণিভুক্ত হলে এটুকু সুবিধা পাওয়া যেত। আমরা জনগণের সামনে গোটা বিষয়টা তুলে ধরছি।’’ গোটা বিযয়টায় দৃশ্যতই অস্বস্তিতে বিজেপি। স্থানীয় বিজেপি নেতা-কর্মীদের বক্তব্য, এটা আগেই হয়ে গেলে নির্বাচনে সুবিধা হত। তবে, এই সুবিধা রমন সিংহের সরকার বাঙালিদের জন্য দেবে বলে তাঁরা আশাবাদী।
কিন্তু স্থানীয় বাঙালিরা এই ঘটনাকে কী ভাবে দেখছেন?
পখাঞ্জুরের ৩৩ নম্বর পারুলকোট ভিলেজ (পিভি ভিলেজ বলেই স্থানীয় ভাবে বলা হয়) উদয়পুরের বাসিন্দা সুশান্ত মজুমদারের কথায়: ‘‘আমরা এমনিতেই প্রচণ্ড লড়াই করে বেঁচে আছি। বাবারা চার ভাই। ৬ একর চার ভাগ হয়ে প্রত্যেকে দেড় একর করে পেয়েছিল। সেটুকু জায়গাতেই চাষবাস করি। আমাদের উদ্বাস্তুদের প্রতি এই সরকারের মনোভাব এ সব দেখেই বোঝা যায়।’’ গ্রামেসুশান্তবাবুর একটি মুদির দোকান আছে। সেটি মোটামুটি চলে। সুশান্তবাবুর বক্তব্য, ‘‘এটুকু না থাকলে না খেয়ে মরতে হত।’’
গ্রামের বৃদ্ধা অঞ্জলি মল্লিক দুঃখ করছিলেন, ‘‘কোনও কিচ্ছু পাই না। স্বামী মারা গিয়েছে। বিধবা ভাতাও জোটেনি। অনেক দরখাস্ত দিয়েছি। গ্রাম পঞ্চায়েতের সভায় বহু বার দরখাস্ত দিয়েও কিছু হয়নি।’’ গ্রামের বধূ পূজা মজুমদারের অভিযোগ, আসল উন্নয়ন কোথায়?
পখাঞ্জুর নতুন বাজারে বসে স্থানীয় বিজেপি কাউন্সিলর বীরেন বিশ্বাস অবশ্য উন্নয়ন না হওয়ার কথা আদৌ মানতে চাইলেন না। তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘কে বলল উন্নয়ন হয়নি? রাস্তা হয়েছে, বিদ্যুৎ এসেছে। জমিও দোফসলি হয়েছে। সবার বিপিএল কার্ড আছে। গরিব বলে এখন কেউ নেই।’’ তাঁর পাশে দাঁড়িয়েই অবশ্য স্থানীয় ওষুধের দোকানের মালিক তপন মজুমদার বললেন, ‘‘ওর রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে, তাই এ কথা বলছে। উন্নয়ন হয়েছে? দু’বছর আগের নোটবন্দির জের এখনও সামলাতে হচ্ছে আমাদের, ব্যবসায়ীদের। বাজারের যে কোনও দোকানে জিগ্যেস করে দেখুন, সবাই বলবে।’’
আরও পড়ুন: রাজনীতি আর বুলেট, দুই লড়াই দেখার প্রতীক্ষায় সুকমা
আগে কাঁকের জেলার এই অন্তাগড় কেন্দ্রের বিভিন্ন স্কুলে বাংলা পড়ানো হত। আলাদা করে শিক্ষকও নিয়োগ করা হত। কিন্তু সে সব অনেক দিনই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পরের প্রজন্ম বাংলা ভাষা ভুলতে বসেছে। পড়তে পারা তো দূরের কথা। ভিটেমাটি খুইয়ে যাঁরা একদিন দেশের এ প্রান্তে এসে বসতি স্থাপন করেছিলেন, বঙ্গ সংস্কৃতির শিকড় ছড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেই তাঁরাই এখন অস্তিত্বের সঙ্কটে ভুগছেন। যার জের পড়তে পারে এই কেন্দ্র্রেরব্যালট বাক্সে।
অনিলবরণ হালদারের বাগানে চমৎকার জবা ফুল ফুটেছে। ফুটেছে অপরাজিতা। লাগোয়া পুকুরে মাছও ওঠে। কলা-আম সমেত নানা ফলের গাছ বাড়ির বাগানে। আসলে এ সবই শিকড় খোঁজার প্রয়াস। ভরদুপুরের অতিথিকে না খাইয়ে যেতে দিতে চাইছিলেন না অতিথিপরায়ণ অনিলবরণ ও তাঁর স্ত্রী।
কলকাতা থেকে এসেছি শুনে যেন বড় আনন্দ হয় বৃদ্ধবৃদ্ধার। বাগানের গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসা অনিলবরণের মুখে বিষাদ খেলা করে। বলেন, ‘‘ক্লাস এইটে পড়ার সময় বরিশাল ছেড়ে এসেছিলাম। আমাদের সে বাড়িতেও এ রকম বাগান আর গাছপালা ছিল, জানেন।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy