Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

হৃদয় নিরাময়ে জট, বিপন্ন হাসপাতাল

হার্টের দু’টি ভাল্ভ বিকল। মুর্শিদাবাদের রায়নগর শেখপাড়ার বাসিন্দা, বছর চব্বিশের বাবর আলি একেবারেই শয্যাশায়ী। অস্ত্রোপচারের জন্য পরিবারের লোকেরা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে এক লক্ষ ৯০ হাজার টাকা জোগাড় করেছেন। কিন্তু রোগীকে ভর্তি নেওয়া যাবে না, জানিয়ে দিয়েছে কল্যাণীর সুপার স্পেশ্যালিটি গাঁধী হাসপাতাল।

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিতান ভট্টাচার্য
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৩
Share: Save:

হার্টের দু’টি ভাল্ভ বিকল। মুর্শিদাবাদের রায়নগর শেখপাড়ার বাসিন্দা, বছর চব্বিশের বাবর আলি একেবারেই শয্যাশায়ী। অস্ত্রোপচারের জন্য পরিবারের লোকেরা কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে এক লক্ষ ৯০ হাজার টাকা জোগাড় করেছেন। কিন্তু রোগীকে ভর্তি নেওয়া যাবে না, জানিয়ে দিয়েছে কল্যাণীর সুপার স্পেশ্যালিটি গাঁধী হাসপাতাল।

নদিয়ার তেহট্টের বাসিন্দা ৪০ বছরের মানতা হাজরারও হার্টের দু’টি ভাল্ভ নষ্ট। অবিলম্বে অস্ত্রোপচার না-করলে বিপদ হতে পারে। তিনিও অনুদান জোগাড় করেছেন। কিন্তু অস্ত্রোপচারের জন্য ভর্তি হতে না-পেরে বাড়িতে শুয়ে অসহায় ভাবে দিন গুনছেন মানতা। ভর্তি নেওয়া যাবে না, জানিয়ে দিয়েছে কল্যাণীর সুপার স্পেশ্যালিটি গাঁধী হাসপাতাল।

মহা-হাসপাতালের তকমা যাদের গায়ে, তারা রোগী নিচ্ছে না কেন?

শুধু এক জন টেকনিশিয়ানের অভাবে ওই সুপার হাসপাতালে হার্টের যাবতীয় অস্ত্রোপচার বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অথচ কম হলেও চিকিৎসক-নার্স আছেন। আছে যন্ত্রপাতিও। কিন্তু টেকনিশিয়ান না-থাকায় দু’সপ্তাহ ধরে মরণাপন্ন রোগীদেরও ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে হাসপাতাল থেকে। কার্ডিওথোরাসিক সার্জারি বিভাগে ১০৫টি শয্যা খালি পড়ে রয়েছে। অস্ত্রোপচার বন্ধ বলে বহির্বিভাগ থেকে কাউকে ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না।

এমন প্রাণদায়ী পরিষেবা দিতে না-পেরে গাঁধী হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ বিপাকে পড়েছেন। সমস্যা কম নয় কল্যাণী মেডিক্যাল কলেজেরও। কারণ, দু’টি প্রতিষ্ঠান পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত। সুপার স্পেশ্যালিটি গাঁধী হাসপাতালকে কল্যাণী মেডিক্যালের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এমন গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালে হার্টের অস্ত্রোপচার বন্ধ হয়ে গিয়েছে জানতে পারলে মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই) এ বার কল্যাণী মেডিক্যালের ১০০ আসনের অনুমোদনও বাতিল করবে, এই আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে রয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা। মাসখানেকের মধ্যেই এমসিআইয়ের পরিদর্শকদের কল্যাণী মেডিক্যালে পরিদর্শনে আসার কথা।

অবস্থানগত দিক থেকেও গাঁধী হাসপাতাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদিয়া, উত্তর ২৪ পরগনা, মুর্শিদাবাদের বিস্তীর্ণ অঞ্চল থেকে রোগীরা আসেন এখানে। কল্যাণী মেডিক্যালের নিজস্ব কোনও কার্ডিওথোরাসিক বিভাগ নেই। তাই এমসিআইয়ের কাছে গাঁধী হাসপাতালের কার্ডিওথোরাসিক বিভাগকেই কল্যাণী মেডিক্যালের কার্ডিওথোরাসিক বিভাগ হিসেবে দেখানো হয়। আশেপাশে আর কোনও সরকারি হাসপাতালে হৃৎপিণ্ডের এই চিকিৎসা পরিষেবা নেই। এই অবস্থায় গাঁধী হাসপাতালের স্বাস্থ্যের উপরে কল্যাণী মেডিক্যালের অস্তিত্ব নির্ভর করছে অনেকটাই।

গাঁধী হাসপাতাল সূত্রের খবর, কার্ডিওথোরাসিক বিভাগে এমনিতেই ডাক্তারের অভাব। আট জন সার্জনের বদলে রয়েছেন মাত্র দু’জন। তবু এত দিন সপ্তাহে ৪-৫টি ওপেন হার্ট বা বাইপাস সার্জারি হতো। কিন্তু সপ্তাহ দুয়েক আগে হার্ট-লাং মেশিনের টেকনোলজিস্ট সতীনাথ মুখোপাধ্যায় অবসর নিয়েছেন। তাঁর জায়গায় কোনও লোক নেওয়া হয়নি বলে কার্ডিওথোরাসিক বিভাগের সব অস্ত্রোপচার বন্ধ করে দিতে হয়েছে।

গাঁধী হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ স্বীকার করেছেন, কার্ডিওথোরাসিকে রোগী ভর্তি হচ্ছে না বলে বিভাগের দু’জন সার্জন, ন’জন নার্স এবং ন’জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মী ১৫ দিন ধরে কার্যত বসেই আছেন। তাঁদের কোনও কাজ নেই। বিভাগীয় চিকিৎসক ও নার্সেরা জানান, বহির্বিভাগে অসংখ্য রোগী আসছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে মরণাপন্ন। গত ১৫ দিনে এই ধরনের অন্তত ২২ জন গুরুতর অসুস্থ রোগীকে ভর্তি না-করে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে রোগী-অসন্তোষের মুখেও পড়তে হচ্ছে। এমন অনেক সঙ্কটাপন্ন রোগী রয়েছেন, যাঁরা হয়তো অস্ত্রোপচারের জন্য অনেক কষ্টে সরকারি অনুদান জোগাড় করেছেন। কিন্তু তার পরেও হাসপাতালে ভর্তি হতে পারছেন না।

কী বলছে স্বাস্থ্য দফতর?

দায় এড়ানোর ঠেলাঠেলি চলছে সেখানে। রাজ্যের স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, কল্যাণী মেডিক্যাল পরিচালনার দায়িত্ব রাজ্যের স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের। তাঁর প্রশ্ন, “স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয় সময়মতো টেকনিশিয়ান নিয়োগ করেনি কেন? গাঁধী হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই বা আগে থেকে বিষয়টি কেন জানাননি স্বাস্থ্য দফতরকে?”

তিন মাস ধরে স্বাস্থ্য দফতরের সঙ্গে এই নিয়ে চিঠি চালাচালি চলছে বলে জানান গাঁধী হাসপাতালের সুপার নিরুপম বিশ্বাস। তিনি বলেন, “এই হাসপাতালে হার্ট-লাং মেশিন চালানোর টেকনিশিয়ানের কোনও পদ অনুমোদিত ছিল না। যিনি কাজ চালাচ্ছিলেন, তিনি আসলে ছিলেন ল্যাব-টেকনিশিয়ানের পদে। এখনও পর্যন্ত নতুন পদ অনুমোদনই করে উঠতে পারেনি স্বাস্থ্য দফতর।”

আর স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তারা জানান, মেডিক্যাল কাউন্সিলের পরিদর্শনের কথা মাথায় রেখে আপাতত অবসরপ্রাপ্ত কর্মীকেই ফের অস্থায়ী ভাবে নিয়োগ করে কাজ চালানোর কথা ভাবে হচ্ছে। নইলে ১০০ আসন যে বাঁচানো যাবে না, সেটা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন তাঁরা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE