Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

বিষে বিষক্ষয়, খুঁতো হার্টের ফুটোই দিল নবজীবন

যে সমস্যা অন্যদের বেলায় জীবনঘাতী হয়ে উঠতে পারত, চার বছরের মেয়েটির ক্ষেত্রে সেটাই হয়ে গেল জীবনদায়ী! কোনও শিশুর হৃৎপিণ্ডে ফুটো থাকলে দ্রুত অস্ত্রোপচার না-হলে প্রাণসংশয় হতে পারে। সেখানে মিজোরামের মেয়েটি হার্টে ফুটো নিয়েই চার-চারটে বছর কাটিয়েছে! অথচ এমনিতেই তার বেঁচে থাকার কথা নয়, কারণ তার হার্টে ছিল পাঁচটি প্রকোষ্ঠ (চেম্বার), যা কিনা অস্বাভাবিক। কিন্তু হৃৎপিণ্ডের আর এক অস্বাভাবিকতা, অর্থাৎ ফুটোর অস্তিত্বই এত দিন তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল বলে জানান চিকিৎসকেরা।

কলকাতায় অস্ত্রোপচারের পরে মিজোরামের মেয়ে লালনুহলিমি।

কলকাতায় অস্ত্রোপচারের পরে মিজোরামের মেয়ে লালনুহলিমি।

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ নভেম্বর ২০১৪ ০২:২৭
Share: Save:

যে সমস্যা অন্যদের বেলায় জীবনঘাতী হয়ে উঠতে পারত, চার বছরের মেয়েটির ক্ষেত্রে সেটাই হয়ে গেল জীবনদায়ী!

কোনও শিশুর হৃৎপিণ্ডে ফুটো থাকলে দ্রুত অস্ত্রোপচার না-হলে প্রাণসংশয় হতে পারে। সেখানে মিজোরামের মেয়েটি হার্টে ফুটো নিয়েই চার-চারটে বছর কাটিয়েছে! অথচ এমনিতেই তার বেঁচে থাকার কথা নয়, কারণ তার হার্টে ছিল পাঁচটি প্রকোষ্ঠ (চেম্বার), যা কিনা অস্বাভাবিক। কিন্তু হৃৎপিণ্ডের আর এক অস্বাভাবিকতা, অর্থাৎ ফুটোর অস্তিত্বই এত দিন তাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল বলে জানান চিকিৎসকেরা।

তবে বাঁচতে হচ্ছিল খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে, নানা শারীরিক সমস্যায় জর্জরিত হতে হতে। কলকাতায় অস্ত্রোপচারের পরে এখন চার প্রকোষ্ঠের ফুটোহীন হৃৎপিণ্ড পেয়েছে লালনুহলিমি নামের ফুটফুটে মেয়েটি। ডাক্তারদের আশ্বাস, এ বার স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে সে।

লালনুহলিমির হার্টে যে ফুটো রয়েছে, তা আগেই ধরা পড়েছিল। ধরেছিলেন মিজোরামের ডাক্তারেরাই। তবে তাঁরা এটা ধরতে পারেননি যে, মেয়েটির হৃৎপিণ্ডে পাঁচটা প্রকোষ্ঠ রয়েছে, যেখানে থাকার কথা চারটে। বুঝতে পারেননি, অস্বাভাবিক হৃৎপিণ্ড মেয়েটির ধমনীতে অক্সিজেনযুক্ত শুদ্ধ রক্ত পৌঁছে দিতে পারছে না। ফলে কোষে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন পৌঁছচ্ছে না। স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে। মাঝেমধ্যে নীল হয়ে যাচ্ছে ছোট্ট শরীরটা। অভিভাবকদের স্থানীয় ডাক্তারেরা বলেছিলেন, মেয়ের হার্টের ফুটো সারাতে অবিলম্বে অপারেশন করাতে হবে। বস্তুত হার্টে ফুটো নিয়ে সে এত দিন বেঁচে রয়েছে কী ভাবে, তার ব্যাখ্যা ওঁরা খুঁজে পাননি।

মিলল কলকাতা এসে। বাইপাসের ধারের এক বেসরকারি হাসপাতালে যখন ধরা পড়ল লালনুহলিমির হার্টে পাঁচটা প্রকোষ্ঠ, তখনই বোঝা গেল, ওই ফুটোরই সৌজন্যে এত দিন সে টিকে থাকতে পেরেছে। আর তার কারণ বোঝাতে গিয়ে চিকিৎসকেরা প্রথমে মানবশরীরে রক্ত সঞ্চালনের পদ্ধতিটি বুঝিয়েছেন। সেটা কী রকম?

স্বাভাবিক মানুষের হার্টে চারটে প্রকোষ্ঠ দু’টো অলিন্দ (অরিক্ল), দু’টো নিলয় (ভেন্ট্রিক্ল)। প্রধান দুই শিরা মারফত কার্বন-ডাই-অক্সাইডযুক্ত দূষিত রক্ত প্রথমে এসে ঢোকে ডান অলিন্দে, তার পরে ডান নিলয়ে। ডান নিলয় থেকে ফুসফুসীয় ধমনী দিয়ে তা চলে যায় ফুসফুসে, শোধিত হতে। ফুসফুস থেকে অক্সিজেনযুক্ত শুদ্ধ রক্ত ফুসফুসীয় শিরা বয়ে চলে আসে বাম অলিন্দে। তার পরে নামে বাম নিলয়ে। প্রধান ধমনী সেখান থেকে হার্টের বাইরে নিয়ে যায় শুদ্ধ রক্তকে, যা অন্যান্য ধমনী মারফত শরীরের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ে।

এবং লালনুহলিমির দেহে এই প্রক্রিয়াটাই বিঘ্নিত হচ্ছিল। কলকাতার ফর্টিস হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জন কায়াপাণ্ডা মুথানা মান্ডানা বলেন, “বাম অলিন্দ ও বাম নিলয়ের মাঝে যে পর্দা থাকে, তার উপরে আর একটা পর্দা জুড়ে গিয়ে মেয়েটির হার্টের বাম নিলয়ের মাঝে বাড়তি একটা প্রকোষ্ঠ তৈরি করেছিল। চিকিৎসা পরিভাষায়, সুপ্রামাইট্রাল মেমব্রেন। এমনটা হলে ফুসফুস থেকে আসা শুদ্ধ রক্ত বাম নিলয়ে না-আসারই কথা।” তিনি জানিয়েছেন, পর্দার কারণে বাচ্চাটির হার্টের বাম অলিন্দ থেকে বাম নিলয়ে রক্ত চলাচল বাধাপ্রাপ্ত হয়ে কোষে কোষে রক্ত পৌঁছনোর রাস্তাটাই কার্যত বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

এখানেই আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়ায় ডান অলিন্দ-বাম অলিন্দের মাঝের ওই ফুটো। যা দিয়ে ডান অলিন্দ থেকে অশুদ্ধ রক্তই পঞ্চম প্রকোষ্ঠে ঢুকছিল চুঁইয়ে চুঁইয়ে। সেটাই যাচ্ছিল বাম নিলয়ে। আর সেই কার্বন ডাই-অক্সাইডযুক্ত অশুদ্ধ রক্তই মূল ধমনী বেয়ে বিভিন্ন কোষে পৌঁছচ্ছিল। তাতে অশক্ত শরীর নিয়েও কোনও মতে বেঁচে থাকতে পেরেছে লালনুহলিমি। ডাক্তারেরা বলছেন, ফুটোটা না-থাকলে চিকিৎসার সুযোগটুকুও মিলত না। এক বছর বয়স হতে-না-হতেই হয় পালমোনারি হাইপার টেনশনে হার্ট ফেল হতো, নতুবা অক্সিজেনের অভাবে কোষগুলো সব মরে যেত। তাতেও মৃত্যু ছিল অবধারিত।

যা-ই হোক, অস্ত্রোপচারের পরে লালনুহলিমিকে তাঁরা স্বাভাবিক হৃৎপিণ্ড উপহার দিতে পেরেছেন বলে মান্ডানার দাবি। “বাম অলিন্দের মাঝের পর্দাটা আমরা বাদ দিয়ে দিয়েছি। ফুটোটাও বন্ধ করেছি। চার প্রকোষ্ঠের হৃৎপিণ্ডে স্বাভাবিক ভাবে রক্ত চলাচল করছে।” বলেন তিনি। ওঁদের আশ্বাস, মেয়েটি সুস্থ জীবন পাবে।

এই সাফল্যের খবরে শহরের অন্য হৃদ্রোগ-চিকিৎসকেরাও খুশি। কার্ডিওলজিস্ট বিশ্বকেশ মজুমদার বলছেন, “সমস্যাটা ছিল একই সঙ্গে বিরল ও বিপজ্জনক। দুই অস্বাভাবিকতা যুগপৎ থাকায় মেয়েটি বেঁচে গিয়েছে। নচেৎ মর্মান্তিক পরিণতি হতে পারত।” কার্ডিওলজিস্ট সুসান মুখোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “হার্টের জন্মগত ত্রুটিগুলোর মধ্যে সুপ্রামাইট্রাল মেমব্রেন কিছুটা বিরল। সঙ্গে আর্টিয়াল সেপটাল ডিফেক্ট (হার্টে ছিদ্র) থাকা আরও বিরল। তবে দু’টো এক সঙ্গে থাকায় প্রাণ বেঁচেছে।” কার্ডিওথোরাসিক সার্জন সত্যজিৎ বসুর মন্তব্য, “ধমনীতে শুদ্ধ রক্ত পৌঁছানোয় প্রতিবন্ধকতার কারণেই শরীর নীল হয়ে যাচ্ছিল। হার্টে ছিদ্রটি থাকায় কোনও মতে টিকে ছিল। অপারেশনে এই সমস্যা পুরোপুরি দূর হয়ে যায়। আশা করা যায়, ভবিষ্যতে ও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাঁচতে পারবে।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE