মুখ্যমন্ত্রী উদ্বোধনের পরেও ফাঁকা পড়ে রয়েছে ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড হাব’। ছবি: সুজিত মাহাতো।
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদ্বোধন করার তিন মাস পরেও চালু করা গেল না পুরুলিয়া দেবেন মাহাতো সদর হাসপাতালের ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড হাব’!
করিডরের কাজ অসম্পূর্ণ থাকায় তিনি এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করে গেলেও প্রসূতি মা ও নবজাতক বা শিশুদের কাছে এই প্রকল্পের পরিষেবা আজও অধরা।
দায়িত্ব নিয়েই রাজ্যের পিছিয়ে পড়া এই জেলায় স্বাস্থ্য পরিষেবার হাল ফেরাতে উদ্যোগী হন মুখ্যমন্ত্রী। জেলায় প্রথমবার প্রশাসনিক বৈঠক করতে এসে স্বাস্থ্য পরিষেবায় নানা ঘাটতির কথা জানতে পারেন তিনি। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, তার মধ্যে অন্যতম ছিল পরিকাঠামোজনিত ঘাটতির কারণে মাঝে মাঝেই শিশুমৃত্যুর ঘটনা। মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেন, অনুন্নত এই জেলায় সদর হাসাপাতালে প্রসূতি ও তাঁদের সন্তানদের উন্নতমানের স্বাস্থ্য পরিষেবা দিতে ‘মাদার অ্যান্ড চাইল্ড হাব’ গড়ে তোলা হবে।
হাব অর্থে একই ছাদের তলায় মা ও শিশুর উন্নত স্বাস্থ্য পরিষেবা। বর্তমানে পুরুলিয়া সদর হাসপাতালে শিশু বিভাগে ৩০টি শয্যা রয়েছে। হাসপাতাল সূত্রের খবর, ৩০টি শয্যা থাকলেও প্রায় সব সময়ই এই বিভাগে রোগীর চাপ থাকে অন্তত তিনগুণ। প্রসূতি বিভাগে শয্যার সংখ্যা ৪০ হলেও সেখানেও প্রায় একই পরিমাণ রোগীর চাপ থাকে। আর নবজাত শিশুর পরিচর্যা কেন্দ্রে শয্যার সংখ্যা ৩২। এই বিভাগে শয্যা খালি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা। সে কারণে অনেক সময়ই চিকিত্সকরা অসুস্থ নবজাতকদের সেখানে ভর্তি নিতে পারেন না। তারপরেও রয়েছে পরিকাঠামোজনিত অসুবিধা।
বর্তমানে হাসপাতালে শিশু বিভাগ রয়েছে তিনতলায় আর প্রসূতি বিভাগটি রয়েছে দোতলায়। হাসপাতালের এক চিকিত্সকের কথায়, “কোনও প্রসূতি মা নিজের সদ্যোজাত সন্তানকে নিয়ে সাধারণত দোতলায় থাকেন। কিন্তু তাঁর সদ্যোজাত সন্তান যদি অসুস্থ হয়ে পড়ে, তখন ওই শিশুকে তিনতলায় নিয়ে গিয়ে ভর্তি করতে হয়। এর ফলে ঘণ্টাখানেক অন্তর ওই প্রসূতির পক্ষে তিনতলায় উঠে গিয়ে সন্তানকে দুধ খাওয়াতে যেতে বেগ পেতে হয়। আর অস্ত্রোপচার করে সন্তানের জন্ম দেওয়া হলে সেই প্রসূতির পক্ষে বারবার সিঁড়ি ভাঙা শুধু কষ্টকরই নয়, বিপজ্জনকও বটে।” আর প্রসূতিদের অভিজ্ঞতা, প্রসূতি ওয়ার্ডের কাছাকাছি থাকা দু’টি লিফট দীর্ঘদিন ধরেই অচল। অন্য একটি লিফট চালু থাকলেও সেটি বেশ দূরে। এ ছাড়া ঘণ্টায়-ঘণ্টায় লিফটে প্রসূতিদের তোলা-নামা করাতে কর্মীরা বিরক্ত হন বলেও অভিযোগ। লিফটের সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে দালালদের টাকা চাওয়ার অভিযোগও রয়েছে।
এমনই সব অসুবিধার কথা মাথায় রেখেই একই তলার এক দিকে প্রসূতি বিভাগ, অন্য দিকে শিশু বিভাগ এবং সেই তলাতেই নবজাত শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র থাকার ওই মাদার অ্যান্ড চাইল্ড হাব তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। প্রতিটি বিভাগেই বরাদ্দ শয্যা সংখ্যা বাড়ানো হবে বলেও ঠিক হয়। প্রসূতি বিভাগে ও শিশু বিভাগে প্রায় ১০০টি করে শয্যা রাখা হবে বলে ঠিক হয়। প্রকল্প রিপোর্টে ওই তলাতেই স্টেপ ডাউন ইউনিটিও চালু করার কথা উল্লেখ করা হয়। দ্রুত এই প্রকল্প গড়ে তুলতে পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়ন পর্ষদ ২০১১ সালের শেষের দিকে ১৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করে। কাজ শেষের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ২০১৩ সালের অগস্ট মাস। ঠিক হয়েছিল মুখ্যমন্ত্রী জেলায় প্রসাশনিক বৈঠক করতে এলে তিনি এই হাবের উদ্বোধন করবেন। মুখ্যমন্ত্রী গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জেলায় প্রশাসনিক বৈঠক করতে এলেও এই প্রকল্পটির উদ্বোধন করতে পারেননি। তখনও প্রকল্পের কাজ শেষ হয়নি। কিন্তু চলতি বছরে গত জুলাইতে যখন তিনি ফের জেলায় আসেন, তখন তড়িঘড়ি তাঁকে দিয়ে এই বিভাগের উদ্বোধন করিয়ে নেওয়া হয়।
কাজ কেন শেষ হয়নি? পরিকল্পনায় নানা জটিলতাই মূল কারণ। চলতি বছরের গোড়ার দিকে মাদার এন্ড চাইল্ড হাবের অবস্থা দেখে চোখ কপালে ওঠে হাসপাতাল পরিদর্শনে আসা রাজ্য স্বাস্থ্য কর্তাদের। স্বাস্থ্য দফতরের তত্কালীন উপ-অধিকর্তা সন্দীপ সান্যালের নজর এড়ায়নি অব্যবস্থা। হাসপাতালের পিছনের দিকে একটি ভবনের তিনতলায় এই হাব গড়ে তোলা হচ্ছে। আর বর্তমানে হাসপাতালের লেবার রুম বা অস্ত্রোপচারের ঘর রয়েছে সামনের দিকের মূল ভবনের দোতলায়। সন্দীপবাবু প্রশ্ন তোলেন, একজন প্রসূতির অস্ত্রোপচার হওয়ার পরে কী ভাবে তাঁকে পিছনের বিল্ডিংয়ের তিনতলায় তোলা যাবে? কারণ ওই ভবনে লিফটের ব্যবস্থাই নেই। স্ট্রেচারে করে কী ভাবে সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় সদ্য সন্তানের জন্ম দেওয়া প্রসূতিকে তোলা সম্ভব? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অবশ্য এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি। তখনই ঠিক হয় দুই ভবনকে একটি করিডরের মাধ্যমে জুড়ে দেওয়া হবে।
হাসপাতাল সুপার নীলাঞ্জনা সেন মেনে নিয়েছেন পরিকল্পনায় এই গলদের কথা। তিনি বলেন, “এই ভবনে লিফট নেই এ জন্যই অসুবিধা। ওই ভবনে নতুন করে লিফট বসাতে হবে।” জেলা পরিষদের জনস্বাস্থ্য কর্মাধক্ষ্য উত্তম বন্দ্যোপাধ্যায়ও বলেন, “কাজ একে শ্লথ গতিতে হয়েছে। তার উপর এখন দেখা যাচ্ছে লিফট বসানোর পরিকল্পনাও ছিল না। গলদ যে ছিল অস্বীকারের উপায় নেই।” জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক মানবেন্দ্র ঘোষ বলেন, “এটা পরিকল্পনার সময়ই দেখা দরকার ছিল। এই ভবনে লিফট বসানোর প্রাথমিক কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া করিডর জোড়া দেওয়ার কাজও সম্পূর্ণ হয়েছে।” কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তো গত জুলাই মাসেই এই হাবটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেছিলেন। মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক বলেন, “তখনও কিছু কাজ বাকি রয়ে গিয়েছিল। চালু করে দিলে কিছু বাস্তব অসুবিধা দেখা দিত। তাই বাকি কাজটুকু আমরা শেষ করেই এই বিভাগ চালু করতে চলেছি।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy