প্রতীকী ছবি।
বাড়িতে যে কোনও সমস্যার দায় চাপে তাঁর উপর। কারও শরীর খারাপ হলে বলা হয়, বাড়ির বউ বাইরে কাজ করতে গেলে সংসারের এমন হালই হবে। সন্তানের পরীক্ষায় ফল খারাপ হলেও ওঠে একই কথা। দিনের পর দিন এ ভাবে চলতে থাকায় তানিয়া রায় নামের একজন ব্যাঙ্ককর্মীরও মনে হতে থাকে চাকরি করাই ভুল হচ্ছে তাঁর। কিন্তু তানিয়ার অর্থের উপর সংসারের নানা খরচ নির্ভর করে। ফলে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়াও কঠিন। সব মিলে বাড়তে থাকে মানসিক চাপ। নিজেকে অপরাধি মনে হতে থাকে তাঁর।
ঘটনাটি আপাত ভাবে ঘরোয়া। এমন বহু পরিবারেই হয়। তাই খুবই পরিচিত। এ নিয়ে সকলে তেমন মাথাও ঘামাতে চান না। কিন্তু এটিও এক ধরনের নির্যাতন। মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় একে বলা হয় ‘গ্যাসলাইটিং’। দিনের পর দিন একই ভাবে কেউ সমালোচনা করতে থাকলে হারাতে পারে আত্মবিশ্বাস। নিজের আচরণ নিয়েই সন্দেহ তৈরি হয়।
শুধু বাড়ির মহিলাদেরই এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, এমন নয়। হতে পারে পুরুষদেক সঙ্গেও। ধরা যাক অভিষেক সিংহের কথাই। মতে না মিললেই অভিষেককে প্রেমিকা রিয়া বলেন, মানসিক অবসাদের কারণ তিনিই। দিনের পর দিন এমনটা শোনার পর অভিষেকও এক অর্থে মেনে নেন, রিয়ার জীবনের সব সমস্যার দায় তাঁর। চেষ্টা করতে থাকেন যাতে রিয়া মনের মতো হয়ে উঠতে পারেন তিনি। কিন্তু এমন যত চেষ্টা করেন, ততই যেন হারাতে থাকে আত্মবিশ্বাস। সব কাজেই ব্যর্থ হওয়ার ভয় তাড়া করে।
একই সমস্যা হয় অন্য ধরনের সম্পর্কেও। যেমন হয়েছে এক মা-মেয়ের মধ্যে। দুই নাতি-নাতনির দায়িত্ব নিতে সক্ষম নন বছর ষাটের মিতালি বর্মণ। সবে এত বছরের কর্মজীবনের অবসান ঘটেছে। এ বার একটু হাল্কাই থাকতে ভাল লাগে তাঁর। বই পড়ে, গান শুনে দিন যাপন করতেই পছন্দ করেন। তাতেই আপত্তি মেয়ে নন্দিনীর। মনোবিদের কাছে গিয়ে মিতালি জানান, নন্দিনী জোর করেই তাঁকে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছেন। সর্ব ক্ষণ নাতি-নাতনির দায়িত্ব নিতে না চাওয়া নাকি অবসাদের লক্ষণ বলে মনে হয় মেয়ের। কারণ, বেশির ভাগ ঠাকুরমা-দিদিমা এমনিতে নাতি-নাতনির সঙ্গে সময় কাটাতেই পছন্দ করেন। নিত্য এ সব শুনতে শুনতে মিতালিও ভাবতে শুরু করেন, তাঁর বুঝি অবসাদই হয়েছে।
সব ক’টি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছ, অন্যের দেওয়া অপবাদ শুনতে শুনতে নিজেকে সে ভাবেই দেখতে শুরু করেছেন সেই ব্যক্তি। আপাত ভাবে তেমন বড় বিষয় মনে না হলেও এই ধরনের নির্যাতনের ক্ষতি অনেক গুণ বেশি। গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হলে উদ্বেগ বেড়ে যায়। চিন্তা হয় নিজের আচরণ নিয়ে। কথায় কথায় নিজের সব পদক্ষেপের জন্য ক্ষমা চাওয়ার অভ্যাস হয়ে যায়। সব মিলিয়ে অপরাধবোধের গ্রাসে পড়ে যান গোটা দিন। সব সময়ে একাকিত্বে ভুগতে থাকেন। কোনও সিদ্ধান্ত নিতেও সমস্যায় পড়েন নির্যাতিত সেই ব্যক্তি।
গ্যাসলাইটিং ঠিক কী?
গ্যাসলাইটিংয়ের ক্ষেত্রে একটি বড় সমস্যা হল অনেক সময়ে যিনি নির্যাতন করছেন, তিনিও এ বিষয়ে সচেতন নন। তিনি হয়তো ভাবছেন যে নির্যাতিতের ভাল চেয়েই তাঁর কিছু আচরণের সমালোচনা করছেন। কিন্তু প্রতিনিয়ত সমালোচনার মুখে পড়ে ভাল তো হচ্ছেই না, উল্টে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন সেই ব্যক্তি।
সাধারণত খুব কাছের কোনও ব্যক্তির থেকেই গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হতে হয়। প্রেমের সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি এমন হলেও পরিবারের অন্যদের কাছেও হতে পারেন গ্যাসলাইলিংয়ের শিকার। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় বাবা-মায়ের চাপে পড়ে আত্মবিশ্বাস হারায় সন্তান। উল্টোটাও আবার হয়। যেমন হয়েছে মিতালির ক্ষেত্রে। কর্মক্ষেত্রে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আচরণও অনেক সময়ে নির্যাতনের সমান হয়ে উঠতে পারে। তার ফলে কোনও কর্মী কাজের ইচ্ছা, ক্ষমতা হারাতে পারেন।
এই ধরনের অত্যাচার ‘গ্যাসলাইটিং’ বলে পরিচিত হয়েছে হলিউডের একটি ছবির নাম থেকে। ১৯৪৪ সালের ছবি ‘গ্যাসলাইট’-এ স্বামীর-স্ত্রীর সম্পর্কের মাধ্যমে এই সমস্যাটি দেখানো হয়। ৯০-এর দশক থেকে এই ধরনের মানসিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে ‘গ্যাসলাইটিং’ কথাটি ব্যবহৃত হতে থাকে। মূলত ‘গ্যাসলাইট’ ছবিতে যে ভাবে নির্যাতিতার আত্মবিশ্বাস তলানিতে গিয়ে ঠেকে, সেই সমস্যার কথা বোঝাতেই ব্যবহৃত হয় এই শব্দটি।
গ্যাসলাইটিং সম্পর্কে কী বলছেন মনোবিদ?
মনোবিদ অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হওয়া বহু বহু মানুষ আসেন তাঁর কাছে। এমন সমস্যা পরিবার, বন্ধুত্ব, কর্মক্ষেত্রে লেগেই থাকে। অনুত্তমা বলেন, ‘‘যদিও এটা আমরা বহু সময়ে অন্তরঙ্গ প্রেমের সম্পর্কের ক্ষেত্রেই অনেক বেশি শুনে থাকি, কিন্তু এটা যে কোনও সম্পর্কের জমিতেই তৈরি হতে পারে। যখন কেউ গ্যাসলাইটিংয়ের শিকার হচ্ছেন, তখন গোড়ার দিকে হয়তো তিনি বুঝতেই পারছেন না যে, তাঁর সম্পর্কে যেটা বলা হচ্ছে, সেটা সঠিক মূল্যায়ন নয়। যে সব কথা বলা হচ্ছে, সেই নঞর্থক লেন্সে তিনি নিজেও নিজেকে মূল্যায়ন করতে শুরু করেন। যার ফলে ক্রমশ আত্মবিশ্বাস আহত হতে থাকে। বেশ কিছু সময় পর তাঁরা এ কথা বুঝতে পারেন। মনোবিদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে তাঁরা নিজেকে যখন নতুন করে দেখতে পান। তখন তিনি বুঝতে পারেন যে, এত দিন তিনি অন্যের চোখ দিয়ে নিজেকে দেখছিলেন। অন্যের তৈরি করা কাঠগড়ায় যেন নিজেই নিজেকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন। অন্যের দেখানো দোষ দিয়ে নিজেরাও নিজেকে দোষী ভেবে ফেলেছেন।’’ অনুত্তমা আরও মনে করান, এ ক্ষেত্রে যাঁদের দ্বারা নির্যাতিত হচ্ছেন, তাঁরা মূলত নিজেদের প্রিয় মানুষ। ফলে এমন ক্ষেত্রে অনেক বেশি ক্ষত-বিক্ষত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কারণ, আমরা কাছের মানুষের মূল্যায়নই অধিকাংশ ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকি। তাঁর দ্বারা বেশি প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনাও থাকে। এবং সেটাই অধিকাংশের অভ্যাস। তাঁদের মূল্যায়ন যে ভুল হতে পারে, তা থেকে যে নিজের ক্ষতি হতে পারে, তা বুঝতেই লেগে যায় অনেকটা সময়। তত দিনে ক্ষত আরও গাঢ় হয়ে যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy