একটি মন্দির। দান, প্রসাদগ্রহণ, পূজা -- সব কিছুই অন্যান্য মন্দিরের মতোই। কেবল একটি মাত্র জিনিসে অন্য সব মন্দিরের থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে কেরলের ‘নবপুরম মতাতীত দেবালয়ম’ মন্দির। গর্ভগৃহে কোনও দেবতার মূর্তি নেই। তার জায়গায় রয়েছে পাথরের বই, প্রকাণ্ড স্থাপত্য। দানের জায়গায় বইয়ের পাহাড়। প্রসাদ হিসেবে দুই হাত পেতে নিতে হচ্ছে বই। আর পূজিত হচ্ছে বই এবং শিক্ষা। পুরোহিত নেই, নৈবেদ্য নেই। দর্শনার্থীদের (পড়ুন বইপ্রেমী) হাতে প্রসাদ হিসেবে বই তুলে দেওয়া হয়।
শিক্ষাই আরাধ্য— এই ভাবনার বাস্তব রূপের সন্ধান মিলবে কেরলে, যেখানে আজও শিক্ষার হার ভারতের বাকি সব রাজ্যের তুলনায় বেশি। সেই রাজ্যের উত্তর প্রান্তে কান্নুর জেলার চেরুপুঝার কাছে অবস্থিত প্রপোয়িল গ্রামের গর্ব এই মন্দির। ‘নবপুরম মতাতীত দেবালয়ম’-এর অর্থ হল ‘ঈশ্বরের ধর্মনিরপেক্ষ ঘর’। এই উপাসনালয়ে কোনও দেবতা বা দেবীর মূর্তি নেই। রয়েছে একটি বইয়ের ভাস্কর্য। ৩০ ফুট উঁচু সেই বইয়ের পাতায় খোদাই করে মালয়ালম ভাষায় লেখা রয়েছে, ‘জ্ঞানই ঈশ্বর। ধর্ম হল, প্রশস্ত চিন্তাভাবনা। বিনয়ের সঙ্গে জ্ঞানচর্চাই পথ।’

মন্দিরে প্রবেশ করার পরই ৫ হাজার বই সম্বলিত গ্রন্থাগার দেখা যাবে। ছবি: সংগৃহীত।
২০২১ সালের ৪ মার্চ জনসাধারণের জন্য এই মন্দিরের দরজা খুলে দেওয়া হয়। তার পর থেকে বই পড়া, লেখালেখি করা, লেখকদের নিয়ে বইয়ের মেলা, বইয়ের উৎসব, সব কিছুরই পীঠস্থান এই দুই একরের জমি। চারপাশে গাছপালার ভিড়। এই মন্দিরের দরজা সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষের জন্য উন্মুক্ত। মনে করা হয়, জ্ঞানই একমাত্র ঐক্যবদ্ধ শক্তি। কোনও ভেদাভেদকে জায়গা দেওয়া হয় না সেখানে।
মন্দিরে প্রবেশ করার পরই ৫ হাজার বই সম্বলিত গ্রন্থাগার দেখা যাবে। আর দেওয়ালগুলিতে খোদাই করে কেরলের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি এবং সাহিত্যের বর্ণনা করা হয়েছে।
এই মন্দিরের নেপথ্যে রয়েছে মালয়ালি লেখক প্রপোয়িল নারায়ণনের ৩৫ বছরের স্বপ্ন এবং পরিশ্রম। তাঁর কাছে সাহিত্য এবং শিক্ষাই জীবনের একমাত্র ধর্ম। পৈতৃক সম্পত্তি হিসেবে ছিল দুই একরের এই জমি। বাবার মৃত্যুর পর রোজকার সংসার চালানোর দায়িত্ব তাঁর কাঁধেই এসে বর্তায়। পাঁচটি বিষয়ে স্নাতকোত্তর তিনি। এই মুহূর্তে ইংরেজিতে একই ডিগ্রি অর্জনে ব্যস্ত নারায়ণন। কলেজে পড়িয়ে যা রোজগার হয়, তা দিয়ে সংসারের খরচ বহন করে বাকি টাকা জমিয়ে রাখেন। আজ পর্যন্ত এই মন্দির বানাতে তাঁর নিজেরই খরচ হয়েছে প্রায় ৭.৬ কোটি টাকা।
মন্দিরটিকে একটি স্বনির্ভর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার স্বপ্ন দেখছেন নারায়ণন। জ্ঞানচর্চার 'এঝুথুপুরা' (লেখালেখির কুটির) হিসেবে পরিচয় দিতে চান এই জায়গাটিকে। এই মুহূর্তে তিনটি কুটির বানানো হয়েছে, আরও ৭টি কুটির তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।