Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Cancer Patients

ক্যানসার রোগীর ‘কেয়ারগিভারের’ মনের যত্ন নিয়ে ভাবনা শুরু

বিদেশে যেমন রোগীর ব্যক্তিসত্তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, এ দেশে কেয়ারগিভারের মতামতও গুরুত্ব পায়। সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে কেয়ারগিভারের ভূমিকা অনেকটাই বেশি।

An image of Hands

—প্রতীকী চিত্র।

জয়তী রাহা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ ০৫:০৫
Share: Save:

আধার যত ভাল হবে, তার ভিতরের জিনিসও ততটাই সুরক্ষিত থাকবে। অতএব আধারটির প্রতি যত্নবান হতে হবে।

ক্যানসার চিকিৎসায় রোগীর সঙ্গী কেয়ারগিভার বা মুখ্য কেয়ারগিভারের মানসিক স্বাস্থ্য প্রসঙ্গে কথা শুরু করতেই এ কথা বলছিলেন এক মনোরোগ চিকিৎসক। ‘‘আজ, ৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ক্যানসার দিবস— মনে রাখতে হবে ক্যানসার মানেই জীবনের শেষ নয়। প্রিয়জন ক্যানসার আক্রান্ত হলে তাঁর দ্বিতীয় ইনিংস শুরু হল ভাবুন। আপনার ভালবাসার মানুষটির ক্যানসার হয়েছে, এমন খবরে ভারী হয়ে যায় ঘরের বাতাস। যেন শিয়রে কড়া নাড়ছে রোগ। তা না করে বরং যথাযথ চিকিৎসা করানোর এবং প্রতিটা মুহূর্ত আনন্দ করে বাঁচার জেদ ধরতে হবে।’’

যেমন ধরেছিলেন স্কুলশিক্ষিকা দেবযানী বসু। দশ বছর আগে হজকিন’স লিম্ফোমায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। দীর্ঘ চিকিৎসার পর্ব মিটিয়ে অস্থিমজ্জার প্রতিস্থাপনের শেষে এখন সুস্থ তিনি। রোগ যখন ধরা পড়ে তখন দেড় বছরের যমজ বাচ্চা নিয়ে মা-বাবার সঙ্গে থাকতেন দেবযানী। প্রথম দিন ডাক্তারকে প্রশ্ন করেছিলেন, বাঁচার আশা কতটা? জেনেছিলেন, ৮০ শতাংশ। ব্যস, আর কাউকে প্রশ্ন করেননি। এক বারও ভাবেননি, হয়তো বাঁচব না। নিজেই রোগী, আবার নিজেই কেয়ারগিভার। ‘‘ছোট থেকেই লড়াই করেছি। আরামের জীবন ছিল না। তাই ভিতর থেকেই শক্ত আমি। এটা সবার হয় না। এখনও নানা ভাবে ক্যানসার আক্রান্ত কেউ পরামর্শ চাইলে পাশে থাকি। দেখেছি, কেয়ারগিভারের যন্ত্রণা। নিজেই হয়তো তিনি অসুস্থ। জিনিসের বোঝা টানতে হচ্ছে তাঁকেই। কিংবা লোকবলের অভাবে রোগীর সঙ্গে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, চাকরির ক্ষতি বুঝেও। এ ছাড়া মনের যন্ত্রণা তো আছেই।’’

শহরের একটি ক্যানসার হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত মনোরোগ চিকিৎসক সৌমিত্রশঙ্কর দত্ত বললেন, ‘‘কেয়ারগিভার হলেন অনেকটা পাত্র বা আধারের মতো। হাসপাতালে রোগীর সঙ্গে থেকে তাঁকে দেখাশোনা করার প্রশিক্ষণ হাতেকলমে নেন, বাড়ি ফিরে তাঁকে আগলে রাখেন। কিন্তু কেয়ারগিভারের মনও আগলে রাখা দরকার। কারণ, আধার ভাল থাকলে তবেই তাঁর সঙ্গে থাকা রোগীর মন ভাল থাকবে।’’

বিদেশে যেমন রোগীর ব্যক্তিসত্তাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, এ দেশে কেয়ারগিভারের মতামতও গুরুত্ব পায়। সামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে কেয়ারগিভারের ভূমিকা অনেকটাই বেশি। সৌমিত্রের কথায়, ‘‘হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সঙ্গে থাকা মানুষটিকে যখন বলি, আপনি কেমন আছেন? আপনার ওষুধ এনেছেন? সে সব খাচ্ছেন তো ঠিক করে? রোগীর দেখাশোনা করতে আপনাকে সুস্থ থাকতে হবে। তখন দৃষ্টিতে দেখেছি, ভরসা।’’

ক্যানসার রোগীর পরিজনদের নিয়ে কাজ করছেন মনোবিদ অরুণিমা দত্ত। শহরের একটি বেসরকারি হাসপাতালের ক্যানসার ইউনিটের সঙ্গে যুক্ত তিনি। তাঁর কথায়, রোগীর চিকিৎসার সিদ্ধান্তে জড়িয়ে থাকেন কেয়ারগিভার। তাঁকে ভারাক্রান্ত করলে আসল কাজটাই ঠিক হবে না। পরিবারের সিদ্ধান্তে এবং দায়িত্বে রোগাক্রান্ত মানুষটিকেও জড়িয়ে রাখতে হবে। বাড়িতে কী রান্না হবে, বাজার থেকে কী কিনবেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করুন। তাঁর সঙ্গে গল্প করুন। তাঁর ভাল লাগার কোনও কাজ করতে সুযোগ দিন। অরুণিমা বলছেন, ‘‘তা হলে রোগী নিজেকে একঘরে ভেবে বোঝা মনে করবেন না। এ ভাবে কাজ ভাগাভাগি হলে ভাল থাকবে কেয়ারগিভারের মনও। উপায় না থাকলে রোগীকে অল্প সময়ের জন্য একা রেখে নিজের কাজ সারতে হবে তাঁকে। দিনে এক ঘণ্টা হলেও সম্পূর্ণ নিজের সঙ্গে কাটান।’’

মেডিকা সুপারস্পেশ্যালিটি হাসপাতালের ক্যানসার ইউনিট সম্প্রতি এই দিকটা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে। এখানে কেয়ারগিভারদের বিনামূল্যে মানসিক স্বাস্থ্যের পরামর্শ দেওয়া হয়। ১৭৫ জন কেয়ারগিভারের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়েছে তারা। গত তিন মাসের প্রাথমিক ফলাফলে দেখা গিয়েছে, কেয়ারগিভার মানসিক সাপোর্ট পেলে তাঁর এবং রোগীর জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। ওই হাসপাতালের ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘কেয়ারগিভারদের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কখনও ভাবা হয়নি। সেই কাজ শুরু হয়েছে। সর্বস্তরে আরও বিস্তৃত করতে হবে সেই কাজের পরিধি।’’

একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কলকাতা শাখার দায়িত্বে রয়েছেন শম্পা চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘‘শিশু ক্যানসার রোগীর পরিবারকে নিয়ে আমরা কাজ করি। দীর্ঘ মাস ধরে বহু রোগীর চিকিৎসা চলে। তখন তার বাবা-মাকে সঙ্গে থাকতে হয়। সেই সময়ে নিখরচায় তাঁদের থাকা-খাওয়ার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্য, রোগীকে দেখাশোনার প্রশিক্ষণ, পেশার জন্য নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় কেয়ারগিভারদের। সবটাই বিনামূল্যে। যাতে কিছু কাজ শিখে পরে অর্থ উপার্জন করা যায় এবং রোগের চিন্তার বাইরে মনকে ব্যস্ত রাখা যায়।’’

তবে এই ধরনের কাজ বা ভাবনা আরও অনেক বেশি এবং বিস্তৃত করার প্রয়োজনের কথা মানছেন দেবযানী, অরুণিমারা।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy