সাহিদা আর প্রীতি। দুই নারী। হাতে তরবারি নয়, শরীরে উদ্দাম নাচ। আর চিত্তে হ্যালুসিনেশন। মাদক তৈরি করতে গিয়ে একটুখানি চেখে দেখেই অঙ্গে অঙ্গে তা তা থৈ থৈ। হিতেশ ভাটিয়ার ‘ডাব্বা কার্টেল’-এর এমন একটা মুহূর্তে সঙ্গীত পরিচালক গৌরব রায়না আর তারানা মারওয়া নেপথ্যে দিলেন পুরুষকণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে’ গানটি, তা-ও আবার একটু বিকৃত সুরে।
বিপদ বেধেছে এখানেই। একে তো পরিচালক, সঙ্গীত পরিচালক— দু’জনেই অবাঙালি। তার উপরে মাদকাসক্তের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ! তারও উপরে, নাচছে যে দুই নারী, তারা সমকামী। এই তিনের ঘায়ে বিতর্কের রব উঠেছে ভুবনে।
রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক এ বাংলায় নতুন নয়। যত দিন রবীন্দ্ররচনা কপিরাইটের আওতায় ছিল, তত দিন বিশ্বভারতী সংগীত সমিতির অনুমতি দেওয়া-না-দেওয়া নিয়ে তর্ক উঠেছে নানা সময়ে। সে কপিরাইট উঠে গিয়েছে চব্বিশ বছর আগে, ২০০১-এ। বিশ্বভারতীর অনুমতি নিয়ে এখন আর সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করতে হয় না। কিন্তু তাতে কী? রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে রক্ষণশীলতার কপিরাইট যে বঙ্গচিত্তেরই একান্ত।

‘চারুলতা’-র এই দৃশ্যেই ব্যবহৃত হয়েছিল ‘মম চিত্তে’-র সুর। ছবি: সংগৃহীত।
সে চিত্তে কোন ধরনের নাচের সঙ্গে মম চিত্তে গাওয়া যাবে, সে-ও এক রকম পূর্বনির্ধারিত। আশৈশব লালিত রবীন্দ্রজয়ন্তীর স্মৃতি আমাদের বলেই দিয়েছে যথেষ্ট রাবীন্দ্রিক পোশাকেই ও গান গাওয়া যাবে। নির্জন ঘরে নিষিদ্ধ মাদক আর নিপাতনে অসিদ্ধ সম্পর্কের অনুষঙ্গে অবাধ্য মেয়ের হৃদয়ে ও গান কেন? তায় আবার গানের সঙ্গে নাচতে নাচতে এক মেয়ে আর এক মেয়েকে চোখ টিপে দেয়!
রবীন্দ্রসঙ্গীতে যে এক ধরনের ঋষিসুলভ পবিত্রতা আমরা অনেকেই আজও আরোপ করে চলি, সেইখানে ঘা দিয়েছে ‘ডাব্বা কার্টেল’-এর এই রবীন্দ্রসঙ্গীত। অথচ এ গানের কথায় বেশ মিলে যায় সাহিদা আর প্রীতির অন্তরের গল্প। যেমন মিলে গিয়েছিল ‘চারুলতা’র গল্পও। গিয়েছিল বলেই ওই গানটাকেই ‘চারুলতা’-র থিম মিউজ়িকে একেবারে টাইটেল কার্ড থেকে ব্যবহার করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। সেই নামপত্রে চারুলতা ভূপতির রুমালে ইংরেজি ‘বি’ অক্ষর বুনছে আর নেপথ্যে বাজছে ‘মম চিত্তে নিতি নৃত্যে…’। এর পরে গোটা ছবিতে চারুর তথাকথিত ভাল-মন্দের বোধ আর স্ট্যাটিক থাকবে না, দোলাচল তৈরি হবে বন্ধন আর মুক্তির, তারই যেন সুরটি ধরিয়ে দিলেন সত্যজিৎ।
আসলে রবীন্দ্রনাথের গানের স্মৃতি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আমাদের প্রথম দু’লাইনের। সে স্মৃতি আমাদের বোকা বানায় মাঝেমাঝেই। যেমন কোনও এক কালীপুজোর কাছাকাছি সময়ে ওই এক-দু’লাইনের স্মৃতি মনে রেখেই হয়তো এক প্রবীণ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী কালীপুজোর রবীন্দ্রসঙ্গীত বানিয়ে দিয়েছিলেন ‘নাচ শ্যামা তালে তালে’-কে। অথচ ও গানের শ্যামা, পাখিমাত্র, দেবী নয়। কোথাও কোথাও এখনও শিল্পোৎসবে অবলীলায় ‘নমো যন্ত্র নমো যন্ত্র’ গাওয়া হয়, যে গান আসলে যন্ত্রসভ্যতাকে ব্যঙ্গ করে। কিন্তু যদি রবীন্দ্রসঙ্গীতের ওই প্রথম দু’লাইনের পরেও আমরা ভাবা প্র্যাকটিস করি, তা হলে দেখব সে গান কত বিচিত্র মানসিকতার সঙ্গে জুড়ে যায়, মনের কত রকম, কত রকমের মন সে গানে আশ্রয় পায়।

নিজের গান নিয়ে অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ছবি: সংগৃহীত।
আর একটা সিনেমায় রবীন্দ্রসঙ্গীতের একদম অন্য রকম এক ব্যবহারের কথা, অনুমান করি, ভুলেই গিয়েছে বাঙালি। ‘যদুবংশ’। বিমল করের উপন্যাস থেকে পার্থপ্রতিম চৌধুরীর চলচ্চিত্র। তার বিষয় সত্তরের দশকের ক্ষয়ে যাওয়া বাঙালি যৌবন। পোকাধরা, জীর্ণ সেই সময়ে দুঃখের তিমিরে মঙ্গলালোক জ্বলে ওঠার প্রশ্নই ছিল না। ছবির মুক্তি উপলক্ষে প্রকাশিত পুস্তিকায় পার্থপ্রতিম লিখেছিলেন, “হারিয়ে যাওয়া পঞ্চপ্রদীপের মঙ্গলালোক আজও আমরা খুঁজছি। এই ছবিতে তাই কোনও গল্প নেই। আছে কিছু মানুষ। জীবনের কিছু রৌদ্রছায়া। কিছু অচলায়তন।” এ ছবিতেও রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করেছিলেন পরিচালক, তা-ও আবার ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’র মতো গান। পরিচালকের শ্লেষ যে দৃশ্যকে কী ভাবে গানের মাধ্যমে আন্ডারলাইন করে, তার এর চেয়ে আর ভাল উদাহরণ বোধহয় বাংলা ছবিতে নেই। দৃশ্যে একের পর এক আসছে সাট্টা খেলা, মাঝবয়সির অসুন্দর যৌনতা, কুৎসিত হাসি, প্রৌঢ়ার ফুলের গন্ধ শোঁকার মতো মুহূর্ত আর নেপথ্যে বেজে চলেছে ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’। বোঝা গিয়েছিল, বাঙালির মুগ্ধললিত অশ্রুগলিত গীত হিসেবে রবীন্দ্রসঙ্গীতকে ভাবার অভ্যাসটিকে কী বিপুল ব্যঙ্গ করা হল। আদিত্য বিক্রম সেনগুপ্তের সাম্প্রতিক ‘মায়ানগর’ ছবিতেও এ রকম তির্যক ভাবে এসেছে ‘আলোকের এই ঝর্নাধারায়’।
মৃত্যুর কয়েক বছর আগে কিশোরীমোহন সাঁতরাকে এক চিঠিতে নিজের গান নিয়ে অবাক করা আত্মবিশ্বাসের কথা লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ, “আমার রচিত গানের সুরগুলি রক্ষা করবার যোগ্য বলেই আমি কল্পনা করি— আমার কাব্যের কোনো কালে অনাদর হতেও পারে কিন্তু বাংলাদেশের লোককে সুখে দুঃখে আমার গান গাইতেই হবে…”। শুধু সুরের জন্য রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর চুরাশি বছর পরেও তাঁর গান বাঙালি গায়, এমনটা তো নয়। তার কথাগুলো আজও অনেক বাঙালিরই মনের কথা হয়ে ওঠে বলেই তাকে আজও রবীন্দ্রনাথের গান গাইতেই হয়। রবীন্দ্রসঙ্গীতের সেই দারুণ ভাবে বেঁচে থাকার আরও প্রমাণ সিনেমায় রবীন্দ্রনাথের গানের এমন সব খোপমুক্ত ব্যবহার এবং তা নিয়ে বিতর্কও।