Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Corona virus

Friends: করোনা দূরে থাকুক, বন্ধু নয়

বাড়ির মধ্যেই দিন কাটছে শিশু থেকে কিশোর-কিশোরীদের। অনলাইন ক্লাসে পড়া চললেও ভার্চুয়াল জগতে তারা কি আদৌ পাচ্ছে বন্ধুসঙ্গ?

শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২১ ০৭:২৪
Share: Save:

বছর পাঁচেকের ঝিলিক রোজ জানালা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে আর রাস্তা দিয়ে কোনও বাচ্চা গেলেই তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, ‘‘আমার বন্ধু হবি? খেলবি আমার সঙ্গে?’’ ফ্ল্যাটের কম্পাউন্ডে দুটো বাচ্চার সঙ্গে খেলার জন্য সে আকুল। এ দিকে করোনার ভয়ে তার মা-বাবা লক্ষ্মণরেখা টেনেছেন ঘরের দরজায়।

অন্য দিকে চোদ্দো বছরের একদা বন্ধুবৎসল হিয়ার এখন বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে ভিডিয়ো কল, গ্রুপ চ্যাট করতে আর ভাল লাগে না। তার চেয়ে ওয়েব মুভি আর সিরিজ়ই তার প্রিয় বন্ধু। এর বিপরীত চিত্রও আছে। অর্থাৎ ছোট বাচ্চা গুটিয়ে যাচ্ছে তার একার জগতে। কোনও টিনএজার হয়তো বন্ধুদের দেখা পাওয়ার জন্য মরিয়া।

সন্তানের বেড়ে ওঠায় বন্ধুদের ভূমিকা অনেকখানি। সব বয়সেই কিন্তু বন্ধু দরকার। ক্লান্তি কাটাতে বন্ধুরাই আমাদের অক্সিজেন। সেখানে শৈশব, কৈশোরের মতো বন্ধুত্ব গড়ে তোলার সময় ওরা কাটাচ্ছে একা, বদ্ধ ঘরে।

বন্ধু বিনে সমস্যা কোথায়?

পেরেন্টিং কনসালট্যান্ট পায়েল ঘোষ বলছেন, ‘‘বন্ধু এমন একজন, যাকে নির্দ্বিধায় মনের কথা বলা যায়। শৈশব থেকে যৌবনে পা রাখার বয়সে মনোজগতে অনেক পরিবর্তন দেখা দেয়। অভিভাবকের সঙ্গে সব কিছু শেয়ার করতে পারে না ওরা। সেখানে বন্ধুরাই কিন্তু ওদের অবলম্বন। আবার দুঃখের দিনের আশ্বাস, অসময়ের ভরসাও।’’ সেই অবলম্বন, আশ্বাস, ভরসার মতো প্রত্যেকটা জায়গায় এখন শূন্যস্থান। হয়তো পারিবারিক অশান্তির জেরে কেউ মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। রোজ স্কুলের প্রিয় বন্ধুর সঙ্গে সেই দুঃখটুকু ভাগ করে নিয়েই সে খুশি থাকত। স্কুলের সময়টা ছিল তার অক্সিজেন। এই পরিস্থিতিতে মনের কথা ভাগ করার সেই অবকাশও হয়তো সে পাচ্ছে না, তার সঙ্গে পারিবারিক সমস্যায় জেরবার। ফোন থাকলেও অনেকের বাড়িতেই একান্তে কথা বলার উপায় নেই। হয়তো ঘরে অন্য কারও সঙ্গে থাকতে হয়। ফলে বন্ধুদের সঙ্গে ফোনে কথাবার্তা চালিয়ে যেতেও তারা স্বচ্ছন্দ বোধ করে না।

রয়েছে অন্য অসুবিধেও। জেন নেক্সটের ভাষার ব্যবহার। পায়েল ঘোষ মনে করিয়ে দিলেন, ‘‘এখন টিনএজারদের কথায় এমন অনেক শব্দের প্রয়োগ হয়, যা আমরা হয়তো ওদের বয়সে ব্যবহার করতাম না। হয়তো কথার মাঝে একটা স্ল্যাং ব্যবহার করল। চব্বিশ ঘণ্টা পরিবারের অনেকেই বাড়িতে। মা কিংবা বাবা... কারও কানে সেই শব্দপ্রয়োগ যেতেই তাঁরা রাগারাগি করলেন। সেই নিয়ে অশান্তির সূত্রপাত। ক্রমাগত এই ধরনের সমস্যা এড়িয়ে যেতেও ওরা নিজেদের মতো একার জগৎ সাজিয়ে নিচ্ছে।’’ সেখানে বন্ধুদের কাছে পাওয়া কঠিন হওয়ায় ওরা ডিজিটাল জগতে ডুবে যাচ্ছে।

এর থেকে সমস্যা দু’ধরনের। এক তো ওদের মনের খোরাক নেই। অন্য দিকে, ভিডিয়ো গেমের নেশা, ওয়েব সিরিজ়ের দৌলতে অন্ধকার জগতের সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে তারা। এমনকি পরিচয় ঘটছে অপরাধজগতের সঙ্গেও। পর্নোগ্রাফির নেশায় আসক্ত হয়ে পড়ার মতো ঘটনাও ঘটছে।

যে শিশুদের স্কুলজীবনই শুরু হয়েছে অনলাইনে বা স্কুলে যাতায়াত শুরু হতে না হতেই তা হঠাৎ বন্দি হয়ে গেল ফোনে— সেই ছোটরা আরও ধন্দে। যে ছোট্ট মেয়েটিকে অভিভাবকরা অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলার জন্য এগিয়ে দিতেন, পার্কে নিয়ে যেতেন, সে দীর্ঘ দিন ধরে বাড়ি বন্দি। যাকে এত দিন ‘শেয়ারিং ইজ় কেয়ারি‌ং’ শেখানো হয়েছে, তাকে এখন সে কাজে নিষেধ করছে মা-বাবাই। সমবয়সি কোনও বন্ধু নেই যে তার মতোই কাদায় লাফিয়ে বা জামায়, জুতোয় রং করে আনন্দ পাবে। পার্কে গিয়ে একে অপরের দোলনা ঠেলে দেওয়ার জন্য ধৈর্য ধরে দাঁড়াবে। ফলে এদের মনোজগতের গঠন শুরু হতেই তা ভেঙে যাচ্ছে...

উপায় কী?

বন্ধুসঙ্গ খুব জরুরি আর তার ব্যবস্থা মা-বাবাকেই করে দিতে হবে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আবীর মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘এখনও ফেলে আসা স্কুলের দিনগুলো আমরা মনে করি, মিস করি। সেখানে ওরা সেই জীবনটা কাটানোর মাঝে হঠাৎ যোগসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। ফলে ওদের মানসিক চাপ অনেক বেশি। তা ছাড়া চরিত্রগঠনে যথার্থ শিক্ষার প্রয়োজন। শিক্ষা অর্থে সার্বিক শিক্ষা। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব, তাকে তো সামাজিকতা শিখতেই হবে। তাই সন্তানের মধ্যে সোশ্যাল স্কিল, যেগুলো এত দিন ধরে মা-বাবা শিখিয়ে এসেছেন, সেগুলো বজায় রাখতে হবে। স্কুলে যাওয়া মানে তো শুধু পড়াশোনা নয়, তার সঙ্গে রয়েছে খেলাধুলো, টিফিন ভাগ করে খাওয়া, বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে বাড়ি ফেরা। সেগুলো তো ভার্চুয়ালি সম্ভব নয়। তাই বন্ধুসঙ্গ যাতে পায়, তার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।’’ অতিমারির ধরন খেয়াল করলে দেখা যাবে, প্রত্যেক ওয়েভের মাঝে একটা ছোট বিরতিপর্ব পাওয়া যাচ্ছে। সেই সময়ে ওদেরও বন্ধুদের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ করে দিতে হবে, তবে অবশ্যই কোভিডবিধি মেনে। দুটো ছোট বাচ্চাকে পার্কে গিয়ে আধ ঘণ্টা ছেড়ে দিন। দেখবেন, বাড়ি ফিরে সারাদিন ওই মুহূর্তের গল্প করেই কাটিয়ে দেবে।

অবসরে তারা যাতে ডিজিটাল জগতের প্রতি আসক্ত হয়ে না পড়ে বা একার জগতে গুটিয়ে না যায়, তার দায়িত্বও অভিভাবককে নিতে হবে হবে। আবীর মুখোপাধ্যায়ের পরামর্শ, ‘‘ওদের শখপূরণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। গান, নাচ, আঁকা, খেলাধুলো, অরিগ্যামি, গিটার... কত কিছু শেখার রয়েছে। সন্তানের সঙ্গে কথা বলে বুঝতে হবে, কোন বিষয়ে ওর আগ্রহ আছে। এমন কোনও অনলাইন ক্লাসে ভর্তি করিয়ে দিতে পারেন। মনের মতো জিনিস শিখতে পারলে গঠনমূলক কাজে সময় ব্যয় করবে।’’ নতুন ক্লাসে নতুন বন্ধুবান্ধবও জুটে যেতে পারে। আর পুরনো বন্ধুদের সঙ্গেও দেখাসাক্ষাৎ জারি রাখতে হবে।

শরীর সুস্থ রাখতে যেমন শরীরের উপযুক্ত যত্ন দরকার, মনের জন্যও তাই। আর মন ভাল রাখার সবচেয়ে বড় ওষুধ কিন্তু আমাদের প্রিয় বন্ধুদের হাতেই থাকে। তাই বন্ধুত্বে বাধা নয়।

অন্য বিষয়গুলি:

Friends Coronavirus Pandemic Corona virus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy