সন্তানের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কোলোস্ট্রাম থেকে বঞ্চিত করবেন না তাকে। ছবি: শাটারস্টক।
কথায় বলে, পয়সা ফেললে না কি বাঘের দুধও মেলে! কিন্তু এর জন্য একটি পয়সাও খরচ করতে হয় না। দুধের অফুরন্ত ভাণ্ডারের জন্য উট বা নীল তিমির দ্বারস্থও হতে হয় না। কারণ, আপনার সদ্যোজাতর প্রথম খাদ্যের মালিক শিশুর মা নিজেই। আর সদ্যোজাতর জন্য মায়ের দুধের কোনও বিকল্পও নেই। ১-৭ অগস্ট পৃথিবী জুড়ে পালন করা হচ্ছে ‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ’। মায়ের দুধকেই শিশুর প্রাথমিক ও প্রধান খাদ্য করে তুলতে হবু মা, সদ্য হওয়া মা এবং তাঁদের পরিবারকে আরও একবার মনে করিয়ে দেওয়াই এর উদ্দেশ্য।
জন্মের পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুকে স্তন্যপান করানো উচিত কোলোস্ট্রামের জন্য, বললেন স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ মল্লিনাথ মুখোপাধ্যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, বা ‘হু’)- র নির্দেশ অনুযায়ী, জন্মের ১ ঘণ্টার মধ্যেই শিশুকে স্তন্যপান করালে ভবিষ্যতে নানা অসুখ-বিসুখকে দূরে রাখে তা। পাশাপাশি বুদ্ধির বিকাশ হয় দ্রুত।
প্রসবের ঠিক পর পরই মায়ের স্তনবৃন্ত থেকে ঈষৎ হলদেটে ঘন দুধ নিঃসৃত হয়। এই দুধকে বলা হয় কোলোস্ট্রাম। পুষ্টি বিজ্ঞানীরা একে বলেন ‘তরল সোনা’। তবে, সোনা বললেও কম বলা হয় পুষ্টির আকর এই কোলোস্ট্রাম নামক যৎসামান্য মাতৃদুগ্ধকে, বলছিলেন মল্লিনাথবাবু। প্রসবের পর ম্যামারি গ্ল্যান্ডে জমে থাকা ঘন কোলোস্ট্রাম, স্বাভাবিক মাতৃদুগ্ধের থেকে প্রায় ১০ গুণ ঘন।
আরও পড়ুন: সন্তানের ক্ষুরধার বুদ্ধি ও সুস্থতার বীজ লুকিয়ে আছে কীসে জানেন?
শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ পল্লব চট্টোপাধ্যায়ের মতে, প্রসবের পর মোটে ২–৩ দিন এই দুধ নিঃসৃত হয়। কোলোস্ট্রাম নিঃসরণের পরিমাণ অত্যন্ত কম। সারা দিনে মাত্র কয়েক চামচ। তবে তা নিয়ে চিন্তা করার কোনও কারণ নেই, কারণ, সদ্যোজাতর পাকস্থলির আকারও একটা মার্বেল গুলির মত। যদিও প্রতি মুহূর্তে পাকস্থলী আকারে বাড়ে। তবে তার পরও ওইটুকু কোলোস্ট্রামে কুলিয়ে যায় তাদের। তাই প্রথম দু’-তিন দিন যৎসামান্য অমৃতেই সে ভরপেট হয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমোয়।
কোলোস্ট্রাম জীবাণু আটকায়
কোলোস্ট্রামে আছে IgA নামক এক বিশেষ ধরণের অ্যান্টিবডি— যা সদ্যোজাতর মুখগহ্বর, গলা থেকে শুরু করে ফুসফুস ও অন্ত্র প্রতিটি অঙ্গের রক্ষাকারী আবরণ মিউকাস মেমব্রেনকে সুরক্ষিত রাখে। মিউকাস স্তর মজবুত হলে সংক্রমণ প্রতিরোধ করা সহজ। এমনকি, যদিও বা সংক্রমণ হয় তা-ও বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌছতে পারে না। বিশেষ করে যে সব শিশু নির্ধারিত সময়ের আগে ভূমিষ্ঠ হয়েছে, অর্থাৎ প্রি টার্ম বেবি, তাদের শ্বাসনালী ও ফুসফুসে সংক্রমণের ঝুঁকি অন্যদের তুলনায় বেশি। তাই প্রসূতির যতই শারীরিক কষ্ট থাকুক না কেন, সব তুচ্ছ করে আত্মজের ভবিষ্যত সুরক্ষিত রাখতে জন্মের পর দ্রুত কোলোস্ট্রাম পান করাতেই হবে।
আরও পড়ুন: যথেচ্ছ পিল, আশঙ্কা অসুস্থ সন্তানের
সন্তান জন্মের পর দ্রুত দিন কোলোস্ট্রাম। ছবি: পিক্সঅ্যাবে।
পুষ্টির খনি কোলোস্ট্রাম
এতে শুধুই যে IgA অ্যান্টিবডি আছে তা নয়, সদ্য মায়ের প্রথম দুধে আছে এমন কিছু পুষ্টিকর উপাদান, যা শিশুকে দিলে তার জীবনভর সুরক্ষা প্রায় সুনিশ্চিত। মল্লিনাথবাবুর কথায়, মায়ের এই দুধ পান করলে শিশুকে ফিজিওলজিক্যাল জন্ডিসের সমস্যায় ভুগতে হয় না। একই সঙ্গে মায়ের শরীরের সব হরমোন নিঃসরণ দ্রুত নির্দিষ্ট ছন্দে ফিরে আসে।
একই মত পোষণ করেন চিকিৎসক পল্লব চট্টোপাধ্যায়ও। তাঁর কথায়,
কোলোস্ট্রামে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় আছএ এক বিশেষ ধরণের প্রোটিন সাইটোকাইনস। শরীরের প্রতিটি কোষের গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয় এটি। একই সঙ্গে জীবাণুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে, ব্যথা কমাতে এবং অ্যান্টি টিউমার অ্যাক্টিভিটি বা টিউমার তৈরিতে বাধা দেয় সাইটোকাইনস। এতে আছে লাইসোজাইম নামে এক বিশেষ ধরণের অ্যান্টি মাইক্রোবিয়াল এনজাইম। এটি ব্যাকটিরিয়ার সংক্রমণ প্রতিরোধ করে। মায়ের প্রথম দুধে আছে ল্যাক্টালবুমিন। এটি মস্তিষ্কের সেরোটোনিন নামে নিউরোট্রান্সমিটারের কার্যকারিতা বাড়িয়ে দিয়ে বুদ্ধির বিকাশ ও মন ভাল রাখতে সাহায্য করে। এই রাসায়নিকটির প্রভাবে একাগ্রতা বাড়ে। গবেষণায় প্রমাণিত, ল্যাক্টালবুমিনের টিউমার ও ক্যানসার আটকানোর ক্ষমতা আছে। সদ্য মায়ের প্রথম দুধ কোলোস্ট্রাম গ্রোথ ফ্যাক্টরে পরিপূর্ন। বাচ্চার ত্বক, পেশি, কার্টিলেজ, নার্ভ টিস্যু ও হাড় গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নেয় এই গ্রোথ ফ্যাক্টর। জন্মের পর প্রথম দু’-তিন দিন এই দুধ পান করলে প্রায় জীবনভর সুরক্ষিত থাকবে আপনার পরবর্তী প্রজন্ম। প্রোটিন রিচ পলিপেপটাইড বা ‘পিআরপিএস’ সমৃদ্ধ কোলোস্ট্রাম নিয়ে গবেষণা করে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হয়েছেন যে, ই-কোলাই, রোটা ভাইরাস, সিগেলার মতো মারাত্মক জীবাণুদের হাত থেকে এটি আজীবন সুরক্ষা দিতে পারে। এই প্রসঙ্গে একটা কথা জেনে রাখা ভাল যে, আমাদের দেশ-সহ প্রায় সব ক’টি উন্নয়নশীল দেশে রোটা ভাইরাসের সংক্রমণে অজস্র সদ্যোজাত শিশুর মৃত্যু হয়। কোলোস্ট্রাম খাওয়ানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে অনায়াসে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধ করা যায়। আর এই কারনেই বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ এবং ওয়ার্ল্ড অ্যালায়েন্স ফর ব্রেস্ট ফিডিং অ্যাকশন জন্মের এক ঘণ্টার মধ্যেই মায়ের দুধ খাওয়ানোর উপর জোর দিচ্ছেন। এগুলো ছাড়াও কোলোস্ট্রামে আছে গ্লাইকোপ্রোটিন, ইমিউনোগ্লোবিউলিন, ল্যাক্টোফেরিন-সহ অজস্র উপাদান। যা একজন মানবশিশুর সুস্থ শরীর ও মন গড়ে তুলতে উল্লেখযোগ্য ভুমিকা নেয়। তাকে দিতে পারে সুস্থ নীরোগ দীর্ঘজীবন। আজকের এই সাইবার যুগেও মায়ের প্রথম দুধকে ‘উইচ মিল্ক’ বলে ফেলে দেওয়ার কু-সংস্কার আছে। এই ভুল ধারণা ভেঙ্গে মায়ের কোলে তুলে দিন সদ্যোজাত সন্তানকে। পান করুক অমৃত, আজীবন সুস্থ থাকুক আপনার সন্তান।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy