তাঁদের দু’জনের সম্পর্কের ভাঙন নিয়ে আলোচনা ছড়িয়েছে বলিউড থেকে টলিউডে। তার কারণ হিন্দি টিভি ধারাবাহিকের এক কালের জনপ্রিয় জুটি ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত এবং বরখা বিস্তের মধ্যে চলে এসেছিলেন টলিউডের এক অভিনেত্রী! সেই আলোচনা মাঝে থিতিয়ে গেলেও এখন আবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে। কারণ, বরখা এই প্রথম তাঁদের সম্পর্ক ভাঙার কারণ নিয়ে সরাসরি মুখ খুলেছেন। ইন্দ্রনীলের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন প্রতারণার। তবে একই সঙ্গে বরখা জানিয়েছেন, ওই ঘটনার পরেও বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি তিনি। ইন্দ্রনীল বিয়ে ভাঙার সিদ্ধান্ত না নিলে হয়তো তিনি এখনও দাম্পত্য সম্পর্কে থেকেই যেতেন!
একা বরখা নন, প্রতারণার মতো মানসিক আঘাত সহ্য করেও অনেক সময়ে সম্পর্কে থেকে যান বহু মহিলা এবং পুরুষ। দাম্পত্য সম্পর্কে তো বটেই, যেখানে বিয়ের বন্ধন নেই, তেমন প্রেমের সম্পর্কেও সঙ্গীর প্রতারণা সত্ত্বেও তাঁকে ছেড়ে চলে যেতে পারেন না অনেকে। বরখা যেমন বলেছেন, ‘‘ও বিয়ের সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কারণ কী ছিল, তা ও-ই ভাল জানে। তবে বিষয়টা যদি আমার হাতে থাকত, তা হলে আমি বিয়ের সম্পর্কে আজও থেকেই যেতাম।’’ বিশ্বাসভঙ্গের পরেও কেন থেকে যেতেন তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে অভিনেত্রী বলেছেন, ‘‘আমি সেই মহিলাদের মতো, যাঁরা ভাবেন, ‘আমার সঙ্গে কেউ প্রতারণা করলে আমি ছেড়ে চলে যাব’। কিন্তু বাস্তবে যখন বিষয়টা সত্যিই ঘটে, তখন বুঝতে পারেন, কথাটা বলা যত সহজ ছিল, কাজে করা ততটা সহজ নয়। আমার আজ বলতে লজ্জা নেই যে, আমি হয়তো ইন্দ্রনীলকে ক্ষমাও করে দিতাম। এমনকি, আমি এর পরে আমার বিয়ে বাঁচানোর চেষ্টাও করেছি দু’বছর।’’

ইন্দ্রনীল এবং বরখা। ছবি: সংগৃহীত।
কিন্তু কেন এমন হয়? একটা সম্পর্কে প্রতারণার মতো ঘটনা ঘটার পরেও কেন সেই সম্পর্ক ছেড়ে যেতে অসুবিধা হয়? মনোবিদ অঞ্জলি গুরসাহনে এ প্রসঙ্গে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘‘প্রতারণার মুখোমুখি হয়ে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেবেন বলে ভাবেন অনেকেই। কারণ, সেই সময়ে মনে হয় যে বিশ্বাসের ভরসায় সম্পর্কে প্রবেশ করেছিলেন, তা ভাঙলে আর সম্পর্কে কিছুই থাকে না। কিন্তু একটা সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগের মুহূর্তে আরও নানা ধরনের বিষয় এবং পরিস্থিতি চোখের সামনে চলে আসে, যার ফলে সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসা ঠিক ততটাও সহজ হয় না।’’
সম্পর্ক ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে কী কী বিষয় বাদ সাধে?
১। দু’জনের একসঙ্গে কাটানো সুখস্মৃতি
দীর্ঘ দিন একটা সম্পর্কে থাকলে তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে অনেক সুখস্মৃতিও। ভালবাসা, একসঙ্গে কাটানো ভাল সময়, নানা ধরনের অভিজ্ঞতা, নানা মুহূর্ত দু’জনের মধ্যে একটা জোরালো আবেগের বন্ধন তৈরি করে। যা রাতারাতি ছিঁড়ে ফেলা সম্ভব নয়।
২। মানসিক নির্ভরতা
দু’টি মানুষ পরস্পরের প্রতি ভাল লাগা থেকেই একসঙ্গে ছিলেন দীর্ঘ দিন। হঠাৎ এক তরফ থেকে সম্পর্ক বদলে গেলেও বা অন্য কোথাও মানসিক নির্ভরতা খুঁজে পেলেও আরেক তরফের মানসিক নির্ভরতার সমীকরণ হঠাৎ বদলে যায় না। তিনি তখনও তাঁর আবেগ, সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেওয়ার জন্য আগের মানুষটির উপরে নির্ভর করেন। সেই নির্ভরতার বোধও হঠাৎ বদলে যায় না।
৩। হিসাব মেলাতে না পারা
প্রতারণা বিষয়টি এতটাই গুরুতর যে, তার ধাক্কা সামলাতে সময় লাগে। অনেকে বিশ্বাসই করতে পারেন না, তিনি প্রতারিত হয়েছেন। মনোবিদ বলছেন, অনেক ক্ষেত্রেই সম্পর্কের সুসময় এবং প্রতারণার ঘটনাকে পাশাপাশি রেখে মনে মনে তুলনা চলত থাকে। তাতে মানসিক আঘাত বাড়ে বই কমে না। এই হিসাব মেলাতে না পারাও প্রভাব ফেলে সিদ্ধান্তে। মানসিক দৃঢ়তার অভাব দেখা যায় তাতে।

— ফাইল চিত্র।
৪। একাকিত্বের ভয়
একা থাকার ভয় মারাত্মক হতে পারে বলে মনে করেন মনোবিদ অঞ্জলি। তিনি বলছেন, ‘‘বিয়ের মতো একটা সম্পর্ক যদি নিরাপত্তাবোধ জুগিয়ে থাকে, তা হলে সেই নিরাপত্তার গণ্ডি থেকে বেরিয়ে একা জীবন কাটানোর ভাবনাটাই মনে ভয় ধরানোর জন্য যথেষ্ট।’’ ফলে, একা থাকতে হবে ভেবেও অনেকে সম্পর্কের নানা নেতিবাচক দিককে মেনে নিয়ে বিয়ে বা প্রেম টিকিয়ে রাখেন।
৫। পরিবর্তনের আশা
অনেকে সম্পর্কে থেকে যান, উল্টো দিকের মানুষটির মানসিক পরিবর্তনের আশায়। হয়তো তাঁরা ভাবেন, কোনও দিন হয়তো মানুষটি তাঁকে বুঝবেন। আর প্রতারণা করবেন না। হয়তো তাঁরা এমনও ভাববেন, সম্পর্ক আবার আগের মতো হয়ে যাবে। এই আশায় অনেকেই সঙ্গীকে ক্ষমা করে দেন। যেমন বরখা করবেন বলে ভেবেছিলেন।
৬। সামাজিক পরিস্থিতি
সমাজ বিচ্ছেদকে এখনও সহজ ভাবে দেখে না। বিশেষ করে, বিয়ে ভেঙে যাওয়ার ঘটনা বহু মহিলার জীবনেই প্রভাব ফেলে। সেই ভয় থেকেও অনেকে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে চান বলে জানাচ্ছেন মনোবিদ।

— ফাইল চিত্র।
৭। সন্তান এবং অর্থনৈতিক নির্ভরতা
বিয়ের সম্পর্কে যদি সন্তান থাকে, তা হলেও সন্তানের কথা ভেবে অনেক সময় বিয়ে টিকিয়ে রাখার কথা ভাবেন স্বামী বা স্ত্রী। বিশেষ করে অর্থনৈতিক নির্ভরতা থাকলে ছেড়ে যাওয়া আরও বেশি কঠিন হয়ে পড়ে।
ক্ষমা পরম ধর্ম— তত্ত্বটি কি প্রতারণার ক্ষেত্রেও কাজ করে?
মনীষীরা বলে গিয়েছেন, ক্ষমা পরম ধর্ম। ‘অপরাধী’কে ক্ষমা করে মানসিক শান্তি পাওয়ার কথাও বলেন কেউ কেউ। কিন্তু যেখানে সবচেয়ে কাছের মানুষটির কাছ থেকেই আসে প্রতারণার মতো আঘাত, সেখানে ক্ষমা করে শান্তি পাওয়ার কথা বলা যত সহজ, কাজে করা তত সহজ নয় বলে মানছেন মনোবিদও। অঞ্জলি বলছেন, ‘‘ক্ষমা বিষয়টি খুব জটিল একটি তত্ত্ব। আর তা অত্যন্ত ব্যক্তিগত বিষয়ও। ক্ষমা করা স্বাস্থ্যকর সিদ্ধান্ত হতেই পারে যদি তা প্রতারিতের মানসিক স্বাস্থ্যকে ভাল রাখে। যদি নিজের জন্য কাউকে ক্ষমা করতে হয়, তবে ক্ষমা করার সিদ্ধান্ত সত্যিই শক্তিশালী অস্ত্র হতে পারে নিজেকে ভাল করে তোলার জন্য। এই ক্ষমার অর্থ কিন্তু কখনওই উল্টো দিকের মানুষটিকে মেনে নেওয়া নয়। এটা শুধু তাঁর প্রতি কোনও ক্ষোভ পুষে রেখে নিজের ক্ষতি না করা।’’