বাঁচতে চেয়েছিল ৩৮ বছরের আন্দ্রেজ মোরেনো। মেক্সিকো নিবাসী বিশ্বের স্থুলতম মানুষ মোরেনোর ইছে পূরণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন একদল চিকিৎসক। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। বেরিয়াট্রিক সার্জারির দু মাসের মধ্যেই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে ৩৮ বছরের জীবন ঘড়ি থেমে গেল। আসলে ভয়ানক মোটা বা মরবিড ওবিসদের ওজন স্বাভাবিক করতে বেরিয়াট্রিক সার্জারি করা হয়। এ ক্ষেত্রে ল্যাপারোস্কোপিক পদ্ধতিতে পাকস্থলীর প্রায় তিন চতুর্থাংশ বাদ দেওয়া হয়। সার্জারির পর বেশি খাবার কোনও ঊপায় থাকে না। খাওয়া কমার সঙ্গে সঙ্গে ওজনও কমতে শুরু করে। এটাই হল মোদ্দা কথা। বেরিয়াট্রিক সার্জারির আগে রোগীর শারীরিক অবস্থা বিচার করে প্রয়োজন মতো চিকিৎসা করে স্বাভাবিক অবস্থায় এনে তবেই বেরিয়াট্রিক সার্জারি করানো উচিৎ। যাদের বডি মাস ইনডেক্স বা বিএমআই অত্যন্ত বেশি এবং নাক ডাকার অসুখ বা স্লিপ অ্যাপনিয়া, হাই ব্লাড প্রেশার ইত্যাদি রোগের প্রবণতা আছে তাদেরই এই সার্জারির সাহায্যে ওজন নিয়ন্ত্রণ করা দরকার ।
বাড়তি ওজনের বিপদ এক নজরে –
মোটা চেহারা হাস্যকর দেখতে লাগা ছাড়াও নানান অসুখ বিসুখ ডেকে আনে। শুধু মাত্র মোটা হওয়ার কারণে বিশ্বের ২৮ লক্ষ মানুষ অকালে প্রাণ হারান। হার্ট অ্যাটাক, অ্যাক্সিডেন্ট, ক্যানসার ইত্যাদির পরেই পাঁচ নম্বরে আছে বাড়তি ওজনের কারণ জনিত মৃত্যু। আসলে অনেক লাইফস্টাইল ডিজিজের অন্যতম কারণ হল মেদবাহুল্য। ৪৪ শতাংশ ডায়াবিটিস, ২৩ শতাংশ ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ, ৭ থেকে ১৪ শতাংশ ক্যানসারের কারণ হল অতিরিক্ত ওজন। হাইপার টেনশন, আচমকা হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোক, সাডেন কার্ডিয়াক ডেথ, অস্থিসন্ধির ক্ষয়, ও তার জন্য অষ্টিও আরথ্রাইটিস সহ বাত ইত্যাদি অন্যান্য নানাবিধ সমস্যায় জেরবার হতে হয়।
বেশি ওজন ও বিএমআই –
মোটা চেহারার বিবরণ দিতে বিএমআই শব্দটার কথা প্রায় শোনা যায়। বিএমআই অর্থাৎ বডি মাস ইনডেক্স। এই বিএমআই মাপা হয় কিলোগ্রামে ওজনকে উচ্চতার (মিটারে) স্কোয়ার দিয়ে ভাগ করে। এর মান ২৫ পর্যন্ত হওয়া মানে স্বাভাবিক। ২৫ থেকে ২৯ বেশি ওজন, ৩০ বা তার বেশি মানে ওবিস এবং বিএমআই ৩৫ এর থেকে বেশি মানে মরবিড ওবিস।
বেরিয়াট্রিক সার্জারির আগে পরে –
মরবিড ওবিস হলে বেরিয়াট্রিক সার্জারির সাহায্যে ওজন কমাতে হয়। তবে তার আগে রোগীকে এই অপারেশনের ভাল-মন্দ দিক সম্পর্কে রোগী ও তার পরিজনদের যাবতীয় তথ্য জানিয়ে দেওয়া উচিৎ। একই সঙ্গে রোগীর বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সঠিক চিকিৎসা করে অপারেশনের জন্য তৈরি করে নেওয়া জরুরি। আন্দ্রেজ মোরেনোর যে ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশন হয়েছিল তা মোটেও খুব অস্বাভাবিক নয়। আমাদের পাকস্থলীতে প্রচুর উপকারি জীবাণু থাকে। যারা বাইরের সংক্রমণ আটকাতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। বেরিয়াট্রিক সার্জারির সাহায্যে পাকস্থলীর তিন চতুর্থাংশ বাদ দেওয়া হয় বলে উপকারি জীবাণুর সংখ্যা কমে যায়। তাই সংক্রমণের সম্ভাবনাও যায় বেড়ে। অন্য দিকে, বেশি্রভাগ ক্ষেত্রে মোটাদের ফ্যাটি লিভার থাকে। সার্জারির আগে এই ব্যাপারটা ম্যানেজ না করলে রোগীর ভয়ানক সমস্যা হতে পারে। এই প্রসঙ্গে আমার একজন রোগীর কথা উল্লেখ করছি। মধ্য ৩০ এর এক ভদ্রলোক আমার কাছে এসেছিলেন বেরিয়াট্রিক সার্জারির জন্য। এই তরুণটির ওজন প্রায় ১২০ কেজি এবং বিএমআই ছিল ৪২। বিভিন্ন টেস্ট করে দেখা গেল ওনার ফ্যাটি লিভার-এর সমস্যা আছে। সার্জারির জন্য ওনাকে রেডি করতে প্রায় মাস দু’এক সময় লাগবে। সেই মত ওষুধ ও ডায়েট চার্ট করে দেওয়া হল। কিন্তু ওনার খুব তাড়া ছিল। অন্য একটি হাসপাতালে ঐ তরুণকে বোধহয় কোনও প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। বেরিয়াট্রিক সার্জারির মাস খানেক এর মধ্যেই ভীষণ অসুস্থ হয়ে মারা যান।
আসলে আমাদের দেশে কোনও সরকারি নিয়ন্ত্রণ না থাকায় অনেকেই নিয়ম কানুনের তয়াক্কা না করে ইচ্ছে হলেই বেরিয়াট্রিক সার্জারি করান। আখেরে ফল হয় অত্যন্ত খারাপ। বিজ্ঞাপনের চমকে মোহিত হয়ে অল্প বয়সের মেয়েরা ৭০ কেজি ওজনকে ৪৫ কেজিতে নামিয়ে আনতে এই সার্জারির সাহায্য নিতে গিয়ে বিপদে পড়েন । এবং অবশ্যই চিকিৎসকরাও তাদের সঠিক পথে চালিত করেন না।
সঠিক পুষ্টি না হলেই বিপদ –
বেশিরভাগ মানুষের ধারনা বেরিয়াট্রিক সার্জারি করালেই রাতারাতি রোগা হয়ে যায়। কিন্তু তা নয়। এই অপারেশনের পরে অনেক নিয়ম মেনে চলার সঙ্গে সঙ্গে পুষ্টিকর খাবার খেতে হয়। অনেকে খাওয়ার ব্যাপারে গুরুত্ব দেন না। এ ক্ষেত্রে অপুষ্টি জনিত মারাত্মক রোগের শিকার হতে হয়। সিভিয়ার ম্যালনিউট্রিশন এদের মৃত্যু মুখে ঠেলে দিতে পারে। সার্জারির পর নিয়মিত ফলো আপ এবং সঠিক ডায়েট প্রোটোকল মেনে না চললে সমুহ বিপদ। নইলে ওজন কমাতে গিয়ে স্রেফ ‘নেই’ হয়ে যেতে হবে।
অনুলিখন – সুমা বন্দ্যোপাধ্যায়
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy