এই বছর স্নাতক স্তরের ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা দেওয়ার কথা ইতিহাসের ছাত্র সঞ্জয় বেরা-র। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)-এর পরীক্ষা সংক্রান্ত নির্দেশিকা তাকে চিন্তায় ফেলেছে। কোভিডের কারণে বাড়ি থেকেই অনলাইন পরীক্ষা দেবে ছেলেমেয়েরা। সময় দু’ঘণ্টা (কিছু বিষয়ের ক্ষেত্রে তিন ঘণ্টা)। প্রশ্নপত্র ডাউনলোড করা এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কাছে উত্তরপত্র অনলাইন মারফত পাঠানোর জন্য সর্বাধিক আধ ঘণ্টা সময় দেওয়া হবে।
সঞ্জয়ের পরিবার আর্থিক ভাবে সচ্ছল নয়। তার কাছে স্মার্টফোন আছে বটে, কিন্তু সব ফিচার সম্পর্কে সে এখনও তেমন সড়গড় নয়। উত্তরপত্র স্ক্যান করে ই-মেলে পাঠানোর চেয়ে নিজে গিয়ে সেটা কলেজে জমা দিয়ে আসতে পারলেই ভাল হত তার পক্ষে। কিন্তু কলেজ থেকে সঞ্জয়ের বাড়ি অনেকটা দূর। আধ ঘণ্টায় সেখানে পৌঁছানো অসম্ভব। পরীক্ষার চিন্তার থেকেও এই সব বিষয় তাকে ভাবাচ্ছে বেশি।
এ দিকে যারা এ বছর কলেজে ঢুকবে, তাদের চিন্তাও কম নয়। অন্য বার যেখানে শিক্ষাবর্ষ শুরু হয় অগস্ট থেকে, সেখানে ইউজিসি-র নির্দেশিকা অনুযায়ী ২০২০-’২১ শিক্ষাবর্ষ শুরু হওয়ার কথা ১ নভেম্বর থেকে। যদিও রাজ্য সরকার বিভিন্ন সরকারি কলেজ এবং সরকার অনুদানপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিসেম্বর থেকে শিক্ষাবর্ষ শুরু করার পক্ষপাতী। ফলে হাতে সময় থাকছে কম। সেই অনুযায়ী সিলেবাস বাড়বে না কমবে, জানা নেই। বেশ কিছু ছুটি ছেঁটে ফেলা হবে বলে খবর। পড়াশোনা এখন অনেক দিনই চলবে অনলাইন কিংবা অফলাইনের সঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে। সব মিলিয়ে একটা গোলমেলে পরিস্থিতিতে পড়েছে তারা।
ছাত্রছাত্রীদের এই মুহূর্তে উদ্বেগের শেষ নেই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সুরঞ্জন দাসের মতে, অতিমারির কারণে অনলাইন পরীক্ষা বা পড়ানোর যে নতুন পদ্ধতির দিকে আমরা এগোচ্ছি, তার সঙ্গে ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষক কেউই সে ভাবে পরিচিত নন। ক্লাসে পড়ানোর সময় শিক্ষক এবং ছাত্রছাত্রীর মধ্যে পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের সুযোগ থাকে। এখন যে ভাবে অনলাইন শিক্ষা শুরু হতে চলেছে, তাতে শিক্ষা হবে একমুখী— শিক্ষকরা বলবেন আর ছাত্রছাত্রীরা শুনবে। অথচ জ্ঞানের আদানপ্রদান তখনই সফল হয়, যখন পারস্পরিক ভাব বিনিময়ের সুযোগ থাকে। দেশে ‘ডিজিটাল ডিভাইড’ একটা ধ্রুব সত্য হলেও তিনি মানছেন, এই মুহূর্তে হয়তো এ ছাড়া অন্য বিকল্পও নেই। পড়াশোনার ক্ষেত্রে যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, তার জন্য শিক্ষকদের যেমন বাড়তি উদ্যোগ নিতে হবে, তেমনই ছাত্রছাত্রীদেরও নিজেদের তৈরি করতে হবে এই নতুন পদ্ধতির সঙ্গে তাড়াতাড়ি মানিয়ে নিতে। তিনি এ-ও বললেন যে, ডিজিটাল আর্কাইভ ঘাঁটা, ই-বুক পড়ার মতো বিষয়গুলির ক্ষেত্রে এক ধরনের প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকা দরকার।
• অতিমারির এই সময়ে প্রথম বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা যেমন নিজেদের মতো সিলেবাসের কিছুটা অংশ তৈরি করে রাখতে পারে, তেমনই দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের ছাত্রছাত্রীরা সময়টা ব্যবহার করতে পারে পুরনো দুর্বল অংশগুলি বুঝে নিতে।
• পড়াশোনার ক্ষেত্রে সাহায্য নেওয়া যেতে পারে সরকারি শিক্ষা পোর্টাল ‘স্বয়ং’-এর।
• অনলাইন পড়াশোনায় সড়গড় হতে ডিজিটাল আর্কাইভ ঘাঁটা, ই-বুক পড়ার মতো বিষয় আয়ত্ত করতে হবে, আর সে ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকা দরকার।
• ছাত্রছাত্রীদের উচিত, যে পদ্ধতিতে ফাইনাল পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সুবিধেমতো সেটা বাড়িতে প্র্যাকটিস করে নেওয়া।
কিছুটা সুরঞ্জনবাবুরই মতো অভিমত কলকাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের অধ্যাপক সাংখ্যায়ন চৌধুরীর। তিনি জানালেন, অনলাইন শিক্ষা কখনও ক্লাসরুম শিক্ষার বিকল্প হতে পারে না। তা ছাড়া ফিজ়িক্স, কেমিস্ট্রি, জ়ুয়োলজি বা ইঞ্জিনিয়ারিং-এর বিভিন্ন শাখা, যেখানে প্র্যাকটিক্যাল বা হাতেকলমে কাজ করে বিষয়টা জানার ব্যাপার থাকে, অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে তা মার খাচ্ছে। শিক্ষকরাও জানেন না, কী ভাবে ওই ঘাটতি পূরণ করা যাবে। যদিও সাংখ্যায়নবাবুর আশা, এই সমস্যার কোনও না কোনও সমাধান হয়তো আগামী দিনে বেরোবে, কিংবা পরিস্থিতি আবার অনেকটা স্বাভাবিক হবে, যখন ছাত্রছাত্রীরা কলেজে ফিরে ল্যাবরেটরিতে কাজ করতে পারবে। বিশেষত, ছাত্রছাত্রীদের চেষ্টা করতে হবে, এই সময়ে সেল্ফ স্টাডির মাধ্যমে জ্ঞান বাড়ানোর। যেমন, ‘স্বয়ং’ নামে কেন্দ্রীয় সরকারের একটি পোর্টাল রয়েছে, যেখানে তারা বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করতে পারে।
কোনও কারণে যদি নির্ধারিত সময়ে কলেজ শুরু না-ও হয়, তা হলেও ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের মতো করে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া উচিত বলে পরামর্শ সুরেন্দ্রনাথ কলেজ ফর উইমেন-এর অধ্যক্ষ পূর্ণিমা বিশ্বাসের। এখন অনেক ক্ষেত্রেই ক্লাস অনলাইন হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে ইন্টারনেট সংযোগ থাকাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যে সব ছেলেমেয়েদের এই ক্ষেত্রে অসুবিধে হচ্ছে, তাদের জন্য স্থানীয় ভাবে— বেসরকারি বা সরকারি— কোনও ব্যবস্থা করা যায় কি না, তা দেখা দরকার বলেই তাঁর মত।
সময় প্রতিকূল হলেও তার ইতিবাচক দিকটাই দেখতে চাইছেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির অধ্যাপক সুমিত চক্রবর্তী। তিনি জানালেন, বর্তমান সিবিসিএস পদ্ধতিতে পড়াশোনা শুরু হতে না হতেই এত তাড়াতাড়ি পরীক্ষা চলে আসে যে, নতুন ছাত্রছাত্রীদের অনেকেই বুঝে উঠতে পারে না, কী ভাবে এই পদ্ধতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে। শিক্ষাবর্ষ কয়েক মাস পিছিয়ে যাওয়াটাকে শাপে বর হিসেবে দেখতে পারে ছেলেমেয়েরা। হাতে যতখানি সময় রয়েছে, তাতে যে যে-ভাবে পারছে নিজেদের সুযোগ-সুবিধে মতো সিলেবাসের কিছুটা অংশ পড়ে ফেলতে পারে। এর ফলে কলেজ শুরুর পরে যে আকস্মিক চাপটা অন্য বার ছেলেমেয়েদের ভোগ করতে হয়, সেটা কিন্তু এই ছাত্রছাত্রীদের মুখোমুখি হতে হবে না। একই ভাবে দ্বিতীয় বা তৃতীয় বর্ষের ছেলেমেয়েদেরও পড়াশোনার ভিত শক্ত করার সবচেয়ে ভাল সময় এটাই। আগের সিমেস্টারের দুর্বল অংশগুলিকে ঝালিয়ে বা বুঝে নেওয়ার আদর্শ সময় এটাই বলে দাবি সুমিতবাবুর। তাঁর আশা, এ বার যে ভাবে ফাইনাল বর্ষের পরীক্ষা পরিচালনা করা হচ্ছে, তার পুনরাবৃত্তি হয়তো আগামী দিনে হবে না। যদি দেখা যায়, এই পদ্ধতিতে পরীক্ষা নিয়ে অধিকাংশ শিক্ষার্থী, বিশেষত প্রান্তিক ছাত্রছাত্রীদের খুবই অসুবিধেয় পড়তে হচ্ছে, তা হলে পরীক্ষা নিয়ামক সংস্থা পদ্ধতি পরিবর্তনে বাধ্য হবে বলেই দাবি তাঁর।
পরীক্ষা যখন দিতেই হবে, তখন এর প্রযুক্তিগত দিকের ভালমন্দ নিয়ে বেশি মাথা ঘামানোর পক্ষপাতী নন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক যাদব কৃষ্ণ দাস। তাঁর মতে, কোভিড-কালে যে হেতু সরকারকে পরীক্ষা পরিচালনায় বিকল্প ব্যবস্থা নিতে হচ্ছে, তাই প্রক্রিয়ায় কোনও সমস্যা হলে তা হয়তো সহানুভূতির সঙ্গেই বিবেচনা করবেন তারা। ছাত্রছাত্রীদের উচিত, যে পদ্ধতিতে পরীক্ষা নেওয়া কথা বলা হয়েছে, সুবিধেমতো সেটা বাড়িতে দু’-এক বার প্র্যাকটিস করে নেওয়া। প্রক্রিয়াটার সঙ্গে এক বার সড়গড় হয়ে গেলে হয়তো পরীক্ষার দিন সে ভাবে এটা নিয়ে ভাবতে হবে না। একই সঙ্গে কলেজ শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে তাঁর পরামর্শ, পড়াশোনার ডিজিটাল দিকটির সঙ্গে বেশ কিছু ক্ষেত্রে ছেলেমেয়েদের পরিচয় হয়েই গিয়েছে, হয়তো এই প্রক্রিয়ায় এখন বেশ কিছু দিন পড়াশোনা করতে হবে তাদের; বিষয়টা যখন এড়ানো যাচ্ছে না, তখন তা কী ভাবে কাজে লাগানো যায়, সেই বিষয়ে ভাবতে হবে।
সকলেই আশা করছেন, এই অনিশ্চয়তা হয়তো কিছু দিনের মধ্যেই কাটবে। তখন আমরা আবার পুরনো জীবনে ফিরতে পারব। কিন্তু তা কাটলেও করোনা-পরবর্তী পড়াশোনা আর আগের মতো হবে না। অনেকখানি অনলাইন ব্যবস্থা ঢুকে যাবে তাতে, অন্তত তেমনই ভাবছেন সবাই। সুতরাং, এই সময়টাকে যতটা সম্ভব কাজে লাগানোর চেষ্টা করাই ভাল। কী আর করা যাবে, অনলাইন শিক্ষা যদি ভবিষ্যতের জন্য এতই গুরুত্বপূর্ণ হয়, কলেজ ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে আপাতত বুদ্ধিমানের কাজ হবে, যে যে-স্তরে রয়েছে, সেখান থেকেই আরও বেশি করে এই পদ্ধতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেওয়া। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy