(বাঁ দিকে) মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অনুব্রত মণ্ডল (ডান দিকে)। —ফাইল ছবি।
তিহাড় জেল থেকে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পর দু’বার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু কোনও না-কোনও কারণে দেখা হয়ে ওঠেনি দু’জনের! অবশেষে সাক্ষাৎ হল তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং দলের বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত (কেষ্ট) মণ্ডলের।
সোমবার তৃণমূলের জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠক ছিল মমতার কালীঘাটের বাড়িতে। সেই বৈঠকে যোগ দিয়েছিলেন অনুব্রত। দলীয় সূত্রে খবর, অনুব্রতকে বৈঠকে দেখে তাঁর স্বাস্থ্যের খোঁজ নেন দলনেত্রী মমতা। অনুব্রতকে তিনি প্রশ্ন করেন, ‘‘কেমন আছিস কেষ্ট? শরীর ঠিকঠাক তো?’’ অনুব্রতও উত্তর দিয়েছিলেন, ‘‘হ্যাঁ, দিদি।’’ এর পরেই মমতার পরামর্শ, ‘‘শরীর ঠিক রাখিস।’’ পরে বৈঠকে আলোচনা চলাকালীনও অনুব্রতের কাছে মমতা জানতে চেয়েছিলেন, ‘‘তোর কিছু বলার আছে?’’ জবাবে অনুব্রত বলেছেন, ‘‘আমার কিছু বলার নেই।’’
গত সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে গরু পাচার মামলায় সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পেয়েছিলেন অনুব্রত। জামিন পাওয়ার পর যখন কেষ্টর বীরভূমে ফেরার তোড়জোড় শুরু হয়েছিল, ঠিক সেই সময়েই ওই জেলায় প্রশাসনিক সফরে গিয়েছিলেন মমতা। জল্পনা তৈরি হয়েছিল, দু’বছরের বন্দিদশা থেকে মুক্তির পরেই দলনেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হতে পারে কেষ্টর। কিন্তু তা আর হয়ে ওঠেনি। মমতার প্রশাসনিক বৈঠকের সময়কালের মধ্যে বীরভূমে ফিরতে পারেননি অনুব্রত। আইনি কাগজপত্র জমা না-পড়ায় তিনি মুক্তি পাননি। জেলায় ফেরার পর পুজোর সময় এক বার কলকাতায় চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন কেষ্ট। তখনও মমতার সঙ্গে মুখোমুখি সাক্ষাতের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সেই জল্পনায় কেষ্ট নিজেই জল ঢেলেছিলেন। জানিয়েছিলেন, পুজোর পর দলনেত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে। শেষমেশ তা-ই হল।
তৃণমূলের অন্দরের খবর, অনুব্রত বরাবরই মমতার ‘কাছের’। তাঁকে ‘কেষ্ট’ নামেই সম্বোধন করে থাকেন দলনেত্রী। ২০২২ সালের অগস্টে গরু পাচার মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পরে অনুব্রতের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘কেষ্ট যখন বেরোবে, তখন ওকে বীরের সম্মান দেব।’’ নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় প্রায় একই সময়ে গ্রেফতার হওয়া রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের ক্ষেত্রে যদিও তেমনটা বলতে শোনা যায়নি মমতাকে। পার্থকে দল থেকে সাসপেন্ড করা হলেও অনুব্রতকে কোনও রকম শাস্তি দেয়নি তৃণমূল। অনুব্রতের পরিবর্তে বীরভূমে দলের জেলা সভাপতিও করা হয়নি কাউকে। সংগঠন পরিচালনার জন্য মমতা জেলায় একটি কোর কমিটি গড়ে দিয়েছিলেন। সেই কমিটিই যাবতীয় দায়িত্ব সামলেছে লোকসভা ভোট পর্যন্ত। এর পর অনুব্রত জেলায় ফিরতেই দলের অন্দরে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল, বীরভূমের রাজনীতিতে কি আগের মতোই ‘প্রাসঙ্গিক’ থাকবেন অনুব্রত? সেই জল্পনা আরও জোরালো হয় সম্প্রতি জেলায় দলের কোর কমিটির বৈঠকের পর। বৈঠকে অনুব্রতকে ওই কমিটির সদস্য করা হয়েছিল। কিন্তু বৈঠকের পর থেকেই দলের একাংশ বলতে শুরু করেছিলেন, জেলায় অনুব্রতের ‘একাধিপত্যে রাশ’ টানা হয়েছে! কারণ, বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, কোর কমিটির কোনও নেতা জেলার কোনও এলাকায় যেতে চাইলে সেই এলাকার সংশ্লিষ্ট নেতাকে জানিয়ে যেতে হবে। এই সিদ্ধান্তে অনুব্রতের ‘ক্ষমতা’ খর্ব করা হয়েছিল বলেই মনে করেছিলেন দলের কেউ কেউ।
তৃণমূলের একটি সূত্রে খবর, সোমবার মমতার বাড়িতে বৈঠকের পর সেই ‘ক্ষমতা’ আবার ফিরে পেয়েছেন অনুব্রত। দলনেত্রীই তাঁকে জেলার কোর কমিটি পরিচালনার যাবতীয় দায়িত্ব দিয়েছেন। যদিও শাসকদলের তরফে এই দাবির সপক্ষে আনুষ্ঠানিক কোনও সমর্থন মেলেনি।
অনুব্রত গ্রেফতার হওয়ার পরে বীরভূমে কোর কমিটি গড়ে দিয়েছিলেন দলনেত্রী নিজেই। সেই কোর কমিটিতে রেখেছিলেন বরাবর ‘কেষ্ট-বিরোধী’ বলে পরিচিত নানুরের তৃণমূল নেতা কাজল শেখকে। যিনি আবার তৃণমূলের অন্দরে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ঘনিষ্ঠ’ বলেই পরিচিত। শুধু কোর কমিটির সদস্য হওয়াই নয়, কাজলকে বীরভূম জেলা পরিষদের সভাধিপতিও করেছে তৃণমূল। অনুব্রত গ্রেফতার হওয়ার আগে জেলায় কার্যত ‘কোণঠাসা’ ছিলেন কাজল। কেষ্টর অনুপস্থিতিতে তাঁর সেই ‘উত্থান’ দলের অনেকেরই নজর কেড়েছিল। প্রশ্ন উঠেছিল, অনুব্রতের গোষ্ঠীকে বার্তা দেওয়ার জন্যই কাজলের ‘ক্ষমতাবৃদ্ধি’ করা হচ্ছে? অনুব্রত জেলায় ফিরে আসার পরেও সেই জল্পনা অব্যাহত ছিল। দলের একাংশের মত, জাতীয় কর্মসমিতির বৈঠকের পর আর ওই জল্পনার অবকাশ নেই। বীরভূমের রাজনীতিতে অনুব্রত যে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাননি, তা স্পষ্ট হয়ে গেল।
দলের কারও কারও মত, মমতা কখনওই অনুব্রতের উপর ‘আস্থা’ হারাননি। তা হলে জেলে যাওয়ার পরেও তাঁকেই জেলা সভাপতির পদে রেখে দিতেন না। দলের এক নেতার কথায়, ‘‘অনুব্রতকে জেলা সভাপতি পদে রেখে দেওয়ার অর্থই হল, ওঁর উপর কোনও অনাস্থা দেখানো হচ্ছে না। এখন অনুব্রত জেলায় ফিরে আসায় আবার তাঁর উপরেই যাবতীয় দায়িত্ব দিয়ে দিলেন। এটা হওয়ারই ছিল।’’ অন্য একটি অংশের মত যদিও, শুধু আস্থার জায়গা থেকে নয়, জেলায় দলের গোষ্ঠীকোন্দল রোখাও জরুরি। অনুব্রত জেলায় ফেরার পর থেকেই তাঁর অনুগামীরা ‘উজ্জীবিত’। অনুব্রতের ‘ক্ষমতা খর্ব’ হচ্ছে দেখে তাঁরা যাতে কোনও রকম ‘গোলমাল’ না করেন, তা নিশ্চিত করতেই হয়তো ফের অনুব্রতকে যাবতীয় দায়িত্ব পালনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অনুব্রতের ‘একাধিপত্য’ যে আর নেই, তা কোর কমিটি বহাল রাখার সিদ্ধান্তেই স্পষ্ট বলেও মনে করছেন কেউ কেউ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy