Advertisement
২২ নভেম্বর ২০২৪
Education

দেখব এ বার জগৎটাকে

বাড়ি ছেড়ে অন্য শহরে পড়তে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছাত্রছাত্রীদের সমৃদ্ধ করে। এতে শেখা যায় অনেক কিছু। যা পরবর্তী জীবনের বহু ক্ষেত্রেই কাজে লাগে। বাড়ি ছেড়ে অন্য শহরে পড়তে যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছাত্রছাত্রীদের সমৃদ্ধ করে। এতে শেখা যায় অনেক কিছু। যা পরবর্তী জীবনের বহু ক্ষেত্রেই কাজে লাগে।

মধুমন্তী পৈত চৌধুরী
শেষ আপডেট: ২২ ডিসেম্বর ২০২০ ০৭:২৬
Share: Save:

বয়স সতেরো-আঠারো। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে পা রাখার প্রবেশিকার। ঠিক এই সন্ধিক্ষণে শহরের বাইরে পড়তে যাওয়ার বেশি প্রবণতা দেখা যায় এখনকার বাঙালি ছেলেমেয়েদের মধ্যে। স্নাতক স্তরে ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিক্যাল, হোটেল ম্যানেজমেন্টের মতো বৃত্তিমূলক কোর্সে পড়াশোনার জন্য অনেক সময় ছাত্রছাত্রীরা রাজ্যের বাইরে যায়। এ ছাড়া মূলধারার বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর ডিগ্রির জন্যও অন্য শহরে পড়তে যাওয়ার দৃষ্টান্ত অসংখ্য। অচেনা রাজ্যে, অচেনা পারিপার্শ্বিকের সঙ্গে মানিয়ে-গুছিয়ে নিয়ে পড়াশোনা ও নিজের ভাল লাগার বিষয়গুলির মধ্যে ভারসাম্য গড়ে তোলা সত্যিই চ্যালেঞ্জ। তবে এই আপাত কাঠিন্যের আড়ালে সম্ভাবনাময় আগামীকেই দেখতে পছন্দ করে ছাত্রছাত্রীরা।

অ্যাডভেঞ্চার বেশি

মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের বেশির ভাগ ছেলেমেয়েরা বাড়ির কাজ করতে সে ভাবে অভ্যস্ত নয়। বাড়ির বাইরে পড়তে যাওয়া মানে নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে। হস্টেলে থাকলে রান্না করার ঝক্কি এড়ানো যায়। তবে আলাদা অ্যাপার্টমেন্টে থাকলে সেই দায়িত্ব এড়ানোর উপায় নেই। বয়সের নিয়মে হোক বা ক্ষেত্রবিশেষে কড়া অভিভাবকত্ব, এই বয়সে বাইরে যাওয়ায় আনন্দই বেশি।

বেঙ্গালুরুর এক বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে বি টেক পড়তে গিয়েছিলেন অভীক গঙ্গোপাধ্যায়। সেখানেই এক বহুজাতিক সংস্থায় এখন তিনি কর্মরত। কাজের সূত্রে তাঁকে থাকতে হয়েছে জাপানেও। “প্রথম বার যখন বাড়ির বাইরে গিয়েছিলাম, খারাপ লাগেনি। কারণ আমার পরিবার খুব রক্ষণশীল। কলকাতা শহরে থেকেও স্কুলে পড়াকালীন সে ভাবে কিছু করতে পারিনি। তাই বেঙ্গালুরু গিয়ে প্রথম বার ঘর ঝাঁট দেওয়া, কাপড় কাচার মতো নানা ধরনের কাজ করলেও, বাড়ির কথা সে ভাবে মনে হয়নি” বললেন অভীক।

স্নাতকোত্তর পড়াশোনা করবার জন্য দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন তিতাস ভৌমিক। এখন তিনি মুম্বইয়ে কাজ করছেন। “শহরটার নাম দিল্লি, আর মেয়ে বলে বাবা-মায়েদের চিন্তা একটু বেশিই থাকে। তবে কলকাতা থেকে আমরা তিন বন্ধু একসঙ্গে দিল্লি এসেছিলাম। সেটাই স্বস্তির কারণ ছিল আমাদের বাবা-মায়েদের জন্য” জানালেন তিতাস।

ডায়েট ও ভাষাগত সমস্যা

রাজ্যের বাইরে পড়তে যাওয়া ছাত্রদের প্রধানত দু’টি সমস্যায় পড়তে হয়— খাবার ও ভাষাগত পরিবর্তন। বাড়িতে বাছবিচার করে খাওয়ার অভ্যাস এখনকার প্রজন্মের সংখ্যাগরিষ্ঠের। তবে হস্টেল-মেসের খাবার মিস করলে বা পছন্দ না হলে বন্দোবস্ত নিজেকেই করতে হবে। অভীকের কথায়, “বাড়ির ডায়েট সম্পূর্ণ পাল্টে যায় নতুন জায়গায় এসে। সেটার সঙ্গে মানিয়ে নিতে শরীরের সময় লাগে। প্রথম দিকে আমার এই ডায়েটের পরিবর্তনের জন্য জ্বরও হত।”

ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স-এ (আইআইএসসি) পিএইচ ডি করছেন কৌশিক চৌধুরী। তাঁর কথায়, “এক বার ক্যান্টিনে শুনেছিলাম, ঠিক বাঙালি কায়দায় এখানে ননভেজ রান্না হয়। যদিও বাঙালি স্বাদের ধারেকাছে তা আসে না। ননভেজ জলখাবার খাওয়ার জন্য আগে আইআইএসসি-র বাইরে বেশ কিছুটা দূরে যেতে হত। এখন অবশ্য ক্যাম্পাসেই ব্যবস্থা হয়েছে।” দিল্লিতে থাকলেও বাড়িওয়ালার মর্জিমতো নিরামিষ খাবার খেতে হতে পারে। “রাজমা-চাওয়ল, ছোলে-চাওয়ল... পেট ভরানোর জন্য সবই খেয়েছি। প্রথম বার ভাত রান্না করতে গিয়ে হাতও পুড়িয়েছি,” বললেন তিতাস।

দক্ষিণে হায়দরাবাদ, বেঙ্গালুরু, চেন্নাইয়ে পড়তে গেলে ভাষার সমস্যা হতে পারে। তবে ইংরেজি সর্বত্রই চলে। স্থানীয় কন্নড় বা তেলুগু দোকানেও সহায় হতে পারে ইংরেজি। প্রথাগত তালিম ছাড়াই কম-বেশি হিন্দি বলতে পারেন বাঙালিরা। কিন্তু বাঙালিদের হিন্দি বলার কায়দা নিয়ে অনেক সময়ে বিদ্রুপ করা হয়। ক্যাম্পাসেও বিরূপ অভিজ্ঞতা হতে পারে। তবে সেটা নিয়ে বিব্রত না হওয়ারই পরামর্শ দিচ্ছেন অভিজ্ঞরা।

সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান

কলকাতার বাইরে পা রাখা মানেই বাঙালি কিন্তু গ্লোবাল। টেকনোলজির সুবাদে তা অনেকখানি হয়েছেও বটে। কিন্তু সেই ভাবনাকে চিন্তায় রাখতে হবে, কাজেও করে দেখাতে হবে। কারণ বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে দেশের নানা প্রদেশ থেকে ছাত্রছাত্রীরা পড়তে আসে। তাদের সঙ্গে যত ভাল ভাবে মিশে যাওয়া যায়, ততই কিন্তু এক জন ছাত্র বা ছাত্রীর চলার পথ সহজ হবে। বর্তমানে ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি অব এক্সেটার-এ পিএইচ ডি করছেন ঋষিকা মুখোপাধ্যায়। স্নাতকোত্তরের পড়াশোনা করেছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। “হস্টেলে বিভিন্ন প্রদেশ থেকে আসা মেয়েদের সঙ্গে থাকতে গিয়ে ‘কালচার শক’ পেয়েছিলাম। বাড়ির পোশাকই, তবে তার মধ্যেও গ্রহণযোগ্যতার বিষয় ছিল। তাই শর্টস পরা শুরু করলাম।”

দক্ষিণে হোক বা দিল্লিতে, দেশের উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলির মানুষের সঙ্গে বাঙালিদের পরিচয় হওয়ার সুযোগ বদলে দেয় তাঁদের সম্পর্কে অনেক ভ্রান্ত ধারণা। আর এই ভাবে চেনাজানার পরিসর যত বাড়তে থাকে, পরবর্তী ক্ষেত্রেও তা বাড়তি সুবিধে দেয় বলেই মত ছাত্রছাত্রীদের।

মেনে ও মানিয়ে নেওয়া

অচেনা পরিবেশে টিকে থাকার মূল মন্ত্র একটাই— মেনে ও মানিয়ে নেওয়া। হায়দরাবাদে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে ফ্যাশন টেকনোলজি নিয়ে স্নাতকের পড়াশোনা করেছেন মৌমিতা মাইতি। আর পাঁচটি কোর্সের চেয়ে এই পড়াশোনার ধারা একেবারেই আলাদা। “শুধু তাই নয়, বন্ধু সার্কলও এখানে খুব আলাদা ছিল। তার সঙ্গে পার্টি, ক্লাবে লেডিজ় নাইটের মতো হ্যাপেনিং বিষয়গুলোও ছিল। কিন্তু সব কিছু সামলে নিজের পড়াশোনার কাজটা নিজেকেই করতে হবে” বক্তব্য মৌমিতার।

একাকিত্ব ও আসক্তি

অনেকেই বাড়ি থেকে দূরে পড়তে এসে বন্ধুসঙ্গে অ্যালকোহল, মাদক সেবনের প্রথম অভিজ্ঞতা অর্জন করে। কিন্তু নিজের গণ্ডি এ ক্ষেত্রে নিজেকেই টেনে নিতে হবে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা থাকে। কোনও রকম জটিলতার মধ্যে পড়লে সেই প্রফেশনাল কাউন্সেলিংয়ের সাহায্য নেওয়া দরকার। তবে জটিলতা দূর করার পথ কোনও রকম আসক্তি নয়, সেটা আগেভাগে বুঝে গেলেই ভাল।

বিবিধের মাঝে

বাইরে পড়াশোনা করতে গিয়ে অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার যত সমৃদ্ধ হয়, ততই বাড়ে আত্মবিশ্বাস। তৈরি হয় যে কোনও পরিস্থিতিতে খাপ খাইয়ে নেওয়ার মতো মানসিক জোর এবং ধৈর্য। রাজ্যের বাইরে যাঁরাই পড়াশোনা করেছেন, তাঁদের সকলকেই কোনও না কোনও বিরূপ অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়তে হয়েছে। সেই অসময়ে পাশে দাঁড়াতে পারে বন্ধুরা। নিজের শহরে থাকলে বন্ধুদের যতটা দরকার, অন্য শহরে তার বেশি বই কম নয়। সে ক্ষেত্রে বাঙালি সার্কলেই মিশব, এমন ধারণা না রাখাই ভাল। কারণ বাইরে পড়াশোনা করার সুবাদে যত ধরনের মানুষের সঙ্গে ওঠাবসার সুযোগ হবে, আগামী দিনে সেই বর্ণময় অভিজ্ঞতাই হয়ে উঠবে কর্মজীবনের পথের সম্বল।

অন্য বিষয়গুলি:

Education Communication
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy