ছবি: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য
অপেক্ষার অবসান। এসে গেল পুজো। আর দু-তিন দিনের মধ্যে পড়ে যাবে ছুটি। তার পর নতুন জামাকাপড়ের ভাঁজ খোলার পালা। সকালে পাড়ার পুজোয় হাতে হাতে কাজ, কোন জামাটা কোন দিন পরবে তার পার্মুটেশন-কম্বিনেশন, বন্ধুবান্ধব, বাড়ির লোক বা বিশেষ বন্ধুটির সঙ্গে কবে, কখন বেরোবে তার হিসেবনিকেশ, ম্যাডক্স স্কোয়্যার বা দুর্গাবাড়িতে চেনা-অচেনা সবাই মিলে আড্ডা, খাওয়াদাওয়ার নো রেসট্রিকশন— এ ক’টা দিন কত কিছু করার থাকে। কিন্তু সময়? সে যেন ঘোড়ায় জিন দিয়ে আসে। ফলে পুজোর শেষে দেখা যায়, সময় দিতে পারোনি বলে ঠাম্মির গোমড়া মুখ, বিশেষ বন্ধুটির সঙ্গে কথা বন্ধ, পাড়ার বন্ধুরাও তোমাকে দেখে অন্য পথ ধরছে। কিন্তু এই পুজো থেকেই আমরা শিখতে পারি বেশ কিছু জিনিস— টাইম ম্যানেজমেন্ট, মাল্টিটাস্কিং, প্ল্যানিং, আরও কত কী। যা আমাদের কাজে লাগে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে। বিশেষত পরীক্ষার সময় তো বটেই। দেখা যাক কী ভাবে।
প্ল্যানিং
দুর্গাপুজো কী বিরাট একটা প্রোজেক্ট ভাবো! ছোট-বড় কত কাজ! থিম কী হবে, প্রতিমা কেমন হবে, কে প্রতিমা গড়বেন, কোন কোন সংস্থার বিজ্ঞাপন হোর্ডিং পড়বে, কবে বিল ছাপা হবে, কবে থেকে চাঁদা তোলা শুরু হবে, আলোকসজ্জা কেমন হবে ইত্যাদি। এত সব কাজের তো একটা জবরদস্ত প্ল্যানিং চাই। অনেকটা তোমাদের পরীক্ষার রুটিন বানানোর মতো। যে কোনও বড় পরীক্ষার আগেই যেমন তোমরা অনেকেই রুটিন বানিয়ে ফেলো। বিষয় অনুযায়ী সময় ভাগ করো। সেইমতো প্রস্তুতি নাও। পুজোর ব্যাপারটাও ঠিক সেই রকম। সব কাজ সুষ্ঠু ভাবে করার নিয়মটাও একই রকমের। আগে পুরো কাজটা ভেবে নিয়ে এ বার সেইমতো প্রত্যেকটা বিষয়ের জন্য সময় ভাগ করো। দরকার হলে কাগজে গোটা জিনিসটা লিখে ছক বানাও। তবে সাবধান, এটা করতে গিয়ে ‘আরে, অনেক দিন সময় আছে, ধীরেসুস্থে করা যাবে’— এই মনোভাব রাখলে আখেরে অসুবিধেয় পড়তে পারো। পুজোর মতো প্রোজেক্টের ক্ষেত্রে যেমন সামান্য গড়িমসিও চলে না, তেমনই পরীক্ষার ক্ষেত্রেও রুটিনমাফিক না এগোলে দেখবে সময় কখন হাতের ফাঁক দিয়ে টুক করে গলে গিয়েছে। তখন শত হাত পাঁ ছঁুড়েও কোনও লাভ হবে না।
প্লাস-মাইনাস-এক্সট্রা
যে কোনও প্ল্যানিং-এর একটা বড় অংশ টাইম ম্যানেজমেন্ট। এটা ওই পুজোর বাজেটের মতো। যাঁরা পুজোর দায়িত্বে থাকেন, তাঁরা জানেন কোন খাতে কত টাকা বরাদ্দ করতে হবে। কিছু খরচ থাকে বড়— যেমন প্রতিমার বায়না, প্যান্ডাল, আলো, খাওয়াদাওয়া। এর পরে অন্যান্য খরচ— ঠাকুরের ফুল, ঢাকি, পুজোর টুকটাক জিনিসপত্র। আর থাকে ‘এক্সট্রা ফান্ড’। মানে চেনা খরচের বাইরে না-জানা খরচ। হঠাৎ করে জানা গেল অষ্টমীর দিন যতটা ফুলের দরকার ছিল তা পাওয়া যাচ্ছে না। তখন অন্য জায়গা থেকে বেশি দাম দিয়ে ফুল আনতে হবে। এই হিসেবনিকেশের ব্যাপারটা রুটিন পরীক্ষার ক্ষেত্রেও লাগে। নতুন পড়া ও তোমার যেটা শক্ত লাগে, তার জন্য বেশি সময় দিতে হবে। সোজা পড়ার জন্য কম। রিভিশনের জন্য একটা নির্দিষ্ট সময় রাখতে হবে। আর থাকবে ‘এক্সট্রা টাইম’। হঠাৎ করে তোমার শরীর খারাপ হয়ে গেল বা বাড়ির এমন কোনও কাজ পড়ে গেল, যেটা তুমি ছাড়া আর কেউ পারবে না। তখন এই এক্সট্রা টাইম তোমার কাজে লাগবে। আবার পরীক্ষাতেও এই হিসেব অনুযায়ী বড়, মাঝারি, ছোট প্রশ্নের জন্য সময় ভাগ করে নিও। আর শেষে কিছুটা টাইম রাখো রিভিশনের জন্য।
টিম-গেম
পুজোটা একটা টিমওয়ার্কও। ধরো, কেউ ভাল আঁকে কিন্তু খুব দৌড়োদৌড়ির কাজ পারে না। ফলে তাকে দিয়ে আলপনা, পুজোর ডেকরেশন ইত্যাদি কাজ করানো যায়। কেউ হয়তো খুব চটপটে, ভাল কথা বলতে পারে, কিন্তু আঁকাআঁকিতে নেই। তাকে ফুল আনা, ঢাকি জোগাড় করা ইত্যাদির দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। টিমে যদি ঠিক লোককে ঠিক কাজটা দেওয়া হয়, তা সবাই মিলে গুছিয়ে কাজ করতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত গোটা কাজটা সফল ভাবে শেষ করা যায়। তোমাদের অনেকে হয়তো গ্রুপ করে পড়াশোনা করো। সেখানেও এই টিমওয়ার্ক কাজে লাগে। যেমন, কেউ হয়তো অঙ্কে ভাল। সে বাকিদের অঙ্কের যে কোনও সমস্যায় সাহায্য করতে পারে। আবার যে ভাল ইতিহাসে, সে প্রয়োজনে ইতিহাসের উত্তর লেখায় সাহায্য করতে পারবে বন্ধুদের। এখন থেকে টিমওয়ার্কের গুরুত্ব বুঝলে আগামী দিনে তোমাদেরই লাভ। কারণ কর্মক্ষেত্রে টিমওয়ার্ক-এর বিরাট ভূমিকা থাকে। সেটার তালিম এখন থেকেই হয়ে থাকলে পরে অসুবিধে হবে না।
প্রেজেন্টেশন
পুজো আর এখন নিছক উৎসব নয়। তার আয়োজনে এখন পেশাদারিত্বের ছাপ। সবারই লক্ষ্য থাকে তাদের পুজোতেই দর্শকরা সবচেয়ে বেশি আসবেন। কলকাতার নামী পুজোগুলো তাই প্রতি বছর নতুন নতুন থিম নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হয়। মানে সবাই নিজেকে দর্শকদের সামনে এমন ভাবে ‘প্রেজেন্ট’ করতে চায় যাতে তাকেই মানুষ সেরা বলে বেছে নিতে পারে। পরীক্ষার সময়েও এই বিষয়টা তোমাকে অন্যান্যদের থেকে আলাদা করে দিতে পারে। মানে, তোমার খাতাটাকে পরীক্ষকের সামনে এমন ভাবে তুলে ধরতে হবে যে এক ঝলকেই তিনি যেন সেটার প্রতি আকৃষ্ট হন। সুন্দর হাতের লেখা, গোছানো উত্তর, পরিষ্কার খাতা— সব সময়েই শিক্ষকদের নজর কাড়ে। সেই সঙ্গে চেষ্টা করবে উত্তরগুলোর মধ্যে কিছুটা নতুনত্ব রাখতে। গতানুগতিক তথ্যের পাশাপাশি দু’একটা নতুন পয়েন্ট যোগ করে দিতে পারলে ভাল হয়।
মাল্টিটাস্কিং
দুর্গাই এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তা ছাড়া উদ্যোক্তাদের কথাই ভাবো। পুজোর আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট— সব কিছুর দায়িত্ব তাঁদের। ঠাকুরমশাইকে বিভিন্ন পুজোর দিনের দায়িত্বের কথা বলতে বলতে, ফোনে ফুল ব্যবসায়ীর সঙ্গে ফুলের দরদাম করছেন— এমন নানা মাল্টিটাস্কিং-এর ছবি হামেশাই ধরা পড়ে এঁদের ধারেকাছে থাকলে। তুমি কী ভাবে এই মাল্টিটাস্কিং করতে পারো? ধরো বাসে বা মেট্রোয়, স্কুলে যাচ্ছ। ওই দিন স্কুলে প্রথমে যে ক্লাস রয়েছে, তাতে যা পড়ানো হবে সেটা বই থেকে পড়তে পড়তে চলে যাও। রথ দেখা, কলা বেচা দুটোই হয়ে গেল। মানে, স্কুলে পৌঁছতে পৌঁছতে তোমার প্রথম ক্লাসের পড়াটা রেডি। এটা একটা উদাহরণ মাত্র। এখন যা সময়, তাতে দৈনন্দিন জীবন তো বটেই, কাজের জায়গাতেও মাল্টিটাস্কারদের কদর বেশি।
বুল্স আই
যখন যে কাজটা করছ তখন সেটা ছাড়া অন্য কিছু ভাববে না। হয়তো তোমাকে পুজোর কোনও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ঠিক সেই সময়েই পাড়ার বন্ধু এসে বলল, অমুকের বাড়িতে আড্ডার আসর বসেছে। তোমাকে সবাই ডাকছে। সেই শুনে যদি কাজটা ফেলে যাও, তা হলে কিন্তু লোকের তোমার প্রতি ধারণা হবে যে, তুমি খুব দায়িত্বশীল নও। তাই বন্ধুকে বলতে হবে, তুমি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাতের কাজটা সেরেই যাবে। ঠিক একই রকম ভাবে যখন পড়তে বসছ, তখন সব ধরনের ডিসট্র্যাকশন থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করো। যদি মনে করো টানা এক ঘণ্টা পড়বে, মোবাইল বন্ধ রাখো। পারলে বাড়ির লোক বা বন্ধুবান্ধবদের বলে দাও, অমুক সময় থেকে অমুক সময় তোমাকে পাওয়া যাবে না। কেউ এলে তাঁকে বলে দাও তুমি এখন ব্যস্ত। খুব প্রয়োজন ছাড়া উঠো না।
চেকলিস্ট
এটাও একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ। সাধারণত এক দিনে না করে দু-তিন দিন নিয়ে লিস্টটা বানালে ভাল হয়। কারণ এক বারে যে পয়েন্ট মনে পড়ে না, তা পরে মনে পড়তে পারে। এ বার ওই যে হাতে পাঁচ-দশ দিনের বাড়তি সময়ের কথা বলা হয়েছে, সেই সময় লিস্ট ধরে ধরে মেলাতে হবে। ঘটের ডাব= টিক, চাঁদমালা= টিক, প্রসাদ দেওয়ার ছোট প্লেট= টিক, পুজোর প্রস্তুতি= টিক...। পরীক্ষার পড়াতেও দৈনিক এমন চেকলিস্ট বানাতে পারো। তা হলে দেখে নিতে পারবে, প্রতি দিন কতখানি পড়া হল আর কতখানি বাকি রইল। সেই অনুযায়ী পরের দিনের রুটিনটা এ দিক-ও দিক করে নিও।
যা যা এত ক্ষণ পড়লে তার সবটাই কিন্তু অভ্যাস। রপ্ত করতে ক’টা দিন লাগবে। সেই মহড়া এখন থেকে শুরু করে দিতেই পারো। যদিও আপাতত টার্গেট পুজো। তার পর আগামী জীবনটা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy