পড়াশোনার পথটার বিভিন্ন ধাপে ধাপে যারা রয়েছ, তাদের সবার জন্যেই এ বছরটা খুবই অন্য রকম। পুরনো বন্ধু ভরা নতুন ক্লাস ঘর, নতুন শিক্ষক বা শিক্ষিকা, নতুন কোনও দুষ্টুমি— কোনওটাই এ বার নেই। নতুন বলতে সকাল থেকে উঠে কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে পড়া বোঝার চেষ্টা। অনলাইনে পড়াশোনাটা তোমাদের-আমাদের চেনা ছকের বাইরে, ভালমন্দ মিশিয়েই। মানিয়ে নিতে হবে। এটাই যে এখন স্কুল, কলেজ, বন্ধুবান্ধব, স্যর-ম্যাডামদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখার একমাত্র সেতু। যে হেতু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এখন অনস্ক্রিন, নিজেদের স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে, বিনোদনের প্রয়োজনে মোবাইল বা কম্পিউটারের ব্যবহারটা কমিয়ে ফেলা আবশ্যক। নিজেরাই ঠিক করে নাও, এর বেশি সময় তোমরা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে কাটাবে না। আর একটা কথা। তোমাদের বাবা-মা’ও এমন পরিস্থিতির মধ্যে কখনও পড়েননি। তাই যতটুকু পারবে, তাঁদের পাশে থেকো। এই সময়ে তোমাদের সহমর্মিতার বড় প্রয়োজন তাঁদের।
সবচেয়ে অনিশ্চিত অবস্থা তাদের, যারা এ বার উচ্চ মাধ্যমিক বা সমতুল কোনও পরীক্ষা পাশ করলে। জীবনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা মাঝপথে থমকে যাওয়ার পর থেকে আজও কিছুই যেন ঠিক হল না। এ দিকে সবারই রেজাল্ট বেরিয়ে গিয়েছে। হয়তো সবচেয়ে বেশি প্রস্তুতি নেওয়া, সবচেয়ে পছন্দের বিষয়টির পরীক্ষাই দিতে পারোনি। আশাভঙ্গও হয়েছে অনেকের। কলেজের প্রথম দিনটাকে নিয়ে বহু যত্নে লালন করা সোনালি স্বপ্নগুলো খানিক দূরের মনে হচ্ছে এখন। একটা ছন্দপতন হয়েছে ঠিকই। কিন্তু ধীরে ধীরে আবার সব স্বাভাবিক হতে বাধ্য। এক বারের জন্যেও ভেবো না, তোমরাই একমাত্র, যারা এমন দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ। প্রত্যেক প্রজন্মকেই জীবনের একটা পর্বে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হতে হয়েছে। সেটা বিশ্বযুদ্ধ হোক, মহামারি হোক কিংবা দেশভাগ। এখন ধৈর্য ধরে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে চলতে হবে।
কলেজে ভর্তি হতে দেরি হচ্ছে। এই অবসরে একটা দরকারি কাজ সেরে ফেলতে পারো। হয়তো বড়রা বলেছেন, অথবা তুমি ওই বিষয়ে বেশি নম্বর পেয়েছ বলে সেই বিষয়টি নিয়ে পরবর্তী ধাপের পড়াশোনা করবে বলে ভেবে রেখেছ। সে ক্ষেত্রে আগামী বেশ কয়েকটা বছর ওই বিষয়টি নিয়েই তোমাদের পড়তে হবে। পারবে তো অত দিন ধরে বিষয়টিকে ভালবেসে পড়তে? যদি পারো, তা হলে ইন্টারনেট খুলে দেখে নাও, ওই বিষয় নিয়ে ভবিষ্যতে কী ভাবে এগোনো যাবে। তার মধ্যে কোন পেশাটি তোমার পছন্দের। দরকার হলে সেই পেশার বিষয়ে আরও তথ্য জোগাড় করো। নিজের চারিত্রিক দোষ-গুণ বোঝার চেষ্টা করো, প্রয়োজনে বড়দের, বন্ধুদের সাহায্য নাও। তোমার পছন্দের পেশাতে তোমার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলো কী ভাবে সাহায্য করতে পারে, সেটাও ভেবে দেখার বিষয়।
তোমাদের মধ্যে যারা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্যে প্রস্তুতি নিচ্ছিলে, তাদের অনিশ্চয়তা অনেকটাই বেশি— পরীক্ষার জন্যে পড়ব কি পড়ব না? পড়লেও কতটা পড়ব? আদৌ পরীক্ষাটা হবে তো? পরীক্ষাগুলো হবেই। সেপ্টেম্বরের শুরুতেই হয়ে যেতে পারে, পিছিয়েও যেতে পারে। কিন্তু একেবারে বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা কম। তোমরাও নিজেদের সাধ্যমতো প্রস্তুতি নিচ্ছ। অন্যান্য বার এই সব পরীক্ষায় তারাই সফল হয়, যারা খুব ভাল ভাবে বিষয়গুলো পড়েছে আর নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উত্তর দেওয়ার দক্ষতা অর্জন করেছে।
এ বারের পরীক্ষাতে আরও বেশি করে একটি গুণের প্রয়োজন। একাগ্রতা। এই সঙ্কটে যারা মনোবল না হারিয়ে, নিয়ম করে পড়াশোনা করার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের লক্ষ্যে অবিচল থাকতে পারবে, সাফল্য তারাই পাবে। তার মানে কিন্তু এটাও নয় যে দিনের পর দিন ১৪-১৬ ঘণ্টা পড়াশোনা করতে হবে। বরং, সময়ের অভাবে যে যে অংশগুলো ভাল করে পড়া হয়নি বা যে অংশটা আর একটু বিশদে জানার ইচ্ছে থাকলেও সিলেবাস শেষ করার তাড়ায় হয়ে ওঠেনি, এখন সময় সেটা করে ফেলার। প্রায় সবার কাছেই এখন স্মার্টফোন আছে। ইন্টারনেটে অনেক ভিডিয়ো পাওয়া যায়, যেখানে নানা দেশের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বিভিন্ন বিষয়ের উপর আলোচনা করছেন। আছে প্রচুর প্রবন্ধ আর বইও। এক-দু’পাতার মধ্যে প্রত্যেকটা অধ্যায়ের ‘কি পয়েন্ট’গুলো লিখে ফেলো— পদার্থবিদ্যা আর অঙ্কের সূত্র, রসায়নের সূত্র আর সমীকরণ, জীববিদ্যার ছবি বা উদাহরণ, যা যা তোমাদের মনে রাখতেই হবে। প্রতি সপ্তাহে দুই থেকে তিন বার ওই নোটগুলো পড়তে হবে। রিভিশনের জন্য এনসিইআরটি-র বইপত্র দেখতে পারো। পারলে দিনে দু’টো, অন্তত একটা করে নিট বা জেইই-র আগের বছরের প্রশ্নপত্র বা স্যাম্পল পেপার ঘড়ি ধরে শেষ করো। ‘ন্যাশনাল টেস্ট অভ্যাস’ অ্যাপেও এমন প্রশ্নপত্র পাবে প্র্যাকটিসের জন্যে। যে যে জায়গায় ভুল হল, বই খুলে আবার এক বার দেখে নিয়ো। রোজ সময় ধরে পরীক্ষা দিতে দিতে নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়বে। আসল পরীক্ষার দিন এটা তোমাদের সাহায্য করবে।
অনেকেই নিট-জেইই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার জন্য ‘ইয়ার গ্যাপ’ নিয়েছ। তাদের বাড়িতে থাকার সময়টা আরও দীর্ঘ হচ্ছে নিশ্চয়ই। মনে রেখো, একটা বা দু’টো বছর ধরে যে ইচ্ছেটা নিয়ে এগিয়ে চলেছ, সেটার দিকে লক্ষ্য স্থির রেখে এগিয়ে চলতেই হবে। নইলে তোমার আগের সব চেষ্টা বিফলে যাবে। “সব পড়া হয়ে গিয়েছে, আর কত বার পড়ব”— এমন ভাবনা যেন না আসে। এক বার কম পড়লে ক্ষতি হয়ে যেতে পারে, বেশি বার পড়লে কিন্তু সে ক্ষতিটা এড়ানো সম্ভব। পরিশ্রম না করলে সাফল্য ধরা দেবে না।
পর্যাপ্ত ঘুম, একটু ব্যায়াম, একটু নিজের ভাল লাগার কিছু করা— এর মধ্যে একটা ভারসাম্য থাকা জরুরি। গান, নাচ, আবৃত্তি, গল্পের বই পড়া, সেতার বাজানো, খেলাধুলো— যা তোমার ভাল লাগে, সেগুলোয় সময় দাও। প্রতিটি মানুষ, সে যে জীবিকাই বেছে নিক না কেন, সৃষ্টিশীল জগতের সঙ্গে সম্পর্ক সকলের কাছেই এক ফালি খোলা জানালার কাজ করে। জীবনে ওই জানলাটার বড্ড দরকার।
অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর,
পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট অব হসপিটাল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (পিয়ারলেস ক্যাম্পাস)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy