০২ নভেম্বর ২০২৪
Extraordinary Person of the Month

হরিজনপাড়া হয়ে ভূতপাড়া ছাড়িয়ে ‘মাস্টারদার সংসার’ চলে কৃষ্ণনগর স্টেশনেও

ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে নিয়ম করে ভোর সাড়ে ৪টেয় ঘুম থেকে ওঠেন। সব্জিবাজার সেরে ৬টা নাগাদ স্কুটির দু’পাশে দু’টি ১৩ কেজির ‘ক্যান’ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েন। শুরু হয় অ-সাধারণ এক যাত্রা।

Amaresh Achaya of Krishnanagar: ABP Online Extraordinary Person of the Month: September 2023

অমরেশ আচার্য। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

প্রণয় ঘোষ
কৃষ্ণনগর শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:০০
Share: Save:

ভোলেননি। তরুণবেলার কোনও এক জন্মদিনে বাবার দেওয়া বইয়ের সেই বলিষ্ঠ উচ্চারণ।

...ভুলিও না— নীচ জাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই!

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শব্দগুলিতে হয়তো কিছুটা ধুলো পড়েছিল। কিন্তু সব ধুলো এক ফুঁ-তে উড়ে গিয়েছিল হরিজনপাড়ায় ঢুকে। তখন লকডাউন চলছে দেশ জুড়ে। অতিমারি ঘরে ঢুকিয়ে ছেড়েছে সকলকে। নিজের উদ্যোগে শুরু করেছিলেন স্থানীয় বাজার, ক্লাব, পাড়ার মোড় স্যানিটাইজ়েশনের কাজ। আর সে সব করতে করতেই এক দিন ঢুকে পড়েছিলেন, জীবনে প্রথম বার, হরিজনপাড়ায়। আক্ষরিক অর্থেই মেথরের বাস। পাড়াজোড়া সকলের পদবিই হাঁড়ি। শহরের সব নোংরা এই এলাকাতেই জমা হয়। পোশাকি নাম ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড’। তার পাশের ছোট্ট পাড়াটার নামই হরিজনপাড়া। নামেই বোঝা যায়, হরিজনেরা থাকেন এখানে। ঢুকেই মনে পড়েছিল বাবার দেওয়া বইয়ের কথা— বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা সংকলন। সেখানেই ছিল ‘বর্তমান ভারত’ প্রবন্ধ। আর সেই প্রবন্ধেরই অংশ ওই ‘...ভুলিও না...’। মনে গেঁথে থাকা ওই বাক্যগুলিই এক দমকায় মনে পড়েছিল অমরেশ আচার্যের।

নদিয়ার কৃষ্ণনগরের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ড। সেখানেই হরিজনপাড়া। লকডাউনকালে কিছুটা বাইরে বেরোনোর ছাড় মেলার পর পেশায় স্কুলশিক্ষক অমরেশের মনে হয়েছিল, শহরের সেই সব গরিব মানুষদের পাশে দাঁড়ানো প্রয়োজন। কারণ, সরকারি চাকুরে হিসাবে তিনি না-হয় সবেতন ঘরে থাকছেন। কিন্তু যাঁদের দিন আনা দিন খাওয়া জীবন, তাঁদের পরিবারের কী হাল হয়েছে! শরীর-স্বাস্থ্য-পুষ্টি তো ঘেঁটে একশা হওয়ার উপক্রম নিশ্চয়ই! সেই উদ্বেগেই বাড়ির বাইরে বেরিয়েছিলেন। প্রথম গন্তব্য হরিজনপাড়া। যা আশঙ্কা করেছিলেন, ঠিক তা-ই। এর পর নিজের পয়সায় প্রতি দিন সেখানে দুধ আর বিস্কুট নিয়ে সাতসকালে হাজিরা। বাড়ি বাড়ি বাচ্চাদের হাতে তা তুলে দেওয়া। এ সব করতে করতেই একটা সময়ে লকডাউনে আরও কিছুটা ছাড় মেলে। সেই সময় ছোটখাটো মাপের অন্য উদ্যোগে ওই পরিবারগুলির বাচ্চাদের সমাজের মূল স্রোতের সঙ্গে কিছুটা মিশিয়ে দেওয়ার চেষ্টাও করছেন। কখনও অ-আ-ক-খ, কখনও বল-খেলনা উপহার দেওয়া, কখনও বা নাচ-গান-বাজনা। এ সবের মধ্যে চলেছে পুষ্টির জোগান।

অমরেশের লেখাপড়ার পাঠশালায় নিয়ম করে কচিকাঁচাদের হাতে ধরে পাঠ দেন দিদিমণি সান্ত্বনা সর্দার।

অমরেশের লেখাপড়ার পাঠশালায় নিয়ম করে কচিকাঁচাদের হাতে ধরে পাঠ দেন দিদিমণি সান্ত্বনা সর্দার। —নিজস্ব চিত্র।

কিছু দিনের মধ্যেই হরিজনপাড়া থেকে বাহির পানে তাকালে‌ন অমরেশ। ভূতপাড়া। কৃষ্ণনগর শহরের বাইরে দোগাছি পঞ্চায়েতের মধ্যে পড়ে ওই এলাকা। এখানে সকলেই আদিবাসী সম্প্রদায়ের। বেশির ভাগই সর্দার। সেখানেও প্রথমে পুষ্টির সম্ভার নিয়ে হাজিরা। তার পর শিক্ষা। শেষে একটি পাঠশালাও। কারণ তত দিনে অমরেশ বুঝতে পেরেছেন, বেঁচে থাকতে গেলে যেমন পুষ্টি চাই, তেমনই চাই শিক্ষা। প্রথাগত নয়, একেবারেই প্রথার বাইরে বেরিয়ে তিনি শিক্ষার আলো ফেলতে চেয়েছেন আদিবাসী শিশুদের বর্তমানে। যাতে ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও আলোকিত হয়।

হরিজনপাড়ায় ছিল ৬৬ জন বাচ্চা। তবে সে পাড়ার পাঠ বছরখানেক আগে চুকিয়েছেন অমরেশ। এর পর ভূতপাড়ায় সেটাই প্রায় আড়াই গুণ বেড়ে গেল। প্রথমে দুধ-বিস্কুটের টানে পাঠশালায় আসা। পরে ওই সব বাচ্চাদের মন বসানো গেল পড়াশোনায়। অমরেশ বলেন, ‘লেখাপড়ার পাঠশালা’। রাখতে হল এক জন শিক্ষিকাকে। সবেতন। সপ্তাহে চার দিন বসে এই পাঠশালা। বিকেলে। ৪টে থেকে সাড়ে ৫টা। শীতকালে একটু এগিয়ে বসে পাঠশালা। আর বর্ষাকালে লোকের উঠোন ছেড়ে কারও বাড়িতে ঢুকে পড়ে শেখার আঙিনা। আর সকালে দুধ-বিস্কুট যেমন ছিল, তেমনই। অমরেশের কথায়, ‘‘প্রথাগত পদ্ধতির বাইরে গিয়ে ওদের শেখানোর চেষ্টা করি আমরা। শব্দ নিয়ে খেলা, সেখান থেকে বাক্য গঠন, রোজকার হিসাব রাখা— এই সব করতে করতে কখন যেন ওরা অনেকটা বাংলা-অঙ্ক শিখে যায়।’’ কেউ করেন সাফাইকর্মীর কাজ। কেউ কাজ করেন ইটভাটায়। কেউ রাস্তায় তৈরি সময় পিচ ঢালেন। কেউ আবার কোনও কাজই করেন না, স্ত্রী অন্যের বাড়ির পরিচারিকা। এই সব পরিবারের সন্তানদেরই পাঠশালায় এনে জীবন শেখানোর চেষ্টা করেন অমরেশ এবং তাঁর টিম। টিমের সক্রিয় সদস্য মনোজিৎ, পলাশ, সৌমিক, জয়দেব, ভাস্কর, সাহেব, মনিকা, কুন্তলা, কমলেরা।

অমরেশের লেখাপড়ার পাঠশালায় নিয়ম করে কচিকাঁচাদের হাতে ধরে পাঠ দেন দিদিমণি সান্ত্বনা সর্দার। তিনি ভূতপাড়ারই বধূ। তাঁর কথায়, ‘‘আমাদের কথা, আমাদের বাচ্চাদের কথা, কেউ কোনও দিন ভাবেনি। রাজনীতির জন্য আমরা ভোট। আর মালিকের জন্য আমরা নোট। এ সবের বাইরে অমরেশদাদা আমাদের নিয়ে ভাবছেন। আমাকে এই যাত্রায় সঙ্গে নিয়েছেন। ওঁকে ধন্যবাদ জানানোর ভাষা নেই। অনেককেই তো দেখলাম। এতটা স্বার্থহীন কাউকে দেখিনি।’’

হরিজনপাড়ায় বাচ্চাদের সঙ্গে অমরেশ।

হরিজনপাড়ায় বাচ্চাদের সঙ্গে অমরেশ। —নিজস্ব চিত্র।

অমরেশের বয়স ৪৩। বাড়ি কৃষ্ণনগরেরই তাঁতিপাড়ায়। সংসার বলতে মা নীলিমা আচার্য, দিদি মন্দিরা আর ভাগ্নে। জামাইবাবু একটি কলেজের অধ্যাপক। সপ্তাহান্তে আসেন। বাড়ি থেকে অমরেশের স্কুল ৩০ কিলোমিটার দূরে, সেই বগুলা ছাড়িয়ে। নাম ‘বরণবেড়িয়া কৃষক সংঘ বিদ্যালয়’। হাই স্কুল। সেখানেই পদার্থবিজ্ঞান পড়ান অমরেশ। রোজনামচা বড় অদ্ভুত এই যুবকের। ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে নিয়ম করে সাড়ে ৪টেয় ঘুম থেকে ওঠেন। সব্জিবাজার সেরে সকাল ৬টা নাগাদ স্কুটির দু’পাশে দু’টি ১৩ কেজির ‘ক্যান’ ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়েন। বাড়ি থেকে সাত কিলোমিটার পেরিয়ে ভূতপাড়া। এক গ্লাস দুধ আর এক প্যাকেট ছোট বিস্কুট। বিনা, সুলেখা, প্রবীর, রিম্পা, গুড্ডুর মতো কচিকাঁচাদের সঙ্গে খেলার ছলে কিছুটা সময় কাটিয়ে সাড়ে ৯টায় বাড়ি ফেরা। কোনও রকমে স্নান-খাওয়া সেরে এ বার নিজের স্কুলের উদ্দেশে রওনা। সাড়ে ৪টেয় স্কুল ছুটি। তার বাড়ি পৌঁছতে পৌঁছতে ৬টা বেজে যায়। তত ক্ষণে মা আর দিদি মিলে রান্না প্রায় করেই ফেলেছেন। রান্না শেষ হলে মা-দিদি দু’টি কন্টেনারে সাজিয়ে দেন প্রায় ৪০ জনের খাবার।

আসলে অমরেশের সকালটা ছোটদের জন্য। সেই ‘দেবশিশু’দের কাছে তিনি পৌঁছে দেন দুধ-বিস্কুট। সঙ্গে কিছুটা অপ্রথাগত শিক্ষা। আর রাতটা তিনি রেখেছেন বড়দের জন্য। সেই বড়দের জন্যই এই খাবার নিয়ে বেরোন অমরেশ। ঘড়িতে রাত সাড়ে ৮টা বাজলেই অমরেশ পৌঁছে যান কৃষ্ণনগর রেলস্টেশনের টিকিট কাউন্টারের সামনে। তত ক্ষণে সেখানে তাঁর পথ চেয়ে বসে আছেন সেই সব মানুষেরা। যাঁদের খাবারের সংস্থান নেই। স্থানীয় ভবঘুরে এবং ট্রেনপথে ভুল করে চলে আসা মানসিক সমস্যায় ভোগা মানুষজন। যাঁরা অমরেশের ‘অভিজ্ঞ সন্তান’। অমরেশ পৌঁছতেই তাঁকে ঘিরে ধরেন ক্ষুধার্ত মানুষেরা। প্রত্যেককে সারিবদ্ধ ভাবে বসিয়ে কাগজের থালায় পরম স্নেহে অমরেশ সাজিয়ে দেন খাবার— ভাত, ডাল, সব্জি আর ডিম। প্রতি শনিবার নিয়ম করে সহজপাচ্য ডালিয়া।

সকাল-রাতের এই কর্মকাণ্ডে তো বিপুল খরচ। আসে কোথা থেকে? অনেক হিসাব করে অমরেশ বলছেন, ‘‘সপ্তাহে তা প্রায় ১২-১৩ হাজার টাকা খরচ হয়। মা, দিদি আর আমি মিলে চেষ্টা করি সেটা দেওয়ার। কখনও কখনও বন্ধুরাও কিছু দেয়।’’ প্রেম করেন? অমরেশের জবাব, ‘‘না না, অমন কিচ্ছু নেই। আমার ভালবাসা তো এরাই। আমার দেবশিশুরা রয়েছে। রয়েছে অভিজ্ঞ সন্তানেরাও।’’ বিয়ে করবেন না? এ বারে সটান জবাব এল, ‘‘না।’’

নীলিমা যদিও চান, ছেলে এ সবের পাশাপাশি, নিজের একটা সংসার পাতুক। তাঁর কথায়, ‘‘ছেলেকে যখনই সংসারের কথা বলি, তখনই উত্তর দেয়, আমার মতো বড় সংসার ক’জনের আছে? মাঝেমাঝে ভীষণ গর্ব হয়, আবার অনেক সময় আঁতকে উঠি! ভাবি, আমরা না-থাকলে ও একা হয়ে যাবে না তো?’’ দিদি মন্দিরাও রয়েছেন তাঁর ভাইয়ের পাশে। বলছেন, ‘‘ও যে ভাবে এই শিশুদের আর সহায়-সম্বলহীনদের আপন করে নিয়েছে, এটা দেখে আমরাও যেন কবে ওদের আত্মীয় হয়ে গিয়েছি। যতটুকু সাধ্য পাশে থাকার চেষ্টা করি। ওই সলতে পাকানোর মতো আর কি!’’

কৃষ্ণনগর স্টেশনের পরিচয়হীন ওই ভবঘুরেদের কেউ অমরেশের দিদা, কেউ বা দাদু, কারও কাছে আবার তিনি পরম স্নেহের বড় ভাই। ওই ‘বড়’দের মতোই হরিজনপাড়া বা ভূতপাড়ার কচিকাঁচারা ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে অমরেশকে। আসলে অমরেশ যে প্রত্যেকের ভালবাসার ‘মাস্টারদা’।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:

Share this article

CLOSE