২১ নভেম্বর ২০২৪
Journey of a Blind Man

বৃষ্টি আর কান্নার জল একাকার, একটা দিন বদলে দিল জীবন

কেঁদে ফেলেছিলাম ঝরঝর করে। এমন করল আমার সঙ্গে? কেন করল? আমার অসহায়তা নিয়ে মজা করল? বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় আমার চোখের জল তখন আশপাশের কারও চোখে পড়ছিল না।

Tarak Chandra of North 24 Parganas & the blind students: ABP Online Extraordinary Person of the Month: August 2023

তারক চন্দ্র। গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।

অমিতা দত্ত
বারাসত শেষ আপডেট: ৩১ অগস্ট ২০২৩ ০৮:৩৭
Share: Save:

কলেজ স্ট্রিটে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। এক জন বলেছিল, ওখানে এসে আমাকে ক্লাসের ইতিহাস বইটা কিনে দেবে। তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ি। কিছু চিনি না। একে-তাকে জিজ্ঞাসা করে যেখানে দাঁড়ানোর কথা ছিল, সেখানে পৌঁছলাম। বেনিয়াটোলা লেনের ঠিক উল্টো দিকের গলির মুখে। ঘণ্টা তিনেক দাঁড়িয়ে রইলামকেউ এল না। এল তেড়েফুঁড়ে বৃষ্টিহাতড়ে হাতড়ে পাশে একটা টানা রিকশা পেলামসেটার আড়াল নেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু বৃথা। চুপচুপে ভিজে গিয়ে ভাবছি, এই বৃষ্টির মধ্যে কী করে বাড়ি ফিরব! কী ভাবে শিয়ালদহ গিয়ে ট্রেন ধরব! মা চিন্তা করবে। কেঁদে ফেলেছিলাম এমন করল আমার সঙ্গে! কেন? আমার অসহায়তা নিয়ে মজা করল? বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় আমার চোখের জল তখন আশপাশের কারও চোখে পড়ছিল না।

দৃষ্টিহীন তারক চন্দ্রের চোখ খুলে দিয়েছিল সে দিনের অভিজ্ঞতা। তৈরি করে দিয়েছিল জীবনদর্শনের ভিত্তি। জন্ম থেকেই তারক প্রায় দৃষ্টিহীন। বাঁ চোখে তা-ও ক্লাস ওয়ান পর্যন্ত একটু-আধটু আলোর রেশ পৌঁছত। কিন্তু সেটুকুও বন্ধ হয়ে গেল ফুটবলের এক ঘায়ে। তার পর থেকে তারক ১০০ শতাংশ দৃষ্টিহীন। মাধ্যমিকে স্টার, উচ্চ মাধ্যমিকে ভাল নম্বর পেয়ে প্রথম বিভাগে পাশ। তার পর স্নাতক, স্নাতকোত্তর। জীবনের প্রতিটা পদক্ষেপেই নানা চ্যালেঞ্জ জয় করে তারক এখন হাই স্কুলের শিক্ষক। অভিধান বলে, ‘তারক’ শব্দের অন্যতম অর্থ ‘উদ্ধারকারী’। যিনি ‘ত্রাণ’ করেন। ‘তরিয়ে’ দেন। স্কুলে পড়ানোর পাশাপাশি তারক সেই ভূমিকাই পালন করেন। রাজ্যের কয়েকশো দৃষ্টিহীন পড়ুয়ার ভরসার পাত্র তিনি। যিনি এই সব কিছুর জন্য মনে রাখতে চান কলেজ স্ট্রিটের সেই দিনটাকে।

শুধু শারীরিক প্রতিবন্ধকতা নয়, পারিবারিক দারিদ্রের সঙ্গেও তারকের যুদ্ধ আজন্ম। বাবা পঙ্গু। স্বামীকে সামলানো আর ছোট দুই ছেলেমেয়েকে বড় করতে তারকের মা কল্যাণী অন্যের বাড়িতে রাঁধুনির কাজ করেন। সামান্য আয়। তা দিয়েই স্বামীর চিকিৎসা, সংসার চালানো। মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করেছেন। কিন্তু ছেলে দৃষ্টিহীন! উত্তর ২৪ পরগনার গুমার মতো জায়গায় সেই ছেলেকে কোন স্কুল ভর্তি নেবে! ট্রেনে পরিচয় হল এক ‘দিদি’র সঙ্গে। তিনিও দৃষ্টিহীন। সেই ‘দিদি’ই সন্ধান দিলেন কলকাতার টালিগঞ্জের একটি স্কুলের— ‘লাইট হাউস ফর দ্য ব্লাইন্ড’। পাঁচ বছরের তারককে সেখানে ভর্তি করালেন কল্যাণী। দৃষ্টিহীনদের সরকারি সেই স্কুলেই তারকের নার্সারি দিয়ে শুরু। আবাসিক স্কুলে ভর্তি হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই বাবার মৃত্যু।

স্কুলে পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা শুরু হল। দাবায় চোস্ত হয়ে উঠল তারক। সহপাঠীদের কিস্তিমাত করতে ওস্তাদ! মাঝেমাঝে বাড়িতে মা-দিদির কাছে আসে বটে, কিন্তু মন তার স্কুলেই বাঁধা। ‘ব্রেল’ পদ্ধতিতে পড়াশোনা করে অষ্টম শ্রেণি পাশ করল। এর পরে সাধারণ পড়ুয়াদের সঙ্গে পাঠ। কিছুটা ব্রেল, বেশিরভাগটা শুনে শুনে শেখা। ‘রাইটার’ নিয়ে সেই স্কুল থেকেই ২০০৬ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিল তারক। স্টার পেল। ৭৫ শতাংশ নম্বর। মা চাইলেন, ছেলে যখন ভাল ফল করেছে, তখন ব্রেল পদ্ধতির পড়াশোনার বদলে যদি তাকে বাড়ির কাছে কোনও স্কুলে ভর্তি করা যায়। দু’স্টেশন পরের হাবড়া হাই স্কুলে ভর্তি হল তারক। প্রধানশিক্ষক প্রথমে একটু আপত্তি জানিয়েছিলেন। কারণ, ১০০ শতাংশ দৃষ্টিহীন হিসাবে তারক সেই স্কুলের প্রথম ছাত্র। সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দোটানায় পড়েন প্রধানশিক্ষক। তাঁকে বুঝিয়েছিল সদ্য মাধ্যমিক পাশ করা বছর ষোলোর ছেলেটি। তার মাসখানেকের মধ্যেই কলেজ স্ট্রিটের ওই অভিজ্ঞতা।

তারকের সঙ্গে ‘প্রেরণা অডিয়ো লাইব্রেরি’তে ‘শব্দ-বই’ নিতে আসা দৃষ্টিহীন পড়ুয়ারা।

তারকের সঙ্গে ‘প্রেরণা অডিয়ো লাইব্রেরি’তে ‘শব্দ-বই’ নিতে আসা দৃষ্টিহীন পড়ুয়ারা। —নিজস্ব চিত্র।

ঘণ্টাখানেক পর বৃষ্টিটা ধরে এলচারপাশে কে কোথায়, কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। তবে টের পাচ্ছিলাম বৃষ্টিটা সব ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে তিন ঘণ্টা ধরে টানা অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা, তার পরে বৃষ্টি— সব মিলিয়ে চার ঘণ্টা পার। কী করব বুঝতে না পেরে ওই রিকশাটার পাশে দাঁড়িয়েই জোরগলায় বলে উঠেছিলাম, আমাকে কেউ একটু শিয়ালদহ পৌঁছে দেবে? বার দশেক বলার পর একটা হাত এগিয়ে এল। বলল, ‘‘আমি দেব, চলো।’’

সেই চলাটাই তারকের জীবনে নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিল। তবে সে পথে হাঁটার আগে নিজেকে তৈরি করতে হয়েছিল। স্বাবলম্বী হতে হয়েছিল। উচ্চ মাধ্যমিকের কলা বিভাগে স্কুলের মধ্যে অন্যতম ভাল ফল করেছিলেন তারক। ইচ্ছে ছিল বারাসত গভর্নমেন্ট কলেজে ইতিহাসে সাম্মানিক নিয়ে ভর্তি হওয়া। কিন্তু বাধ সেধেছিল অর্থ। তবে ভাল ফলের দৌলতে স্কুলের খবর বাইরেও কিছুটা ছড়িয়ে পড়েছিল। জানতে পেরে মঞ্জু মজুমদার নামে এক মহিলা বিদেশ থেকে আর্থিক সাহায্য করেছিলেন তারককে। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর শিক্ষকেরা আবার চিন্তিত— সাধারণ পড়ুয়াদের ভিড়ে তারকের মতো দৃষ্টিহীন ছাত্রের প্রতি তাঁরা যত্নশীল হতে পারবেন তো! তারকই উল্টে শিক্ষকদের ভরসা দিলেন। স্নাতক স্তরেও ভাল ফলাফলের পর রাজ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স। ইতিহাসেই। কিন্তু সমস্যা অনেকগুলি। প্রথমত, ব্রেল পদ্ধতিতে বইয়ের সংখ্যা খুব কম। দ্বিতীয়ত, মাস্টার্সে যত রকমের রেফারেন্স বই দরকার, বিশ্ববিদ্যালয়ে তা নেই। আবার অডিয়ো বই রেকর্ড করার খরচও প্রচুর। তখন টেপ রেকর্ডারের যুগ। এক একটা খালি ক্যাসেটের দাম প্রায় ৪০ টাকা। পাঠ্যপুস্তক কেউ পাঠ করে ক্যাসেটে রেকর্ড করে দেবেন, তার খরচ সামলানোর মতো অর্থ তারকদের ছিল না। সেই সমস্যার বৈতরণীও নানা ভাবে পার করেছিলেন তারক।

২০১১ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসলেন। ২০১২ সালে ফলপ্রকাশ। ২০১৩ সালে ইন্টারভিউ। ২০১৪ সালে চাকরি পেলেন তারক। মধ্যমগ্রামের দোহারিয়া বিধানপল্লি হাই স্কুলে। সেখানেও বিপত্তি। কো-এডুকেশন স্কুল কর্তৃপক্ষ তারকের মতো সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন শিক্ষক নিতে নিমরাজি। তারকই তাঁদের ভরসা জুগিয়ে কয়েক দিনের মধ্যে হয়ে উঠলেন পড়ুয়াদের প্রিয় শিক্ষক। প্রধানশিক্ষক সুজিতকুমার মণ্ডল বলছিলেন, ‘‘প্রথম যখন ওকে দেখি, আমরা খুব উদ্বিগ্ন ছিলাম! ও কী ভাবে কাজ করবে দোতলা স্কুলে! ক্লাসে যাবে কী করে? ছাত্রছাত্রীরা কী ভাবে নেবে? কিন্তু ওর উদ্যম দেখে আমরা স্তম্ভিত! ও যে ভাবে কাজ করছে, সেটা আমাদের কাছে অনুপ্রেরণা।’’ চাকরিটা পেয়ে যাওয়ার পরেই তারকের আর এক স্বপ্নের বাস্তবায়ন শুরু হবে। যে স্বপ্নের বীজ বপন হয়েছিল কলেজ স্ট্রিটের সেই বৃষ্টিভেজা দিনে।

তারক গত ২০২০ সাল থেকে যে কাজে নেমেছেন, তা রাজ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোথাও নেই— দৃষ্টিহীনদের জন্য পাঠ্যপুস্তকের অডিয়ো লাইব্রেরি।

তারক গত ২০২০ সাল থেকে যে কাজে নেমেছেন, তা রাজ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোথাও নেই— দৃষ্টিহীনদের জন্য পাঠ্যপুস্তকের অডিয়ো লাইব্রেরি। —নিজস্ব চিত্র।

হাত ধরে ছেলেটি আমাকে বলল, ‘‘চলো।’’ হালকা বৃষ্টিতে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলাম দু’জনেছেলেটির নাম এখন আর মনে নেই। তবে হাতের স্পর্শটা মনে আছে। ওর পরের বার মাধ্যমিক। অঙ্কের কী একটা সহায়িকা বই কিনতে এসেছিল কলেজ স্ট্রিটে। আমার চিৎকার শুনে এগিয়ে এসেছিল। আমি কোথায় থাকি, কেন কলেজ স্ট্রিট এসেছি— সব শুনল। কী বই কিনতে এসেছিলাম তা-ওআমিও ওর কথা শুনছি। কখন যে শিয়ালদহ চলে এসেছি বুঝতে পারিনিছেলেটি বলল, আমরা ফ্লাইওভারের তলায় পৌঁছে গিয়েছি। একটা জায়গায় থেমে আমার হাতটা ছেড়ে বলল, ‘‘তুমি এখানে একটু দাঁড়াও। আমি আধ ঘণ্টার মধ্যেই চলে আসব। তুমি কিন্তু চলে যেয়ো না। আমি তোমাকে ট্রেনে তুলে দেব’’

তারকের মনের ট্রেন বাঁক নিয়েছিল সে দিন। চাকরি পাওয়ার পর সেই ইচ্ছেগুলো কাজ করতে শুরু করল। প্রথমটা রেশন। দুঃস্থ মহিলাদের চাল, ডাল, তেল, নুন, মশলা, সাবান-সহ বিভিন্ন গেরস্থালির জিনিসপত্র দেওয়া। এখনও তারক এ কাজ করেন। মাসে এক বার। গুমা স্টেশন থেকে এই ‘রেশন’ বিলি করেন তারকের সতীর্থেরা। প্রায় দুশো মানুষ প্রতি মাসে এই সাহায্য পান। এখনও। দ্বিতীয় কাজ, ‘প্রেরণা’ নামের এক সংগঠন তৈরি। দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ানোই যার প্রধান উদ্দেশ্য। অভাবী পরিবারের চিকিৎসা থেকে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা— সব কিছুতে সাহায্য করতে চান তারক। জনা কুড়ি অনাথ বাচ্চার দায়িত্বও নিয়ে ফেলেছেন। তাদের বইখাতা থেকে শুরু করে স্কুলের খরচ— সব তারক সামলান। আলাদা করে দৃষ্টিহীনদের জন্যও ভাবছিলেন তারক। প্রথমে প্রেরণার উদ্যোগে ‘দাবা প্রতিযোগিতা’। স্কুলজীবনের দাবার প্রতি ভাল লাগা থেকেই এই উদ্যোগ। সারা বাংলা থেকে প্রতি বার এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে আসেন অন্তত ৮০ জন দৃষ্টিহীন।

তবে তারক গত ২০২০ সাল থেকে যে কাজে নেমেছেন, তা রাজ্যে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া আর কোথাও নেই— দৃষ্টিহীনদের জন্য পাঠ্যপুস্তকের অডিয়ো লাইব্রেরি। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে দৃষ্টিহীন পড়ুয়ারা তারকের এই লাইব্রেরিতে আসেন শব্দবই (অডিয়ো বুক) নিতে। দৃষ্টিহীনদের জন্য পাঠ্যপুস্তকের অভাব চিরকালীন। ব্রেল পদ্ধতিতে বইয়ের সংখ্যা খুব কম। রেফারেন্স বই নেই বললেই চলে। ‘অডিয়ো বুক’ তেমন ভাবে নেই। থাকলেও তার দাম অনেক। তারক ‘প্রেরণা অডিয়ো লাইব্রেরি’তে অডিয়ো বুক তৈরি করেন। তার পর তা বিনামূল্যে তুলে দিচ্ছেন দৃষ্টিহীন পড়ুয়াদের হাতে। রাজ্যের শ’খানেক ছাত্রছাত্রী তারকের অডিয়ো বুকের উপর ভরসা করেই পড়াশোনা চালিয়ে যান। আর তারকের মনে পড়ে যায় তাঁকে ভরসা দেওয়া সেই হাতটার কথা।

ছেলেটি বলে গেল, আধ ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসবে। কেন জানি না, কথাগুলো বিশ্বাস করতে মন চাইল। আধ ঘণ্টার মধ্যেই ছেলেটি ফিরে এল। আমার হাতে একটা বই ধরিয়ে বলল, ‘‘এই নাও, এই বইটা আমি তোমাকে দিলাম।’’ যে বইটা দিল, সেটাই আমার দরকারি সেই বইটা! আমি আবার কেঁদে ফেললাম। ছেলেটা আমার হাতটা তখনও ধরে ছিলবলল, ‘‘ট্রেন ছেড়ে দেবে। চলো।’’ ট্রেনে উঠিয়ে দেওয়ার পর জানলার বাইরে দাঁড়ানো ছেলেটিকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি এটা কেন আমাকে দিলে? ও আমার হাতটা ধরে বলেছিল, ‘‘তোমার তো বই পড়তে সময় লাগেআমারটা ক’দিন পরে কিনলেও হবে। আমি মেকআপ করে নিতে পারব।’’

সেই ট্রেনযাত্রায় এক অদ্ভুত অনুভূতি নিয়ে চলেছিল তারক। কলেজ স্ট্রিটে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকার সময়ে মানুষের প্রতি যে অবিশ্বাস আর অভিমানের জন্ম হয়েছিল, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে তা বদলে দিয়ে চলে গিয়েছিল অচেনা একটি ছেলে। ক্লাস ইলেভেনের তারক ঠিক করে নিয়েছিল, সে-ও এ ভাবেই অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াবে। এখন তারক যে কাজ করেন, তাতেও টাকার দরকার হয়। একটি সাধারণ পাঠ্যবইয়ের দাম যদি ৫০০ টাকা হয়, তার ‘অডিয়ো বুক’ তৈরি করতে প্রায় তিন হাজার টাকা লাগে। তারকের সতীর্থ প্রণবেশ দাসের ব্যাখ্যায়, বই বাজার থেকে কিনতে হবে ৫০০ টাকায়। তার পর রিডারকে দিয়ে সেটি পাঠ করিয়ে রেকর্ড করাতে হবে। এর জন্য পৃষ্ঠাপ্রতি রিডার নেবেন ৬ টাকা। ৩০০ পৃষ্ঠার বই হলে রিডার নেবেন ১,৮০০ টাকা। রেকর্ড যদিও ‘প্রেরণা’র নিজস্ব কম্পিউটারে হয়। এর পরে সম্পাদনা। তার পর মেমরি কার্ডে করে পড়ুয়ার হাতে তুলে দেওয়া। সব মিলিয়ে খরচ অতটাই হয় বলে জানালেন প্রণবেশ। অডিয়ো লাইব্রেরি তৈরিতে তাঁর মতোই তারকের পাশে দাঁড়িয়েছেন রাজীব, রজত, অনিন্দ্যেরা।

তারকের আর এক সহযোগী বিনয় সরকার জানালেন, বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের পড়ুয়ারা হোয়াট্‌সঅ্যাপে যোগাযোগ করেন তারকের সঙ্গে। বিনয়ের কথায়, ‘‘উনি নিজে প্রযুক্তিগত ভাবে ভীষণ সচল। দুটো মোবাইলই টকিং সফ্‌টঅয়্যারে চলে। কী বই চাই হোয়াট্‌সঅ্যাপে তা জানালে তারক নিজে সেই বই কিনে অডিয়ো বুক তৈরি করে পড়ুয়ার সঙ্গে আবার যোগাযোগ করে জানিয়ে দেন, কবে এলে বই পাওয়া যাবে। সেই মতো পড়ুয়ারা এসে অডিয়ো বুকের মেমরি কার্ড নিয়ে যান।’’

এমনই এক পড়ুয়া আকাশ প্রধান। উত্তর ২৪ পরগনারই মিনাখাঁর বাসিন্দা আকাশ নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশন আবাসিক কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের তৃতীয় বর্ষের পড়ুয়া। তিনি নিয়মিত আসেন তারকের লাইব্রেরিতে। আকাশ বলছিলেন, ‘‘আমরা দৃষ্টিহীনেরা পিছিয়ে রয়েছি। আপডেট থাকতে গেলে প্রচুর রেফারেন্স বই পড়তে হয়। আমাদের ক্ষেত্রে সেই বই প্রায় নেই বললেই চলে। ফলে এক জন দৃষ্টিহীন পড়ুয়া তাঁর সাধারণ সহপাঠীর থেকে অনেকটাই পিছিয়ে থাকেন। তারকদার লাইব্রেরি তাই আমাদের কাছে লাইট হাউসের মতো। আমি প্রায় নিয়মিতই আসি। কলেজ কর্তৃপক্ষও তাতে সম্মতি দিয়েছেন।’’

এলাকা জুড়ে এখন তারক এক পরিচিত নাম। যে এলাকায় তাঁর বাড়ি, সেই অশোকনগর থানার অফিসার ইনচার্জ অয়ন চক্রবর্তী যেমন বলছিলেন, ‘‘বেশ কয়েক বছর ধরে তারকবাবুদের কাজ দেখার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। সমাজের জন্য এ কাজ অত্যন্ত বিরল। এক জন দৃষ্টিহীন মানুষ যে ভাবে অন্যদের পাশে দাঁড়াতে সর্ব ক্ষণ লড়ে যাচ্ছেন, তা শুধু প্রশংসনীয় বললে কম বলা হয়। ওঁকে কুর্নিশ করি আমরা। প্রশাসন যতটা সম্ভব ওঁর পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করবে।’’

তারককে ঘিরে রয়েছে তাঁর পরিবারও। মা কল্যাণী এখন অনেক স্বস্তিতে। ছেলের কাজে গর্বিত। মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন হাবড়ায়। জামাই কাঠমিস্ত্রি। তারকেরও বিয়ে দিয়েছেন। সুপ্রিয়ার সঙ্গে তারকের সম্পর্ক চাকরি পাওয়ার আগে থেকেই। বিয়ের পর তিনি আছেন তারকের পাশে। তারক-সুপ্রিয়ার একমাত্র ছেলে তৃষাণ। কল্যাণী তা-ও ছেলেকে একটু বকাঝকা করেন বাড়িতে সময় না-দেওয়ার জন্য। কিন্তু সুপ্রিয়া স্বামীকে আগলে রাখেন।

সে দিন ওই ছেলেটি আমার জীবনের লক্ষ্য ঠিক করে দিয়েছিল। ওই দিন ঠিক করেছিলাম, চলার পথে যে সাহায্য আমি পেয়েছি, সেই সাহায্য অন্য দৃষ্টিহীনদের করব। পাশে থাকব দুঃস্থদের। সেই লক্ষ্যে অবিচল থেকেই প্রথমে চাকরি পেতে চেয়েছি। চাকরি না পেলে আমার মতো প্রতিবন্ধী মানুষের আর্থিক ঋজুতা তৈরি হয় না। সেটা হওয়ার পর নিজের ইচ্ছেমতো কাজ শুরু করেছি। হয়তো বেতনের অর্ধেক টাকা এ সব কাজেই খরচ হয়ে যায়। কিন্তু তাতে কী! সকলের সঙ্গে বাঁচাকেই তো সত্যিকারের বাঁচা বলে। যত দিন পারব, এটাই করব। আর একটা লক্ষ্য আছে, তৃষাণকে মানুষ করে তোলা। ও যেন আমাদের সহমর্মিতায় না দেখে, সমমর্যাদায় দেখে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy