সারা বছর শুধু বড়দের জন্য ভারী ভারী শব্দ সাজিয়ে রচনার পাহাড় বানাই কিন্তু তোমাদের, ছোটদের, জন্য জমিয়ে রাখা লেখার পাতাগুলো সাদাই রয়ে যায়। কলমের একটা আঁচড়ও তাতে পড়ে না। অথচ তোমরাই আমাদের সব কিছু— আমাদের ভবিষ্যত্, আশা, ভরসা। তোমরা, ছোটরা, না থাকলে এই পৃথিবীটাই আমাদের কাছে অর্থহীন হয়ে যেত। তোমাদের মুখের হাসির মূল্য পৃথিবীর সব সম্পদের চেয়েও বেশি আর তোমাদের চোখের জল— না না, সে আমরা দেখতে চাই না, কারণ, তোমাদের চোখের জল মানে আমাদের বুক ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া। হ্যঁা গো আমার ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা আমাদের কাছে এমনই ফুলের মতো সুন্দর আর ভোরের প্রথম আলোর মতো পবিত্র। বছরের অন্য লেখাগুলোয় বড়দের জন্য শব্দ খরচ করলেও এই লেখাটা কিন্তু শুধু তোমাদের জন্যেই।
মাঝে মাঝে আমার কী মনে হয় জানো? তোমাদের মনের ভেতর এত বিচিত্র সব কল্পনার জগত্ রয়েছে যে, মনে হয় কেন যে ভগবান আমাকে চিরকাল তোমাদের মতো ছোট্টটি করে রাখলেন না! তা হলে রূপকথার দেশ, ভূতপেন্তি দত্যিদানোর দেশ, আজব কল্পনার দেশ— এ সব আরও ভাল করে মনে মনে ঘুরে আসতে পারতাম। তা সে তো হওয়ার নয়। সবাইকে একদিন নিজেদের ছোট্টবেলাটাকে পিছনে ফেলে রেখে আসতে হয়। কিন্তু আমরা যত বড় হই ততই যেন সেই ছোট্টবেলার স্মৃতিগুলো মনের মধ্যে স্থায়ী আসন করে নিতে থাকে। পৃথিবীর কোনও মানুষই তার ছোটবেলার কথা ভুলতে পারে না।
ছোটবেলায় আমরা সবাই গল্প শুনতে খুব ভালবাসি। আমরা তো আমাদের ছোটবেলাটা ফেলে এসেছি। এখন কে আমাদের গল্প শোনাবে বলো? কিন্তু আমি জানি, তোমরা এখনও উন্মুখ হয়ে থাকো কবে তোমাদের দাদু, দিদা বা ঠাম্মারা আসবে আর তোমাদের নানা রকমের গল্প বলবেন অথবা সারাদিনের স্কুল, খেলা, পড়াশোনা বা রুটিনে বাঁধা দিনের শেষে কখন রাত আসবে আর মায়ের ঠিক পাশটিতে শুয়ে তোমরা বায়না করবে, মা একটা গল্প বলো। আর তোমাদের মায়েরা সারা দিনের পরিশ্রমের শেষে ঘুমজড়ানো চোখে ঠিক তোমাদের জন্য গল্প বলে চলবেন যতক্ষণ না তোমরা হারিয়ে যাবে স্বপ্নের দেশে।
আজ তা হলে তোমাদের একটা গল্পই বলি, কী বলো? এটি তোমাদের জন্যই লিখে গিয়েছিলেন আমাদের সবার ভীষণ প্রিয় সাহিত্যিক সুকুমার রায়। তোমরা সকলে চুপ করে বসেছ তো? শুরু করি তা হলে?
একটি ছেলে, বিশাল তার শরীর। কী তার শক্তি, কী তার তেজ। কিন্তু এমন ছেলে অল্প বয়সেই তার সঙ্গীসাথীদের ছেড়ে চলে গেল। যাওয়ার সময় সে বলে গেল, যদি কখনও রাজার মতো রাজা পাই, তবে তার গোলাম হয়ে থাকব। ছেলেটির নাম কী ছিল জান? অফেরো।
অফেরো তেমন রাজার সন্ধানে কত দেশ ঘুরল। কাউকেই মনে ধরে না। অবশেষে সে এমন একটা দেশে পৌঁছল যেখানে রাজার নামে সবাই ভয়ে কাঁপে। কেউ অন্যায় করতে সাহস পায় না। চুরি করতে ভয় পায়। রাজার প্রতাপে সবাই থরহরি কম্প। হ্যঁা, রাজার মতো রাজা বটে। অফেরোর মনে ধরল এই রাজাকে। সে এই রাজার চাকর হয়ে রইল। রাজার পাশে অফেরো সর্বদাই খাড়া। ভীষণ বিশ্বস্ত সে। অফেরোকে নইলে রাজার চলে না। এমন ভাবে বেশ দিন চলে যাচ্ছিল।
কিন্তু একদিন রাজসভায় শয়তানের নাম ওঠায় রাজা কেমন গম্ভীর হয়ে গেলেন। অফেরো অবাক হল। সে রাজামাশাইকে জিগ্যেস করল, আপনার মুখে হাসি নেই। কী এত ভাবছেন মহারাজ? রাজা বললেন, এই শয়তান আর মৃত্যু— এ ছাড়া আমি আর কাউকে ভয় পাই না।
রাজার মুখে এমন উত্তর শুনে অফেরোর মাথায় হাত। হায় হায়! এ কোন রাজার গোলামি করতে এলাম, যে শয়তানকে ডরায়। যাই এ বার শয়তানের কাছে। দেখি সে কত বড় তালেবর।
এই ভেবে সে শয়তানের খোঁজ করতে লাগল। কত লোককে অফেরো শয়তানের কথা জিগ্যেস করল। সবাই এড়িয়ে যায়, শয়তানের খবর কি কেউ দিতে পারে! ঘুরতে ঘুরতে একদিন কতগুলো নিষ্কর্মা লোকের মাঝে শয়তানকে পাওয়া গেল। অফেরোর মতো এমন লোক পেয়ে শয়তান তো বেজায় খুশি। শয়তান অফেরোকে নিজের শক্তি দেখায়। বলে, দেখো, আমার কথায় লোকে ওঠে বসে। কী ধনী, কী দরিদ্র আমার হাত থেকে কারও নিস্তার নেই। যেখানে মারামারি, শঠতা, তঞ্চকতা—সেখানেই শয়তানের জয়।
অফেরো সব দেখে শোনে, কিন্তু কাজে তার মন লাগে না। সে কোনও শান্তি পায় না। ভাবে এ কেমন ধারা কাজ। এমন করেই শয়তানের কাছে অফেরোর দিন কাটতে থাকে। শয়তান বেশ স্ফূর্তিতে আছে অফেরোকে পেয়ে। এ দিক সে দিক তারা ঘোরাঘুরি করে। অফেরোকে সঙ্গে নিয়ে যেতে যেতে একদিন হঠাত্ শয়তান থমকে গেল। সে পথ পরিবর্তন করে চলতে শুরু করল। অফেরো অবাক হল, কী ব্যাপার, ঘুরপথে চললেন যে? শয়তান বলল, ওই দ্যাখো, ওটা কী? অফেরো তাকিয়ে দ্যাখে একটা ক্রুশের গায়ে এক মানুষের মূর্তি আঁকা। মাথায় তাঁর কাঁটার মুকুট, শরীরে রুধিরধারা। অফেরো জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে শয়তানের দিকে, কে ইনি? শয়তান বলে, ওঁর কাছে আমি যাই না। ওই মানুষটি আমাকে ভয় পায় না। মৃত্যুকেও ভয় পায় না। ওঁকে দেখলেই আমি দূরে সরে যাই।
অফেরো হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। যাক, শয়তান তুমিও তা হলে ভয় পাও। ভালই হল, তোমার কাজ করতে আমার আর ভাল লাগছিল না। আমি সেই মানুষটির সন্ধানে চললাম যিনি তোমাকে ভয় পান না। যদি তাঁকে পাই, তা হলে তাঁর গোলাম হয়ে থাকব।
এই বলে অফেরো আবার পথ চলতে থাকে। যার সঙ্গেই দেখা হয়, তাকেই জিগ্যেস করে, ক্রুশের মানুষকে কোথায় পাব বলতে পারো। সবাই বলে, খোঁজো, এক দিন না এক দিন তুমি তাঁকে নিশ্চয়ই পাবে।
এমনই ভাবে চলতে চলতে অফেরোর সঙ্গে এক যাত্রীদলের দেখা হল। তারা পথশ্রমে শ্রান্ত, ক্লান্ত— তবু তাদের মুখে হাসি। অফেরোর বড় ভাল লাগল, তোমরা কোথায় যাচ্ছ? তারা বলল, ক্রুশের মানুষ যিসাস ক্রাইস্ট— তিনি যে পথে গেছেন, সেই পথের খোঁজেই আমরা চলেছি।
সে পথ অনেক দূর। কত রাত কত দিন কেটে যায়, পথের শেষ কোথায়? চলতে চলতে, চলতে চলতে এক সময় সাঁঝের আঁধারে সে পথের শেষ দেখা গেল। ও পারে স্বর্গ, এ পারে পথ, আর মধ্যিখানে অন্ধকার নদী। নদীতে নৌকো নেই, নদীর কূল দেখা যায় না। মাঝে মাঝে কার ডাক আসে, পার হয়ে এসো। অফেরো মনে মনে ভাবে, এই অন্ধকার নদী কী ভাবে মানুষ পার হবে! কত অসহায় অন্ধ, খঞ্জ, অসুস্থ, বৃদ্ধ, শিশু— কে এদের পার করে দেবে এই কূলহীন নদী! বয়স্ক মানুষেরা বললেন, যখন ডাক পড়বে, তখন দূত আসবে।
সত্যি সত্যিই দূত এসে এক সময় ডাক দিল। এক রোগজীর্ণ ছোট্ট মেয়ের ডাক এল। সে বেচারি অসুখে ভুগে ভুগে হাঁটতে চলতে পারে না। সামনে অন্ধকার নদী। ঘূর্ণির মতো ফেনিয়ে উঠছে তার জল। কী করে পার হবে সে এই নদী? চোখ ফেটে জল এল মেয়েটির। দুই হাতে মুখ ঢাকল সে। মেয়েটির দুঃখ অফেরো সহ্য করতে পারল না। সে চিত্কার করে বলে উঠল, ভয় নেই— কোনও ভয় নেই— আমি আছি। কোথা থেকে পেল সে অমিত শক্তি। মেয়েটিকে মাথায় নিয়ে সে পার হয়ে গেল ওই ঘোর আঁধারসঙ্কুল ভয়াল নদী। মেয়েটিকে ও-পারে নামিয়ে দিয়ে সে বলল, যদি কখনও ক্রুশের মানুষের দেখা পাও, তা হলে তাঁকে বলো এই কাজ আমার খুব ভাল লেগেছে। যত দিন না আমার ডাক আসে, আমি এই কাজই করব।
তখন থেকে অফেরোর কাজ হল নদী পারাপার করা। দিনের পর দিন রাতের পর রাত ঝড়বৃষ্টি, তুফান মাথায় নিয়ে সে কত মানুষকে পার করে দেয় এই নদী। এই কঠিন কাজ সে হাসি মুখে অবিরাম করে চলে।
একদিন গভীর রাতে খুব ঝড় উঠল। অঝোরে নামল বৃষ্টি। নদীর স্রোত গর্জন করে উঠে সব কিছু ভাসিয়ে দিতে লাগল। সে দিন অফেরো বড় শ্রান্ত। এই দুর্যোগের রাতে আর কে আসবে, এই ভেবে সে ঘুমিয়ে পড়েছে। হঠাত্ ঘুমের মধ্যে সে শুনতে পেল এক শিশুকণ্ঠের ডাক। খুব মিষ্টি আর রিনরিনে গলায় কে যেন বলছে, আমি এখন পার হব। কেউ আছ, আমাকে পার করে দাও। অফেরো ঘুম ভেঙে উঠে বসল, এই দুর্যোগের রাতে এই শিশুটি পার হবে। কোনও ভয় নেই, আমি আছি। আমি তোমাকে পার করে দেব। এই বলে শিশুটিকে কাঁধে নিয়ে সে পার হয়ে গেল ওই ভয়ঙ্কর নদী।
কিন্তু ও পারে পৌঁছনো মাত্র তার সারা শরীর অবশ হয়ে এল। চোখ ঝাপসা, গলার স্বর জড়িয়ে গেল। মনে হল এই বুঝি তার শেষ পারাপার। তার পর সে যখন চোখ মেলল, কোথায় ঝড়, কোথায় বৃষ্টি। চার দিক শান্ত নিস্তব্ধ— শুধু তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন এক মহাপুরুষ, মাথায় তাঁর আলোর মুকুট। তিনি বললেন, আমি ক্রুশের মানুষ। এত কাল তুমি কত লোককে পার করেছ। আজ আমাকে পার করতে গিয়ে তুমি নিজেই পার হয়ে এলে। আজ থেকে তোমার নাম হল সেন্ট ক্রিস্টোফার। স্বর্গের শ্রেষ্ঠ সাধুদের মাঝে তুমি আনন্দে বাস করো।
ছোট্ট বন্ধুরা, দেখলে তো রাজার রাজাকে খঁুজতে গিয়ে অফেরো কী ভাবে সেন্ট ক্রিস্টোফার হলেন প্রভু যিসাস ক্রাইস্টের আশীর্বাদে। ভারী চমত্কার না গল্পটা। আমরাও কিন্তু সারা জীবন ধরেই সেই রাজার রাজাকেই খুঁজে চলি। হয়তো বা আমাদের অজান্তেই। আমাদের মধ্যে যাঁরা অফেরোর মতো সকল দুঃখ কষ্টকে সহ্য করে অপরের জন্য জীবনপাত করে তাঁরাই কেবল পৌঁছতে পারেন সেই পরম পুরুষের কাছে।
আমার সেই সব ছোট্ট বন্ধুরা, তোমরা যারা নিজেদের শৈশবকে বলি দিয়ে উদয়াস্ত পরিশ্রম করে চলো, তোমরা যেন হার মেনো না। ঈশ্বরের ওপর বিশ্বাস রাখো, নিশ্চয়ই কেউ না কেউ আমাদের সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেবেন।
এই বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার পেলেন যিনি, আমাদের ভারতের কৈলাস সত্যার্থী শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে কাজ করে চলেছেন সেই ১৯৮০ সাল থেকে। গড়ে তুলেছেন ‘বচপন বাঁচাও’ আন্দোলন। কত শিশুশ্রমিক এর ফলে শিক্ষার আলো পেয়েছে, নিজের পায়ে দাঁড়াতে পেরেছে। আর একজন পাকিস্তানের মালাল ইউসুফজাই মাত্র সতেরো বছর বয়সে কৈলাস সত্যার্থীর সঙ্গে যিনি ভাগ করে নিলেন নোবেল শান্তি পুরস্কার— দুর্দমনীয় সাহস আর জেদ না থাকলে আজ কি তিনি এই জায়গায় আসতে পারতেন? এতটুকু মেয়ে, যে তালিবানি হুমকিতে একটুও ভয় না পেয়ে নিজের জীবন বাজি রেখে শিক্ষার আলো প্রচারে নিরন্তর সংগ্রাম চালিয়ে গেছে। গুলি খেয়েও যে ফিনিক্স পাখির মতো উঠে এসেছে ধ্বংসস্তূপ থেকে।
এঁরা আমাদের অনুপ্রেরণা, ছোট্ট বন্ধুরা। তোমরাও কখনও হাল ছেড়ো না। ভাল কিছু করতে গেলে জেনো কাউকে না কাউকে তোমার পাশে পাবে আর সেটাই ঈশ্বরের আশীর্বাদ। তোমরা ভাল থাকো আর আগামী ১৪ নভেম্বর শিশু দিবস তোমরা নিজেদের মতো করে উদযাপন করো কারণ দিনটা যে তোমাদেরই। আজ আসি। তোমাদের জন্য রইল অনেক অনেক আদর আর ভালবাসা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy