নরেন্দ্র মোদীর ‘গুজরাত মডেল’ নিয়ে শিল্পমহলের একাংশের তুমুল উচ্ছ্বাসের মধ্যেই বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী প্রার্থীর অর্থনৈতিক দিশা নিয়ে তীব্র আক্রমণ শানালেন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম। তাঁর বক্তব্য, নরেন্দ্র মোদী ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’-এর প্রতীক— যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর স্বার্থে নীতি নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে চিদম্বরমের তোপ, “মোদীর এই কাজকর্মের ধারণার সঙ্গে কিছু বৃহৎ শিল্পসংস্থা স্বচ্ছন্দ বলেই তাদের সঙ্গে মোদীর এত দহরম মহরম!”
অবশ্য শুধু অর্থনীতির প্রশ্নে নয়, রাজনৈতিক ভাবেও আজ মোদীর বিরুদ্ধে ঝাঁঝালো আক্রমণ শানান চিদম্বরম। এ দিন তিনি বলেন, “ওঁর বড় ধরনের চারিত্রিক খামতি রয়েছে। ভোট প্রচারে এমন সব কুকথা বলছেন যে, ওঁকে প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ভাবতেই লজ্জা হচ্ছে!”
লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেসের একজন বর্ষীয়ান নেতা হিসেবে চিদম্বরম যে বিজেপি বা মোদীকে নিশানা করবেন, তা প্রত্যাশিত। কিন্তু ‘মোদী ভজনার’ কারণে বড় শিল্প সংস্থাকে তিনি যে ভাবে কটাক্ষ করলেন, তাতে অনেকেই বিস্মিত। কারণ জাতীয় স্তরে যুযুধান দুই দল কংগ্রেস ও বিজেপি কেউই সাধারণত বড় শিল্প সংস্থাগুলিকে চটাতে চায় না।
তা হলে ঘটনা কী? বস্তুত, শিল্পপতিদের অনেকেই মোদীর ভূমিকায় উচ্ছ্বসিত। বিভিন্ন মঞ্চে তাঁরা বহু বার মোদীর প্রশংসাও করেছেন। মোদী বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার পরে সেই প্রশংসা আরও বেড়েছে। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কেন্দ্রে ইউপিএ সরকারের নীতিপঙ্গুত্ব ও আর্থিক নীতি সম্পর্কে কিছু শিল্প কর্তার প্রকাশ্য সমালোচনা। সব মিলিয়ে বেশ কিছু দিন ধরেই শিল্পপতিদের একাংশ সম্পর্কে কংগ্রেসের অন্দরে ক্ষোভ বাড়ছিল। কংগ্রেসের অনেকের মতে, কেন্দ্রে সরকার গড়ার ব্যাপারে মোদী তথা বিজেপি অনেক এগিয়ে রয়েছে বলে যে ধারণা তৈরি হয়েছে, তার পিছনেও কিছু শিল্প সংস্থার হাত রয়েছে। সে কারণেই আজ মোদীর পাশাপাশি সেই সব শিল্প সংস্থাকেও বিঁধেছেন চিদম্বরম।
তবে অনেকেই মনে করছেন, চিদম্বরমের এ ভাবে সরব হওয়ার নেপথ্যে কংগ্রেসের অন্য রাজনীতিও রয়েছে। শহুরে মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তদের বড় অংশ যখন মোদীতে মজেছে, তখন চিদম্বরমরা এ বার গ্রাম ও শহরের গরিব মানুষের মন পেতে মরিয়া। পুঁজিবাদের সমালোচনা করে যে অংশের ভোট টানার চেষ্টা করেন প্রকাশ কারাটরা, এ বার তাঁদের দিকেই নজর দিতে চায় কংগ্রেস। ক’দিন আগে রাহুল গাঁধী যে নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করেছেন, তারও লক্ষ্য এই বিপুল সংখ্যক মানুষ।
স্বাভাবিক ভাবেই চিদম্বরমের এই আক্রমণের জবাব দিয়েছে বিজেপি। দলের নেতা রবিশঙ্কর প্রসাদ বলেন, “এত সহজে মানুষকে বোকা বানাতে পারবেন না চিদম্বরম। লোকে টু-জি কাণ্ডের কথা ভোলেনি। পাইয়ে দেওয়ার পুঁজিবাদের অভিযোগে চিদম্বরম নিজেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে।”
আক্রমণ শানিয়েছে সিপিএম-সহ বামেরাও। তাদের বক্তব্য, চিদম্বরম বরাবরই পুঁজিবাদের বড় সমর্থক। বৃহৎ শিল্প গোষ্ঠীর স্বার্থ দেখতে গিয়ে সাধারণ মানুষের উপর বোঝা চাপাতেও তিনি দ্বিধা করেননি। তা ছাড়া, বিজেপি বা কংগ্রেসের অর্থনৈতিক নীতিও এক। সিপিএম নেতা সীতারাম ইয়েচুরির কথায়, “দু’দলই একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। দু’দলই পুঁজিবাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু!”
বিজেপি নেতারা অবশ্য এক দিক থেকে খুশি। দলের একাংশের বক্তব্য, মোদীকে ঠেকাতে কংগ্রেস এখন মেরুকরণের রাজনীতি করছে। কিন্তু মোদী চাইছেন বিতর্ক হোক উন্নয়নের প্রশ্নে। সেই কারণেই ইউপিএ-র অর্থনীতিকে আক্রমণ করে গত কাল ১৮টি প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছিলেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী যশবন্ত সিন্হা। তার পরেই আজ চিদম্বরমের মন্তব্যকে ‘ফাঁদে পা দেওয়া’ বলছেন বিজেপি নেতারা।
যদিও কংগ্রেসের অনেকেই মনে করেন না যে, চিদম্বরম বিজেপি-র ফাঁদে পা দিয়েছেন। বরং অনেক দিন পর আজ দেখা গেল চিদম্বরমকে নিয়েও খুশি হতে পারেন কংগ্রেসের নেতারা! অনেকেই বলছেন, এ দিন কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি যে ভাবে যশবন্তের সমালোচনার জবাব দিয়েছেন, সেটা তাঁর কাজ। কিন্তু যে ভাবে তিনি মোদীকে ‘পুঁজিপতিদের বন্ধু’ হিসেবে তুলে ধরলেন, তাতে নিম্নবিত্তদের কাছে কংগ্রেসের গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।
এ বার চিদম্বরম তামিলনাড়ু শিবগঙ্গা কেন্দ্র থেকে ভোটে লড়ছেন না। সেই কেন্দ্রে দাঁড় করিয়েছেন ছেলে কার্তি চিদম্বরমকে। কংগ্রেস সূত্র বলছে, রাহুল চাইছেন, চিদম্বরম, আনন্দ শর্মার মতো মন্ত্রিসভার যে শীর্ষ সদস্যরা ভোটে লড়ছেন না, তাঁরা অন্তত প্রচারে নামুন। বিশেষ করে মোদীর উন্নয়ন নিয়ে যে প্রচার হয়, তার মোকাবিলা করুন। আজ সেই সূত্রেই চিদম্বরমকে মাঠে নামায় কংগ্রেস।
চিদম্বরমের আগেই আজ সকালে মোদীর সমালোচনায় মুখর হন কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী শরদ পওয়ার। এনসিপি নেতার কথায়, “বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী যা তা বলছেন! ওঁকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত!” বস্তুত মোদীর বিরুদ্ধে আক্রমণ পওয়ার যেখানে শেষ করেছেন, চিদম্বরম শুরু করেন সেখান থেকেই। বলেন, “বিজেপি-র প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী ভোট প্রচারে কুকথা বলার থেকে নিজেকে কোনও ভাবেই সংযত করতে পারছেন না। আসলে এটা তাঁর বড় ধরনের চারিত্রিক খামতি। এমন একটি লোক প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী, ভাবতেই লজ্জা করছে!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy