প্রচারে মিসা ভারতী। পাটলিপুত্রে। —নিজস্ব চিত্র।
গ্রামের ধুলো ওড়া রাস্তায় কুড়ি-বাইশটি ঝাঁ চকচকে গাড়ির লম্বা কনভয়। কনভয়ের সামনে মাইকে তারস্বরে বাজছে চটুল সুরের গান: ‘লালটেন নিশানি লেকে আইওল বারি... লালুকে দুলহারি বেটি মিসা ভারতী বারি... আন্দোলনকারী...।” কখনও বাজছে: “মিলে গা, মিলে গা তুমহারা... লাডলি মিসা আ গ্যায়া।’
রাস্তার দু’ধারে উপছে পড়ছে ভিড়। ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন মহিলারাও। কী কপাল! বাড়ির দরজায় এসেছেন যাদব ঘরের ‘লাডলি বিটিয়া’! বিহারের যাদব-কুলপতির বড় মেয়ে মিসা ভারতী। লালু-রাবড়ীর পরের প্রজন্ম।
বিহারের লালুপ্রসাদ আর উত্তপ্রদেশের মুলায়ম সিংহ যাদব। দুই যাদব কুলপতির বন্ধুত্বের সমাপ্তি ঘটে গিয়েছে অনেক কাল আগেই। এখন কার্যত মুখ দেখাদেখি বন্ধ দু’জনের। গঙ্গা কিনারের এক শহরের মুখ্যমন্ত্রীর তখতে ছেলেকে বসিয়ে মুলায়ম বুঝিয়ে দিয়েছেন উত্তরপ্রদেশে যদুবংশের উত্তরাধিকার অখিলেশ যাদবের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছেন তিনি। গঙ্গা কিনারের পটনা শহরে আর এক যদুনন্দন লালুপ্রসাদ নিজের উত্তরাধিকার তা হলে কার হাতে ছাড়বেন? সাত মেয়ে দুই ছেলের মধ্যে বড় মিসা না তাঁর দুই ছেলে তেজপ্রতাপ ও তেজস্বী কার হাতে যাবে লালুর ব্যাটন? আপাতত সবার নজর তাই পাটলিপুত্র কেন্দ্রের প্রার্থী মিসা ভারতীর দিকে, কারণ লালুর ছেলেমেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম লড়ছেন ভোটে।
পশুখাদ্য কেলেঙ্কারিতে সাজাপ্রাপ্ত লালুপ্রসাদ নিজে এ বার নেই ভোটযুদ্ধে। কিন্তু সর্বত্র তো তিনিই। সারা সকাল যাদব-গ্রাম চষে ফেলে মেয়ে নিজের পরিচয় দিচ্ছেন, তাঁদের ঘরের মেয়ে হিসেবেই। রোজ রাতে ঘরে ফিরে বাবার কাছ থেকে নিচ্ছেন রাজনীতির পাঠ। সঙ্গে থাকছেন সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার এবং আইআইএমের ছাত্র, স্বামী শৈলেশকুমার। ইনফোসিসের প্রাক্তন এই ইঞ্জিনিয়ার আপাতত স্ত্রীর নির্বাচনী যুদ্ধের সেনাপতি।
ভোটযুদ্ধে কী রকম রুটিন মিসার? ভোরে যোগ-প্রশিক্ষক বাড়িতে এসে হালকা শরীরচর্চা করিয়ে যাচ্ছেন। তার পর স্নান সেরে ছাতুর সরবৎ খেয়ে সারা দিনের জন্য প্রচার-যাত্রা। আপাতত ঠিকানা, ১০ নম্বর সার্কুলার রোড, মা রাবড়ী দেবীর সরকারি বাসভবন। রাবড়ীর কেন্দ্র সারণে দেরিতে ভোট। তাই মিসার ১২ বছরের মেয়ে দুর্গা এবং ৬ বছরের গৌরী থাকছে তাঁর জিম্মাতেই।
পটনা শহরের গ্রামীণ এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা পাটলিপুত্র কেন্দ্রের ভোটারদের মন ভেজাতে সালোয়ার-কামিজে প্রচারে বেরোচ্ছেন মিসা। সমর্থকরা যখন যেমন খাওয়াচ্ছে, তেমনই খাচ্ছেন। ঠিক যে ঢঙে মহল্লায় মহল্লায় লালু প্রচার চালাতেন।
কেমন চলছে প্রচার? মিসার কথায়, “সকলেই পিতাজির নাম নিচ্ছেন। বলছেন, লালুজির মেয়ে অল্পবয়সী, শিক্ষিতা। সুতরাং তাঁকেই আমরা এ বার সংসদে পাঠাতে চাই।” এই কথাগুলোই শোনা গেল ফুলওয়াড়ি বিধানসভা এলাকায় ঢুকতে। বাইপাসের ধারে গোটা তিরিশেক মোটরবাইক দাঁড়িয়ে। যুবকদের হাতে মিসার জন্য মালা। সকলেই বলছেন লালুর কথা। যা শুনে আপ্লুত মিসা এবং তাঁর স্বামী।
কিন্তু যাদব-মুসলিম অধ্যুষিত পাটলিপুত্র কেন্দ্রে লালুকন্যাকে ভোটে জিততে এ ভাবে মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হচ্ছে কেন? কারণ শুধু মিসাই নন, তাঁর প্রধান দুই প্রতিপক্ষও তো যদুবংশজাত। শুধু যাদবই নন, তাঁরা দু’জনেই এক সময়ে ছিলেন লালুর ছায়াসঙ্গী। কে তাঁরা? এক জন লালুপ্রসাদের এক সময়ের ‘ফ্রেন্ড, ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড’ রঞ্জনপ্রসাদ যাদব, এই কেন্দ্রের বর্তমান জেডিইউ সাংসদ। লালুর উত্থানের সময়ে এই রঞ্জনপ্রসাদকেই বলা হতো তাঁর ‘চাণক্য’। লালুর সঙ্গে গোলমালে ভিড়ে যান নীতীশ কুমারের দলে। মিসার সেই রঞ্জনচাচা তো আছেনই, আছেন লালুর এক সময়ের সেকেন্ড-ইন-কম্যান্ড, সদ্য সঙ্গত্যাগী রামকৃপাল যাদবও। তিনি বিজেপি প্রার্থী। মিসাকে এই কেন্দ্র দেওয়ার ফলেই দল ছাড়েন তিনি। দিল্লি গিয়ে বুঝিয়েও রামকৃপাল চাচার ক্ষোভ কমাতে পারেননি মিসা।
প্রশ্ন, তিন যাদবের লড়াইয়ে লালুর ‘দুলহারি বেটি’ কি পারবেন বিহারের যাদব রাজনীতির ঝান্ডা সফলভাবে তুলে ধরতে? উত্তরপ্রদেশের মতো বিহারেও কি লেখা হবে নয়া প্রজন্মের যাদব-কহানি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy