আজকে চোরের জন্মদিন। আজ্ঞে হ্যা।ঁ পুরাণ, বেদ, উপনিষদ, প্রাক্-ইতিহাস তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রথম তস্করের জন্মদিন আজ, রোববার। শৈশবে হামাগুড়ি দিয়ে, দলবল-সমেত পাড়াপড়শির হেঁশেলে ঢুকে পড়েছে। হাঁড়ি, কলসি হাতড়ে দুধ-দই-মাখন-ক্ষীর সাবাড় করে দিয়েছে। কৈশোরে, যৌবনের প্রাঙ্গণে চুরি করেছে তাবৎ রমণী-হৃদয়। বধূ-মাসি-মামি কেউ বাদ যায়নি। ছল চাতুরির গোঁসাই। সবচেয়ে মজার কাণ্ড নিজে ভূমিষ্ঠ হয়েছে জেলখানায়। কিন্তু জীবদ্দশায় কোনও দিন যেতে হয়নি থানা বা জেলখানায়। আসলে, এহেন পুরুষকে ধরে রাখার মতো জেলখানা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে নেই, ছিল না, হবেও না কোনও দিন। এ তো পুরুষ নয় এ যে পরমপুরুষ। ত্বমাদিদেব পুরুষপুরাণ ত্বমস্য বিশ্বস্য পরমনিদান..।
...অঝোরঝরন আকাশ-ভাঙা ঘোর বর্ষার মধ্যরাতে সদ্যোজাত শিশুটি হল নির্বাসিত। রাজার প্রাসাদ-কারাগার থেকে গোপগৃহে। গোকুলে সে বেড়ে উঠল ছদ্মপরিচয়ে। ক্ষত্রিয় সেই ডানপিটে শিশুটির বেড়ে ওঠার কাহিনিও বহু রঙে রঞ্জিত। বিভিন্ন পুরাণের বিভিন্ন রঙে। তার কৈশোরকালের সেই বিষম নিষিদ্ধ পরকীয়া প্রেমকাহিনি বর্ণিত হয়েছে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে। ভারতবর্ষের দিক্-দিগন্ত জুড়ে এক মোহন বাঁশিওয়ালার আকুল-ব্যাকুল বংশীধ্বনি যেন অনন্তকাল ধরে এক আশ্চর্য সংস্কৃতিকে বহন করে চলেছে নিরন্তর। কী অসম্ভব সুন্দর অনুষঙ্গ। সেই কিশোরের সমগ্র জীবনের অজস্র কর্মকাণ্ডের মধ্যে অমন বল্গাহীন প্রেমের আয়ু কতটুকুই বা! কী-ই বা তার মূল্য!
কোন যুগের কথা হলফ করে কে বলতে পারেন! হয়তো সেই সনাতন বিস্মৃতপ্রায় যুগের নানান কবি, চিন্তাবিদ, শিল্পীরাযাঁরা আজকে মুনি-ঋষি হিসেবে নমস্যতাঁদেরই বিভিন্ন সময়ের কল্পনাপ্রসূত এই অসামান্য চরিত্র!
সেই নীপশাখে বাঁধা ঝুলনায় এই কিশোর ও রাধিকার মত্ততার কল্পনা আজও আমাদের মনকে ভিজিয়ে দেয়। দুলিয়ে দেয় মন। স্নিগ্ধ সুগন্ধি বাতাসে। বিস্মিত হয়ে ভাবি, এমন এক অসামাজিক সম্পর্ক যুগ-যুগান্তর ধরে পূজনীয় হল কোন মন্ত্রবলে? রুক্মিণী নয়, সত্যভামা নয়, রাধা হলেন পূজ্যা? রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তির পায়ে যুগ যুগ ধরে নিবেদিত হয়ে চলে অর্ঘ্য?
বৃন্দাবন বা ব্রজধাম নয়, এই ঊর্ধ্বশ্বাস আধুনিক মুম্বই শহরের কথাই ধরুন না! জুহুতে ‘ইস্কন’ মন্দির। রথ-জন্মাষ্টমী-ঝুলন-শ্রীচৈতন্যের জন্মদিন ছাড়াও সন্ধেবেলা নিত্য-আরতির সময়ে অসম্ভব ভিড় হয়। সেই ডানপিটে দুষ্টু প্রেমিকের জন্মদিনে তো মাঝরাত্তির থেকে দরজার সামনে লাইন পড়ে। সূর্যোদয়ের মধ্যেই লাইন অতিকায়, প্রাগৈতিহাসিক সরীসৃপের মতো বহু অলিগলি-রাজপথে ছড়িয়ে পড়ে। কী? না, সেই ‘ঠাকুর’কে দেখব। দর্শন করব সেই অনবদ্য, অসামান্য, অসামাজিক যুগল মিলন। পুজো করব প্রেমের।
কৃষ্ণের গোপিকা বা সঙ্গিনী ছিল অগণিত নারী। কিন্তু রাধার? রাধা তো কৃষ্ণপ্রেমেই মগ্ন ছিলেন চিরজীবন। একদিন অকস্মাৎ মিলন-বিরহ-মানভঞ্জনের পালা সাঙ্গ হল। কিশোর কৃষ্ণের ডাক এল কর্তব্যের। গোচারণ-বংশীবাদন তার জন্যে নয়। সে বুঝতে পারল, রাধার চেয়েও তার ‘ক্ষত্রিয় ধর্মকর্ম’ অনেক বেশি মূল্যবান। অন্য কোনও ‘হারিয়ে যাওয়া’ প্রসঙ্গে কবির বাণীতে বলা যায় : “সূর্য গেল অস্তাচলে। আর উঠিল না।” অধমের অনুর্বর কল্পনার রঙে ভাবার প্রয়াস পেয়েছি সেই অসহায়া, বিরহিনী একাকিনী রাধার কথা। সেই গোপনারী তার সর্বস্ব উজাড় করে দেবার পর, কৃষ্ণের কোন উপহার তিনি বয়ে বেড়ালেন তাঁর নিস্ব, রিক্ত পরবর্তী জীবনে? সুবৃহৎ তেলরঙের ছবিতে দেখতে পেলুম, নীল রঙের শ্রীরাধা দূর-দিগন্তে চেয়ে আছেন শূন্য চোখে। রিক্ততার, বৈধব্যের শুভ্র থান পরনে। ব্যথিত নয়নে গোপিনীগণ যেন তাঁকে সান্ত্বনা দেবার বৃথা চেষ্টা করছেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর আপন নীল রঙে প্রেয়সীকে রাঙিয়েছেন। তাদের প্রেমের চিরন্তন সাক্ষী সেই সোনালি হলুদ মোহনবাঁশিটি রাধিকাকে উপহার হিসেবে দিয়ে চলে গেছেন চিরতরে বৃন্দাবন ছেড়ে এই ছবিটি আঁকার পেছনে, যে যুক্তি আমার মনে কাজ করেছে, তা হল, ব্রজধাম ছেড়ে মথুরা-দ্বারকার পথে চলে যাবার পর আর কখনও, কোনও দিনই শ্রীকৃষ্ণ বাঁশি বাজিয়েছেন এমন কোনও নজির পুঁথি-পুরাণ-গ্রন্থে আছে বলে জানা নেই।
ঠিক এমনই অতি বিচিত্র আরও একটি দেবতার সৃষ্টি হয়েছে প্রাচীন যুগের কবি-শিল্পী-লেখক-চিন্তাবিদদের আশ্চর্য কল্পনাকে আশ্রয় করে। এর বাহ্যিক আকার সাধারণের স্বপ্নেও ভাবনার অতীত। অথচ, সেই ‘ঠাকুর’ আজ ঘরে-বাইরে সর্বত্র পূজ্য। হিন্দু শাস্ত্রমতে তাবৎ দেবতাদের মধ্যে এই ঠাকুরের আরাধনাই অগ্রগণ্য। আমাদের বাঙালিদের যেমন প্রধান বা বড় পুজো হল গিয়ে ‘দুর্গা মাঈ কি জয়’, এখানে, এই পশ্চিমী রাজ্যের প্রধান পুজো
“গণপতি বাপ্পা মওরিয়া,
পুর্চা বর্ষে লওকর ইয়া”।
শ্রীকৃষ্ণের জন্মদিনের দিন দশেক পরেই মরাঠা রাজ্য মাতাতে হই-চই করে, কাড়া-নাকাড়া বাজিয়ে ধরাতলে নেমে আসছে সিদ্ধিদাতা গণেশ বাবাজীবন। এ ঠাকুরের আগমনে ধুন্ধুমার লেগে যায় ঘরে-ঘরে, হাটে-মাঠে-ঘাটে-বাটে। পাড়ায় পাড়ায়, বারোয়ারি পুজোর প্যান্ডেলে।
আপন অশক্ত বুদ্ধি এবং ততোধিক দুর্বল জ্ঞানের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ কল্পনার দৃষ্টিতে আমি দেখতে পাই দুটি পরিবার। সমসময়ের না হলেও, দোষের দেখি না। কারণ, মনের তাজমহলে কল্পনার বাতাস লাগলে ‘তরঙ্গ রোধিবে কে’?
স্বর্গ বা পাতাল কোথায় জানি না। আকাশে, না আমাদের পায়ের তলায়, মাটির অনেক নীচে? আমি বিশ্বাস করি, মর্তেই স্বর্গ ও পাতাল অবস্থিত। ঈশ্বর বা দেবদেবীও আমাদের মধ্যেই আছেন যেমন আছে নরকের ঘৃণ্য দানবেরা। তাই, আপনার ঘরের কালোকোলো ওই ছোট্ট, দুষ্টু বা ডানপিটে শিশুটি যে হামাগুড়ি দিয়ে হাসছে খলখলিয়ে সেই-ই কেন নাড়ুগোপাল বা খুদে গণেশ নয়? আপনার বান্ধবী বা স্ত্রীর মধ্যেই হয়তো রাধিকা লুকিয়ে আছে! মায়ের ভিতর দুর্গা? আসলে গণেশই তো কৃষ্ণ বা বিষ্ণু.....এমনকী, হয়তো আপনিই স্বয়ং!
তাই, আমার মতো ক্ষীণবুদ্ধি যদি ক্যানভাসে কেষ্টঠাকুর বা গণপতিকে দুই বন্ধু হিসেবে দেখে কে ঠ্যাকাবে আমায়? দলবল-বন্ধুবান্ধব নিয়ে, হামাগুড়ি দিয়ে যদি গোপাল ও গণেশ আপনার হেঁশেলে ঢুকে দুধের মোটা সর সাবাড় করে দেয়আমি কী করতে পারি? যে কোনও বালকের মতোই বক্রতুণ্ড বাবাজীবন যদি তার বাবার অলক্ষ্যে তার ত্রিশূল-ডমরু নিয়ে ‘তাণ্ডব’ নেচে শিবের নকল করতে চায় তাকে আটকাবে কে?
এ ছাড়া আরও একটি বিষয় মনে আসে। যথা, ‘গড ক্রিয়েটেড ম্যান’ অর্থাৎ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন ঈশ্বর কথাটি মেনে নিতে কোনও দ্বিধা যেমন নেই, (প্রকৃতির সমষ্টিগত ‘প্রাণশক্তি’র নামই তো ঈশ্বর) তেমনই অন্য দিকে মনে রাখতে হবে, মানুষই দেবতা বা দেবদেবীর স্রষ্টা। ঠাকুরের মূর্তি যাঁরা গড়েন, সেই ‘কুমোর’, বা মূর্তি-শিল্পীই তো সৃষ্টি করছেন, করেছেন কৃষ্ণ, গণেশ বা শিব, দুর্গা।
‘রাধা’ও কিন্তু সেই কল্পনার সৃষ্টি। অথচ, প্রাচীন পুঁথি বা গ্রন্থে ‘রাধা’র উল্লেখ পাওয়া যায় শুধু ব্রহ্মবৈবর্ত-পুরাণে। শ্রীকৃষ্ণের জীবনবৃত্তান্ত যে-প্রামাণ্য গ্রন্থে পাওয়া যায়, সেই শ্রীমদ্ভাগবতম্-এ কিন্তু কুত্রাপি ‘শ্রীরাধা’র নামগন্ধ নেই। স্রেফ সামান্য ঘটনার উল্লেখ আছে। গোপীদের সব্বাইকে তাঁর বাঁশির সুরে নাচিয়ে, মাতিয়ে দিয়ে রাখালরাজ সহসা উধাও। খোঁজ খোঁজ, কোথায় গেল আমাদের প্রেমিক? কুঞ্জবনের গা’ দিয়ে বেরুনো ভেজা আলপথে দু’জোড়া পদচিহ্ন পাওয়া গেল। গোপবালারা দেখল, একটি বিশাল প্রস্তরখণ্ডে চিহ্ন মিলিয়ে গেল বটে, তবে কিছু ফুল ছড়ানো ইতস্তত। বোঝা যায়, এখানে এই বিশেষ রমণীকে ফুলসাজে সাজানো হয়েছে। তারপর আবিষ্কৃত হল শুধু এক জোড়াই পায়ের ছাপ বেশ গভীর। দ্বিতীয় জোড়া উধাও। (ভাগবতম, পৃ: ৩৯৭ দ্রষ্টব্য)! সহজেই বোঝা যায় পুরুষ কৃষ্ণ এই বিশেষ গোপ-বধূটিকে কোলে তুলে নিয়ে গভীরতর অরণ্যে হারিয়ে গেছেন তাঁর লীলাখেলায়!
এই বিশেষ রমণীটির নামই হয়তো রাধা!
এমনই অজস্র গল্পগাথা তৈরি হয়েছে নানান দেবদেবীর রূপবর্ণনায়। যেমন কৃষ্ণ, তেমনই গণেশ!
তবে, ব্যক্তিগত ভাবে আমার পছন্দ এই ভাদ্র মাসের দুই মন-কাড়া, ঘরোয়া অতিথিকে! এঁদের অভ্যর্থনা জানাই। এ রাজ্যের মরাঠি মন্ত্রের সামান্য হেরফের করে:
গণপতি-কৃষ্ণ মওরিয়া!
পুর্চা বর্ষে লওকর ইয়া!!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy