আলো-অন্ধকার গলিপথ। অপরিসর। স্যাঁতসেঁতে এবড়ো-খেবড়ো কবেকার ভাঙা পাথরের টুকরো বসানো। দু’তিন জন পাশাপাশি হাঁটলে, দু’ধারের কাঁচা-পাকা ঘরের দেওয়ালে ধাক্কা লাগবে। তাই একটু আগে আগে হাঁটছে টমাস। আমাকে পৌঁছে দেবে বাসস্টপ অবধি। লক্ষ করলুম, নিট দু’তিন পেগ বা ওদের হিসেবে নঁওটাক খেয়েও সোজা-সাপটা হেঁটে চলেছে আর নিজের মেয়ে ডানা-র গুণগান করছে টমাস। এ রাজ্যের আদি বাসিন্দা ‘ ‘জেলে’ বা ‘কোলি’দের বস্তিতে একটু ‘নিষিদ্ধ’ জলপান করে দান্ডা এলাকা দিয়ে সাবধানে দেখেশুনে পা ফেলছি। এপাশ-ওপাশ থেকে কোথাও গানের টুকরো কলি, কোথাও অসংলগ্ন কথা বা টিভি-র সংলাপ ভেসে আসছে। হঠাত্ পেছন থেকে শুনতে পেলুম, ‘দাদা’!
চোখ তুলে ডানপাশে তাকালুম। দেখি, দাওয়ায় কে একজন বসে। মাথাটি কোনও রকমে তুলে আমায় দেখছে। বসে বসে হয়তো সামান্য দুলছে বা টলছে। একমুখ সাদা দাড়ি। সেই তুলনায় হাল্কা চুল মাথায়— পাকা ও অবিন্যস্ত। দু’পা আগে টমাসও থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে।
একটু পিছিয়ে, কাছে গিয়ে অল্প ঝুঁকে জিজ্ঞেস করলুম হিন্দিতে— আপনে মুঝে বুলায়া?
সামান্য জড়ানো গলায় উল্টে প্রশ্ন করল, হিন্দির সুরমাখা বাংলায়,— আপনি তো সব্বার দাদা। এ লাইনে লেখেন-টেখেন। আমাকে চিনতে পাচ্ছেন না? অ্যাঁ!
টমাসও পিছিয়ে এসে মানুষটিকে জিজ্ঞেস করেন, হিন্দিতে— কিঁউ রে হিরো! দাদাকো পহচানতা হ্যায়?
চেনামুখ মনে হচ্ছে না। অমন এলোমেলো চুলদাড়িতে সারা মুখটি ঢাকা থাকলে চেনারও তো উপায় নেই! নিশ্চয়ই এমন কেউ যার সঙ্গে চেনাপরিচয় হয়তো ছিল। কিন্তু কে? মনে মনে দাড়ি-গোঁফ বাদ দিয়ে ধরবার চেষ্টা করছি। চোখজোড়া, কপাল, নাকের বাঁশি কেমন চেনা চেনা লাগলেও ঠিক ধরতে পারছি না, কে!
লোকটিও যেন আমাকে কোনও ধাঁধার খেই ধরাবার চেষ্টা করল, এলোমেলো জড়ানো কথা— প্রাণ? ভিলেন প্রাণ? আহা! যে এবার সরকারি ফালকে পুরস্কার পেল...হিন্দি-বাংলা মিশিয়ে।
মনে মনে ভেসে উঠল কোনও সিনেমায় দেখা দৃশ্য। একটু ঝাপসা মতন হলেও দেখলুম, এক ঘোড়সওয়ার। এক হাতে ঘোড়ার রশি ধরে, অন্য হাতে পিস্তল। ঘোড়া ছুটছে। ছুটছে বেশ জোরে। এ দিকে এক পলকের জন্য মুখ ঘোরাতেই...আরে! এ তো... নামটা ঠিক মনে করতে পারছি না...হুবহু ভিলেন প্রাণের মতো দেখতে ছিল। কী নাম যেন? নামটা...ধ্যাত্! নামটা ধরি ধরি করেও নাগালে আসছে না। বাঙালি? আহ্!
টমাস আবার বলল,— হমারা মেহমান বাঙালি দাদা। বহুত বড়া আদমি হ্যায়। ডিরেক্টর-প্রোডিউসারকা দোস্ত হ্যায়। তু পহচানতা হ্যায়, হরিয়া?
ফসকে যেতে যেতে টমাসের মুখে হিন্ট পেয়ে ঝপ করে নিশানা লেগে গেল— হরিসাধন। পদবি কী একটা বলেছিল সেই কয়েক দশক আগে, সাঁপুই না সাহা, না সাঁতরা...আজ আর মনে নেই। কোন স্টুডিওতে যেন! যদ্দুর মনে হচ্ছে গোরেগাঁয়ের ‘ফিল্ম সিটি’তে।
শটটা ‘ওকে’ হওয়াতে সেই ঘোড়সওয়ার ‘প্রাণ’ ক্যামেরার চৌহদ্দির বাইরে চলে এল। বসল আমার প্ল্যাস্টিকের চেয়ারের পাশের চেয়ারে। বসতে বসতে সৌজন্যমূলক সম্বোধন— নমস্তে দাদা!
চেনাজানা না থাকলেও ফিল্ম লাইনের ‘স্ট্রাগলাররা’ চোখের সামনে যে কাউকেই দেখে, বিশেষ করে, বড় ‘কত্তা’দের চেনাজানা মানুষকে, অভ্যাসবশত সৌজন্য দেখায় ‘আদাব’, ‘নমস্তে’ বা ‘নমস্কার’ জানিয়ে। কোথায় কে, কার পরিচয়ে ওপর মহলে, মানে প্রযোজক, পরিচালক, সঙ্গীতকার, লেখক প্রমুখের সূত্রে ‘চান্স’ পাওয়ার পথ খুলে যাবে কে জানে! তাই যেখানে দেখিবে ছাই...
সেই প্রথম আলাপ। নাম জানা গেল। কাঁচড়াপাড়ায় ‘বাবু ব্লকে’ থাকত। বাবা নেই। সংসার চালায় বড় ভাই। ছোট চা-বিস্কুটের দোকান চালাত। তার রোজগারেই সংসার চলত। সেই ছোটবেলায় বড়দার সঙ্গে ঝগড়া করে চলে এসেছিল হরি।
রাগ কমতে, বছর তিনেক বাদে, ষাট দশকের শেষে একবার গিয়েছিল।
“মা’টা মরে গেল। বড়দার সঙ্গে ফের ঝগড়া লাগতে জন্মের মতো চলে এসেছি এখানে।—”
তার পর টুকটাক ফুরনে কাজ করে স্টুডিওতে ধরনা দিয়ে পড়ে থাকত। ‘এক্সট্রা’র রোল কয়েকটা পেতে পেতেই সহসা নজরে পড়ে গেল এক মাঝারি ক্যামেরাম্যানের। শরীর স্বাস্থ্য ভালই। ব্যায়াম করা। মুখখানি অনেকটা প্রাণের আদলে। ব্যস! প্রাণ সাহেবের ডুপ্লিকেট হিসেবে একদিন, দু’দিন শু্যটিং জুটে যেত। দু’শো, পাঁচশো টাকা মাসে আসত পকেটে। সবই ব্যাক শট, সাইড শট। কপাল খুলে গেল হঠাত্।
বলতে বলতে হরির মুখ-চোখ বেশ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। “পরিচালক আর ভট্টাচার্য, আহা, যার ‘বেদাগ’, ‘সুহাগ রাত’ সুপার হিট। তাঁর সহকারী লতিফ সাব আমাকে পুরোপুরি ‘ভিলেন’ বানিয়ে দিল!”
“হিরো হিরোইন কে কে ছিল?” গম্ভীর মুখে বলল হরি, “চার জন হিরো— দিলীপকুমার, রাজকপূর, সঞ্জীবকুমার আর মনোজকুমার— আর আমি একলা ভিলেন, প্রাণ”।
তা-বড় তা-বড় সব হিরো একসঙ্গে কোন সিনেমা করল, তার নামও মনে পড়ছে না। কোথাও বিজ্ঞাপন দেখেছি বলে খেয়ালে আসছে না। ধন্ধের কথা বলতেই হা হা করে নাটুকে হাসি দিয়েছিল হরিসাধন। তাও প্রায় বছর কুড়ি আগের কথা। মেহবুব স্টুডিওর ক্যান্টিনে।
হাসির দমক থামলে বলেছিল, “লতিফ সাহেবের গ্রেড থ্রি ফিল্মের নাম ‘শোলা-যো-ভড়কে’। গ্রান্ট রোডের ‘আলেকজান্দ্রা’, বম্বে সেন্ট্রালের ‘এডোয়ার্ড’ থিয়েটারে রিলিজ করেছিল।” নকল হাসিও শেষ হয়ে গেল। মাথা নিচু করে রইল একটুক্ষণ। তার পর বড় করে শ্বাস ছেড়ে আস্তে আস্তে বললে, “এক হফতাও চলেনি ‘হলে’। ফ্লপ ছবি দাদা। আমিও ফ্লপ ছবির ভিলেন হয়ে গেলুম।—”
“অত বড় বড় হিরো নিয়ে ছবি চলল না কেন, হরি?”
ম্লান হেসে হরিসাধনের জবাব, “বড়া হিরো, না, ঘণ্টা!” এ রাজ্যের গন্ধ-মাখা কথার টানে, আরও বললে, “সব দো নম্বর কা হিরো। ডুপ্লিকেট! নকল—নকল সব্বাই—হসতি দাদা—দো নম্বর কা ডুপ্লিকেট ভিলেন।” কণ্ঠস্বরে হতাশা। হঠাত্ উঠে, ঝাপসা চোখ আমার থেকে লুকোবার জন্যেই যেন নিজের মনে বকতে বকতে বেরিয়ে গেল ক্যান্টিন থেকে।
ক্যান্টিনের মালিক বুড়োমানুষ রঘুনাথের মুখে শুনলুম, হরির সেই “শোলা—” ছবি ভয়ঙ্কর ফ্লপ হওয়ার ফলে, ওই সব ডুপ্লিকেট যারা হিরো ভিলেনের রোল করেছিল, তাদের ক্যারিয়ার প্রায় ডুবে গেছে। দেড়, দু’ বছর হয়ে গেল সেই বইয়ের পর আর কোথাও নাকি ওদের ডাকে না। “ছবি ফ্লপ হলে—” রঘু আরও জানালে, “আসল হিরোদের ক্যারিয়ার এ লাইনে ডুবে যায় দাদা। বদনাম হয়ে যায় চারদিকে ‘পনোতি’ (মানে ‘অপয়া’) বল অফিস-পাড়া, বাণিজ্য পাড়ায় জনবহুল ফুটপাথ। ওদের দু’জনের সঙ্গে সঙ্গে হাঁটছি। সাধারণ পথচারীরা ওদের কয়েক মুহূর্ত দেখে, খানিক বাদেই নকল দিলীপকুমার ও প্রাণ বুঝে চোখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। আমল দিচ্ছে না কেউ। তবে, ফুটপাথে ‘ঢালাও বিক্রি’র ফিরিওয়ালারা... ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy