Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

বফর্স-ভূতের বোঝা ঝেড়ে অস্ত্র-দালালিতে সায়

উদ্দেশ্য ছিল, বফর্স কেলেঙ্কারির ভূত ঘাড় থেকে নামানো। দশ বছর আগে ইউপিএ-সরকার গঠনের পরেই তাই সামরিক সরঞ্জাম কেনাবেচায় মিডলম্যান বা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। দুর্নীতি থেকে গা বাঁচানোর সেই সিদ্ধান্তে কামান-গোলাবারুদের অভাবে ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠে সামরিক বাহিনীগুলিতে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০১ জানুয়ারি ২০১৫ ০৩:০৮
Share: Save:

উদ্দেশ্য ছিল, বফর্স কেলেঙ্কারির ভূত ঘাড় থেকে নামানো। দশ বছর আগে ইউপিএ-সরকার গঠনের পরেই তাই সামরিক সরঞ্জাম কেনাবেচায় মিডলম্যান বা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়। দুর্নীতি থেকে গা বাঁচানোর সেই সিদ্ধান্তে কামান-গোলাবারুদের অভাবে ত্রাহি ত্রাহি রব ওঠে সামরিক বাহিনীগুলিতে। কিন্তু ইউপিএ সরকার সিদ্ধান্ত বদলায়নি। নরেন্দ্র মোদীর সরকার এ বার সেই ভুল শোধরাচ্ছে।

প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পর্রীকর জানিয়েছেন, বিদেশি সমরাস্ত্র সংস্থাগুলির প্রতিনিধি তথা মিডলম্যানদের ভূমিকাকে ফের আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হবে। এর জন্য মাস দেড়েকের মধ্যেই আইনে বদল ঘটানো হবে। পর্রীকর বলেন, “যুদ্ধাস্ত্র কেনার নীতি পাল্টানো হবে। বিদেশি সংস্থাগুলির থেকে যুদ্ধাস্ত্র কেনার সময় তাদের প্রতিনিধিদের ভূমিকাও আইনি স্বীকৃতি পাবে।” তার মানে কি যুদ্ধাস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে ঘুষ বা কমিশন খাওয়ার অনুমতি দিচ্ছে মোদী সরকার? পর্রীকরের যুক্তি, “কোনও রকম ঘুষ বা লাভের অংশের গোপন লেনদেন আমরা হতে দেব না। বিদেশি সংস্থাগুলিকেই জানিয়ে দিতে হবে, কতটা পারিশ্রমিক দেওয়া হচ্ছে মিডলম্যানদের।”

শুধু তা-ই নয়, অতীতে যে সব বিদেশি সংস্থাকে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে, তাদের সম্পর্কেও নতুন করে পর্যালোচনা করছে সরকার। নয়া নীতির নিরিখে যে যে সংস্থা সম্পর্কে আপত্তির কিছু নেই তাদের কাছ থেকে অস্ত্র ও সমর-সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা তুলে দেওয়া হচ্ছে। এতে সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিনের চাহিদাগুলি পূরণ করার রাস্তা খুলবে।

অ্যান্টনির আমলে সেনার জন্য টেট্রা ট্রাক কেনায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। ব্রিটিশ টেট্রা সংস্থা থেকে সরঞ্জাম কেনা বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু ট্রাক চালাতে গেলে যে সরঞ্জাম প্রয়োজন, তা মূল সংস্থা থেকে কেনার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ভিভিআইপি হেলিকপ্টার কেনায় দুর্নীতির অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত অগুস্তা ওয়েস্টল্যান্ডকেও ব্যবসার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর গদি হারানোর পরেও রাজীব গাঁধী যত দিন বেঁচে ছিলেন, বফর্স কেলেঙ্কারির ভূত তাড়া করে গিয়েছে তাঁকে। তাঁর মৃত্যুর পরেও বফর্স কেলেঙ্কারি গাঁধী পরিবারের পিছু ছাড়েনি। অভিযোগ উঠেছিল, গাঁধী পরিবারের ঘনিষ্ঠ ইতালীয় ব্যবসায়ী ওত্তাভিও কুত্রোচ্চি বফর্স কামান কেনাবেচায় ‘মিডলম্যান’-এর ভূমিকায় ছিলেন। বফর্সের ঘুষের টাকা তাঁর মাধ্যমেই গাঁধী পরিবারের সিন্দুকে গিয়েছে। দশ বছর আগে ইউপিএ সরকার গঠনের পরে তাই আর দেরি করেননি সনিয়া গাঁধী। তাঁর ‘নির্দেশেই’ মিডলম্যানদের ভূমিকাকে বেআইনি ঘোষণা করে দেওয়া হয়।

সেই নীতি বদলে ফেলার সিদ্ধান্তকে মোদী সরকারের সাহসী পদক্ষেপ বলেই মনে করছেন সামরিক বাহিনীর কর্তা ও প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা মনে করছেন, এতে দেশে যুদ্ধাস্ত্র কেনাবেচার ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা আসবে। কারণ, বিদেশি সংস্থাগুলির থেকে যুদ্ধাস্ত্র বা যুদ্ধ সরঞ্জাম কিনতে হলে মধ্যস্থতাকারী বা মিডলম্যানদের ভূমিকা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু সেই মিডলম্যানদের পারিশ্রমিক ঠিক কত, বিদেশি সংস্থাকে কোটি কোটি টাকার বরাত পাইয়ে দেওয়ার সময় পারিশ্রমিকের নামে তাঁরা আসলে ঘুষ নিচ্ছেন কি না, সেই টাকার ভাগ দেশের রাজনীতিক, আমলা বা সেনা অফিসাররা পাচ্ছেন কি না, এই সব প্রশ্ন ঘিরে এত দিন রহস্য ছিল। যার ফলে ধারণা তৈরি হয়েছিল, যুদ্ধাস্ত্র কেনাবেচায় মিডলম্যান রয়েছে মানেই ঘুষের লেনদেন হচ্ছে। আর এই ধারণা থেকেই ইউপিএ জমানায়, বিশেষ করে এ কে অ্যান্টনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী থাকার সময় সামরিক বাহিনীর অধিকাংশ যুদ্ধাস্ত্র কেনার কাজে বাধা এসেছে।

অ্যান্টনি নিজের ভাবমূর্তি স্বচ্ছ রাখা নিয়ে অতি মাত্রায় সচেতন ছিলেন বলে অভিযোগ। যেখানেই তিনি মিডলম্যান থাকার নামমাত্র গন্ধ পেয়েছেন, গোটা চুক্তিটাই বাতিল করে দিয়েছেন। সেই সঙ্গে যে বিদেশি সংস্থা যুদ্ধাস্ত্র বেচতে যাচ্ছিল, তাদের কালো তালিকাভুক্ত করেছেন। সেনাবাহিনীর এক কর্তা বলেন, “এমনও হয়েছে যে ভারতীয় সেনার চাহিদা মাফিক বিশেষ এক ধরনের সমরাস্ত্র গোটা বিশ্বে একটি মাত্র সংস্থাই তৈরি করে। অথচ সেটিই কালো তালিকাভুক্ত। সেই অভাব তাই রয়েই গিয়েছে।”

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, ইউপিএ সরকারের ওই সিদ্ধান্ত ছিল একেবারেই যুক্তিহীন। শেয়ার বাজারের ব্রোকার তথা দালালরা লগ্নিকারীর হয়ে শেয়ার কেনাবেচা করেন। তার বদলে তাঁরা কমিশন পান। মিডলম্যানরাও একই কাজ করেন। ভারত নিজের প্রয়োজনের ৭০ শতাংশ সমরাস্ত্র বিদেশ থেকে কেনে। আমেরিকা, ইজরায়েল বা রাশিয়ার একটি সংস্থা সরাসরি ভারতীয় সেনাবাহিনীকে যুদ্ধাস্ত্র বিক্রি করছেএটা বাস্তবে সম্ভব নয়। কারণ, ওই সব সংস্থার পক্ষে দিল্লিতে কী ভাবে সরকারি কাজকর্ম চলে, তা জানা সম্ভব নয়। কাজেই তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি বা মিডলম্যান নিয়োগ করতেই হয়। মিডলম্যানরা তাঁদের কাজের বিনিময়েই পারিশ্রমিক পান।

অটলবিহারী বাজপেয়ীর আমলেও বারাক ক্ষেপণাস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। সে সময় ‘তহলকা কেলেঙ্কারি’ নামে যা সারা দেশে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। রেহাই পাননি তখনকার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জর্জ ফার্নান্ডেজও। বাজপেয়ী জমানার সেই অভিজ্ঞতার কথা মাথায় রেখেও বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী পর্রীকর বাস্তব মেনেই এগোতে চাইছেন।

ক্ষমতায় এসেই মোদী ঘোষণা করেছিলেন, আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের উপস্থিতিকে জোরালো করে তুলতে হলে দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি প্রতিরক্ষার ভিতও মজবুত করতে হবে। সেই লক্ষ্যে ইতিমধ্যেই প্রতিরক্ষার কিছু ক্ষেত্রে বিদেশি লগ্নির দরজা খুলেছে তাঁর সরকার। দেশি-বিদেশি সংস্থা এ দেশে প্রতিরক্ষা-সরঞ্জামের কারখানা গড়তে চাইলে জমি যাতে বাধা না হয়, সেটাও আপাতত অর্ডিন্যান্সের পথে নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ঘাটতি পূরণে বাধা হয়ে ছিল ইউপিএ জমানার নীতি। সেই বাধাও এ বার দূর করা হচ্ছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জানাচ্ছেন, যুদ্ধাস্ত্র কেনার ক্ষেত্রে নতুন নীতির খসড়া আগামী ৮-১০ দিনের মধ্যে তৈরি হয়ে যাবে। ওই খসড়া নিয়ে আরও আলোচনার পর তা মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। ফেব্রুয়ারির মধ্যেই নতুন নীতি চালু হয়ে যাবে বলে পর্রীকরের আশা।

অন্য বিষয়গুলি:

bofors upa manohar parrikar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE